কবিতা, ছড়া, পদ্য লেখার ক্ষেত্রে ছন্দ জ্ঞানের প্রয়োজন অনস্বীকার্য l কিন্তু ছন্দের এই জ্ঞানটা সহজ নয় l তাই আমরা অনেকেই আছি, যারা ছন্দের প্রাথমিক জ্ঞান ছাড়াই যখন কবিতা চর্চা করি, ছড়া লিখি, পদ্য লিখি - তাদের রচনা যখন ছন্দের পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ হয়, বিষয়টা যখন কোন ছান্দরসিক আমাদের নজরে আনেন, তখন ব্যথা লাগে l অনেকে বলেন, ছন্দের বিষয়টা তাঁরা বুঝতে চান, বোঝার চেষ্টাও করেছেন, তবু সব খটকা যেন দূর হতে চায় না l সংশয়, দুর্বলতা থেকেই যায় l
ছন্দ বিষয়টা কি তার উত্তরে আমরা এখন যাচ্ছি না l প্রথমে গল্পকথা শুরু করি l মনে করি, এক ব্যক্তি একটি রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে আছেন l পাশেই দুই ব্যক্তি গল্প করছেন l তাঁরা একটু উচ্চ স্বরে কথা বলছেন l ফলে আমাদের ব্যক্তিটি তা শুনতে পাচ্ছেন l কাছেই একটি বাড়ি l সেই বাড়ীর ভেতর থেকে এক যুবকের গলার স্বর ভেসে আসছে l ব্যক্তিটি মোটামুটি শিক্ষিত, কিন্তু কবি বা ছন্দ বিশেষজ্ঞ নন l তিনি যুবকটিকে দেখতে পাচ্ছেন না, শুধু তার স্বর শুনছেন, তিনি বুঝলেন যে ঐ যুবকটি একটি কবিতা আবৃত্তি করছে l
আমরা ছন্দের ধারনা নিতে শুরু করব ঠিক এইখান থেকে l তিনি কি করে বুঝছেন, পাশের লোকদুটি এমনি সাধারন কথোপকথনে ব্যস্ত এবং ঐ যুবকটি একটি কবিতা আবৃত্তি করছে ?
এর সোজা উত্তর হল, পাশের লোকদুটি কথা বলছেন l তার জন্য তাঁরা শব্দ, বাক্য ব্যবহার করছেন l কিন্তু সেই কথা ও বাক্যে ছন্দের প্রয়োগ নেই l কিন্তু ঐ যুবকটি যে কবিতা আবৃত্তি করছে, সেখানেও শব্দ আছে, বাক্য আছে, কিন্তু তার মধ্যে ছন্দের প্রয়োগ হয়েছে l যার ফলে, সাধারণত আমরা যেভাবে কথা বলার সময় বাক্য বলি, কারও সঙ্গে কথোপকথনের সময় যেভাবে বাক্য উচ্চারণ করি, কোনো কবিতা পাঠ বা আবৃত্তি করার সময় কবিতা, ছড়া ও পদ্যে ব্যবহৃত কথা বা বাক্যগুলিকে আর সেই সাধারনভাবে বলা যাচ্ছে না l বিশেষভাবে বলতে হচ্ছে, যার ফলে দূর থেকেও কেউ সেটা শুনতে পেয়ে বুঝে যাচ্ছেন যে একটি কবিতা পাঠ বা আবৃত্তি হচ্ছে, শুধু শুধু কেউ কথা বলছেন এমন নয় l
তাহলে ছন্দ ব্যাপারটি কি দাঁড়ালো ?
