শৈশব থেকেই কবিতা নিয়ে যার খেলা শুরু তিনি হলেন এ প্রজন্মের আলোচিত কবি শফিকুল ইসলাম। তিনি ১৯৮১ সালেই কবিতায় "বাংলাদেশ পরিষদ সাহিত্য পুরষ্কার"লাভ করেন। তার প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থগুলো হলো "এই ঘর এই লোকালয়","একটি আকাশ ও অনেক বৃষ্টি", "মেঘ ভাঙা রোদ্দুর", "তবুও বৃষ্টি আসুক" ও "শ্রাবন দিনের কাব্য"।
আজ আমি আলোচনা করবো কবি শফিকুল ইসলামের "তবুও বৃষ্টি আসুক "কাব্যগ্রন্থ নিয়ে। গ্রন্থটি কবির চতুর্থ কাব্যগ্রন্থ। ২০০৭ সালের ২১শে বই মেলায় ঢাকাসহ সর্বত্র ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছে । গ্রন্থটির প্রথম প্রকাশ ফাল্গুন ১৪১৩ বাংলা ও ফেব্রুয়ারী ২০০৭ ইংরেজী । আগামী প্রকাশনী ,৩৬ বাংলা বাজার ,ঢাকা থেকে প্রকাশিত। প্রচছদ এঁকেছেন ধ্রুব এষ। গ্রন্থটিতে মোট ৪১(একচল্লিশ)টি কবিতা স্থান পেয়েছে। গ্রন্থটির উৎসর্গ লেখা হয়েছে "সুলতাকে" নিয়ে। যেমনঃ--
'সুলতা'
তোমার অনিঃশেষ স্মৃতির উদ্দেশ্যে
নিবেদিত।
যেদিন আমি থাকবনা
সেদিনও আমার কবিতার পঙক্তিমালা
তোমার জন্য প্রতীক্ষার প্রহর গুনবে
অনন্তকাল ধরে...।
গ্রন্থটির প্রথম কবিতা খুবই চমকপ্রদ । কবিতাটিতে কবি বৃষ্টি আসার আহ্বান জানিয়েছেন। বাতাসে বহুদিন পর বৃষ্টির আভাস দেখা দিয়েছে। মনে হচেছ এখনই বৃষ্টি আসবে । সবার মনে তাড়াতাড়ি ঘরে ফেরার ব্যস্ততা থাকলেও কবির মনে বৃষ্টি ভেজার উদ্বেগ নেই। সকল আনাচার বৃষ্টিতে ভিজে পরিষ্কার হয়ে যাবার আকাঙ্খা ব্যক্ত করেছেন কবি। কিন্তু সবার আগে কবি আমাদের হৃদয়ে বৃষ্টি কামনা করেছেন । যেমন কবি উল্লেখ করেছেন-
"....তারও আগে বৃষ্টি নামুক
আমাদের হৃদয়ের মরুভূমিতে
সেখানে মানবতা ফুল হয়ে ফুটুক
আর পরিশুদ্ধ হোক ধরা,হৃদয়ের গ্লানি--
মানুষের জন্য মানুষের মমতা
ঝর্ণাধারা হয়ে যাক
বৃষ্টি সাথে মিলে মিশে
সব পিপাসার্ত প্রাণ ছুঁয়ে ছুঁয়ে
বয়ে যাক অনন্ত ধারাজল হয়ে।"
(বহুদিন পর আজ )
এই গ্রন্থটিতে কবি শফিকুল ইসলাম প্রেম-বিরহের বাস্তব চিত্র তুলে ধরেছেন। কবি বুঝাতে চেয়েছেন যে, ভালবাসার মানুষ চলে গেলে প্রেমিক কতটা অসহায় হয়ে যায়। প্রেমিকার অভাবে হৃদস্পন্দন থেমে যায়। কন্ঠ বাকরুদ্ধ হয়ে যায় অজানা ব্যথায়। আর নিজেকে মৃত বলে মনে হয় প্রিয়া কাছে না থাকলে। প্রেমিকার সকল স্মৃতি মনে পড়ে প্রিয়া চলে যাবার পরে । হৃদয়ে শুন্যতার গহ্বর সৃষ্টি হয় । বৃটেনের প্রয়াত 'রাজবধূ ডায়নার' প্রতি কবি কতটা অনুরাগী ছিলেন "ডি তুমি চলে গেছ" কবিতার মাধ্যমে তা কবি প্রকাশ করেছেনঃ--
