২৮-০৪-২০১৮ "বাংলা কবিতা" ওয়েবসাইটের কলকাতা কবি সম্মেলনে বক্তব্য রেখেছিলাম l তার দ্বিতীয় ও তৃতীয় বিষয় ছিল যথাক্রমে
২. কবিতার বিবর্তন
৩. সমাজ জীবনে প্রতিফলন l
সময় সংক্ষিপ্ততার কারণে বিষয় দুটি মিশিয়ে একসঙ্গে বলেছিলাম l আসরে আলোচনা সভায় বিষয় দুটিকে পৃথক করে প্রবন্ধ লিখলাম l আজ দ্বিতীয় বিষয় - "কবিতার বিবর্তন" নিয়ে l
আগামীকাল থাকবে শেষ বিষয় - "কবিতা ও  সমাজজীবন" নিয়ে l
__________________________

কবিতা এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে না l একই বিষয়ের চর্বিতচর্বণ কবিদের পছন্দ নয় l তাই কবিতা পরিবর্তিত হয়ে চলে, বিবর্তিত হয়ে চলে l নানা ক্ষেত্রে এই পরিবর্তন আমরা লক্ষ্য করি - আঙ্গিক, শব্দ, বাক্যের গঠন, ছন্দ, রূপক, অলংকারের ব্যবহার, বিষয়গত l
আজকের বিষয় - কবিতার বিষয় বিবর্তন l
প্রশ্ন হতে পারে, কবিতার আবার বিষয় কী? কবিতা তো লিপিবদ্ধ অনুভব। কিন্তু সেই অনুভবে পৌঁছোবার একটা প্রক্রিয়া থাকে। সেই প্রক্রিয়ায় বিষয় এক অন্যতম অনুষঙ্গ l

আমরা দেখব যুগে যুগে কবিতার বিষয় কিভাবে পাল্টে পাল্টে গেছে l

বাংলা কবিতার আদি নিদর্শন চর্যাপদ l এই পদাবলীগুলি ছিল বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যদের সাধনসঙ্গীত l সমকালীন বাংলার সামাজিক ও প্রাকৃতিক চিত্র এই পদাবলীগুলিতে প্রতিফলিত হয়েছে l চর্যাপদে খুঁজে পাওয়া যায় বর্ণাশ্রমপীড়িত শ্রেণিভিত্তিক সমাজের চিত্র।

মধ্যযুগে কবিতার নিদর্শন হলো বৈষ্ণবসাহিত্য ও মঙ্গলকাব্য l

বৈষ্ণবকাব্য গীতধর্মী কবিতার সংকলন l মানবরুপী রাধা ও কৃষ্ণের হৃদয়বেদনার কাহিনী l

মঙ্গলকাব্যগুলিতে বিভিন্ন দেবদেবীর মাহাত্ম্য বর্ণনা ও পৃথিবীতে তাঁদের পূজা প্রতিষ্ঠার কাহিনী রয়েছে l রয়েছে তৎকালীন  সমাজজীবনের দুঃখ, দারিদ্র্য, আনন্দ-বেদনার কাহিনী।

চলে এলাম আধুনিক যুগে l কবিতার ক্ষেত্রে পরিবর্তন লক্ষ্য করলাম খুব দ্রুতগতিতে l বিষয় বিবর্তন হয়েছে গল্প থেকে খণ্ডদৃশ্য, টুকরো ঘটনা তারপর চিত্রমালা, এবং সবশেষে বিমূর্ততায় l
রবি ঠাকুরের অনেক কবিতায় গল্পের স্বাদ পাই l গল্পের মধ্যে দিয়ে পাঠককে এক অনুভবের দিকে নিয়ে যায় l “হঠাৎ দেখা” কবিতাটি যেন একটি টান টান গল্প। কবিতার শেষে
“রাতের সব তারাই আছে/ দিনের আলোর গভীরে”— এই অনুভবে পৌঁছোতে পাঠককে একটা গল্পের মধ্যে দিয়ে যেতে হয় l

