যে কোনো সৃজনশীল কার্যকলাপ, সাংস্কৃতিক বা অন্য কোনো ক্ষেত্রে, সবসময় তার গতিপথ মসৃণ থাকে না l
১) কিছু গুণী উদ্যমী ব্যক্তিত্বের, সংগঠকদের যুগোপযোগী সদর্থক পদক্ষেপ,
২) অনেক অনেক কর্মী সদস্যের দায়িত্বশীল অংশগ্রহণ এবং
৩) নিজস্ব জীবনীশক্তি দিয়ে যেমন এই ক্ষেত্রগুলি চলে, তেমনই
১) অন্তর-গত এবং
২) বহিরাগত নানা কারণ অনেক সময় তার চলার পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় l আমরা যদি সরাসরি বাংলা কবিতা চর্চার ক্ষেত্রটিতে আসি তাহলে দেখব উল্লিখিত বিষয়গুলি কিভাবে এক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক l
"বাংলা কবিতা" ওয়েবসাইটটির পরিকল্পনা এবং এটির কাজ শুরু করা উল্লিখিত ১ নং বিষয়টিতে বলেছি l বর্তমান দিনে নিঃসন্দেহে এটি বাংলা ভাষায় কবিতা চর্চার এক সুবৃহৎ মঞ্চ l কবিতা রচনার পাশাপাশি কবিতা আলোচনা ও আবৃত্তি প্রকাশ বিষয়টিকে সংযুক্ত করে একটি সামগ্রিক কাব্য আবহ নির্মাণ করার প্রচেষ্টা করা হয়েছে যা একাধারে যুগোপযোগী এবং উদ্যোক্তাদের বিচক্ষণ দৃষ্টিভঙ্গীর প্রমাণ l
২ নং বিষয়ে বলেছি সেই সাত হাজারেরও বেশী কবি বন্ধুদের কথা যারা এই ওয়েবসাইটটি শুরু হবার পর এখানে যোগদান করেছেন এবং নিয়মিত ভাবে কবিতা, আবৃত্তি ও আলোচনা প্রকাশ করে দিনে দিনে "বাংলা কবিতা" ওয়েবসাইটটিকে সমৃদ্ধ করে চলেছেন l ওয়েবসাইটটির মূল পাতায় গেলে বর্তমান দিনে এই মাধ্যমটিতে যোগদানকারী কবির সংখ্যা, প্রকাশিত কবিতার সংখ্যা, প্রকাশিত আবৃত্তির সংখ্যা, আলোচনার সংখ্যা, গড়ে প্রতিদিন কতো কবিতা এই আসরে প্রকাশিত হয় ইত্যাদির সর্বাধুনিক তথ্য পাওয়া যায় l তাছাড়াও এটি বাংলা কবিতার এক বিশাল গ্রন্থাগার যেখানে অনেক প্রসিদ্ধ কবির শতাধিক কবিতা আঙ্গুলের স্পর্শে তাৎক্ষণিক উপলব্ধ l
৩ নং বিষয়ে বলতে চেয়েছি কবিতা রুপী সাহিত্যের এই চিরজীবি শাখাটির অসাধারণ জীবনীশক্তির কথা, চর্যাপদের যুগ থেকে শুরু করে যা আজ পর্যন্ত স্বমহিমায় টিকে আছে l যুগ তো কম বদলালো না l কত রকমের শাসন ব্যবস্থা এলো, কত মহামারী, দুর্ভিক্ষ, যুদ্ধবিগ্রহ - ইতিহাসের পাতায় লিপিবদ্ধ হলো l দেশের মানচিত্র বদলে বদলে গেল কতবার l কিন্তু কবিতা মানুষকে ছেড়ে যায় নি l কিংবা বলতে পারি মানুষ তার বিপদে, সম্পদে কবিতাকে কাছছাড়া করে নি l "মাথার ওপর বাড়ি পড়ো পড়ো" নিয়েও মানুষ "রাশি রাশি মিল জড়ো" করেই গেছে l এই অসাধারণ জীবনীশক্তি কবিতাকে আজও বাঁচিয়ে রেখেছে l
এ তো গেল স্বস্তির কথা l কিন্তু আলোচনার প্রারম্ভে পরে পুনরায় ১ ও ২ নং এ আরও দুটি বিষয় উল্লেখ করেছি যেখানে বলেছি ১) অন্তর-গত ও ২) বহিরাগত কারণের কথা যা অনেক সময় কবিতা চর্চার ক্ষেত্রে অন্তরায় এর সৃষ্টি করছে l
