স্বপন মোহাম্মদ কামাল জ্বলন্ত কয়লার অন্তর্দহনে বৈষম্যের প্রাচীর ভাঙার অভীপ্সায় রচনা করেছেন ‘মমির বিক্ষোভ’। ব্যক্তি হিসেবে নয়- কেবল কবিতা পাঠকে সর্বস্ব করে তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘তিন স্বপ্নের ছায়া’র ঘোমটা উন্মোচনে সচেষ্ট হলাম। এ প্রয়াশে দেখবেন উন্মোচনকালের সৌন্দর্য।
মাত্র ৫৩ বছর পৃথিবীর আবর্তনে আবর্তিত হয়ে স্বপন মোহাম্মদ কামাল অনন্তযাত্রায় চলে গেছেন ২০১৮ সালের ২৯ জানুয়ারি। যশোর শহরে ১৯৬৫ সালে জন্ম নেয়া এ কবি ছিলেন সরকারী চাকরিজীবী। তবে তিনি ‘কবিতাকর্মী’ পরিচয়ে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন।
দেশের বিভিন্ন জাতীয় পত্র-পত্রিকা এবং সাহিত্য ম্যাগাজিনে তাঁর সাড়ে চার শতাধিক কবিতা প্রকাশিত হয়েছে। তিনি কবিতাকে সমাজ বদলের হাতিয়ার করে নিপীড়িত মানুষের পক্ষে এবং অসঙ্গতি-অনাচার-বৈষম্যের বিরুদ্ধে কবিতার ভাষায় কথা বলেছেন দ্বর্থহীন কন্ঠে। মার্কসতত্ত্বে মার্কস চেয়েছিলেন- শ্রেণিহীন সমাজব্যবস্থাকে সমান করতে। ঠিক স্বপন মোহাম্মদ কামালও বিশ্বাস করেন- বৈষম্যমূলক সমাজব্যবস্থাই প্রগতি ও মানব সভ্যতার মূল প্রতিবন্ধকতা। কবিতার কাছে সমর্পিত কবি কবিতার উপাদান খুঁজতে গিয়ে নিয়ত অন্তর্গত ক্ষরণে হয়েছেন রক্তাক্ত। তবু তিনি পরিশীলিত হতে চান কাব্যের অন্তর্নিহিত সুধায়।
‘মমির সম্মান দিয়ে আমাকে যতোই আবদ্ধ করে রাখো
কুঠুরির ভিতর- কিংবদন্তীর মতো জীবন্ত হবোই, ....
হেরেমের বনিতারা মেতে আছে পুরুষ বশীকরণ মন্ত্রে.....
রক্তের নির্মম কালিতে অকালের বিদ্যাপীঠ রপ্ত করে শিশু
বেণিয়া বাণিজ্য করে মেয়াদোত্তীর্ণ পণ্যের সম্ভারে,
সম্রাট রাজত্ব করে তন্ময় নিরোর বাঁশিতে....
মমির শরীরগুলো স্নায়ুর অনুভবে ঋজুতায় বিমূর্ত হলে.....
ধ্বংসযজ্ঞ থেকে তোমাদের প্রকৃত ফসিল আমরাই নেবো জাদুঘরে।’
(মমির বিক্ষোভ)
'নশ্বর দেহ যেন মৃত্যুর পর অবিনশ্বর থাকে' এ বিশ্বাসকে মূল্য দিয়ে মিশরীয় সম্রাটদের মমি করে রাখা হতো পিরামিডে। মিশরীয়রা মনে করত- ‘যতদিন রাজাদের দেহ রক্ষা করা যাবে ততদিন রাজারা স্বর্গে বাস করবেন।’
সপ্তাশ্চর্যের পিরামিডে প্রাণহীন দেহ মর্ত্যের ভূমিতে স্থান পেলেও পৃথিবীর সব ঘটনাপুঞ্জ থেকে আত্মা অমরলোকের কার্যকরণে অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়ে। এ কবিতায় মমি দুর্বল ও শোষিত শ্রেণির প্রতীক। যারা যুগে যুগে সবল আর অত্যাচারী শাসকগোষ্ঠি দ্বারা নিপীড়িত ও শোষিত হয়। প্রতিবাদী ও অন্যায়ের প্রতি বিদ্রোহী কণ্ঠকে যারা বদ্ধ কুঠুরিতে বন্দি করে রাখে তাদের জীবনতো মমির কফিনে আবদ্ধ থাকার সমান। অথচ এদের শ্রম ও রক্তে পৃথিবীর সভ্যতা-নগরী রচিত হয়। আর সেই সভ্যতার কারুকার্যখচিত প্রাসাদে সুরম্য ও বিলাসী সামগ্রীর সমাহারে ভোগবাদে মত্ত থাকে ভোগবাদীরা। পদে পদে নিয়মের কাঁটাতারে রক্তাক্ত হয়েছে অধিকারবঞ্চিত মানুষ। খেয়ালী রাজারা কালে কালে নেশাগ্রস্ত থাকে নিরোর বাঁশিতে। বেণিয়াদের মেয়াদোত্তীর্ণ পণ্যের সম্ভারে বাণিজ্য হয় রমরমা। চোখের উপর নিয়মের পর্দা ঝুলিয়ে দুর্বলদের রাখা হয়েছে নিয়ম নামের জাদুঘরে। মৌসুমি মেঘের উপর ভোগবাদী ও ষড়যন্ত্রকারীরা যে রাজত্ব বিস্তার করেছে- মমির শরীরগুলো (দুর্বল ও শোষিত শ্রেণি) স্নায়ুর অনুভবে জীবন্ত হলে সে রাজ্য একদিন আস্তাকুঁড়ে নিপাতিত হবে। আর তারপর কবির ভাষায়- ‘ধ্বংসযজ্ঞ থেকে তোমাদের প্রকৃত ফসিল আমরাই নেবো জাদুঘরে।’