কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতার ওপর আলোচনা প্রচুর হয়েছে l কবিতার ওপর আলোচনার নিরিখে কাজী নজরুল ইসলাম, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর পরই তাঁর স্থান l তার পরও কি তাঁর কবিতা নিয়ে আলোচনার প্রয়োজন আছে ?
হ্যাঁ, আছে l জীবনানন্দ দাশের কবিতার মধ্যে যে ভাব গভীরতা রয়েছে, কল্পনা জগতের যে খেলা রয়েছে, কবির নিজের একান্ত জগতের, স্বকীয় সত্তার যে প্রকাশ রয়েছে, তা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পাঠকের কাছে নব নব রূপে ধরা দেয় l তাই এ আলোচনার কোনো শেষ নেই l
"বেড়াল" কবিতাটির মধ্যে সুররিয়ালিজম অর্থাৎ পরাবাস্তবতার প্রয়োগ আছে l পরাবাস্তবতা বিষয়টা কি ? সোজা কথায় বাস্তবকে এড়িয়ে যাওয়া l এটি হচ্ছে স্বপ্ন ও জাগরণের মধ্যে যে বিরোধ তার একটি সমন্বয় চেষ্টা l এখানে এমন সব চিত্রকল্প সৃষ্টি করা হয় বাস্তবের সঙ্গে যা মেলে না l যেমনটা অবচেতন মনের প্রভাবে আজগুবি সব ইমেজ আমরা স্বপ্নে দেখে থাকি, যখন চিন্তার প্রবাহ যুক্তির পথ ধরে চলে না l কিন্তু একটা সময়ে এই স্বপ্নকে বাস্তবের সঙ্গে অন্বিত করতে হয় l একে বলা হচ্ছে পরাবাস্তব l এখানে রূপ-রস-গন্ধময় পার্থিব অনুভূতিকে ছাড়িয়ে অবচেতনজাত স্বপ্নময় চিত্রকল্প নির্মাণ হয় l পরাবাস্তব জগতের অলৌকিক ইশারা চিত্র অঙ্কনে, কবিতা রচনায় আসে l স্যুর্রিয়ালিজ্মের মধ্যে একটা আপাত ধোঁয়াশা থাকে l কবিতায় এমন সব চিত্রকল্প ব্যবহার করা হয় বাস্তবের সঙ্গে তার যোগ নেই l ফলে কবিতার অর্থ বোঝা যায় না l আধুনিক কবিতার ক্ষেত্রে বিষয়টি খুব লক্ষ্য করা যায় l কবি কি বলতে চেয়েছেন, বোঝা কঠিন হয় l
জীবনানন্দ দাশ রবীন্দ্রনাথের সর্বগ্রাসী প্রভাব কাটিয়ে উঠতে পেরেছিলেন l তাঁর কবিতার বিশিষ্টতা হলো তাঁর কাব্যপ্রেরণা বা কাব্য-উন্মাদনা তাঁর কবিসত্ত্বার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। কবি বুদ্ধদেব বসুর ভাষায় তিনি ‘আত্মনিমগ্ন কবি’। তাঁর লেখা একেবারেই ব্যক্তিগত, নিজের জন্য l নিজের ভুল-ত্রুটি দোষকে তিনি অকপটে স্বীকার করেন l এভাবেই তিনি নিজের প্রকৃত স্বরূপকে উদ্ঘাটিত করেন l তাঁর বিখ্যাত স্যুররিয়ালিস্টিক কবিতা ‘বেড়াল’ পড়ার সময় এই কথাগুলি মনে রাখতে হবে।
"বেড়াল" কবিতায় কবি নিজেকে প্রকাশ করেছেন একটা ধোঁয়াশা সৃষ্টি করে l কবিতার শুরুতে পাই,