আধুনিক কবিরা কবিতায় গল্প বলা বিষয়টিকে ব্রাত্য করেছেন l বলা যেতে পারে, অনুভবে পৌঁছনোর রাস্তাটি বদলে গেছে l গল্পের জায়গা দখল করেছে টুকরো ঘটনা বা খণ্ড দৃশ্য l
বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে লেখা নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর “কলকাতার যীশু” কবিতায় পাই একটি খণ্ড মুহূর্তের বর্ণনা, যেন একটি দৃশ্য -
"ঝাঁকামুটে, ফিরিওয়ালা, দোকানি ও খরিদ্দার—
এখন তারাও যেন স্থির চিত্রটির মতো শিল্পীর ইজেলে
লগ্ন হয়ে আছে।
স্তব্ধ হয়ে সবাই দেখছে,
টালমাটাল পায়ে
রাস্তার এক-পার থেকে অন্য পারে হেঁটে চলে যায়
সম্পূর্ণ উলঙ্গ এক শিশু।"
প্রশ্ন হতে পারে, আধুনিক কবিতায় সময়ের পরিধির এই সংকোচন কেন ? একটি সম্ভাব্য উত্তর হতে পারে - হয়তো আধুনিক ব্যস্ত জীবনের সঙ্গে তাল মেলানোর জন্য l

এই ধারায় জীবনানন্দ দাশের 'ঘোড়া' কবিতাটি যেন কয়েকটি সিরিয়াল দৃশ্যের কোলাজ l কবিতাটি শুরুই হয়,
“আমরা যাইনি মরে আজো — তবু কেবলি দৃশ্যের জন্ম হয়” — এই লাইনটি দিয়ে। যেন মরে গেলেই শুধু দৃশ্যের জন্ম হতে পারত!

পরবর্তী ধাপে কবিতা দৃশ্য থেকে সরে গিয়ে বিমূর্ততার দিকে ঝুঁকে l
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর জীবনকাহিনী “অর্ধেক জীবন”-এ এই প্রসঙ্গে লিখছেন, “সরে যেতে যেতে কবিতা হয়ে ওঠে সম্পূর্ণ বিমূর্ত, প্রসঙ্গহীন।”

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, শামসুর রাহমান, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সহ আরও কিছু কবির কবিতায় মূর্ত চিত্রকল্পের ব্যবহার যেমন পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে, তেমনি জীবনানন্দ দাশ, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, শহীদ কাদরী, আব্দুল মান্নান সৈয়দের মতো কবির কবিতায় বিমূর্ত চিত্রকল্পের ব্যবহার পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে।

বলা হলো - চিত্রকল্পকে সবসময় দৃশ্যমান হতে হবে এমন কোনো কথা নেই। দৃশ্যমানতা চিত্রকল্পের সবচেয়ে বড় গুণ হলেও চিত্রকল্পকে সবসময় প্রকটভাবে দৃশ্যমান হতে হবে এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। শুধু চোখ নয়, কান, জিভ ও স্পর্শ ইন্দ্রিয়ও অনুপ্রেরণা জাগাতে পারে। মানুষের বিশ্বাস ও যাপন থেকেও অস্পষ্ট, বিমূর্ত অবয়ব সৃষ্টি হতে পারে, যা বোধ ও চেতনাকে স্পর্শ করে যায়। এমনকী একই সাথে একাধিক সংবেদী অঙ্গকে ছুঁয়ে যেতে পারে কবির বোধ। ইংরেজিতে একে বলে Synesthesia অর্থাৎ  ‘union of senses’ অর্থাৎ বোধ/ভাবনার একতা।

জীবনানন্দ দাশ যখন চিলের ‘ডানার রৌদ্রের গন্ধ’ মুছে ফেলার কথা শোনান, কিংবা বলেন, ‘নরম নদীর নারী ছড়াতেছে ফুল কুয়াশার’ কিংবা বলেন ‘ধূসর চালের গন্ধে তরঙ্গেরা ঝরেছে দুবেলা’ তখন সিনেস্থিসিয়ার উপলব্ধি হয়।

