যে কোনো মানুষের জীবনে, যে কোনো জাতির জীবনে শিক্ষকের অবস্থান অনেক উঁচুতে l সম্মান, শ্রদ্ধার পাত্র তাঁরা l জাতির কারিগর l একটি দেশ, একটি জাতি ততটাই উন্নত, যতটা উন্নত, প্রগতিশীল সেই দেশের শিক্ষকসমাজ l ছাত্রদের কাছে পিতৃতুল্য l পিতামাতার মতো সমান স্নেহে তিল তিল করে একজন শিক্ষক তাঁর ছাত্রকে গড়ে তোলেন, ছাত্রের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ সুনিশ্চিৎ করতে তাঁর জ্ঞানভাণ্ডার উজাড় করে দেন l
শিক্ষকতা একটি পেশা l অনেক শিক্ষক পেশার মধ্যে থেকেও নেশাকে তার সঙ্গে যুক্ত করে শিক্ষকতার ক্ষেত্রে বিরল নজির স্থাপন করেন l তাঁদের ছাত্রছাত্রীরা জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চার নানা ক্ষেত্রে দেশে বিদেশে সফলতার শিখর স্পর্শ করে নিজের, তার পরিবারের, দেশের, সেই বিদ্যালয়ের, সঙ্গে সঙ্গে সেই শিক্ষকের মর্যাদা বৃদ্ধি করেন l
কিন্তু সব শিক্ষকেরই চাকুরীর মেয়াদ একদিন শেষ হয় l একদিন তাঁকে অবসর গ্রহণ করতে হয় l নিজের কর্মস্থল ছেড়ে, নিজের প্রিয় ছাত্রছাত্রীদের ছেড়ে, সমস্ত স্মৃতিকে পিছনে ফেলে তাঁকে চলে যেতে হয় l এই চলে যাওয়ার মুহূর্তকে স্মরণীয় করে রাখার এক আনুষ্ঠানিকতা আছে l এক বিদায় অনুষ্ঠানের মাধ্যমে শ্রদ্ধেয়, প্রিয় শিক্ষককে বিদায় সম্বর্ধনা দেন তাঁর সহকর্মীরা l তাঁর প্রিয় ছাত্র ছাত্রীরা l
বিদায় অনুষ্ঠানের প্রথা অনুসারে বক্তাগণ পুরনো দিনের স্মৃতিচারণ করেন l সৌজন্য অনুসারে সমস্ত বিতর্কিত প্রসঙ্গ এড়িয়ে শুধু মধুর স্মৃতিগুলিকে, মধুর মুহূর্তগুলিকে তুলে আনবার প্রয়াস করা হয় l কথায়, সুরে, আবেগে বিদায়ী শিক্ষককে সম্মান, সম্বর্ধনা জানানো হয় l প্রথা অনুসারে উভয় পক্ষ থেকেই বিগত দিনের ভুল ভ্রান্তির জন্য দুঃখ প্রকাশ করে নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করা হয় l কেউ কেউ সেই ভুলগুলোকে সদর্থক অর্থে ব্যখ্যা করে এমন মত প্রকাশ করেন যে অতীত দিনের সেই ভুলগুলি থেকেই তাঁরা শিক্ষা গ্রহণ করেছেন, যা পরবর্তীকালে তাঁদের চলার পথকে মসৃণ করে তুলেছে l
সুন্দর ছোট্ট কবিতা "অনুষ্ঠান" l কবি বিশ্বজিৎ জানা (ভাস্বর কবি) এরকম এক বিষয় নিয়ে কবিতাটিকে গড়ে তুলেছেন l দীর্ঘ জীবন একটি বিদ্যালয়ে নিষ্ঠা সহকারে কাজ করার পর বয়সের ভারে শিক্ষক ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত l অবসর গ্রহণের মুহূর্ত তাঁর l প্রিয় সহকর্মী ও ছাত্র ছাত্রীরা বিদায় অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে l সেই অনুষ্ঠানে সকলের বক্তব্য শুনছেন তিনি l সকলেই বিদায়ী শিক্ষকের প্রতি তাদের শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, ঋণ আবেগময় ভাষায় প্রকাশ করছে l অনেক অনেক দিনের পরিশ্রমের পর আজ বিদায় অনুষ্ঠানে শত্রু মিত্র সকলের বক্তব্য শুনে বিদায়ী শিক্ষক মনের মধ্যে যেন এক শান্তি অনুভব করছেন l চোখ দুটি সজল হয়ে উঠেছে l যেন এক পশলা বৃষ্টি এসে উত্তপ্ত ভূমি প্রান্তরকে শান্ত করে দিয়েছে l মুগ্ধতাময় অতীত স্মৃতিপ্রবাহ এক পরিতৃপ্তির আবেশ সৃষ্টি করেছে l
বিদায়ী শিক্ষককে আনুষ্ঠানিক বিদায় দিলেও তাঁর সঙ্গে সম্পর্ক শেষ হয়ে যায় না l তিনি শ্রদ্ধার সম্পর্কে, ভালবাসার সম্পর্কে একইরকমভাবে আবদ্ধ থাকেন l তাঁর কাছে শেখার বিষয়ও থাকে অনেক l সর্বোপরি, তাঁর উপদেশ, ত্রুটি সংশোধনের পরামর্শ এবং অবিরাম আশীর্বাদ এখনো পরবর্তী প্রজন্মের কাছে পাথেয় - এমন অভিমত দেন অনেকেই l শ্রদ্ধানত হৃদয়ে, সজল নয়নে, ভাবগম্ভীর পরিবেশে ভাব বিনিময়ের মাধ্যমে এভাবেই এক শিক্ষকের বিদায় অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয় l
কবিতাটিতে অবশ্যই নির্দিষ্ট করে কোনো শিক্ষকের কথা বলা হয় নি l বিদায় অনুষ্ঠানের একটা আভাস আছে l সেটা অন্য কোনো পেশার ক্ষেত্রেও হতে পারে l সমাজজীবনের যে কোনো ক্ষেত্রেই হতে পারে l একজনের সঙ্গে দীর্ঘদিন কাজ করার পর, তাঁর কর্মজীবনের শেষে কৃতজ্ঞতাস্বরূপ তাঁকে একটি অভ্যর্থনা দেওয়া, একটি মনোরম অনুষ্ঠানের মাধ্যমে, অতীত দিনের মধুর কর্মময় দিনগুলির স্মৃতিচারণের মাধ্যমে, ভালোবাসা, শ্রদ্ধা প্রকাশের মাধ্যমে সেই সম্পর্ককে মর্যাদা দেওয়া - কবিতাটির বিষয় l
সুন্দর পরিবেশনের জন্য কবিকে জানাই আন্তরিক শুভকামনা l