আয়রে ছেলের পাল মাছ ধরতে যাই
মাছের কাঁটা পায়ে ফুটলো, দোলায় চেপে যাই;
দোলায় আছে ছপণ কড়ি গণতে গণতে যাই।
ও নদীর জলটুকু টলমল করে,
এ নদীর ধারেরে ভাই বালি বুর ঝুর করে,
চাঁদ মুখেতে রোদ লেগেছে রক্ত ফেটে পড়ে।
                                — ছেলে-ভুলান ছড়া

নমুদের মেয়ে আর সোজনের ভারি ভাব দুইজনে,
লতার সঙ্গে গাছের মিলন, গাছের লতার সনে।
সোজন যেন বা তটিনীর কূল, দুলালী নদীর পানি,
জোয়ারে ফুলিয়া ঢেউ আছাড়িয়া করে কূল টানাটানি।
নামেও সোজন, কামেও তেমনি, শান্ত স্বভাব তার,
কূল ভেঙে নদী যতই বহুক, সে তারি গলার হার।
দুলালী সে যেন বনের হরিণী, সোজন তাহার বন,
লতা পাতা ফুল ছায়া বিছাইয়া হরণ করিছে মন।
বনের হরিণী থাকে বনে বনে, জানে সে বনের ভাষা,
সে বন ঘিরিয়া মনখানি তার বাহিরে যায়নি আশা।

সোজনের সাথে তার ভারি ভাব, পথে যদি দেখা হয়,
যেন রাঙা ঘুড়ি আকাশে উড়াল, হেন তার মনে লয়।
পিছন হইতে সোজন আসিয়া যদিবা হঠাৎ ডাকে,
কুড়ায়ে পাইল পাকা আমটিরে দুলীর এমনি লাগে।
সোজন আসিয়া জাম গাছটির আগডালে যেন উঠি,
মেঘের মতন কালো জামগুলি তুলিতেছে মুঠি মুঠি।
যেন কে তাহারে ধরিয়া রেখেছে এত উচু করে তুলে,
কাঁদির খেজুর দুহাতে ধরিয়া সে পাড়িছে মনের ভুলে।
সোজনের সাথে তার ভারি ভাব, গোলাপ ফুলের গায়,
ছোট বুলবুলি বাসা বেঁধে যেন পাখার বাতাস খায়।
টুনটুনি পাখি উড়ে এসে যেন তাহার খোঁপায় নাচে,
লাল পোকা যেন ঘুরিছে ফিরিছে তাহার চূড়ীর কাঁচে।
সোজনের সাথে তার ভারি ভাব, দুলীর ইচ্ছে করে,
সেজনেরে সে যে লুকাইয়া রাখে সিঁদুর-কৌটো ভরে।
আঁচল খানিরে টানিয়া টানিয়া বড় যদি করা যেত,
সোজনেরে সে যে লুকায়ে রাখিত কেউ নাহি খুঁজে পেত।

সোজন না এলে দুলীর সেদিন চারিদিক আন্ধার;
পুতুল তাহার ভেঙে যায় যেন চরণের ঘায়ে কার।
সেই ত সেবার অসুখ করিল দুলী উঠে খুব ভোরে,
সাতটা মহিষ মানিয়া আসিল রক্ষাকালীর দোরে।
একুশ বামুন খাওয়াইবে দুলী সোজন সারিলে পর,
দুশ মোমবাতি মানিয়া আসিল জেন্দা পীরের ঘর।
সোজন যেদিন সারিয়া উঠিল, কি খুশী দুলীর মনে,
খেজুরের আঁটী যত ছিল জমা বিলাইল জনে জনে।
ও পাড়ার সেই পুটি—যারে দুলী চক্ষে দোখতে নারে,
ঠ্যাংভাঙা তার ছোট পুতুলটি দিয়েই ফেলিল তারে।
সেদিন তাহার মনে এত খুশী, সে খুশীর সরোবরে,
কালী-মাতা তার সাতটি মহিষ হারাইল অকাতরে।
একুশ বামুন ভোজন ছাড়িল, জেন্দা না বলে পীর,
আদায় করিতে পারিল না দাম দুশটি মোমবাতির।
সোজনেরে ছেড়ে চলেনাক তার—কখনো নাহি চলে,
কোন কাজ তার হতে পারেনাক সে নাহি নিকটে হলে।

সেই একবার সোজন কেবল গিয়াছিল মামা বাড়ি
চারিটি দিনের কড়ার করিয়া, মনে আছে সব তারি!
মামার দেশেতে তল্লা বাঁশের খুব ভাল বাঁশী হয়,
দুলীর জন্য এগারটি বাঁশী আনিবে সে নিশ্চয়।
নানান রঙের সজারুর কাঁটা কত পড়ে আছে বনে,
এক বোঝা তার যদি সে না আনে দেখে নিও তক্ষণে।
মামার দেশেতে পদ্ম পুকুরে রঙিন ঝিনুক ভাসে;
সাদা দাঁড়কাক ঘুরিতেছে বনে কাউয়ার ঠুটীর আশে।
ঘন-বেত ঝাড়ে বেথুল ঝুলিছে, কেউ পায়নিক খোঁজ,
কাঁদিতে কাঁদিতে খেজুর পাকিয়া ঝরিয়া পড়িছে রোজ।
এর সব কিছু নিয়ে সে আসিবে, তারপর ও-ই বনে,
সারাদিন ভরি অনেক গল্প করিবে যে দুই জনে।
ও পাড়ার মাঠে সেদিন যে তারা দেখে এলো চক্ষেতে,
কটার বাসায় ছাও হইয়াছে কুসুম-ফুলের খেতে।