‘সারাদিন একটা বেড়ালের সঙ্গে ঘুরে-ফিরে কেবলই আমার দেখা হয়:’।
বেড়াল কিসের প্রতীক? ‘ভণ্ড তপস্বী’র l এখানে বেড়াল কবির নিজ অন্তরাত্মার প্রতিনিধি। জটিল মানবপ্রকৃতির তুলনা বেড়ালের সঙ্গে করা হয়েছে l ভণ্ডামি, উদাসীনতা, কৌতূহল, চৌর্যপ্রবৃত্তি এগুলি বেড়ালের সত্তার সঙ্গে মেলে। এবং মানবসত্তার সঙ্গে l বেড়াল তার আপাত নিরীহ নরম থাবার তলায় লুকিয়ে রাখে ধারালো নখরের হিংস্রতা l যেমনটা মনুষ্য প্রকৃতি, মুখোশ ও মুখ l
বেড়ালের সঙ্গে কবির দেখা হয় ‘ঘুরে-ফিরে l সবসময় নয়। যেমন সবসময় আমরা আত্ম-সচেতন থাকি না। মাঝে মাঝে, ঘুরে-ফিরে নিজ সত্ত্বার মুখোমুখি হই l
এই আত্মদর্শন কখন হয় ? কবি বলছেন,
"গাছের ছায়ায়, রোদের ভিতরে, বাদামি পাতার ভিড়ে;’l
এ হলো প্রকৃতির সৌন্দর্যের বর্ণনা। কবি সৌন্দর্যের মধ্যে, প্রকৃতির মধ্যে নিজ অন্তরাত্মার মুখোমুখি হয়ে পড়েন l
এছাড়াও কবি তাঁর অন্তরাত্মার মুখোমুখি হন,
"কোথায় কয়েক টুকরো মাছের কাঁটার সফলতার পর’l
এখানে বিষয়চিন্তা, ক্ষুধা, তাও মনে পড়ায় নিজেকে। এখানে "সফলতা" কথাটির মধ্যে কোথাও একটা আত্মতৃপ্তির ভাব আছে। মাছের কাঁটা যেভাবেই জোগাড় হয়ে থাক, তার জন্য বেড়াল কারও কাছে কৃতজ্ঞ নয়। ওই মাছের কাঁটা তার ‘সফলতা’র নিদর্শন। কবি আবিষ্কার করেন, বিষয়চিন্তার ক্ষুদ্রতার মধ্যেও আত্মতৃপ্তি আছে l সেভাবেও তিনি নিজেকে খুঁজে পান। ‘গাছের ছায়ায়, রোদের ভিতরে, বাদামি পাতার ভিড়ে’র
সুন্দর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সাথে মিশে যায় আপাত বিরোধী ‘মাছের কাঁটার সফলতা’ - কবির এই দুই সত্তা l
‘বেড়াল’ স্যুররিয়ালিস্টিক কবিতা। প্রথম পঙ্ক্তিদুটিতে ‘বেড়াল’কে কবির অবচেতনার প্রতীক বলা হয়েছে l কিন্তু স্যুররিয়ালিস্ট শিল্পের প্রধান শর্ত হলো, স্বপ্ন ও জাগরণের মাঝের সীমারেখাটাকে অতিক্রম করা l পরের পঙ্ক্তিতে কবি সেই সীমাভঙ্গের শর্ত পূরণ করেন l
‘তারপর শাদা মাটির কঙ্কালের ভিতর
নিজের হৃদয়কে নিয়ে মৌমাছির মতো নিমগ্ন হয়ে আছে দেখি;’
এখানে বেড়াল ‘নিজের হৃদয়কে নিয়ে মৌমাছির মতো নিমগ্ন হয়ে আছে’ ‘শাদা মাটির কঙ্কালের ভিতর’! মাছের কাঁটার সফলতার সঙ্গে বেড়ালকে তো জোড়া যায় সহজেই, কিন্তু, নিজের হৃদয়কে নিয়ে মগ্ন হয়ে থাকা, তাকে যেন বেড়ালের সাথে জুড়া যায় না। যেন এলোমেলো কথাবার্তা, উদ্ভট স্বপ্ন, কোনও মানেই হয় না যার। সাদা চোখে মানে হয়তো হয় না, কিন্তু, মনোবৈজ্ঞানিকেরা বলবেন, যতই এলোমেলো হোক, স্বপ্নের মানে আছে। এবং সে অর্থ এমনই যা অবচেতন মনের গভীরতায় ডুব দেয়।