প্রথমে বলি অন্তর-গত অন্তরায়ের কথা, যা কবিতা চর্চাকারী যাঁরা তাদের দিক থেকে আসছে l আমি অত্যন্ত খোলামনে, আত্মসমালোচনার সুরে বিষয়টি এখানে রাখছি l কাউকে ব্যক্তিগতভাবে বা দলগতভাবে আক্রমণ করছি না l এইভাবে বিষয়টিকে নিতে হবে l তাছাড়া এই রচনাটিকে "সমসাময়িক ঘটনা" হিসাবে প্রকাশ করলেও এটিকে মতামতভিত্তিক লেখা হিসাবেও দেখতে অনুরোধ করলাম l ফলে কেউ অন্যমতও পোষণ করতে পারেন l
এবার যেটা আলোচনা করছিলাম সেই প্রসঙ্গে আসি l বলছিলাম অন্তর-গত অন্তরায়ের কথা যা জ্ঞানত বা অজ্ঞানে কবিতা চর্চাকারী যাঁরা সেই কবিবন্ধুদের কাছ থেকেই আসে l আমি অনেক নবীন-প্রবীণ কবিদের বলতে শুনেছি তাঁদের ছন্দ সম্বন্ধে ধারনা নেই l বিষয়টি এরকম যেন সমুদ্রে ঝাঁপ দিয়েছি কিন্তু শিশির বিন্দুকে ভয় পাই l কবিতা চর্চার সঙ্গে ছন্দের প্রাথমিক জ্ঞান ওতপ্রোত ভাবে জড়িত l এমনিতে সহজাত ভাবেই ছন্দের কার্যকরী জ্ঞান অনেকের থাকে l ছন্দের ওপর কোনো বিশেষ পাঠ না নিয়েও নিজের কানটিকে সঠিকভাবে ব্যবহার করে তাঁরা নিজেদের কবিতায় সফলভাবে ছন্দের প্রয়োগ করে থাকেন l এরকম অনেক কবি, গীতিকার, কবিয়াল আছেন, যাঁরা ছন্দের কোনো আনুষ্ঠানিক পাঠ নেন নি, কিন্তু অসাধারণ সুন্দর ছন্দময় সব রচনা লিখে গেছেন l
কিন্তু সহজাত ভাবে যাঁরা ছন্দের প্রাথমিক ধারণাটা পান নি, কিংবা নিজেদের কানকে যাঁরা সঠিকভাবে ছন্দ প্রয়োগের ক্ষেত্রে ব্যবহার করেন না বা করতে পারেন না, কিন্তু তাঁরা ছড়া কবিতা লেখেন, এরকম সব কবিবন্ধুদের বলব, নিজেদের স্বার্থে, বাংলা কবিতার স্বার্থে, তাঁরা ছন্দের প্রাথমিক পাঠ-টা নিন l ছন্দের ওপর বই আছে l আমি নিজে বিশিষ্ট কবি ও লেখক শাহ আলম বাদশা রচিত "কবি কবি ভাব, ছন্দের অভাব" বইটি পড়ে উপকৃত হয়েছি l বইটি সহজ সরল ভাষায় লেখা l খুব বেশী তাত্বিক আলোচনার মধ্যে না গিয়ে সরস ভঙ্গিতে প্রচুর উদাহরণ সহযোগে ছন্দের বিষয়টি আলোচিত হয়েছে যা কবিতা চর্চাকারী যাঁরা মনে করেন যে তাঁদের ছন্দের ব্যাপারে দুর্বলতা আছে, তাদের বহুল উপকারে আসবে l এছাড়াও ছন্দের ওপর অনেক লেখা "বাংলা কবিতা"র আলোচনা বিভাগে প্রকাশিত হয়, সেগুলি মনোযোগ সহকারে পাঠ করা যেতে পারে l বিশিষ্ট কবি মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান, শ্রদ্ধেয় কবি কবীর হুমায়ুন - ছন্দের ওপর মনোজ্ঞ ও প্রয়োজনীয় লেখা আলোচনা বিভাগে প্রকাশ করেছেন l এই লেখাগুলি পাঠ করলে অবশ্যই তাঁদের ছন্দশুদ্ধি হবে, তাঁরা উপকৃত হবেন, বাংলা কবিতা উপকৃত হবে, কবিতাপাঠ আনন্দময় হবে, কবিতা- পাঠকেরা খুশি হবেন ছন্দময় কবিতা পেয়ে l
