শ্রাবন মাস কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতি বিজড়িত l রবীন্দ্রপ্রয়াণের প্রসঙ্গে চলে আসে ঠাকুর পরিবারে পর পর ঘটে যাওয়া সেই সকল মৃত্যুর প্রসঙ্গ, জীবনভর রবীন্দ্রনাথ যার যন্ত্রণা পেয়েছেন l
পিতা মহর্ষী দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও মাতা সারদাসুন্দরী দেবী। চৌদ্দ ভাই বোনের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন Penultimate Child অর্থাৎ ১৩ তম সন্তান l দীর্ঘ জীবনের সুবাদে এবং পরিবার বিশাল হবার কারণে প্রিয়জনের মৃত্যুর বেদনা বারে বারে আঘাত করেছে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথকে l তিনি কিভাবে তা সামলে উঠেছেন ভাবলে বিস্মিত হতে হয় l বলা যেতে পারে মৃত্যুর সঙ্গে তাঁর এক বোঝাপড়া গড়ে উঠেছিল l মৃত্যুকে ঘিরে তিনি এক দর্শন গড়ে তুলেছিলেন l
মৃত্যু বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উপলব্ধি - "মৃত্যুর ডাক আর কিছুই নহে, বাসা বদলের ডাক। জীবনকে কোনো মতেই সে কোনো সনাতন প্রাচীরের মধ্যে বন্ধ হইয়া থাকিতে দিবে না, জীবনকে সেই জীবনের পথে অগ্রসর করিবে বলিয়াই মৃত্যু।" এজন্য রবীন্দ্রনাথ মৃত্যুকে সত্তার অবিচ্ছেদ্য অংশ মনে করেছেন। মৃত্যু হল মানুষের সহযাত্রী। পৃথিবীর দুঃখ দুর্দশা ও যন্ত্রণা ক্লিষ্ট জীবনের উপশম হল মৃত্যু l মহৌষধ l 'ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী' কাব্যের 'মরণ' কবিতায় সেই বার্তা ফুটে উঠেছে:
"মরণ রে, তুঁহুঁ মম শ্যাম সমান।
......
তাপবিমোচন করুণ কোর তব
মৃত্যু অমৃত করে দান।
তুঁহুঁ মম শ্যাম সমান।l"
মৃত্যুই বয়ে আনে জীবনের পূর্ণতা। মৃত্যু তাঁর কাছে কর্মের প্রেরণা, জগৎ ও জীবন মাঝে চিরন্তন শক্তির সঞ্চারক। মৃত্যুকে তুচ্ছ করা মানে জীবনকেই অস্বীকার করা। কবি তাই বলছেন,
"মরণকে তুই পর করেছিস ভাই,
জীবন যে তোর তুচ্ছ হলো তাই,
দুদিন দিয়ে ঘেরা ঘরে
তাই তো যদি এতই ধরে
চিরদিনের আবাসখানা
সেকি শূন্যময় ?"
নিজের জীবনকালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পরিবার পরিজন যাঁদের মৃত্যু প্রত্যক্ষ করেছিলেন, তার তালিকা বিশাল l
যে কোনো প্রিয়জনের মৃত্যূই বেদনাদায়ক l কিন্তু কিছু মৃত্যুর ঘটনা যেন অধিক হৃদয়বিদারক l
১) মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ এবং সারদা দেবীর চৌদ্দ সন্তানের মধ্যে দু'চারজন ছাড়া বেশির ভাগ সন্তানই দীর্ঘজীবী ছিলেন না। সর্বকনিষ্ঠ ছেলে বুধেন্দ্রনাথ মারা যায় ১৮৬৪ সালে। কবির ৩ বছর বয়সে l
