স্কুলপাঠ্য ভাষাশিক্ষার বই-এ দুটি ভাগ দেখি - পদ্যাংশ ও গদ্যাংশ l প্রথম ভাগে ছড়া, পদ্য ও কবিতা সবই সন্নিবেশিত হয় l
ছড়া, পদ্য ও কবিতার মধ্যে সম্পর্ক খুব নিবিড় l বলা হয় সব ছড়াই পদ্য কিন্তু সব পদ্যই ছড়া নয় l তেমনই সব কবিতাই পদ্য কিন্তু সব পদ্যই কবিতা নয় l ছড়া, পদ্য ও কবিতা সম্বন্ধে ধারণা স্পষ্ট হওয়া প্রয়োজন l
ছড়া :
ছড়া সাহিত্যের এক উজ্জ্বল শাখা l ছেলেভুলানো পদ্য হিসাবে এর জন্ম l ছড়ায় ছন্দ ও অন্ত্যমিলের দ্বারা চটুল শব্দের সহযোগে যে কোনো বিষয়কে মজাদার ও রসাত্মক করে তোলা হয় l ছড়ায় থাকে হালকা বা চটুল চাল এবং তা পড়তে হয় দ্রুততালে l ছড়ার ক্ষেত্রে আর একটি কথা বলা প্রয়োজন, এখানে অর্থ প্রকাশের ব্যাপারটিও জরুরী নয় l শুধুমাত্র অন্ত্যমিল আছে, ছন্দ আছে, কিন্তু ব্যবহৃত পদসমষ্টির কোনো অর্থ হয় না, ছড়ার ক্ষেত্রে এটা হতে পারে - ইংরাজি ভাষায় এই ধরনের ছড়াকে non-sense poetry বলা হয় l
সাধারণত ছড়া হাস্য রসাত্মক/শিক্ষামূলক/ব্যঙ্গার্থক হয় এবং ছড়া মূলত লেখা হয় শিশুদের জন্য।
অন্নদাশঙ্কর রায় ছড়া সম্পর্কে বলছেন ‘ছড়া যদি কৃত্রিম হয় তবে তা ছড়াই নয়, তা হালকা চালের পদ্য। তাতে বাহাদুরি থাকতে পারে, কারিগরি থাকতে পারে, কিন্তু তা আবহমানকাল প্রচলিত খাঁটি দেশজ ছড়ার সঙ্গে মিশ খায় না। মিশ খাওয়ানোটাই আমার লক্ষ্য। যদি লক্ষ্যভেদ করতে পারি তবেই আমার ছড়া মিশ খাবে, নয়তো নয়।’
বুদ্ধদেব বসু ছড়া সম্বন্ধে বলছেন, ‘আধুনিক কবির হাতে ছড়া বের হতে পারে শুধু এই শর্তে যে, তিনি বক্তব্য কিছু দেবেন, অথচ সেটুকুর বেশি দেবেন না যেটুকু এই হালকা ছোট চটুল শরীরে ধরে যায়। একেবারে সারাংশ কিছু না থাকলে তা নেহাতই ছন্দের টুংটাং হয়ে পড়ে, মাত্রা একটু বেশি হলেও আর ছড়া থাকে না।’
ছড়াকার আবদুর হাসিব ছড়া প্রসঙ্গে বলছেন, ‘ছন্দ আর অন্ত্যমিলের প্রতি যত্নশীল হয়ে হালকা চালে সহজ শব্দের সমন্বয় সাধন করে বিষয়কে প্রকাশ করবার জন্যে যে পদ বা পদ সমষ্টির সৃষ্টি করা হয় তাকে ছড়া বলে।’
পদ্য :