এর সোজা উত্তর হলো, ছন্দ হলো এমন একটা কৌশল যা সাধারন বাক্যকে অসাধারণ রূপ দেয়, যার ফলে সেই বাক্য ছড়া, কবিতা, পদ্যে ব্যবহারের উপযোগী হয়ে ওঠে l কবিগুরু বলছেন, "কথাকে তার জড়ধর্ম থেকে মুক্তি দেবার নামই ছন্দ l"
"ভাষা ও ছন্দ" কবিতায় রবীন্দ্রনাথ বাল্মীকির কণ্ঠে বলছেন,
"মানবের জীর্ণ বাক্যে মোর ছন্দ দিবে নব সুর
অর্থের বন্ধন হতে নিয়ে তারে যাবে কিছুদূর
ভাবের স্বাধীন লোকে l"
অর্থাৎ ছন্দ হলো এমন একটি নির্মাণ কৌশল যার প্রয়োগে
১) সাধারণ বাক্য অসাধারণ রূপ নেয় l
২) বাক্য কবিতায় ব্যবহারের উপযোগী হয় l
৩) কথা তার জড়ধর্ম থেকে মুক্তি পায় l
৪) জীর্ণ, দুর্বল বাক্য সুরেলা হয়ে ওঠে l
৫) বাক্য অর্থের বন্ধন থেকে মুক্তি পায় l অর্থের এই বন্ধনই হচ্ছে জড়ধর্ম l
৬) বাক্য ভাবের স্বাধীন লোকে বিচরণ করে l
তাহলে বোঝা গেল ছন্দ হলো একটা কৌশল যা ছড়া/পদ্য/কবিতায় ব্যবহারের সময় বাক্যের ওপর প্রয়োগ করা হয় l এই প্রয়োগটা করা হয় বলেই কবিতার পাঠকে এমনি সাধারন কথোপকথন থেকে পৃথক করা যায়, যেমনটি এই গল্পকথার শুরুতে রাস্তার মোড়ে দাঁড়ানো ঐ ব্যক্তিটি করতে পেরেছিলেন l
এবার বোঝার চেষ্টা করি এই কৌশলটা কি ? এর উত্তর হলো কবিতায় ব্যবহৃত বাক্যের শব্দগুলিকে একটু ভিন্নভাবে সাজানো হয় l ডঃ সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় ছন্দকে বলছেন পদ সাজাবার একটি পদ্ধতি যাতে করে "বাক্যটি শ্রুতিমধুর হয় এবং তার মধ্যে একটা কালগত ও ধ্বনিগত সুষমা বজায় থাকে l"
কবিতার একটি লাইন বা পঙক্তি বা চরণ - তাকে নিয়ে বোঝার চেষ্টা করি l কবিতার একটি চরণে কি থাকে ? কতগুলি শব্দ থাকে l তা দিয়ে একটি পূর্ণ বাক্য বা বাক্যাংশ থাকতে পারে, যে বাক্য পূর্ণ হতে সেটি পরের এক বা একাধিক চরণ গড়াতে পারে l দেখার বিষয় হলো,
প্রথমত, কবিতায় ব্যবহৃত বাক্যের শব্দগুলি গদ্যের থেকে একটু ভিন্নভাবে সাজানো হয় l
দ্বিতীয়ত, একটি চরণ ছন্দ অনুযায়ী এক, দুই বা ততোধিক পর্বে বিভক্ত থাকে l
তৃতীয়ত,ছন্দ অনুযায়ী একটি পর্বে মাত্রার সংখ্যা কিছু নিয়ম মেনে চলে এবং পর্বগুলিতে মাত্রার সংখ্যা অনুযায়ী সেই ছন্দের নামকরণ হয় l
ছন্দ তিন প্রকার - স্বরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত ও অক্ষরবৃত্ত l কোনো ছন্দের একটি চরণে কয়টি পর্ব থাকতে পারে, একটি পর্বে কয়টি মাত্রা থাকতে পারে - এই বিষয়গুলি জানা হয় ছন্দের পাঠ নেবার সময় l