জীবনানন্দ দাশ কবিতায় ইমেজের এই ব্যবহারকে নাম দিয়েছেন ‘ভাবপ্রতিভা’ ।

গত শতকের শেষের দিকে এসে আধুনিক কবিরা সচেতন ভাবে বর্জন করছিলেন ছবি ও গল্প। সময়কে ভাঙছিলেন, চূর্ণ সময়ের কবিতা সৃষ্টি করছিলেন। এই ধরনের বহু কবিতা লেখা হচ্ছিল এবং একটা বিবর্তিত কবিতা-ধারা গড়ে উঠছিল।
উৎপলকুমার বসুর পাঁচ লাইনের 'রাক্ষস' কবিতাটি এই ধারায় রচিত l
“সেদিন সুরেন ব্যানার্জি রোডে নির্জনতার সঙ্গে দেখা হল।
তাকে বলি: এই তো তোমারই ঠিকানা-লেখা চিঠি, ডাকে দেব, তুমি
মন-পড়া জানো নাকি? এলে কোন ট্রেনে?
আসলে ও নির্জনতা নয়। ফুটপাথে কেনা শান্ত চিরুনি।
দাঁতে এক স্ত্রীলোকের দীর্ঘ কালো চুল লেগে আছে।”
কবিতাটিতে গল্প প্রায় নেই বললেই চলে, থাকলেও সেই গল্প পাঠককেই গড়ে নিতে হয়। ছবি যৎসামান্য, রাস্তার নাম দিয়ে আঁকা। রামকিঙ্কর বেইজের ছবির মত চারকোলের দু একটি দ্রুত টানেই স্ফূরিত।

কবিতা অবশ্যই নিরীক্ষা-প্রিয়, বিষয় এবং ভাবনায়  বহুগামী। সব যুগেই একাধিক পরস্পর-বিরোধী চিন্তা-ভাবনা পাশাপাশি বয়ে গেছে। কবিতাকে চিত্রশিল্পের সঙ্গে তুলনা করে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বলছেন - "চিত্রশিল্প যেমন চূড়ান্ত বিমূর্ততায় পৌঁছে আবার যাত্রা শুরু করেছে উল্টোদিকে, ফিরে আসছে অবয়বে, সেইরকম কবিতাও তাল ঠুকে ফিরে আসছে গদ্যের কাছাকাছি l কবিতার মধ্যে একটা কাহিনীর আভাস কিংবা চরিত্রের উঁকিঝুঁকি দেখা যাচ্ছে সাবলীলভাবে"
নব্বইয়ের দশকে লেখা জয় গোস্বামীর “মালতীবালা বালিকা বিদ্যালয়” তো গল্প বলা কবিতাই।

এইভাবে যুগে যুগে কবিতার বিষয় বিবর্তিত হতে হতে আবার কখনো ছুটেছে উৎসমুখে l
আসলে কবিতা হচ্ছে হৃদয় উৎসারিত আলো, যে আলো আমাদের নতুন ভাবে ভাবতে শেখায় l সেই ভাবনা থেকে কবিতা লিখি l
কবিগুরুর ভাষায়,
"অন্ধকারের উৎস হতে উৎসারিত আলো
       সেই তো তোমার আলো।
সকল দ্বন্দ্ব-বিরোধ-মাঝে জাগ্রত যে ভালো,
       সেই তো তোমার ভালো।"  

এইভাবে যুগে যুগে কবিতা বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে গেছে l কিন্তু কবিতার প্রতি, সত্যের প্রতি, সুন্দরের প্রতি কবিদের যে দায়বদ্ধতা, তা অমলিন রয়ে গেছে l

** কৃতজ্ঞতা স্বীকার : সিদ্ধার্থ মুখোপাধ্যায়