২) ১৮৭৫ সালে স্নেহময়ী জননী সারদাসুন্দরী দেবীর মৃত্যু হয়। তখন রবীন্দ্রনাথের বয়স ছিল মাত্র চৌদ্দ বছর। পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন হিমালয়ে। স্ত্রীর অসুস্থতার খবর শুনে কলকাতায় ফিরে আসেন। সে রাতেই স্ত্রীর মৃত্যু হয়। অতটুকু বয়সে রবীন্দ্রনাথ মায়ের স্নেহ থেকে বঞ্চিত হলেন। বুঝলেন মা আর ফিরে আসবে না কোন দিন। জীবনের প্রথম সবচেয়ে আপনজনের মৃত্যুশোক অনুভব করলেন ভীষণভাবে। এই মৃত্যুশোক কবি কোনদিন ভুলতে পারেননি। বড় হয়ে তাঁর জীবনস্মৃতিতে লিখেছেন, “বড় হইলে যখন বসন্ত প্রভাতে একমুঠা অনতিস্ফুট মোটা মোটা বেলফুল চাদরের প্রান্তে বাঁধিয়া খ্যাপার মতো বেড়াইতাম, তখন সেই কোমল চিক্কন কুঁড়িগুলো ললাটের উপর বুলাইয়া প্রতিদিনই আমার মায়ের শুভ্র আঙুলগুলি মনে পড়িত; আমি স্পষ্টই দেখিতে পাইতাম, যে স্পর্শ সেই সুন্দর আঙুলের আগায় ছিল সেই স্পর্শই প্রতিদিন এই বেলফুলগুলোর মধ্যে নির্মল হইয়া ফুটিয়া উঠিতেছে।” (ভারত বিচিত্রা, মে-২০১৫)
৩) তৃতীয় কন্যা সুকুমারী দেবী এবং
৪) ৫ম কন্যা স্বর্ণকুমারীর ২য় কন্যা উর্মিলার মৃত্যু হয় ১৮৭৯ সালে।
৫) মেজছেলে সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোট ছেলে কবীন্দ্রনাথের মৃত্যু হয় ১৮৭৯ সালে মাত্র ৪ বছর বয়সে।
৬) ১৮৮৩ সালে রবীন্দ্রনাথের বিয়ে হয় ভবতারিনির সঙ্গে l পরে রবীন্দ্রনাথ তাঁর নাম রেখেছিলেন মৃণালিনী দেবী l বিয়ের এ আনন্দ-উৎসবের মাঝে খবর এলো শিলাইদহে বড় ভগ্নিপতি সারদাপ্রসাদের মৃত্যু সংবাদ। থেমে গেলো আনন্দ-উৎসব। বিয়ের অনুষ্ঠানে নেমে এলো শোকের ছায়া।
৭) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বৌদি কাদম্বরী দেবীর মৃত্যু হয়েছিল ১৮৮৪ সালে l কাদম্বরী দেবী আত্মহত্যা করে মারা যান। তখন তার বয়স হয়েছিল মাত্র ২৫ বছর। আর এই বৌদি ছিলেন রবীন্দ্রনাথের খেলার সাথী, হৃদয়ের একান্ত সুহৃদ। বৌদির সঙ্গে তার বয়সের ব্যবধান ছিল মাত্র ২ বছরের। বৌদি ছিলেন তাঁর চেয়ে দু'বছরের বড়। বৌদি ছিলেন তার সৃষ্টিশীল কর্মের প্রেরণা, ভালোবাসার একমাত্র আশ্রয়স্থল। তার মৃত্যু ও শূন্যতা রবীন্দ্রনাথ ব্যথিত চিত্তে বয়ে বেড়িয়েছিলেন যুগ থেকে যুগান্তরে।
৮) দেবেন্দ্রনাথের তৃতীয় ছেলে হেমেন্দ্রনাথের মৃত্যু হয় ৪০ বছর বয়সে ১৮৮৪ সালে। রবীন্দ্রনাথ তখন ২৩ বছরের l
৯) ৪র্থ সন্তান বীরেন্দ্রনাথ ঠাকুরের একমাত্র ছেলে বলেন্দ্রনাথের মৃত্যু হয় ১৮৯৯ সালে মাত্র ২৯ বছর বয়সে।
১০) রবীন্দ্রনাথের স্ত্রী মৃণালিনী দেবী মারা গেলেন ১৯০২ সালে l
১১) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মেজ কন্যা রেণুকা, ডাক নাম রানী, ১৯০৩ সালে তার মৃত্যু হয়। এই রেণুকা ছিল বাবার চোখের মণি l রেণুকার ভবিষ্যতের কথা ভেবেই রবীন্দ্রনাথ রেণুকার স্বামী সত্যেন্দ্রনাথকে আমেরিকা পাঠিয়েছিলেন উচ্চশিক্ষার জন্য l কিন্তু রেণুকার স্বামী সেই কাজে ব্যর্থ হয়েছিল l বাবার টাকা জলে গেল দেখে রেণুকা খুব ব্যথিত হয়েছিলেন l সেই থেকে অসুখ এবং শেষে যক্ষ্মারোগে মৃত্যু l
