ছোটবেলায় পড়েছি "বেদের আর এক নাম শ্রুতি" l পরীক্ষায় প্রশ্ন আসত, "বেদের আর এক নাম শ্রুতি কেন ?" উত্তর প্রস্তুত থাকত l লিখে ফেলতাম খাতায়, "যেহেতু বেদ শুনে শুনে মুখস্থ রাখতে হত, তার লিখিত রূপ ছিলো না, তাই বেদের আর এক নাম ছিলো শ্রুতি l" আক্ষরিক অর্থটাই বুঝতাম l গভীরভাবে এই নিয়ে চিন্তা করবার মতো মানসিক শক্তি ছিল না l তখন ছোট ছিলাম l ছোটদের এমনিতেই স্মৃতিশক্তি বেশী l ছড়া কবিতা বার কয়েক পড়লেই মুখস্থ হয়ে যেত l মনেও থাকত বহুদিন l ফলে বেদ শুনে শুনে মুখস্থ রাখার কাজটিকে ভীষণ কঠিন কিছু মনে হত না l একটি দশ বারো পঙ্ক্তির কবিতা আর বেদের মধ্যে কি পার্থক্য ছিল, সেভাবে বুঝি নি কখনো l জেনেছিলাম, এভাবে বংশানুক্রমে বেদ পরবর্তী প্রজন্মের হাত ধরে ধরে আধুনিক কাল পর্যন্ত এসেছে l পাতায় লেখার স্তর পেরিয়ে কাগজ এল l গুটেনবার্গ ছাপাখানা আবিস্কার করলেন l ১৪৭৬ সালে উইলিয়াম ক্যাক্সটন ছাপাখানা থেকে প্রথম বই বের করলেন, অন্য সব লেখার সঙ্গে বেদও মুদ্রিত হলো l
এখন বুঝি l চারটি বেদ - ঋক্ সাম যজুঃ অথর্ব l প্রতিটি বেদের একাধিক ভাগ l সংহিতা, ব্রাম্ভ্রন, আরণ্যক, উপনিষদ বা বেদান্ত l এর সবটাই মুখস্থ রাখা কাজটি অত সহজ নয় l আবার ভাবি এর রচনাকালের কথা l যতো ভাবি, বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যাই l বেদ তো একদিনে রচিত হয় নি নিশ্চয় l তখন লিখে রাখারও কোনো সুযোগ ছিলো না l ফলে একদিনে যতোটা রচিত হলো সেটা মাথায় থাকত l পরে আবার যখন বাকিটা রচিত হতো, প্রথম দিন যতটা রচিত হয়েছিল, তার পর থেকে সেটা করতে হতো l হাতে কোনো কপি থাকত না l পুরোটাই মাথায় l স্মৃতিতে ধরা থাকত l সেখানেই সংযোজন বিয়োজন হতো l এইভাবে একাধিক দিনে রচিত হতে হতে রচনা সম্পূর্ণ হয়েছিল l আজকের দিনের পরিপ্রেক্ষিতে বিষয়টি বুঝতে কেমন যেন লাগে l হাতে কোনো হার্ড কপি নেই, কম্পিউটারে Soft Copy নেই, মাথার মধ্যেই কপি থাকলো, সেটাই আবার একটু বাড়ল l তারপরে আবার কোনোদিন l
পৃথিবীর সব ভাষার সাহিত্যই লিখিত রূপ পাবার আগে এরকম অলিখিত মৌখিক রূপে রচিত হয়েছিল l পঞ্চম শতকের মাঝামাঝি জার্মান উপজাতি অ্যাঙ্গল, স্যাক্সন, গথ, ভ্যান্ডাল যখন বৃটেন দখল করল এবং সেখানে স্থায়ীভাবে বাস করতে শুরু করল, তারা সঙ্গে নিয়ে এসেছিল মৌখিক সাহিত্য l পরবর্তীতে এই জার্মান উপজাতিরা যখন খৃষ্টধর্ম গ্রহণ করল, তখন এই মৌখিক সাহিত্য লিখিতরূপে রচিত হল - যা ওল্ড ইংলিশ লিটরেচর নামে খ্যাত l অ্যাঙ্গলোস্যাক্সন এলিজিস, বেউল্ফ মহাকাব্য প্রভৃতি এই সাহিত্যের নিদর্শন l লিখিত রূপ পাবার আগে এই সাহিত্য মানুষের মুখে মুখেই টিকে ছিল l
আসরের সকল কবিকে মাননীয় অ্যাডমিন মহোদয় বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে নিজ লেখা নিজে সংরক্ষণের দায়িত্ব নিতে বলছেন দেখে সেই ছোটবেলার "বেদের অপর নাম শ্রুতি" দিনগুলির কথা মনে পড়ে গেল l এই বিজ্ঞপ্তিকে কেন্দ্র করে কবি খসা হক আলোচনা পাতায় আসরের সকল কবির দৃষ্টি আকর্ষণ করে অত্যন্ত উপযোগী একটি আলোচনা রেখেছেন l নিজ লেখা সংরক্ষণের গুরুত্ব ও পদ্ধতি প্রকরণ বিষয়ে বলেছেন l বিশদ ব্যাখ্যা করে প্রত্যেকে কিভাবে তাঁদের মূল্যবান লেখা সংরক্ষণ করতে পারেন, তার পথনির্দেশ দেয়া হয়েছে l কবি খসা হক মহাশয়কে এর জন্য আন্তরিক কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানাই l
