ফাগুনের আগুন-হাওয়ায় সকলেই প্রবাহিত l সেই প্রবাহের দোলা কবির খাতায় l হৃদয় পলাশ-রঙে রঙিন l
শীতের জড়তা কাটিয়ে ফাগুনের জীবনীশক্তি সঞ্চারিত পরিবারের প্রধান থেকে মায় বাড়ির কাজের মেয়েটির মধ্যেও l সকলেই নিজ নিজ বৃত্তের মধ্যে ফাগুনকে উপলব্ধি করে l বাড়ির যিনি কর্তা, তিনি পদ্যপাগল কবিগোছের লোক l নিজের কাব্যচর্চা নিয়ে ব্যস্ত থাকেন l ফাগুনের মাদক আবহে এই চর্চা গতি পেয়েছে l কিন্তু পিতার কর্তব্য সম্বন্ধেও তিনি অনবহিত নন l কাব্যচর্চার অবকাশে তাঁর দৃষ্টি থাকে সন্তানের ওপর, তার অধ্যয়নের বিষয়ে l ছেলে ওদিকে পড়ার চাপে কাহিল l ফাগুনের মত্ত হাওয়া তাকে উজ্জীবিত করে l গলায় গানের সুর ধ্বনিত হয় l পড়াশোনার জগত ছাড়িয়ে গানের ইঙ্গো ধুনের জগতে হারিয়ে যায় সে l পড়াশোনা অবহেলা করে ছেলের এই সঙ্গীতচর্চা কাব্যপাগল পিতার নজরে ভালো ঠেকে না l সন্তানের এই বিচ্যুতিতে, তার মনের চপল অভিযানে মেজাজ হারান তিনি l পড়ার মাঝে গুনগুন গানচর্চা বিষয়টিকে বাড়ির যিনি কর্তৃ, তিনিও অনুমোদন করেন না l তর্জন গর্জন তাঁর দিক থেকেও চলে l
কিন্তু ছেলের পড়াশোনার বিষয়ে বাবাও যে যথাযথ পরিচর্যা করছেন না, সেটিও তিনি লক্ষ্য করেন l বাবা মেতে আছেন তাঁর কবিতার খাতা নিয়ে l নিয়মিতভাবে সন্তানের পড়াশোনার ক্ষেত্রে বাবা হিসাবে যে গঠনমূলক সহায়তা, নজরদারি প্রয়োজন, সেই দায়িত্ব তিনি পালন করছেন না l ফলে ছেলে তার নিজের মতো পড়ছে, কি পড়ছে কে জানে ! কখনো পড়ছে না, ফাগুনের আগুনে গানের জগতে হারিয়ে যাচ্ছে l পড়াশোনায় ব্যঘাত হচ্ছে l তার প্রভাব পড়ছে পরীক্ষার ফলে l পরীক্ষায় যখন বিভিন্ন বিষয়ে গোল্লা আসছে, গিন্নির রাগ গিয়ে পড়ছে বাপ ব্যাটা দুজনের ওপরেই l দুজনের জন্যই কঠোর শাস্তি বিধানের ঘোষণা করছেন তিনি l
এর মধ্যে বাড়ির কাজের মেয়েটিও ফাগুনের এই বাঁকা স্রোতে প্রবহমান l ফাগুনের দোলা লেগেছে তাঁর মনেও l কানে তার সেঁটে রয়েছে ফোন l কাজের মাঝেও ফোনে কথা বলায় বিরতি নাই তার l কথা চলতে থাকে তার প্রেমিক পুরুষটির সঙ্গে l বিষয়টি গিন্নি মায়ের নজরে এলে তিনি ক্রোধ প্রকাশ করেন l ফলে অল্প কথায় প্রেমালাপ শেষ করতে হয় বেচারি কাজের মেয়েটিকে l
সংসারে কি এক দুটি বিষয় থাকে ? একের পর একটি বিষয় গিন্নি মায়ের অসন্তোষ উৎপাদন করে চলে l সংসারের বহুমাত্রিক বিশৃঙ্খলায় তিনি ব্যতিব্যস্ত, বিরক্ত l যে ছেলেটি দুধ দিয়ে যায় প্রতিদিন, সেও বা কম কিসে ? দিনের পর দিন দুধের নামে জল দিয়ে মাসান্তে টাকা গুনে নিয়ে যায় l কিন্তু তাকে এবিষয়ে বলে কোনো লাভ হয় না l ফাগুনের উত্তাপে বরং সে-ই উল্টো দু কথা শুনিয়ে দেয় l
ফাগুনের আগমনে একটি পরিবারকে কেন্দ্র করে সরল কৌতুক পরিবেশনের পর কবি চন্দন রায় এর রচনা "ফাগুন হাওয়ায়..." এবার পাড়ি দেয় বাইরের জগতে l পরিবেশ বর্ণনা থেকে একুশের আত্মাহুতি l ফাগুনের আগুন যা কিছু জীর্ণ, স্থবির তাকে বিদায় দিয়ে নতুন প্রাণের আবেশে প্রকৃতিকে সাজায় l গাছে গাছে নতুন সবুজ পাতা প্রাণে সজীবতা জাগায় l
ফাগুনের এমনই এক অমর একুশে মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষায় শহীদ হন বাংলা মায়ের তরতাজা পাঁচ সন্তান l সেই আত্মাহুতির রেশ ধরেই দেশজুড়ে প্রবল আন্দোলন l ভাষা আন্দোলনের পথ ধরেই আত্মপ্রকাশ করে একটি স্বাধীন জাতি l অধীনতা, শোষণ, উৎপীড়ন এর হাত থেকে মুক্তি পেয়ে এক নতুন সুখের ভোর দেখে বাঙালি জাতি l
তার সম্মান ও স্বীকৃতিতে একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে মর্যাদা পায় l ১৭ নভেম্বর ১৯৯৯ ইউনেস্কোর ৩১ তম সম্মেলনে একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে পালন করার প্রস্তাব সর্বসম্মতভাবে পাস করা হয়। ২০০০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে দিবসটি জাতিসঙ্ঘের সদস্যদেশসমূহে যথাযথ মর্যাদায় পালিত হচ্ছে l ২০১০ সালের ২১ অক্টোবর বৃহস্পতিবার জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৬৫তম অধিবেশনে "এখন থেকে প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে পালিত হবে" - এ সংক্রান্ত একটি প্রস্তাব উত্থাপন করে বাংলাদেশ l বাংলাদেশের এই প্রস্তাব আইভরি কোস্ট, ইতালি, ইন্দোনেশিয়া, ইরান, ওমান, গাম্বিয়া, চিলি ডোমিনিয়ন, বাহামাস, বেলারুশ, ভানুআতু, ভারত, সাইক্রোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, রাশিয়া, সস্নোভাকিয়া ও হন্ডুরাস সমর্থন করে। এই প্রস্তাব সর্বসম্মতভাবে পাস করা হয়। বাংলাদেশের পক্ষে এটি একটি মহৎ অর্জন l আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস শুধু বাংলাদেশের নয়, সকল দেশের সকল ভাষাভাষীর। তবুও দিবসটি পালনের জন্য যে একুশে ফেব্রুয়ারিকে বেছে নেয়া হলো, তার জন্য বাংলাদেশের মানুষ, বাংলা ভাষাভাষী মানুষ গর্ববোধ না করে পারে না। সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, এবং সফিক ভাই এর আত্মত্যাগ, তাঁদের রক্তে রাঙা স্বদেশভূমির স্মৃতি অমর হয়ে থাকে l
সুন্দর রচনার জন্য কবিকে জানাই আন্তরিক শুভকামনা l