নগরায়নের প্রবণতায় গ্রামসভ্যতা, গ্রামসংস্কৃতি আজ বিপন্ন l জীবন জীবিকার তাগিদে, সন্তানের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের আশায় সকলেই শহরমুখী l গ্রামগুলি ধুঁকছে l এরকম একটি ধারণা জনমানসে বিদ্যমান, এবং এই ধারণা ভিত্তিহীন নয় l
কিন্তু গ্রামপ্রধান এশীয় দেশগুলিতে শহর যতই প্রসার লাভ করে থাকুক, মানুষ নানা আকর্ষণ ও তাগিদে যতই শহরমুখী হোন, এই দেশগুলিতে গ্রাম এখনো আছে এবং গ্রামে যারা কখনো বাস করেছেন, তারা বর্তমানে শহরে বাস করলেও গ্রাম তার বিশেষত্ব দিয়ে এখনও তাঁদের আকর্ষণ করে, হাতছানি দেয় - যে হাতছানি এড়িয়ে যাওয়া তাঁদের পক্ষে কঠিন হয় l তাঁদের ইচ্ছা হয় শহরের বাঁধন ছিন্ন করে তাঁরা তাঁদের গ্রামমাতার কাছে ফিরে যান l এরকম এক অনুভব থেকে বর্তমান কবিতাটি লিখিত হয়েছে l কবি ছবি আনসারী "হেমন্তের ডাক" কবিতায় ফুটিয়ে তুলেছেন বর্তমানে শহরবাসী এক ব্যক্তির তার জন্মভূমি গ্রামবাংলার সঙ্গে মিলিত হবার আকুল আকুতি l কোনো প্রয়োজনে তাকে শহরে থাকতে হয় l নিজের গ্রামজীবনকে ভুলে গিয়ে শহরে নিজের কাজ নিয়ে বছরের অন্য সময় যা হোক কোনোভাবে সে অতিবাহিত করে l কিন্তু বিশেষ বিশেষ সময়ে, যখন গ্রামবাংলা অপরূপ সাজে সেজে উঠে, সে আর নিজেকে শহরে ধরে রাখতে পারে না l গ্রামের জন্য তার মন চঞ্চল হয়ে ওঠে l এরকম একটি মুহূর্ত হলো হেমন্তকাল l মায়ের প্রতি সে তীব্র আকর্ষণ বোধ করে l মা যেন তাকে ডাকে l তখন মাঠে মাঠে সোনার বরণ নতুন ফসল, তার সুবাসে চারপাশটা ভরে ওঠে l মায়ের হাতে তৈরি পিঠা পুলি খাবার জন্য মনটা নেচে উঠে l তখন আর শহরে আটকে থাকতে ইচ্ছা করে না l মনে হয় যেন শহরের সব বাঁধন ছিঁড়ে কল্পনার রথে চড়ে তার নিজের ছোট্ট গ্রামে গিয়ে পৌঁছয় l
গ্রামপ্রকৃতি তার নানা বৈচিত্র্যময় সৌন্দর্য্যের স্মৃতি দিয়ে অধুনা শহরবাসীকে আকর্ষিত করতে থাকে l সাঁঝের বেলায় জোনাকি পোকা বনের ধারে ভিড় করে l বাতাসের দোলা খেয়ে হলুদবরণ ফুলে ভরা সর্ষেগাছ জমির ওপরে ঢেউ খেলে যায় l গভীর রাতে চাঁদ তার সোনালী জ্যোত্স্নায় গ্রাম এলাকা মায়াবী আলোয় আলোকিত করে রাখে l দুপুর হলেই মায়ের হাতের রান্না মাছের ঝোল, মাসকলাই-এর ডাল দিয়ে ভাত খাবার জন্য মন ছটপট করে l গ্রামের খোলা মাঠে চারিদিকে ছুটে বেড়ানোর জন্য মন আকুল হয় l সর্ষে খেতের আ'লে পা ভিজিয়ে নিতে ইচ্ছা করে l শিশির ভেজা ঘাসের দৃশ্য মনটাকে খুশি করে তোলে l ধানের ক্ষেতের পাশ ঘেষে বয়ে যায় এক নদী l এঁকে বেঁকে l তার ডাকেও তীব্র আবেদনশক্তি l তার জলে স্নান করার জন্য, তার কোলে মাছ ধরার জন্য সে গ্রামবাসীদের আহ্বান করে l নদীর ওপর মাঝি নৌকায় পাল তুলে দেয় l ভাটিয়ালি সুরে গান ধরে । গোধূলি বেলায় রাখাল গরুর পাল নিয়ে ঘরে ফেরে l সন্ধ্যে হলেই দূরে কে যেন বাঁশি বাজায় l
গ্রাম প্রকৃতির এই নৈসর্গিক রূপ অধুনা শহরবাসীকে তার কোমল মাটির প্রতি, যেখানে সারাদিনই প্রায় গরুর গাড়ি চলে, আকর্ষণ করে l
বিষয়গুণেই কবিতাটি আকর্ষণীয় l যদিও কবিতাটির গড়নে সমস্যা আছে l অন্তমিল সবক্ষেত্রে সঠিক হয় নি l দু একটি ক্ষেত্রে বানান সংশোধনেরও প্রয়োজন l কিছু পঙ্ক্তির কিছু পর্বে মাত্রার হেরফের আছে l
আসরের কবি ড. সুজিত কুমার বিশ্বাস কিছুদিন হলো কবিতার ছন্দ বিশ্লেষণ করে কবিতা আলোচনা করছেন l কবিতাগুলির সাপেক্ষে তাঁর আলোচনাগুলি পাঠ করলে কবিতায় ছন্দের ব্যবহার সম্বন্ধে ধারণা স্পষ্ট হবে l
শহর তলী - শহরতলি
সাঁজের - সাঁঝের
মাসখলাই - মাসকলাই
কবিকে জানাই আন্তরিক শুভেচ্ছা l