আসরের প্রবীণ কবি সঞ্জয় কর্মকার, খসা হক মহাশয়কে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে লিখছেন, "গতকাল আপনার দেওয়া সতর্কবাণীতে আমার যেন হুশ ফিরলো। একজন কবির কাছে তার কবিতাগুলিই সম্পদ। একটা সময় একরকম ভাবে অনুভূতিতে লেখা কবিতা-পরবর্তীতে লেখা শুধু দুস্কর নয়-সত্যিকারেই অসম্ভব ব্যাপার। অসম্ভব বলে কিছু নেই-এই প্রবাদ বাক্যটি এখানে অচল। সেই হেতু নিজ সৃষ্টিগুলি সযত্নে যথাযথভাবে সংরক্ষিত করা নিজেরই দায়িত্ব্। অন্যথায় অনেক দুর্যোগ সামনে আসতে পারে। প্রিয়কবি তার লেখাতে তা বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন। আমি প্রিয় কবির কাছে সদা কৃতজ্ঞ থাকবো কারন কাল ওনার সতর্কবাণীর গুরুত্ব উপলব্ধি করে আসর থেকে কপি করে আমার কম্পিউটারে সুন্দর গুছিয়ে লেখাগুলিকে সাজিয়ে নিয়েছি। অর্ধেকের মতো প্রিন্ট নেওয়াও হয়ে গেছে। আজ বাকিগুলি নিয়ে নেব। আপনারাও যদি আমার মত কেঊ থেকে থাকেন কাল বিলম্ব না করে অবশ্যই নিজ লেখা সংরক্ষন করে রাখুন।"
এমনিতে যে কোনো পত্র পত্রিকায় লেখা পাঠানোর সময় লেখক, কবিকে নিজের কাছে তার একটি কপি রেখে দেবার পরামর্শ দেয়া হয় l এখানেও তাই বলা হয়েছে l পুরোপুরি ওয়েবসাইটের ওপর নির্ভর করে নিজের কাছে লেখার কোনো কপি না রাখলে, বিপদ হতে পারে l
এখন তো লেখার soft copy save করে রাখার অনেক সহজ বিকল্প রয়েছে l আমি ভাবি, যখন লেখার চলন হয় নি, তখনও তো সাহিত্য ছিলো l মুখে মুখে রচনা করা হত l স্মরণে থাকত l বংশ থেকে বংশপরম্পরায় চলত l হাজার হাজার পাতা লেখা সাহিত্য এভাবে শুধু স্মৃতিকে অবলম্বন করে টিকে ছিলো l তখন ওয়েবসাইট ছিলো না l ফলে ওয়েবসাইট ক্র্যাশ হতো না l মাথায় মাথায় পিতা থেকে সন্তান, গুরু থেকে শিষ্য সাহিত্য যুগের পর যুগ টিকে থাকত l আবার নতুন সাহিত্য আসত l পুরনোর পাশে স্থান করে নিত l শুধু স্মৃতিকে অবলম্বন করেই এরকম কতো কতো সাহিত্য টিকে ছিলো l এখন দশ লাইনের কবিতা যদি লিখি, কোনভাবে যদি সেই কাগজটা হারিয়ে যায়, বা মোবাইল বা computer এ delete হয়ে যায়, তাহলে সেই দশ লাইনের একটি কবিতাকেও আমরা স্মৃতি থেকে উদ্ধার করতে পারি না l অথচ হাজার হাজার পাতা দৈর্ঘ্যের রচনা পুরনো দিনের মানুষ স্মরণে রাখতেন এবং প্রয়োজনমতো তা ব্যবহৃত হত l
আজকের দিনে বিভিন্ন ভাষায় মোট যে পরিমাণ সাহিত্য রচিত হয়ে আছে, যদি কোনো কারণে তার লিখিত রূপ, soft copy বা hard copy মুছে যাবার সম্ভাবনা দেখা দেয়, যদি বলা হয় এই পুরো সাহিত্যকে আমাদের স্মরণে নিতে হবে, মনে হয় না সেটা আমাদের পক্ষে সম্ভব হবে l বেদের অপর নাম শ্রুতি থাকতে পারে, সঙ্গত কারণেই তা ছিলো, কিন্তু আজকের দিনে সাহিত্যের যে ভলিউম, তার অপর নাম কোনভাবেই শ্রুতি হওয়া সম্ভব নয় l
**আলোচনার প্রাসঙ্গিকতায় বেদকে মানুষের দ্বারা রচিত বলে মনে হতে পারে l কিন্তু শাস্ত্রীয় বিচারে বেদকে "অপৌরুষেয় " (মানুষের দ্বারা রচিত নয়) মনে করা হয় l হিন্দুরা বিশ্বাস করে, বেদ প্রত্যক্ষভাবে ঈশ্বর কর্তৃক প্রকাশিত হয়েছে । তাই বেদের অপর নাম "শ্রুতি" (যা শোনা হয়েছে)। অন্য ধর্মগ্রন্থগুলিকে বলা হয় "স্মৃতি" (যা মনে রাখা হয়েছে) । হিন্দু বিশ্বাস অনুসারে, বেদ সর্বোচ্চ উপাস্য ঈশ্বর ব্রহ্ম কর্তৃক প্রকাশিত ।