(দৈনিক সমাজের কথা'য় প্রকাশিত, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৮)
ছোটগল্পের ইতিহাস থেকে জানা যায়, বাংলা ছোটগল্পের জনক বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাঁর দেখানো পথ অনুসরণ করেই বাংলা সাহিত্যে স্বতন্ত্রধারা সৃষ্টি করেছিলেন এক ঝাঁক কবি-সাহিত্যিক, সে ধারাবাহিকতায় ষাট দশকে কথাসাহিত্যিক শওকত আলী (জন্ম: ১৯৩৬ সালে, পশ্চিম বাংলার পশ্চিম দিনাজপুর জেলার রায়গঞ্জ, মৃত্যু: ২৫ জানুয়ারি ২০১৮) নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন ভিন্ন আঙ্গিকের শৈল্পীকতায়। তাঁর জাদুস্পর্শী লেখনির প্রকাশভঙ্গিতে প্রবন্ধ-উপন্যাস-ছোটগল্প অনবদ্য হয়ে উঠেছে গভীর দৃষ্টিবোধ, ঘটনায়-বাস্তবতায়, গল্পের প্রকরণ এবং বিষয়বস্তুর চমৎকৃত্যে। প্রকৃতপক্ষে শওকত আলী মধ্যবিত্ত বা নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা, টানাপড়েন, দারিদ্র্য, লিবিডো, বিকৃত জীবনাচার্য, লোকায়ত জীবনের অস্তিত্বগত সংকট তাঁর উপন্যাস-ছোটগল্পে সাবলীলভাবে অঙ্কন করেছেন।
ষাটের দশক সময়টা ছিল বাংলা গল্পসাহিত্যের যৌবনকাল। এ সময়ে শওকত আলীর হাতে অনবদ্য সব গল্পের জন্ম হয়েছে। ‘উম্মুল বাসনা’ গল্পগ্রন্থে নরনারীর আদিম কামনা-বাসনা স্বভাবসুলভভাবে চিত্রায়িত হয়েছে। ‘রঙ্গিনী’ গল্পে মানুষের জৈবিক প্রবৃত্তি, হিংসা-বিদ্বেষ ও সন্দেহের আবহ দেখতে পাওয়া যায়। ‘দুই গজুয়া’ গল্পে পিতৃমাতৃহীন রহীমুদ্দীনের ভেতর দিয়ে মহাজনদের চরিত্রের স্বরূপ প্রকাশ পেয়েছে। মহাজন-বেনিয়াদের হিংস্র দৃশ্যাবলি ফুটে উঠেছে ‘লেলিহান সাধ’ গল্পে। ‘নয়নতারা কোথায় রে’ গল্পে জোতদাররা প্রভূত ক্ষমতাশালী হওয়া সত্তে¡ও তাদের নির্যাতনের সহজ লক্ষ্যে পরিণত হয় ধর্মীয় সংখ্যালঘুর কন্যা। ‘ফাগুয়ার পর’ গল্পে জায়গা পেয়েছে ভেঙে পড়া সংসার কাঠামো, নরনারীর অসামাজিক সম্পর্ক আর মানুষের ব্যক্তিগত সম্পর্কের উত্থান-পতন। তাঁর গল্পের প্রেক্ষাপট অনেকটা সেকেলে পঞ্চাশ এবং ষাট দশকের জীবন থেকে নেওয়া হলেও ভাষার স্বাচ্ছন্দময় প্রয়োগ, বেগবান গতি এবং ব্যতিক্রমধর্মী জীবনানুভূতি অঙ্কনের দক্ষতায় অনবদ্য কুশীলব হয়ে উঠেছেন।
তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘পিঙ্গল আকাশ’ এ প্রকাশ পেয়েছে নীতিহীনতা এবং মধ্যবিত্তের নগ্নতা। শ্রেণিসচেতন শওকত আলী পারিবারিকভাবেই বেড়ে উঠেছিলেন রাজনীতি ও সংস্কৃতিমনা পরিবেশে। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক কাল, স্বাধীনতার ক্রান্তিকাল এবং জাতীয়তাবাদের চেতনার উন্মেষ নিয়ে লিখেছেন ‘দক্ষিণায়নের দিন, কুলায় কালস্রোত ও পূর্বরাত্রি পূর্বদিন’ ত্রয়ী উপন্যাস। এ উপন্যাসই মূলত তাঁকে খ্যাতি এনে দেয়। উপন্যাসের বিষয়বস্তু এবং রচনাশৈলীর প্রখরতায় তিনি ছিলেন স্বতন্ত্রধারার প্রবাদপ্রতিম ব্যক্তিত্ব। ‘যাত্রা’ উপন্যাসে ২৫শে মার্চের বর্বরোচিত হামলার হত্যাযজ্ঞে ঢাকায় সৃষ্ট মানবিক বিপর্যয়কে চমৎকারভাবে চিত্রিত করেছেন তিনি। সে সময়ে তিনি মানুষের লিবিডোতাড়িত আকাঙ্ক্ষা এবং সমাজের অতি সাধারণ নিচুতলার মানুষের পাশাপাশি নাগরিক জীবন নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন বারবার।
জীবন-নিরীক্ষার আলোকে বাংলা সাহিত্যে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলা একাডেমি পুরস্কার এবং একুশে পদকসহ তিনি নানাবিধ পুরস্কারে ভূষিত হন। তাঁর কর্মের দ্যূতির মাঝে তিনি যুগান্তরে বেঁচে থাকবেন আজীবন।