দুলী যেন রোজ যাইয়া তাদের আদর করিয়া আসে,
কলমী ফুলের নোলক পরায়ে দেখে যেন আর হাসে।
বনের যেখানে শিমুলের ভালে বাঁধিয়াছে তারা হাঁড়ী,
কোন্ পাখি সেথা বাসা বাঁধে দুলী খোঁজ রাখে যেন তারি।
বেগুনের ডালে টুনটুনি পাখী ডিম যদি পেড়ে যায়,
কারেও কবিনে, সাবধান, যেন কেউ নাহি টের পায়।
এতটুকু দুটি ছোট ছাও হবে, দেখিস একটা ধরে
খোপায় যে তোর বেঁধে দিয়ে তারে উড়াইব মজা করে।
অর শোন্ দুলী, তোদের বাড়ির বিড়ালের ছাওগুলি,
এরই মাঝে যদি চোখ মেলে চায় মোরে যাসনাক ভুলি।
একটি আমারে দিতেই হইবে, কেহ যেন নাহি লয়,
মোরে ছুঁয়ে তুই কীরা কাট দেখি-বাস, হল প্রত্যয়!

সকল শপথ রেখেছে সোজন আমরা বলিতে পারি,
এত লোক গাঁয়ে, সাধে কি সোজন মনের মতন তারি!
সোজনের মত ছেলেই হয় না, তোমরা কি জান তার,
রাঙা ঘুড়িখানি তার চেয়ে ভাল পারে কেহ উড়াইবার!
সোজন বলেছে, দরকার হলে ঘুড়ির সূত্র ধরে,
ও-ই আকাশেতে উড়িয়া যাইতে পারে সে হাওয়ায় ভরে।
সেখানে নিতুই কত তারা-ফুল ফুটিয়া ফুটিয়া হাসে।
সেথায় গাঁথিয়া তারার মালা সে বসিবে চাঁদের পাশে।
শেষ রাতে দুলী উঠানে আসিয়া তারে যেন ডাক দ্যায়,
পোড়া চোখে তার এত ঘুম তাই ডাকিতে পারেনি তাই।
আচ্ছা, সোজন মানুষ না হয়ে হত যদি ফুল-তারা,
চাঁদ যদি হত তখন তাহারে মানাত কেমন ধারা!
তাহলে হয়ত সোজন তাহারে চিনিতেই পারিত না,
হয় হোক সে যে চাষীদের ছেলে, কম তা বলে ত না।
বাপ যদি তারে সোজনের সাথে দিয়েই ফেলে বা বিয়ে,
ধ্যেৎ—তা হলে সে কেমনে বাঁচিবে লজ্জা সরম নিয়ে!

সোজনেরো বড় ভাল লাগে এই নমুদের মেয়েটিরে,
তার জীবনের অনেক কাহিনী লেখা আছে এরে ঘিরে।
সোজন যখন বড় হবে খুব—খুব বড় একেবারে,
যখন তখন ইচ্ছা মাফিক যা কিছু করতে পারে;
তখন সে হয়ে দূরদেশী কোন পাটের নায়ের ভাগী,
যাবে সে পারায়ে কত খাল বিল সুদূর হাটের লাগি;
সেথায় জমায়ে বহু টাকাকড়ি ফিরিয়া আসিবে ঘরে,
শপথ করে সে মধুমালা শাড়ী আনিবে দুলীর তরে।
দুলী কহে সেথা সিঁদুর কৌটা শঙ্খের চুড়ী আর,
ময়ূরের পাখা যদি মেলে যেন ভুলে না সে কিনিবার।

সোজন যখন কৃষাণ হইবে, সবগুলো খেত ভরি
কুসুম ফুলের করিবে সে চাষ মনের মতন করি।
ফাগুনে যেদিন সারা খেত ভরি আঁকিবে রঙের চিন,
কুসুমে কুসুমে চরণ ঘষিয়া কাটিবে দুলীর দিন।
পাট মেরে সে যে নিড়াইয়া দিবে বউ-টুবানীর চারা,
খেত ভরি হবে ফুলের বাহার দুলীর খুশীর পারা।
বাড়ির পালানে কুমড়া লাগাবে নহে কুমড়ার তরে,
কুমড়ার ফুল ভালবেসে দুলী যদিবা খোঁপায় পরে।

মদনের বাপ ভাল লোক নয়, তাহার খেতের মাঝে,
মোটরের শাক তুলিতে গেলেই গাল দেয় বড় ঝাঁজে।
বাছাই করিয়া করিবে সোজন মাঘী মটরের চাষ,
শাক তুলে তুলে সেদিন দুলীর পূরিবে মনের আশ।

জমিরের খেতে ছাই মিঠে আলু দেখো সোজনের খেতে,
শাকের মামুদ আলু হবে কেউ হেরেনি যা চক্ষেতে।
দুলীর সঙ্গে তার ভারি ভাব, দুলীর খুশীর তরে,
হেন কাজ নাই যাহা কোনদিন সোজন না পারে করে।