১২) মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ১৯০৫ সালে মারা যান। রবীন্দ্রনাথের বয়স তখন ৪৪ বছর।
১৩) রবীন্দ্রনাথের সবচেয়ে বেশি আদরের ছোট ছেলে শমীন্দ্রনাথ, কবি আদর করে তাকে ডাকতেন শমী ঠাকুর বলে, মুঙ্গেরে তার মামার বাড়িতে বেড়াতে যান। সেখানেই কলেরায় শমীর মৃত্যু হয় ১৯০৭ সালে মাত্র ১৩ বছর বয়সে l শমীর মৃত্যুতে রবীন্দ্রনাথ এতটাই দুঃখ পেয়েছিলেন যে তার গায়ের রং পর্যন্ত পাল্টে গিয়েছিল। কবি প্রিয় সন্তান শমীকে হারিয়ে কতটা শোকে মূহ্যমান হয়েছিলেন প্রবাসী বন্ধু মনোরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের নিকট লেখা একটি চিঠিতে প্রকাশ পেয়েছে।
"ভোলা মুঙ্গেরে তাহার মামার বাড়িতে গিয়াছিল, শমীও
আগ্রহ করিয়া সেখানে বেড়াইতে গেল তাহার পর আর ফিরিল না।"
১৪) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বড় মেয়ে এবং প্রথম সন্তান মাধুরীলতা, কবি তাকে আদর করে বেলা বেলু এবং বেলবুড়ি বলে ডাকতেন l মেয়েকে বিয়ে দিয়েছিলেন ভোরের পাখি খ্যাত কবি বিহারীলাল চক্রবর্তীর ছেলে শরৎচন্দ্র চক্রবর্তীর সঙ্গে। জামাতা মজফরপুরে ওকালতি করতেন l তবু কবির ইচ্ছা ব্যারিস্টারি পাস করলে কলকাতা হাইকোর্টে প্র্যাকটিস করতে পারবে, উপার্জন ভালো হবে, জামাই মেয়ে সুখে থাকবে। সে কারণে জামাইকে ব্যারিস্টারি পড়ার জন্য বিলেতে পাঠালেন। ব্যারিস্টারি পাস করে জামাই মেয়ে জোড়াসাঁকো শ্বশুরালয়ে এসে ওঠেন। এ বাড়িতে ১৯০৯ থেকে ১৯১২ এই চার বছর সস্ত্রীক বাস করেন। কিন্তু শ্বশুরালয়ে ভায়রা নগেন্দ্রনাথের (মীরার স্বামী) সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায় চরম অশান্তির মধ্যে শরৎ স্ত্রী মাধুরীলতাকে নিয়ে ডিহি শ্রীরামপুরে নিজের বাড়ি চলে যান। পিতৃগৃহ বিচ্ছেদ যন্ত্রণা, অন্য দিকে স্বামীর সঙ্গে দাম্পত্য কলহে মাধুরীলতা অসুস্থ হয়ে পড়ে। তারও যক্ষ্মা রোগ ধরা পড়ে। কবি মেয়েকে দেখতে যেতেন l
একদিন দুপুরে তিনি বাড়ির কাছে পৌঁছাতেই খবর পেলেন বেলার মৃত্যু হয়েছে। তিনি আর দোতলায় মৃত মেয়ের মুখ দর্শন করলেন না। দীর্ঘ বিষাদের যন্ত্রণা বুকে চেপে নিশ্চুপ ফিরে এলেন। ১৯১৮ সালের ১৬ মে বেলার মৃত্যু হয়।
১৫) সেজ বোন সৌদামিনীর কন্যা ইরাবতীর মৃত্যু হয় ১৯১৮ সালে l তখন তার বয়স হয়েছিল ৫৭ বছর।
১৬) ৪র্থ কন্যা শরৎকুমারীর মৃত্যু হয় ১৯২০ সালে ৬৬ বছর বয়সে।
১৭) ৭ম ছেলে সোমেন্দ্রনাথ মারা যান ১৯২২ সালে ৬৩ বছর বয়সে।
১৮) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বড়ভাই দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছেলে দ্বিপেন্দ্রনাথের মৃত্যু হয় ১৯২২ সালে ৬০ বছর বয়সে l
