বর্তমান বিজ্ঞান প্রযুক্তির যুগে, যোগাযোগ ব্যবস্থার এই উন্নত যুগে পৃথিবীটা যেন হাতের মুঠোয় চলে এসেছে l এক দেশ থেকে অন্য দেশে মানুষের যাতায়াত অনেক সহজ হয়েছে l নানা কারণে এই যাতায়াত চলছে l তার অন্যতম কারণ হলো জীবিকা অর্জন l তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলি থেকে মানুষ জীবিকার সন্ধানে পাড়ি দিচ্ছেন ইউরোপ, আমেরিকা ও আরব দেশগুলিতে l এইভাবে বহু মানুষ বিদেশে জীবিকা অর্জনের উদ্দেশ্যে রওনা হচ্ছেন l প্রাথমিক অবস্থায় তাঁরা বিদেশে কাজ করছেন, রোজগার করছেন, মাঝে মাঝে দেশেও আসছেন, দেশে আত্মীয় স্বজন, বন্ধু বান্ধবের সঙ্গে দেখাশোনা, যোগাযোগ হচ্ছে - সবদিক বেশ সামলে নিয়ে চলছেন l কিন্তু যতো দিন যায়, ততই দেশের সঙ্গে তাঁদের যোগাযোগ কমতে থাকে, যাতায়াত কমতে থাকে l যেখানে কাজ করছেন, অর্থ উপার্জন করছেন, নানা সূত্রে সেই দেশের সঙ্গে জড়িয়ে যেতে থাকেন, এক আত্মীয়তা, ভালোবাসার বোধ তৈরি হয় l সেই বিদেশই স্থায়ী বাসভূমি হয়ে ওঠে l নিজের জন্মস্থান, স্বদেশের সঙ্গে যোগাযোগ কমে আসে l আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবের দিক থেকেও সাড়া কম মেলে l কাজের নেশায় এমনটা হয়ে যায় l কাজ নিয়েই ভুলে থাকেন মানুষ l কিন্তু মাঝে মাঝে মনটা দেশের জন্য কেঁদে ওঠে l দেশের কথা মনে পড়ে l
এমনই একটি বিষয় নিয়ে "জন্মভূমি ত্যাগিলো মোরে" শিরোনামে কবিতা রচনা করেছেন কবি বদরুজ্জামান l দীর্ঘদিন ধরে কাজের তাগিদে বিদেশে অবস্থান করছেন কবি l কর্মব্যস্ততায়, নানা বাধ্যবাধকতায় দেশের সঙ্গে যোগাযোগ কমে এসেছে l এমন অবস্থায় কবির মনে হচ্ছে তাঁর জন্মভূমি যেন তাঁকে ভুলে গেছে, তাঁকে ত্যাগ করেছে l স্বদেশের সঙ্গে যোগাযোগ কমিয়ে দেওয়াটা তাঁর অপরাধ হয়েছে l জন্মভূমি তাঁকে এই অপরাধের শাস্তি দিয়েছে l কাজের সন্ধানে একদিন তিনি যাযাবরের মতো নিজের দেশ থেকে বিদেশে পাড়ি দিয়েছিলেন l উদ্বাস্তু, ভবঘুরের মতো ঘুরে বেড়িয়েছেন কতোদিন l বহু বহু বিফল প্রচেষ্টার পর শেষমেষ সফল হয়েছেন বিদেশের মাটিতে স্থায়ী বসবাসের মতো সংস্থান করে তুলতে l এর মাঝে এক যুগ কেটে গেছে l বহু বিচিত্র অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন l যন্ত্রণা ভোগ করেছেন l মনে কষ্ট পেয়েছেন l সবকিছু সহ্য করে বাঁচার মতো একটি উপায় অর্জন করেছেন l সুখ এসেছে জীবনে l স্বপ্ন সফল হয়েছে l বেঁচে আছেন এখনো l
কিন্তু এই দীর্ঘ জীবনসংগ্রামে বিদেশের মাটিতে প্রতিষ্ঠা অর্জন করতে গিয়ে জ্ঞাতসারে, অজ্ঞাতসারে জীবন থেকে হারিয়েও গেছে অনেক কিছু l কাজের চাপে, প্রতিষ্ঠার নেশায় দেশের জন্য, স্বজনদের জন্য সময় দিতে পারেন নি l তাই আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগ ছিন্ন হয়েছে l অর্থ, প্রতিষ্ঠার পেছনে ছুটে সেগুলো অর্জিত হয়েছে l আনন্দের সঙ্গে এগুলিকে জীবনের অংশ করে নিয়েছেন l কিন্তু স্বদেশ, আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন হবার কারণে ব্যথিতও আছেন l নিজেকে কখনো কখনো নিঃস্ব মনে হয় l আবার এই সান্ত্বনাও পান যে বিদেশ তাঁকে অনেক দিয়েছে l এই প্রাপ্তির বোধ থেকে তাঁর নিজেকে নিঃস্ব মনে হয় না l মনের সব চাওয়া এই বিদেশেও তাঁর পূরণ হয়েছে l মানসিক এই প্রাপ্তি যেন তাঁকে সম্পদশালী করেছে l তিনি নিজের জন্য এক পৃথিবীর সন্ধান পেয়েছেন l সেখানে মনের সুখে তিনি বিচরণ করেন l কাজ করেন মনের আনন্দে l তাঁর সব চাওয়াও পূরণ হয় l যেন নিজের জন্য এক উদ্যান রচনা করেছেন তিনি l এখানে বাসের যোগ্য এক পরিবেশ পেয়েছেন তিনি l নিজের উদ্যোগে সেই পরিবেশের সঙ্গে উপযুক্তভাবে মানিয়ে নিয়েছেন l সংযত জীবন যাপনে নিজের মর্যাদা বাঁচিয়ে চলেছেন l
চারিদিকে বিদেশের বন্ধুবান্ধব l রক্তের সম্পর্কে তাঁরা কেউ নন l তবু মন খুলে তাঁরা মিশেছেন তাঁর সঙ্গে l কবিও কৃতজ্ঞচিত্তে এই সম্পর্কের মর্যাদা দিয়ে চলেছেন l স্বাধীনতা, সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে তিনি আবদ্ধ হয়েছেন তাঁদের সঙ্গে l সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদের ঊর্ধ্বে উঠে এক বিশ্বনাগরিকতাবোধে উদ্দীপ্ত হয়েছেন কবি l
কবিকে জানাই আন্তরিক শুভকামনা !!