"ডি তুমি চলে গেছ
আমার হৃদস্পন্দন থেমে গেছে
আমার কন্ঠ অজানা ব্যথায়
বাকরুদ্ধ হয়ে গেছে
আর মনে হচেছ আমিই মৃত।
আর তুমি ক্রমশ জেগে উঠছ
আমার অন্তরে অন্তরে ।
আমার ভেতর
অদৃশ্য ভূকম্পনে
যেন আজ এক বিশাল শুন্যতার
গহ্বর সৃষ্টি হয়েছে।"
(ডি তুমি চলে গেছ )
কবি শফিকুল ইসলাম "তবুও বৃষ্টি আসুক" কাব্যগ্রন্থে বীর যোদ্ধাদের জীবন গাঁথা উল্লেখ করেছেন খুব সুন্দর ও সাবলীল ভাষায় । বীর যোদ্ধারা দেশের স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছেন শত্রু সৈন্যদের হাত থেকে । কবি "একজন বীরযোদ্ধা" কবিতায় উল্লেখ করেছেন যে, একজন বীর সেনানায়ক রনাঙ্গন থেকে রণাঙ্গনে ছুটে সহযোদ্ধাদের প্রয়োজনীয় দিক নির্দেশ দিতে গিয়ে বিশ্রামের জন্য অবকাশ পাননা। বীর যোদ্ধারা গোলাগুলির শব্দে আর বারুদের গন্ধের ভিতর ও স্বদেশের মুক্তির স্বপ্ন দেখেন। বীর সেনানায়ক আত্মপ্রত্যয়কে সম্বল করে একদিন সত্যি সত্যিই বিজয় ছিনিয়ে আনেন । কিন্তু তিনি বিজয় ছিনিয়ে আনার পর শত্রু সেনার গুলিতে নয়, বিশ্বাসঘাতক সহযোদ্ধাদের গুলিতেই তিনি শাহদাত বরন করেন। কবি উল্লেখ করেছেনঃ--
"শুধূ মাত্র আত্মপ্রত্যয়কে সম্বল করে
একদিন সত্যি সত্যি বিজয়
ছিনিয়ে এনেছেন প্রিয় স্বদেশের জন্য,
বিশ্বের মানচিত্রে যিনি স্থান করে দিয়েছেন
স্বাধীন সার্ভভৌম রাষ্ট্র হিসেবে এই ভূখন্ডকে ;
সেই বীরযোদ্ধা মুক্তি সেনানী
একদিন কিনা নিহত হলেন তারই অধীনস্থ
কৃতঘ্ন উদ্ধত সেনাবাহিনীর হাতে
নিরস্ত্র অবস্থায়!
না, কোনো শত্রু সেনার গুলিতে নয়
তারই প্রিয় সহযোদ্ধাদের গুলিতে
তার বুক ঝাঁঝরা হয়ে গেল।"
(একজন বীর যোদ্ধা) ।
মা শব্দটি সকলের প্রিয় । মায়ের কথা মনে হতেই এক অজানা অনুভূতি জন্ম নেয় মনে । পৃথিবীতে মা-ই সবার অতি আপন ও প্রিয়জন । কবি এই কাব্যগ্রন্থের একটি কবিতায় মাকে ছায়াশীতল ,শাখা- প্রশাখা বি¯তৃত একটি ছায়াবৃরে সাথে তুলনা করেছেন। ছায়াবৃরে নীচে গেলে যেমন অফুরন্ত শান্তি পাওয়া যায় ,তেমনি মায়ের আচলতলে ও পাওয়া যায় স্বর্গের সুখ ও শান্তি । কবি বলেছেন মায়ের কথা মনে পড়লেই গরমলাগা চৈত্রের ভরদুপুরে মনে পড়ে একটি শান্ত-শীতল সরোবরের কথা। কবি উল্লেখ করেছেনঃ--
"মায়ের কথা মনে হলেই
আমার ছায়া শীতল
শাখা প্রশাখা বিস্তৃত
একটি ছায়া বৃরে কথা মনে পড়ে।
মায়ের কথা মনে হলেই
আমার মায়াবী জোছনার কথা মনে পড়ে
যার আছে আঁধার -নিবারক হিমেল আলো
অথচ উত্তাপ নেই।
মায়ের কথা মনে হলেই
চৈত্রের গরমলাগা ভরদুপুরে
একটি শান্ত শীতল সরোবরের কথা মনে পড়ে।'
(মায়ের কথা মনে হলেই )