আর পদ্যের ক্ষেত্রে বলা যায় এখানেও ছন্দ ও অন্ত্যমিলের অনুশাসন থাকে, তবে পদ্য পড়তে বা আবৃত্তি করতে হয় ধীর লয়ে l সহজ সরল ভাব সোজাসুজি এখানে প্রকাশ করা হয় l কবিতার মতো বিমূর্ততা বা রূপকতার অবকাশ পদ্যে নেই l এখানে সহজভাবে কবির ভাবনা প্রকাশ পায় এবং পাঠকের ভাবনার সাথে তা মিলেও যায় l পদ্যের বক্তব্যের মধ্যে কোনো রাখঢাক থাকে না l
বলা হয় 'পদ্য আমাদের মনের ভাবকে দুর্বোধ্য না করে প্রকাশ করার একটি পদ্ধতি।’
কবিতা আর পদ্যে এটি একটি বড় পার্থক্য এবং এই পার্থক্যই ‘কবিতা’ এবং ‘পদ্য’কে আলাদা করেছে। পদ্যে বিমূর্ত কিংবা রূপকের আশ্রয় করাটা একদমই জরুরী নয় কিন্তু আধুনিক কবিতায় এই বিষয়টি খুব বেশি প্রয়োজন।
কবিতায় প্রতিটি শব্দ ব্যাপক এবং গভীর অর্থে ব্যবহৃত হয় l অর্থাৎ একটি কবিতায় একই শব্দের একাধিক অর্থ আসতে পারে, ভিন্ন ভিন্ন ভাবের সৃষ্টি করতে পারে। কিন্তু পদ্যের ভাষা অতি সহজ, সরল এবং বোধগম্য। কবি ঠিক যেমনটি বোঝাতে চেয়েছেন ঠিক ঠিক তেমনভাবেই পাঠক বুঝে নিবে। নতুন করে অর্থভেদ করার প্রয়োজন নেই ।
কবিতা :
কবিতা পদ্যের থেকে যোজন দূরত্বে হাঁটে।
কবিতায় শব্দের ব্যবহার বিষয়টি আলাদা l এখানে রূপক ও বিমূর্ততার ব্যাপক ব্যবহার ভাবকে আর সহজ সরল থাকতে দেয় না, আড়ালের সৃষ্টি হয় এবং এই আড়াল সৃষ্টি করতে পারাটাই কবিতার শক্তি l
আধুনিক কবিতা সম্পর্কে নানা গুণীজন বিচিত্র সব মতামত প্রদান করেছেন সেগুলো বিশ্লেষণ করলে কবিতা সম্পর্কে স্বচ্ছ একটি ধারণা পাওয়া যায় এবং পদ্য ও কবিতার পার্থক্য বোঝা যায়।
ভাষাবিদ হুমায়ুুন আজাদ বলছেন, ‘যা পুরোপুরি বুঝে উঠবো না, বুকে ওষ্ঠে হৃৎপিন্ডে রক্তে মেধায় সম্পূর্ণ পাবো না; যা আমি অনুপস্থিত হয়ে যাওয়ার পরও, রহস্য রয়ে যাবে রক্তের কাছে, তার নাম কবিতা।’
খুব সুন্দর একটি সংজ্ঞা দিয়েছেন বুদ্ধদেব বসু। তিনি বলেছেন, ‘কবিতা সম্বন্ধে ‘বোঝা’ কথাটাই অপ্রাসঙ্গিক। কবিতা আমরা বুঝি না, কবিতা আমরা অনুভব করি। কবিতা আমাদের ‘বোঝায়’ না; স্পর্শ করে, স্থাপন করে l কি স্থাপন করে ? একটা সংযোগ। ভালো কবিতার প্রধান লক্ষণই এই যে তা ‘বোঝা’ যাবে না, ‘বোঝানো’ যাবে না।’
অর্থাৎ একটি কবিতা যদি বোঝা না যায়, দুর্বোধ্য হয় তাহলে এমনটা হতে পারে যে ওটি একটি ভালো কবিতা l অর্থাৎ এই যুক্তি অনুযায়ী কবিতার বিরুদ্ধে দুর্বোধ্যতার যে অভিযোগ আসছে তা কবিতার দুর্বলতা নয় বরং কবিতার শক্তিকেই প্রমাণ করে l