তবে ছন্দ শিক্ষার প্রাথমিক পাঠ হলো মাত্রা গণনা l একটি শব্দের যতটুকু অংশকে আমরা একবারে উচ্চারণ করতে পারি, অর্থাৎ বাগ্-যন্ত্রের একবারের চেষ্টায় যেটুকু ধ্বনি উচ্চারিত হয়, সেটাকে ছন্দের ক্ষেত্রে বলি শব্দাংশ, দল বা অক্ষর বা স্বর l স্বর মুক্ত বা বদ্ধ হতে পারে l
যে স্বর উচ্চারণের পর তাকে টেনে রাখা যায় তা মুক্ত স্বর l স্বরবর্ণ সর্বদাই মুক্ত l আর যে স্বর উচ্চারণের পর তাকে আর টেনে রাখা যায় না, কারণ স্বরবর্ণের সাহায্য পাওয়া যায় না, তাকে বদ্ধ স্বর বলে l কর্মফল - এই শব্দে কর্- ম- ফল্ = তিনটি শব্দাংশ l এখানে কর্ - বদ্ধ স্বর, ম - মুক্ত স্বর, ফল্ - বদ্ধ স্বর
স্বরবৃত্ত ছন্দে মুক্ত বা বদ্ধ সব স্বর এক মাত্রা l মাত্রাবৃত্ত ছন্দে মুক্ত স্বর এক মাত্রা এবং বদ্ধ স্বর দুই মাত্রা l অক্ষর বৃত্ত ছন্দে মুক্তস্বর একমাত্রা কিন্তু বদ্ধ স্বর শব্দের শুরু ও মাঝে একমাত্রা কিন্তু শব্দের শেষে দুই মাত্রা l
মাত্রা কি ? মাত্রা হলো স্বর বা অক্ষর উচ্চারণের স্বাভাবিক সময়সীমা l কোনো অক্ষর উচ্চারণের সময়সীমা কম, আবার কোনটাতে সময় বেশী l সেই অনুযায়ী কোথাও পাঠ দ্রুত আবার কোথাও পাঠ ধীর লয়ে l ছন্দের ক্ষেত্রে এই মাত্রার ভূমিকা খুব গুরুত্বপূর্ণ l কবিতার চরণকে যে কয়টি ভাগে অর্থাৎ পর্বে ভাগ করা হয়ে থাকে, সেই প্রতিটি ভাগে (উপপর্ব ও অতিপর্ব বাদে) সমান সংখ্যক মাত্রা থাকা খুব জরুরী l মূল পর্ব সমমাত্রিক হতে হয় l
ছন্দ শেখার সময় ছন্দের নানা উপকরণ যেমন ছেদ, যতি, শ্বাসাঘাত, পর্ব, পদ, চরণ, মাত্রা ইত্যাদির ধারনাও নিতে হয় l
"ছন্দ নিয়ে গল্পকথা" এবার শেষ করার পালা l ছোটো ডাক্তারের ডাক্তারি শেষ l এবার কেস-টা বড়ো ডাক্তারবাবুদের রেফার করবো l
ছন্দের ওপর অনেক ভালো বই আছে l আমি নিজে বিশিষ্ট কবি ও লেখক শাহ আলম বাদশা রচিত "কবি কবি ভাব, ছন্দের অভাব" বইটি পড়ে উপকৃত হয়েছি l বইটি সহজ সরল ভাষায় লেখা l খুব বেশী তাত্বিক আলোচনার মধ্যে না গিয়ে সরস ভঙ্গিতে প্রচুর উদাহরণ সহযোগে ছন্দের বিষয়টি আলোচিত হয়েছে যা কবিতা চর্চাকারী যাঁরা মনে করেন যে তাঁদের ছন্দের ব্যাপারে দুর্বলতা আছে, তাদের বহুল উপকারে আসবে l এছাড়াও ছন্দের ওপর অনেক লেখা "বাংলা কবিতা"র আলোচনা বিভাগে প্রকাশিত হয়, সেগুলি মনোযোগ সহকারে পাঠ করা যেতে পারে l
ছন্দের ওপর শ্রদ্ধেয় কবি রফিকউজ্জামান সাহেব, কবীর হুমায়ুন প্রমুখের সুন্দর আলোচনা আছে l সেখানে প্রাথমিকভাবে ছন্দের উপকরণগুলি সম্বন্ধে আলোচনার পর বিস্তৃত উদাহরণসহ স্বরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত ও অক্ষরবৃত্ত ছন্দের আলোচনা সহজ সরল ভাষায় করা আছে l
সেগুলি মনোযোগ সহকারে পড়লে ছন্দের ধারণাটা আশা করি পরিষ্কার হবে l