সাদা মাটির যে কঙ্কাল, হাড়ে তৈরি যে পাঁজর তার ভিতরে আমাদের হৃদযন্ত্র থাকে লুকোনো। আর আমরা সেই হৃদয়কে নিয়ে মগ্ন থাকি, সযত্নে বাঁচিয়ে চলার চেষ্টা করি সারাটি জীবন ধরে l আক্ষরিক অর্থেও, কারণ, হৃদযন্ত্র বন্ধেই আমাদের মৃত্যু; আবার প্রতীকী অর্থেও, হৃদয়ে আঘাত যেন না লাগে সে দিকে আমাদের যত্নের অন্ত নেই। নিজের হৃদয়কে নিয়ে পরম স্বার্থপরতায় মগ্নই হয়ে থাকি আমরা সারাটা জীবন ধরে। কবিও তাই থাকেন। যেন শ্রমিক মৌমাছির মৌচাক সৃষ্টি ও রক্ষা করার মত প্রবল উদ্যমে। অথচ সত্যিই কেন নিজের হৃদয়ের প্রতি আমাদের এত মমত্ব সে প্রশ্নও আমরা করি না, সেও শ্রমিক মৌমাছির মতই উদাসীনতায়। এ আমাদের প্রকৃতিদত্ত সহজাত প্রবৃত্তি।
এই প্রবৃত্তিকে ছেড়ে উর্দ্ধে ওঠার চেষ্টারও কিন্তু আমাদের অন্ত নেই। তারপরের পঙ্ক্তি,
'কিন্তু তবুও তারপর কৃষ্ণচূড়ার গায়ে নখ আঁচড়াচ্ছে/ সারাদিন সূর্যের পিছনে-পিছনে চলছে সে।'
‘বেড়াল’, অর্থাৎ কবির অবচেতনা, কৃষ্ণচূড়া গাছকেও অগ্রাহ্য করে না। কৃষ্ণচূড়া কিসের প্রতীক ? সৌন্দর্যের l তার গায়ে নখ আঁচড়ানোর অর্থ সৌন্দর্য্যকে চিরে চিরে দেখতে চাওয়া l
আবার, বেড়াল সারাদিন সূর্যের পিছনে পিছনে চলে। সূর্য কি ? আলোর উৎস। সূর্য সময়ের প্রতীক, আবার জ্ঞানেরও। বেড়ালরূপী মনুষ্যপ্রকৃতি, কবিপ্রকৃতি সেই আলোর হাতছানি, জ্ঞানের ডাককেও অস্বীকার করতে পারে না। সত্যের পিছনে সারাদিন চলতে থাকে।
সেই আলোর পিছনে, সেই সত্যের পিছনে ছুটতে ছুটতে সে বহুবার পথভ্রষ্টও হয়। তাই,
"একবার তাকে দেখা যায়, / একবার হারিয়ে যায় কোথায়।'
পরের পঙ্ক্তিতে কবি বলেন,
'হেমন্তের সন্ধ্যায় জাফরান-রঙের সূর্যের নরম শরীরে/ শাদা থাবা বুলিয়ে-বুলিয়ে খেলা করতে দেখলাম তাকে;' এ এক অপূর্ব মাধুর্যে ভরা চিত্রকল্প।
হেমন্ত বাংলাসাহিত্যে শেষকালের প্রতীক, প্রৌঢ়ত্বের প্রতীক। হেমন্ত-সন্ধ্যা জীবনানন্দের কবিতায় বারবার ফিরে ফিরে এসেছে l কখনো সে উদ্যমহীনতার প্রতীক। কখনো স্তব্ধতার প্রতীক l কখনো শান্তির l
হেমন্তের সন্ধ্যা পরিণত বয়সের প্রতীক l সূর্য জ্ঞানের আলোর প্রতীক l তাই হেমন্তের সন্ধ্যার জাফরান রঙের সূর্যের নরম শরীরে শাদা থাবা বুলিয়ে খেলা করার অর্থ হলো সারাজীবন ধরে সঞ্চিত জ্ঞানটুকুকে নিয়ে পরম মুগ্ধতায় নাড়াচাড়া করা। কিন্তু সেই জ্ঞান নিয়ে নাড়াচাড়াতেই বেড়াল থেমে থাকল না।
