"জন্মিলে মরিতে হবে অমর কে কোথা কবে
চিরস্থির কবে নীর হায়রে জীবন নদে?"
(বঙ্গভূমির প্রতি - মাইকেল মধুসূদন দত্ত)
শুভ জন্মদিন কবি !
মানুষ মরণশীল। মৃত্যুই জীবনের অনিবার্য পরিণতি।জীবনের এই অমোঘ পরিণতি কবি চারু মান্নান এর "মৃত্যু সুধা পানে মানব জনম" কবিতার বিষয় l মানুষ যতো শক্তিধরই হোন না কেন, মৃত্যুকে এড়াতে পারেন না l মৃত্যু নামের সুধা পান মানব জনমে অপরিহার্য্য l এ থেকে কারো মুক্তি নাই। মৃত্যু কেউ কামনা করে না l এই পৃথিবীতে মোহের এক জালে সে জড়িয়ে থাকে l এই জাল ছেড়ে, প্রিয়জনদের ছেড়ে, নিজের প্রিয় বস্তুগুলি ছেড়ে মন মৃত্যুকে মেনে নিতে চায় না l কিন্তু মানুষ নিরুপায়। একটা সময়ে সকলকেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে হয় l নিতান্ত বাধ্য হয়েই l যত সাধু, সন্ন্যাসী, মহাপুরুষ, রাজা, মহারাজা - যত শক্তিধর হোন না কেন, মরণের এই অনিবার্যতাকে কেউ অস্বীকার করতে পারেন না। একদিন সবাইকেই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হয়।
এই মানবজন্ম তাহলে কার ? শরীরের ? এক একটি শরীর অর্থ এক একটি জীবন ? কিন্তু শরীর তো মৃক্তিকাসম l ভঙ্গুর l পচনশীল l মানব শরীরের প্রকৃত অধিকারী কে ? পার্থিব এই শরীর নয় l
জীবন যতো রঙিন হোক, মৃত্যুর আছে একটিই রঙ l সফেদ শুভ্র বসন l দিনাবসানে সকলকেই এই বসনে বিদায় নিতে হয় l পার্থিব জীবনের অনন্ত আকর্ষণে মত্ত মানব জানতে পারে না কবে কার জীবনে সেই পরম দিনটি আসবে l
জন্মলাভ করার পর শৈশব, কৈশোর যৌবন পার করে মানুষ জীবনের পথে এগিয়ে চলে l এক একটি করে পার্থিব বিষয় সে অধিকার করে l ভোগের তৃষ্ণা, সম্পদের মোহ তাকে কর্মচঞ্চল করে রাখে l রাতদিন তার কেটে যায় পার্থিব সমৃদ্ধির সন্ধানে l কিন্তু মানবজীবনের প্রকৃত প্রার্থিত বিষয়, যা অপার্থিব, যা মৃত্যুর পরেও তাকে অমর করে রাখবে, তার সন্ধান করতে সে ভুলে যায় l
সেই অমূল্য রতন চেনার কষ্টিপাথরকে সে অবহেলা করে l জীবন অতিবাহিত হয়ে যায় ভ্রমের পথ ধরে l ভাটির কাল এসে পড়ে l পথিক পথ ভুলে যায় l জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় ভুল কাজে ভুল পথে বয়ে যায় l
জীবনের অন্তে শরীর মৃত্তিকায় মিশে যায় l যেন মৃত্তিকায় তার নবজন্ম হয় l লাশ অর্থাৎ মৃতদেহ ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ, ব্যোম - পঞ্চভূতে মিশে যায় l প্রকৃতির যে পাঁচটি উপাদান থেকে মানবশরীরের সৃষ্টি, জীবনের অন্তে শরীর পুনরায় সেই পঞ্চভূতে লীন হয়ে যায় l আত্মীয়স্বজনদের ছেড়ে একদিন সে চলে যায় l কোথায়, সে জানে না l তার মানব শরীর হয় পুড়ে ছাই হয়, নয়তো মাটিতে মিশে যায় l শরীর তাহলে জীবন নয় l সে তো নশ্বর l মাটিতে মিশে যায় l হার মজ্জা ক্ষয়ে ক্ষয়ে কত অব্যক্ত প্রাণীর ক্ষুধার আহার হয় l
তাহলে দেখা যায় মানবঅস্তিত্ব শরীরপতনের পর আত্মায় বিরাজমান l শরীর মরে। শ্বাস বিহীন l লাশ l সাদা কফিনবন্দী। শরীর নামের শুন্য খাঁচা। শ্রবণ শক্তি, কর্মশক্তি, দেখার শক্তি, কথা বলার শক্তি কিছুই থাকে না l থাকে না লোভ, ভালোবাসা, হিংসা দ্বেষ। বেঁচে থাকার শক্তি হারিয়ে যায় l
বাঁচার শক্তির আধার হলো আত্মা l সেই আত্মায় জীবন বেঁচে থাকে l আত্মা চির ভাস্মর l সেই থাকে শরীর জুড়ে, আদি অন্ত সব জানে সে l পথিক ভুল পথে হাঁটতে পারে, শরীর একটি শূন্য খাঁচায় পরিণত হতে পারে, জীবনের আগল খোলার চাবি থাকে আত্মার কাছে l তার বিনাশ নাই l সে-ই ভব সংসারে শরীরের রূপ নিয়ে যাতায়াত করে l সেই আত্মাই মানুষের প্রকৃত সত্তা l তাকে চিনে নেওয়াটাই জীবনের মোক্ষ l লোভ লালসায় মত্ত জীবন বৃথা l সময় থাকতে থাকতে আত্মার অনুসন্ধানের মধ্যে দিয়ে মুক্তির পথে, শুদ্ধ রসে বাঁচার পথে চলতে হয় l বিশ্ব চরাচর জুড়ে আত্মা বিরাজমান l সে-ই শরীরখাঁচার প্রকৃত মালিক l তাকে ভুলে থাকাটা মানুষের ভুল l
ব্যবহারিক, বাস্তবিক ক্ষেত্রে তাই বলা যেতে পারে, মৃত্যুকে অযথা ভয় পাওয়ার কিছু নেই। বরং এই সত্যকে মেনে নিয়ে মানবজীবনকে সার্থক করে তুলতে হবে। নিজের প্রকৃত সত্তাকে চিনতে হবে l কর্মগুণে সমাজ-সভ্যতায় নিজের কীর্তির চিহ্ন রেখে যেতে হবে। নিষ্ফল জীবনের অধিকারী মানুষকে কেউ মনে রাখে না। কিন্তু কৃতি লোকের গৌরব জীবনের সীমা অতিক্রম করে অমরতা ঘোষণা করে। মানুষের শরীরের মৃত্যু হয়। কিন্তু তার জীবনের পুণ্যকর্ম পৃথিবীতে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকে। নশ্বর মৃত্যুও তখন অবিনশ্বর হয়ে ওঠে।
শারীরিক মৃত্যুতে মানুষ মূলত হারিয়ে যায়, কিন্তু মহাকীর্তির মাধ্যমে মানুষ অনন্তকাল মানুষের মাঝে বেঁচে থাকতে পারে। সুকর্মের মধ্যে দিয়ে মানুষ পার্থিব শরীরকে ছাড়িয়ে তার আত্মার পরিচয়ে বেঁচে থাকে l
কবিকে জানাই আন্তরিক শুভকামনা l