পৃথিবীতে কোটি কোটি প্রানী প্রজাতির মধ্যে একমাত্র মানুষকে বিধাতা দিয়েছেন চিন্তাশক্তি । সেই চিন্তাশক্তির দ্বারা মানুষ চিরটা কাল নব নব সৃষ্টিতে নিজেকে, নিজের পরিবেশ, সঙ্গী সাথী আপনজনকে নিয়োজিত রেখেছে । এই ধরিত্রী মাকে করে তুলেছে আরো আরো সুন্দর । সভ্যতার ইতিহাস প্রতি পলে তার সাক্ষ্য বহন করে চলেছে ।
এই চিন্তাশক্তির দ্বারাই মানুষ নিজের জীবনকে নানা অনুশাসনে বেঁধেছে । গড়ে তুলেছে কতো রকমের প্রতিষ্ঠান । প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের রয়েছে নিজস্ব আচরণ বিধি । সেই আচরণবিধি যুগ যুগ ধরে মেনে চলেছে মানুষ । এইভাবে সমাজ ও সভ্যতার অগ্রগমনকে অব্যাহত রেখেছে সে ।
কিন্তু মানুষের যেমন চিন্তাশক্তি রয়েছে, তেমনই রয়েছে একটি ভাবুক মন । এই উভয়ের টানাপোড়নে মানুষ যেমন সৃষ্টিশীল হয়, নিয়ম অনুশাসন গড়ে তোলে, এর মধ্যে যেমন সে আনন্দ পায়, তেমনই আবার কখনও বা সে নিয়ম ভাঙার খেলায় মেতে ওঠে । তার মধ্যে দিয়ে সে আর এক রকমের আনন্দের সন্ধান করে । আনন্দ পায় । মানুষের বুদ্ধিসত্তা, চিন্তাশক্তি, তার ভাবুক মন একাধারে মানুষকে যেমন নিয়মের মধ্যে আবদ্ধ রাখে, তেমনই নিয়ম ভাঙার খেলায় তাকে মাতিয়ে তুলে আর একভাবে তাকে সৃষ্টিশীল করে তোলে । সবের মধ্যেই তার সৃষ্টিশীল সত্তা কাজ করে যায় ।
কবি জাকির হুসাইন তাঁর "ইচ্ছে করে হয়ে যাই পাগল" রচনাটিতে এমন এক নিয়মভাঙার খেলায় মেতে উঠতে চেয়েছেন তাঁর প্রিয়াকে নিয়ে । সারাটা জীবন ধরে নিয়মে আবদ্ধ জীবন যাপন করেছেন, সমাজের অনুশাসন মেনেছেন । তথাকথিত 'ভালো' জীবন যাপন করেছেন ।
কিন্তু একরকম থাকাটা মানুষের স্বভাববিরুদ্ধ । একটা পরিবর্তন সদা তার কাঙ্খিত । তাই কবি তাঁর এই স্বাভাবিক ভালো থাকার যে যাপন তাকে ভাঙতে চাইছেন । চাইছেন একটু অন্যরকম জীবন । হিসেবের জীবন থেকে বেরিয়ে একটু বেহিসাবী হওয়া । প্রতি মুহূর্তের সূক্ষ্ম স্বাভাবিক জীবনের গন্ডি পেরিয়ে একটু অসংলগ্ন 'পাগল' জীবন যাপনের আকর্ষন বোধ করেছেন কবি । ঘর সংসার, প্রতি মুহূর্তের দায়িত্বের বাঁধন এড়িয়ে প্রিয়াকে নিয়ে তিনি বেরিয়ে পড়বেন অনির্দিষ্টের পথে । পথে প্রান্তরে ঘুরে বেড়াবেন, দেশ থেকে দেশান্তরে ছুটে যাবেন । কোনো যুক্তি নয়, কোনো হিসেব নয় - সব কিছুর ঊর্ধ্বে প্রিয়াকে নিয়ে তিনি চষে বেড়াবেন যেদিকে তাঁর মন চায় । সারাটা জীবন ধরে নিয়ম মেনে চলেছেন । হাঁফ ধরে গেছে সেই জীবনে । এখন নিয়ম ভাঙার আকর্ষণ প্রবল হয়েছে শরীর মনে । এ আকর্ষণ দুর্বার । তাকে রোধ করে কার সাধ্য ! নিয়ম ভেঙে মাতাল জীবন, উন্মাদ জীবন যাপন করার জন্য আহ্বান করেছেন তাঁর মনের সাথীকে । কেমন হবে এই যাপন ? কবি তার কিছু নমুনা রেখেছেন কবিতায় । মাঝরাতে শহরের পথে পথে হেঁটে বেড়াবেন তাঁরা । সারারাত ধরে ঢিল ছুঁড়ে ছুঁড়ে ল্যাম্পপোষ্ট ভাঙবেন । পাগলের মতো চিৎকার করবেন । হৈ হুল্লোড় শোরগোল করবেন ।
এমন একটি নিয়মভাঙা জীবন যাপনের জন্য তিনি চান তাঁর প্রিয়াও আকর্ষিত হোন এবং তাঁকে চাপ দিন যেন তাঁকেও এই যাত্রায় সঙ্গী করে নেয়া হয় ।
নিয়ম গড়া, সেই নিয়ম ভাঙা, নিয়ম ভাঙার মধ্যে দিয়ে আবার নতুন নিয়ম গড়ে তোলা - মানুষের জীবন যাপনের এ এক চেনা ছক । তার কিছুটা অনুরণন দেখি কবিতায় ।
ভাব বিস্তারের জায়গায় এটাই বলা - কবিতাটি শুরু থেকে এগিয়েছে ভালো । কিন্তু নিয়ম ভাঙার জীবন যাপনের যে উদাহরণ কবি ব্যবহার করেছেন, তা আর একটু কাব্যিক হলে কবিতার জন্য ভালো হতো । সারা রাত ধরে রাস্তায় চিৎকার করে বেড়ানো বা ল্যাম্পপোষ্ট ভাঙা বিষয়টি তেমন কাব্যিক মনে হয় নি । ল্যাম্পপোষ্ট বিষয়টিকে যদি রূপক হিসাবে গ্রহণ করি, সমাজের জড় অনুশাসন - তাকে ভাঙার কথা বলছেন কবি, আর রাতভর চিৎকারটাকে যদি সমাজের অন্যায়, অত্যাচার, রূঢ়তা - তার প্রতিবাদস্বরূপ গ্রহণ করি - তাহলে ভিন্নভাবে এই ব্যবহারগুলি একটা যৌক্তিকতা পেয়ে যায় । কিন্তু তার পরিমণ্ডল, তার প্রেক্ষিত কবিতার শুরু থেকে রচিত হয় নি । শুরু থেকে যা দেখেছি তা হলো নিয়মবদ্ধ জীবন যাপনের একঘেয়েমি থেকে বেরিয়ে পড়ার একটা আকুতি ।
যাই হোক, কবির প্রকাশের মধ্যে প্রাঞ্জলতা আছে, ভাষার ঝরঝরে ভাব আছে - শুভেচ্ছা রইলো ।