'অন্ধকারকে ছোটো-ছোটো বলের মতো থাবা দিয়ে লুফে আনল সে,'--তারপর,
'সমস্ত পৃথিবীর ভিতর ছড়িয়ে দিল।'
এবার এলো চরম নৈরাশ্যবাদ l জ্ঞানের পিছনে ছোটাছুটি করেও, সৌন্দর্যের চুলচেরা বিশ্লেষণ করার পরও, পৃথিবীকে বেড়াল উপহার দিল শুধু অন্ধকার।
এইখানেই কবির আত্মবিশ্লেষণের চরম পরিসমাপ্তি। বেড়ালের রূপকল্প, বেড়ালের জীবনযুদ্ধ কখন কবির আত্মকথনের সাথে জুড়ে যায় যেন স্বপ্নের মত, আর সেই আত্মকথনের শেষে আমরা দেখি ক্ষুব্ধ কবিকে l
স্যুররিয়ালিস্টিক ‘বেড়াল’ কবিতায় বাস্তব জগতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নয় এমন বহু চিত্রকল্প ব্যবহার করা হয়েছে l
এই উপমাগুলি বেশিরভাগ সময়েই বক্তব্য স্বচ্ছ ও অর্থ স্পষ্ট করার জন্য ব্যবহার হয় না, কেবলমাত্র একটি আবহ সৃষ্টিই উদ্দেশ্য। স্বাভাবিক কারণেই জীবনানন্দের কবিতা পাঠকের কাছে দুর্বোধ্য হয়ে ওঠে। কারণ তাঁর কবিতায় একটি ভাবের সাথে আরেকটি ভাবের যোগসূত্র আবিষ্কার বেশ দুরূহ ব্যাপার।
কিন্তু "বেড়াল" কবিতায় ব্যবহৃত চিত্রকল্পগুলি পরস্পরের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ মনে হয়েছে l কবিতায় ব্যবহৃত কিছু টেক্সট কবিতার অর্থের বার্তা দেয়, যার থেকে কবিতাটি বুঝে উঠতে সাহায্য হয় l দোষত্রুটি গোপন না করে কবির নিজস্ব সত্তাকে নানা চিত্রকল্প ও উপমা ব্যবহার করে বেড়াল সত্তার সঙ্গে তুলনার মাধ্যমে কবিতায় মেলে দেওয়া হয়েছে l
** নীচের চিত্রটি পরাবাস্তবতা চিত্রশিল্প l Caption "Surrealism - Max Ernst, The Elephant Celebes, 1921, Tate, London."
Max Ernst was a German painter, sculptor, graphic artist, and poet. A prolific artist, Ernst was a primary pioneer of the Dada movement and Surrealism. Wikipedia
The Elephant Celebes (or short Celebes) is a 1921 painting by the German Dadaist and surrealist Max Ernst. It is among the most famous of Ernst's early surrealist works and "undoubtedly the first masterpiece of Surrealist painting in the de Chirico tradition."[1] It combines the vivid dreamlike atmosphere of Surrealism with the collage aspects of Dada. Wikipedia