কবি শফিকুল ইসলাম "তবুও বৃষ্টি আসুক" কাব্যগ্রন্থে প্রেমিকা 'সুলতাকে' নিয়ে কবিতা লিখেছেন । সুলতার পরশে কবি যেন অসুস্থ থেকে সুস্থ হয়ে যায়। "সুলতা বহুদিন পর আজ " কবিতায় কবি বুঝাতে চেয়েছেন যে, প্রিয়ার সান্নিধ্যের অভাবে প্রেমিক কতটা অসুখী। এখানে কবি বুঝাতে চেয়েছেন যে, প্রিয়ার সান্নিধ্য ছাড়া প্রেমিকের জীবনে নেমে আসে মৃত্যুহীন মৃত্যু। আবার অন্য আর একটি কবিতায় প্রিয়াকে ছাড়া যন্ত্রণায় হাবুডুবু খাওয়ার কথা বলা হয়েছে । যেমনঃ--
"তুমিতো জাননা
তুমিহীন সুস্থ জীবনে আমি কতটা অসুস্থ,
তুমি জাননা
তোমার সান্নিধ্যে সুখের অভাবে
আমি কতটা অসুখী।
তুমিহীন আমার জীবনে
নেমে আসে মৃত্যুহীন মৃত্যু।"
(সুলতা বহুদিন পর আজ )
আবার অন্য কবিতায় কবি লিখেছেনঃ--
"যন্ত্রণার অথৈ সাগরে হাবুডুবু খাই
আর ভাবি কেবল ভাবি
বিরহের এ তিক্ত গরল শেষে
তোমার মিলন-অমৃত-সুধা
আমি কি পাবনা
পাবনা এ জীবনে ?"
(সুলতা, বাসনার ফাগুনে)
কবি শফিকুল ইসলাম "তবুও বৃষ্টি আসুক " কাব্যগ্রন্থে" পিতৃস্নেহেরর বাস্তব চিত্র তুলে ধরেছেন। কবিকে কবির পিতা ট্রাফিক নিয়ম না জানা থাকায় হাত ধরে রাস্তা পারাপার করায়। সন্ধ্যার সময় খেলায় মেতে ঘরে ফেরার কথা ভূলে যাওয়ায় অনেক সময় কবির বাবা কবিকে অনেক খুঁজাখুঁজি করে হাত ধরে ঘরে ফিরিয়ে আনত। সাতার শিখতে নিয়ে গিয়ে কবির হাত ধরে রাখত তার পিতা। কিন্তু তিনি আজ কোথায় হারিয়ে গেলেন। এখন কবিকে আর সন্ধ্যায় ঘরে ফেরার কথা বলেনা বাবা । তিনি আজ চিরতরে চলে গেছেন। তাই কবি বলেছেনঃ--
"বাবা একদিন তোমার যে খোকাটি
চলার পথে ডানে বায়ে চলার
সঠিক ট্রাফিক নিয়মটি জানতো না বলে
তাকে হাত ধরে
জীবনের পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে
আজ তোমার সেই খোকাকে
পথের মাঝে একা ফেলে
বল তুমি আজ কোথায় চলে গেলে?
******************
এ কোন বিস্মৃতি আজ তোমায় পেয়ে বসেছে,
সব স্মৃতি বিস্মৃতির ওপারে
আজ তুমি চলে গেছ চিরতরে ।"
(বাবা একদিন তোমার যে খোকাটি)
এছাড়াও কবি এই কাব্যগ্রন্থে অনেক মূল্যবান কবিতা রচনা করেছেন । কবির রচিত অন্যান্য কবিতাগুলো হল,"তিনটি ক্ষতি/,কদিন থেকেই বুকের মধ্যিখানে/,তুমি কাছে ছিলে এতদিন/,সুলতা বাসনার ফাগুনে/,"যখন তোমার কথা ভাবি" সহ আরো উল্লেখযোগ্য বেশ ক'টি কবিতা । কবির রচিত প্রত্যেকটি কবিতাই হৃদয় স্পর্শ করে । কবিতাগুলো পাঠক হৃদয়ে ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছে। কবির চতুর্থ কাব্যগ্রন্থ "তবুও বৃষ্টি আসুক" একটি সফল ও সার্থক কাব্য গ্রন্থ ।