অনুরূপ কথাই বলেছেন মার্কিন কবি আর্চিবন্ড ম্যাকলিশ। তিনি বলছেন, ‘কবিতা কিছু বোঝায় না; কবিতা হয়ে ওঠে।’
শেলী বলছেন, ‘কবিতা হলো পরিতৃপ্ত এবং শ্রেষ্ঠ মনের পরিতৃপ্তি এবং শ্রেষ্ঠ মুহূর্তের বিবরণ।’ বোদলেয়ার একধাপ এগিয়ে বলছেন, ‘প্রত্যেক কবি অনিবার্যভাবেই সমালোচক। একজন সমালোচক কবি হয়ে উঠলে আশ্চর্য হওয়া যতটা স্বাভাবিক তার চেয়ে বেশি আশ্চর্য হতে হবে যদি একজন কবির মধ্যে সমালোচক জেগে না থাকে।’
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের মতে ‘রূপের মধ্যে অরূপের সন্ধানই কবিতা।’ অর্থাৎ যা আমরা দেখতে পাচ্ছি তা নয়, যা দেখতে পাচ্ছি না, তার সন্ধানই কবিতা l' এই সূত্রেই বোধ হয় জীবনানন্দ দাশের "সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি" কথাটিকে ব্যাখ্যা করা যায় এইভাবে যে, যাঁরা কবি নন তাঁরা যা দেখতে পান না, সেই অদেখা বিষয়গুলোই কবির চোখে ধরা দেয় এবং তাকে অবলম্বন করে তাঁর রচনা এগোয় l
রবার্ট ফ্রস্ট বলছেন, ‘সেটুকুই বিশুদ্ধ কবিতা, যার অনুবাদ সম্ভব নয়।’
জীবনানন্দ দাশের মতে, ‘উপমাই কবিতা।’ আবার মালার্মে বলেছেন, ‘শব্দই কবিতা।’
দার্শনিক এরিস্টটল বলছেন, ‘কবিতা দর্শনের চেয়ে বেশি, ইতিহাসের চেয়ে বড়ো।’
কবিতা সম্পর্কিত এমন অনেক অনেক মতামত থেকে কবিতা সম্পর্কে আমরা একটা ধারণা পেয়ে যাই l
পরিশেষে : ছড়া, পদ্য ও কবিতার সাধারণ ধারনাগুলি পুনরায় স্মরণ করি l
ছড়া - ছন্দের বাঁধন, অন্ত্যমিল, হালকা চাল, চটুল শব্দ, মজাদার - রসাত্মক বিষয়, দ্রুতপাঠ l
পদ্য - ছন্দের বাঁধন, অন্ত্যমিল, ধীর লয়, সহজ সরল ভাব, বিমূর্ততা বা রূপকতা নেই, নির্দিষ্ট অর্থ আছে, কথার রাখঢাক নেই, কবির প্রকাশিত ভাব এবং পাঠকের অনুভবের মধ্যে দ্বন্দ্ব নেই l
কবিতা - রূপক, বিমূর্ততা, অলংকার ইত্যাদি প্রয়োগের মাধ্যমে বাস্তবতাকে তির্যকভাবে দেখা হয়, চিত্রকল্প সৃষ্টির শৈল্পিক প্রবণতা থাকে l কবিতায় শব্দের পর শব্দ সাজিয়ে অপরূপ শব্দচিত্র আঁকা হয়, অরূপের সন্ধান চলে, অনুভূতির রসে ভিন্ন অর্থের আবহ তৈরি হয় l পাঠকমনের সৃজনশীল কল্পনা এখানে ক্রিয়াশীল হয়ে ওঠে এবং আক্ষরিক ব্যাখ্যার অতিরিক্ত অন্য এক উপলব্ধিগত অর্থের অনুভব হয় l