পথে ঘাটে চলার সময় অনেক কিছু চোখে পড়ে l ব্যস্ত এই বিশ্বে মানুষ সর্বদা কোনো না কোনো কাজে রত l বহুধা বিস্তৃত এই কাজ নানা ভাবে চলতে থাকে l পথচারী পথ চলতে তা প্রত্যক্ষ করেন l দেখি তো আমরা সবাই l কিন্তু একজন কবি যখন কিছু দেখেন তখন তাঁর দৃষ্টি সেই দৃশ্যকে এক ভিন্ন মাত্রা দেয় l ব্যঞ্জনাময় হয়ে ওঠে l চলমান এই দুনিয়ায় একটি দৃশ্যের বিভিন্ন উপাদান সমন্বিত হয়ে কবির চোখে বিশেষভাবে ধরা দেয় l জীবনের রহস্য উন্মোচন করার প্রয়াস পায় l কবির দৃষ্টিতে বিকশিত হয়ে ওঠা সেই দৃশ্যমালা কবিতা আকারে উপস্থাপিত হয় l "চিত্র প্রদর্শনী" রচনায় কবি মূলচাঁদ মাহাত এমনই এক চিত্রমালা উপহার দিয়েছেন পাঠকদের l
প্রথম চিত্রে পাই গ্রীষ্মের নিঝুম দুপুরে এক তালগাছে বাবুই পাখির বাসা বোনার দৃশ্য l আর পাশেই এক বাড়ির উঠোনে নববধূর উত্কণ্ঠিত দৃষ্টি l দ্বিতীয় দৃশ্যে দেখি ভিড়ে ঠাসা এক বাস l আর পথের ওপর ধুলোমাখা এক শিশুর আর্ত কান্নার ছবি l তৃতীয় দৃশ্যে পাই ঝুলন্ত এক সেতুর ওপর এক কিশোর নগ্ন পায়ে দাঁড়িয়ে আছে এবং ঠিক তার পাশেই ফুলের স্তুপের আড়ালে লুকানো আছে অস্ত্রের ভান্ডার l অন্য পাশে কাঁচের টুকরার উপর আছে কয়েকটি বই।চতুর্থ দৃশ্যে কবির দৃষ্টি চলে যায় সাগরপানে l সেখানে অগাধ সমুদ্রে ভাসমান এক রূপসী নারী l এক পুরুষ বৈঠা হাতে সেখানে সেই নারীর পাশে উপস্থিত l পঞ্চম চিত্রে দেখি এক সসস্ত্র সৈনিককে যার মাথায় স্ত্রী, পুত্র, কন্যার দায়িত্ব রয়েছে l ষষ্ঠ এবং শেষ চিত্রে পাই এক রুগ্ন মহিলা তাঁর দুই হাতের বেষ্টনীর আশ্রয়ে দমকা হাওয়ার মাঝে একটা মোমবাতি জ্বালানোর প্রয়াস করে যাচ্ছেন l
এই ছবিগুলি যেন শুধু ছবি নয় l আরো অনেক কিছু l যেন জীবনের এক চিত্ররূপ l প্রথম চিত্রে বাবুই পাখি ও নববধূ জীবনের প্রতি দায়বদ্ধতার নিদর্শন l প্রচন্ড গ্রীষ্মেও বাবুই পাখি কর্মরত l বাবুই পাখির কর্ম নববধূর দায়িত্বসচেতনতার রূপক l হয়তো তাঁর কোল আলো করে আসতে চলেছে এক সন্তান l সন্তানের জন্ম বিষয়টি সর্বদাই অনিশ্চয়তায় পূর্ণ থাকে l অনেক বাধা বিপত্তি আসে l আগামীর ভাবনায় তাই নববধূর কপালে চিন্তার ভাঁজ l দ্বিতীয় দৃশ্যে বাসভর্তি লোক যেন জনবিস্ফোরণের রূপক l আর এই জনবিস্ফোরণের রেশ ধরেই দারিদ্র্য গ্রাস করে সমাজকে l অবহেলিত শিশু ক্ষুধার জ্বালায় পথে ধুলোয় গড়াগড়ি খায়, আর্তনাদ করে l পরের দৃশ্যে পাই দেশের মধ্যে সন্ত্রাসবাদী যে হানা হয়ে চলে, তার অস্ত্রভাণ্ডারের হদিস l কিভাবে ফুলের আড়ালে, কিশোরদের বিভ্রান্ত করে জালে টেনে, আমাদের চোখের সামনেই অস্ত্রগুলিকে লুকিয়ে রাখা হয়েছে এবং হঠাৎ হঠাৎ নেমে আসছে সন্ত্রাসবাদী হানা l আর ভাঙা কাঁচের টুকরোগুলির ওপর কিছু বই - অর্থাৎ এই সন্ত্রাসী হানা দেশের শিক্ষা, সভ্যতা সংস্কৃতির ওপর আঘাত হানছে l আবার অস্ত্রভান্ডারের পাশে বইগুলি এটাও বোঝাতে পারে যে এই সন্ত্রাসীরা শিক্ষিত, প্রশিক্ষিত l একশ্রেণীর শিক্ষিত মানুষ বিপথে চালিত হয়ে সন্ত্রাসের পথ ধরে ক্রমাগত দেশের ক্ষতি করে চলেছে l চতুর্থ দৃশ্যে নারী ও পুরুষের পরস্পর নির্ভরতার বিষয় l নারীর সৌন্দর্য - পুরুষকে প্রাণিত করে, আবার পুরুষজাতিকে একে অন্যের বিরুদ্ধে লড়িয়ে দিয়ে ধ্বংসের পথে ঠেলে দেয় l দেখি সংসার সমুদ্রে যতো ঘাত প্রতিঘাত আছে, নারী পুরুষ সমন্বিত প্রচেষ্টায় তার সঙ্গে লড়ে যাচ্ছেন l নারীর রূপ আর পুরুষের শক্তি ও কর্মচঞ্চলতা সংসারজীবনের সমস্ত রকমের ঝড় ঝঞ্ঝা মোকাবিলা করার শক্তি ও প্রেরণা যোগায় l পঞ্চম দৃশ্যে দেখি এক সশস্ত্র সৈনিককে l তিনি কর্তব্যের তাগিদে সীমান্তে দেশ প্রহরার কাজে নিয়োজিত l কিন্তু তাঁর অন্তরে তাঁর স্ত্রী, পুত্র, কন্যার প্রতি অগাধ ভালোবাসা বিদ্যমান l সদা এই ভালোবাসা তাকে তাড়িত করে l পরিবারের প্রতি এই ভালোবাসা ও দায়িত্ববোধ অন্তরে লালন করেই তিনি দেশরক্ষার কাজে আত্মবলিদান দিতে প্রস্তুত থাকেন l ষষ্ঠ ও শেষ দৃশ্যে পাই কিভাবে একজন নারী শত অসুবিধার মধ্যেও তাঁর সংসারকে চলমান রাখেন, তার জন্য পরিশ্রম করে যান l
এইভাবে নানা খণ্ডচিত্রের মাধ্যমে কবি যেন মানবজীবনের এক একটি দিককে ধরতে চেয়েছেন l
কবিকে জানাই আন্তরিক শুভকামনা !!
* কিছু বানানের সংশোধন প্রয়োজন
অগাদ - অগাধ
ভাসমন - ভাসমান
বোঝায় - বোঝাই
হাওয়াই - হাওয়ায়