এবার বলি ২ নং বিষয়টি যা বহিরাগত এবং কবিতা বিকাশের ক্ষেত্রে অন্তরায় হয় l এক্ষেত্রে অন্তরায় কিন্তু এক নয়, অনেক l প্রথমত প্রতিরোধ আসে পাঠকদের কাছ থেকে যাদের একাংশের বক্তব্য আজকাল কবিতার নামে যা লেখা হয় তার কিছু কবিতা পড়ে তারা কিছু বুঝতে পারেন না, পড়তে ভালোও লাগে না l কাগজে ছাপার অক্ষরে সংবাদপত্রের কলাম এর আকারে কবিতা নামে লেখা আত্মপ্রকাশ করল l পাঠক হয় সেটা এড়িয়ে গেলেন, কেউ পড়তে শুরু করলেন, কিন্তু তাঁর মনে হলো কবিতাটি হয় দুর্বোধ্য, বা এলোমেলো কিছু শব্দবন্ধ, যা ঠিক কবিতা হয়েছে বলে তার মনে হলো না l ফলে তিনি কবিতাটি শেষ পর্যন্ত পড়ে উঠতে পারলেন না l
এখানে অনেকগুলি বিষয় একসাথে উঠে আসে l সবগুলিকেই তার নিজের জায়গা থেকে যথাযোগ্য মর্যাদা দিয়ে নিরাসক্ত মনে বিশ্লেষণ করতে হবে l প্রথমত, পাঠকের অভিযোগটা বা তার অনুভবটা সর্বক্ষেত্রে সঠিক নাও হতে পারে l আবার কিছু ক্ষেত্রে এই অভিযোগ অমূলক নাও হতে পারে l প্রকৃত পর্যবেক্ষণ দিয়ে বিষয়টি বুঝতে হবে l
কবিতার পাঠ ও অনুভবের ক্ষেত্রে বলা হয়, কবিতা বুঝতে পারাটা কবিতার পরীক্ষার প্রাথমিক মাপক নয় - না কবিতার দিক থেকে, না পাঠকের দিক থেকে l বরং অনেক গুরুত্বপূর্ণ মাপক হলো, কবিতাটি পড়তে ভালো লাগলো কি না l এখানেই চলে আসে কবিতার ভাষা, ছন্দ, ও অলঙ্কারের প্রশ্ন l কবিতার চরণগুলিতে যদি বিষয় অনুরূপ শব্দের চয়ন সঠিক থাকে, কবিতার বাক্যগুলি যদি ছন্দ রক্ষা করে চলে, বাক্য-অলঙ্কারের ব্যবহার সুপ্রযুক্ত হয়, তাহলে এরকম একটি কবিতার অর্থ যদি বোঝা নাও যায়, অন্তত তার পাঠটা আনন্দদায়ক হবে l পড়ার সময় পাঠক ছন্দের একটা দোলা অনুভব করবেন l সেক্ষেত্রে কবিতাটির অর্থ তিনি যদি নাও বুঝে থাকেন, কবিতাটি তিনি পড়বেন এবং বারবার পড়বেন l এখানে বলার কথা একটাই, এখানেই বোঝা যায় কবিতা রচনার ক্ষেত্রে ছন্দজ্ঞানের গুরুত্ব কতখানি l ছন্দের জ্ঞান না থাকার কারণে ছন্দের সঠিক প্রয়োগহীন যে কবিতা শ্রেণী প্রকাশিত হচ্ছে বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় বা অন্য কোনো মাধ্যমে, তা কবিতা পাঠকদের বিরক্তি উৎপাদন করছে l কবিতাটি পড়ে যদি তার অর্থ পাঠক বুঝতে না পারেন, অন্তত কবিতাটি পাঠের সময় তার ছন্দসুষমা, তার দোলা যেটা তার পাওয়ার কথা, সেটা না পান, বরং ছন্দহীন কবিতা পাঠ করতে গিয়ে মাঝে মাঝে হোঁচট খান, পাঠের গতি ও অনুভব স্বাভাবিক স্বচ্ছন্দ থাকে না, বাধাপ্রাপ্ত হয় ; তখন পাঠক পাঠটিকে চালিয়ে নিয়ে যেতে পারেন না, থেমে যান l এভাবে কিছু কবিতা পাঠকের সংখ্যা যে কমেছে, এই সত্যটা অস্বীকার করার মতো জায়গায় আমরা নেই l যদিও বলা হয় অনলাইনে আজকাল কবিতা পড়া সম্ভব হয়েছে বলে কবিতা পাঠকের সংখ্যা বেড়েছে l এই তথ্যটা মেনে নিয়েও উল্লিখিত অন্তরায়টি নিয়ে ভাববার এবং আশু প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের প্রয়োজন আছে l
সমস্যাটা শুধু ছন্দের প্রয়োগ নিয়ে নয় l আরও আছে l
ঐ যে পাঠকরা বলেন যে আধুনিক কবিতা পড়ে তাঁরা কিছুই বুঝতে পারেন না, মাথা ধরে যায়, বিরক্তি এসে যায়, কবিতা পড়ে ভালোলাগার কোনো বোধ তৈরি হয় না - বিষয়টিকে আরও গভীরে গিয়ে আমাদের অনুধাবন করতে হবে l আগেই বলেছি, কবিতা পাঠের ক্ষেত্রে অর্থ বুঝতে পারলে ভালোই, যদিও অর্থ বোঝাটাকে ততটা আবশ্যিক বলে মনে করা হয় না l কিন্তু ভালো লাগার বোধটা তৈরি হওয়া খুব জরুরী l কবিতা পড়তে যদি ভালো না লাগে, সেটা কবিতার দুর্বলতা হিসাবেই ধরা হয় l নানা কারণে এটা হতে পারে l ছন্দ ব্যবহারে ত্রুটির কথা বলেছি, এছাড়াও, কবিতার ভাষায় সাধু চলিত গুরুচণ্ডালী দোষ হলে, ভাষা ও ভাবের প্রকাশে অসংলগ্নতা থাকলে, ধারাবাহিকতার অভাব থাকলে ইত্যাদি বহুবিধ কারণে কবিতা পড়তে ভালো না লাগতে পারে l কবিকে অবশ্যই এই বিষয়গুলিতে যত্নবান হতে হবে l
অন্তরায় আরও আছে l কবিতাকে এখন প্রচন্ড প্রতিযোগিতার মধ্যে দিয়ে যেতে হচ্ছে l চারিদিকে নানা বিনোদনসম্ভার এত সুলভ, এত আকর্ষণীয়, এর মধ্যে কবিতা পাঠ করেন কতজন ? কবিতার মনোযোগী পাঠকের সংখ্যা কমছে এটা অনুমানের স্তর পেরিয়ে এখন বিশ্বাস করবার মতো অবস্থায় পৌঁচেছে l কবিতার বই এখন কতজন আগ্রহ করে কেনেন ? এই অবস্থার মোকাবিলা করতে হলে কবিতাকেও বিজ্ঞান প্রযুক্তির সাহায্যে মানুষের কাছে সহজে, সুলভে এবং আকর্ষণীয় ভাবে উপস্থাপন করতে হবে l এটা কবি ও পাঠক - উভয়ের কথা চিন্তা করেই করতে হবে l কবিতা চর্চার সুবিধা হবে l কবিতা সহজেই প্রকাশ করা যাবে l কবিতা পড়া সহজ হবে l আঙ্গুলের ডগায় থাকবে প্রিয় কবির প্রিয় কবিতা l
ঠিক এই কাজটিই অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে ও সুচারুভাবে সম্পন্ন করেছে "বাংলা কবিতা" ওয়েবসাইটটি l যাঁরা এটিকে রূপদান করেছেন, কবিবন্ধু পল্লব, এবং আরও যাঁরা, তাঁরা সকলেই ধন্যবাদার্হ l এখানে বাংলা কবিতা প্রকাশ ও পাঠ - দুটিই সহজ হয়ে গেছে l ওয়েবসাইটটির সামগ্রিক পরিকল্পনা এত সুন্দর যে এখানে নিজের কবিতা, আবৃত্তি, আলোচনা প্রকাশ করা যায়, প্রিয় কবির কবিতা ইত্যাদি পাঠ করা যায়, কোনো লেখার ওপর মন্তব্য করা যায়, মন্তব্যের উত্তরে মন্তব্য করা যায়, লেখা সম্পাদনা করা যায়, কোনো মন্তব্য, লেখা মুছে ফেলা যায় ইত্যাদি ইত্যাদি l
আসরের সকল কবিবন্ধুদের জায়গামতো শ্রদ্ধা, ভালবাসা ও শুভেচ্ছা জানিয়ে শেষ করলাম l