১৯) তৃতীয় ভাই হেমেন্দ্রনাথ ঠাকুরের মেয়ে প্রতিভা ঠাকুরের মৃত্যু হয় ১৯২২ সালে ৫৭ বছর বয়সে l
২০) ১৯২৫ সালে পঞ্চম দাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ রাঁচিতে এবং
২১) ১৯২৬ সালে বড় দাদা দ্বিজেন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে মৃত্যুবরণ করেন।
২২) রবীন্দ্রনাথের তৃতীয় কন্যা মীরা, ডাক নাম অতসী, তার পুত্র নীতিন্দ্রনাথ জার্মানিতে ১৯৩২ সালে যক্ষ্মারোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান মাত্র ২০ বছর বয়সে l
মৃত্যুশোকে হতবিহ্বল কবি একের পর এক স্বজন হারানোর শোক বহন করে জীবনের শেষ প্রান্তে এসে পৌঁছান। হাজারো শোকের মাঝেও তিনি সৃষ্টিকর্ম থেকে হাত গুটিয়ে নেননি। অবিরাম লিখে চলেছেন কালজয়ী গান, কবিতা, গল্প, উপন্যাস ও নাটক। এই কালজয়ী সৃষ্টির জন্য বিশ্বসম্প্রদায়ের কাছে কবি অমর হয়ে আছেন।
শেষ যে মৃত্যুযন্ত্রণা কবি অনুভব করেন তা নিজের l ১৯৪১ সালের ৭ আগস্ট ৮০ বছর বয়সে তাঁর জীবনাবসান হয়। নিজের মৃত্যু যন্ত্রণাও কম ছিল না। দীর্ঘ দিন থেকে কবি মূত্রনালী সমস্যায় ভুগছিলেন। জোড়াসাঁকোতে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার নিয়ে এসে বিনা এ্যানেসথেসিয়ায় কবির মূত্রনালী অপারেশন করা হয়। এই বিনা এ্যানেসথিয়া অপারেশনে কবিকে নিদারুণ কষ্ট সহ্য করতে হয়েছিলো! সপ্তম দিনের মাথায় অপারেশনের জায়গায় ইনফেকশন দেখা দেয়। অপারেশনের ১৫ দিনের মাথায় কবিকে সীমাহীন কষ্ট আর যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে পরলোকগমন করতে হয়।
দৈব-দুর্বিপাকে এবং নিয়তির ক্রুর পরিহাসে একটি মৃত্যুর শোক-যন্ত্রণা প্রশমিত হতে না হতেই আরেকটি মৃত্যু দোরগোড়ায় উঁকি দিয়েছে বারবার। তবু শোক সন্তপ্ত হৃদয়ে অসাধারণ মনোবল এবং ধৈর্য নিয়ে কবি তার মোকাবিলা করেছেন l সাময়িক বিপর্যস্ত হলেও দৃঢ় মনোবলে নিজেকে সৃষ্টিকর্মের সাধনায় ব্যাপৃত রেখেছেন।
ছেলে রথীন্দ্রনাথের ভাষায়, "ভাগ্যের উত্থান-পতন, দুঃখ কিংবা ক্লেশ কোনো কিছুই অবশ্য বাবার চিত্তের প্রশান্তিতে ব্যাঘাত ঘটাতে পারত না। মহর্ষির মতোই তিনিও সর্বাবস্থায় অবিচলিত থাকতেন। বেদনা যতই পীড়াদায়ক হোক না কেন, তা তার ভেতরের শান্তিকে নষ্ট করতে পারত না। সবচেয়ে দুঃখের দুর্ভাগ্যকে সইবার মতো এক অতিমানবিক শক্তি ছিল তার।"
নিকটজনের পর পর এই মৃত্যুর ঘটনা রবীন্দ্রনাথকে ব্যথিত করেছিল নিঃসন্দেহে, কিন্তু তাঁকে বিচলিত করতে পারে নি l নিজের সাধনায় ও সৃজনকর্মের প্রতি নিষ্ঠায় তিনি চিরকাল অবিচল ছিলেন l
** আসরের প্রবীণ শ্রদ্ধেয় কবি প্রবীর চ্যাটার্জীর বিগত ০৭-০৮-২০১৭ তারিখ আসরে প্রকাশিত "রবি স্মরণে" কবিতা পাঠে অনুপ্রাণিত হয়ে নিবন্ধটি রচনা করেছি l কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি