ঐ যে গাঁ-টি যাচ্ছে দেখা 'আইরি'-ক্ষেতের আড়ে—
প্রান্তটি যার আঁধার-করা সবুজ কেয়াঝাড়ে,
পূবের দিকে আম-কাঁঠালের বাগান দিয়ে ঘেরা,
জটলা করে যাহার তলে রাখাল-বালকেরা—
      ঐটি আমার গ্রাম— আমার স্বর্গপুরী,
      ঐখানেতে হৃদয় আমার গেছে চুরি!

বাঁশবাগানের পাশটি দিয়ে পাড়ার পথটি বাঁকা,
পথের ধারে গলাগলি সজনে গাছের শাখা,
গোরুর গাড়ির চাকায় পথে শুকায় নাকো কাদা,
কোথাও বা তার বেড়ার পাশে আবর্জনার গাদা;—
      তবু আমার জন্মভূমি স্বর্গপুরী,
      বিশ্বশোভা ঐখানেতে গেছে চুরি!

যত দেশের যত পাখী ঐ গাঁয়ে কি আছে!
ঝোপে-ঝাড়ে বেড়ায় উড়ে বাসার কাছে কাছে;
পথের পাশে গাছের ডগা নুইয়ে পড়ে গায়ে,
চলতে গেলেই শুকনো পাতা মাড়াই পায়ে পায়ে;—
      বনে-ভরা এমনি আমার স্বর্গপুরী,
      তবু আমার চিত্ত সেথায় গেছে চুরি!

পদ্মদীঘি কোথায় পাব— পদ্ম নাইক মোটে,
চৈৎ-বোশেখে শুকিয়ে ওঠে, জলটুকু না জোটে!
পানায়-মরা ডোবায় ভরা, সিদ্ধি-গাছের ছাওয়া,
ভাঁট-পিঠিলির জঙ্গলেতে হাঁপিয়ে বেড়ায় হাওয়া—
      এমনি আমার স্বর্গছাড়া স্বর্গপুরী,
      স্বর্গশোভা তবু সেথায় গেছে চুরি!

পাঠশালাটিও নাইরে গাঁয়ে— নাই কোনো ডাকঘর,
কোথায় বদ্দি, যদিও কম্তি নয়কো বড় জ্বর;
রাজার প্রাসাদ নাইক সেথা, ধনীর দেবালয়,
সজ্জাহীনের লজ্জা নাইক, দারিদ্রের নাই ভয়;—
      সৃষ্টিছাড়া এমনি আমার স্বর্গপুরী,
      সকল অভাব তবু সেথায় গেছে চুরি!

তবু ওঠে কুমোর-পাড়ায় কদমতলার ধারে
সঙ্কীর্তনের মধুর-গীতি সান্ধ্য অন্ধকারে;
সবাই যেন স্বাধীন সুখী, বাধা-বাঁধন-হারা—
আবাদ করে, বিবাদ করে, সুবাদ করে তারা;
      এমনি আমার সাদাসিধে স্বর্গপুরী,
      তাইত আমার মনটি সেথায় গেছে চুরি।

শোভা বল, স্বাস্থ্য বল,— আছে বা না আছে,
বুকটি তবু নেচে ওঠে এলে গাঁয়ের কাছে;
ঐখানেতে সকল শান্তি, আমার সকল সুখ—
বাপের স্নেহ, মায়ের আদর, ভায়ের হাসিমুখ;—
      তাইত আমার জন্মভূমি স্বর্গপুরী,
      যেথায় আমার হৃদয়খানি গেছে চুরি।।