* আজকে আমার প্রথম আলোচনা সংস্কৃত ছন্দ সংলাপ উৎসর্গ করছি পরম শ্রদ্ধেয় কবি কোমল দাস দাদাভাইকে --
ছান্দংসি ছাদনাৎ।
ইতি যাস্কনিরুক্তম্
ছন্দসশব্দ আহ্লাদনার্থ চন্দধাতুসিদ্ধ
ইতি পাণিনি
চন্দয়তি হলাদয়াতীতি ছন্দঃ
চন্দে বাদেশ্চ ছঃ।
ইতি সিদ্ধান্তকৌমুদি
ছন্দঃ পদ্যে চ বেদে চেতি,
ছন্দোবদ্ধপদং পদ্যম।।
ইতি অমর সিংহ।
সংস্কৃত ছন্দ অধ্যয়নের প্রথম সোপান হল লঘু গুরু নির্ণয়ের নিয়ম জানা। এই লঘুত্ব বা গুরুত্ব স্বরবর্ণেরই ধর্ম। আমরা স্বরবর্ণেরই লঘুত্ব গুরুত্ব নির্ণয় করব। নীচে লঘু গুরু নির্ধারণের নিয়মগুলি সংক্ষেপে প্রয়োগানুকূল ভাবে দেওয়া হল –
1. হ্রস্বং লঘু – অ,ই,উ,ঋ,ঌ এই হ্রস্ব বর্ণগুলি লঘু বলে অভিহিত হয়।
2. সংযোগে গুরু – হ্রস্ব বর্ণের পরে সংযুক্ত বর্ণ থাকলে হ্রস্ব বর্ণটি গুরু বলে বিবেচিত হবে। তাই হ্রস্ব বর্ণ নির্ধারণের ক্ষেত্রে সাবধানতা অবলম্বন করতে হয়। সংযুক্ত বর্ণের পূর্ববর্তী স্বরবর্ণই গুরু হয়। সংযুক্ত বর্ণ বলতে মাঝে স্বরবর্ণের ব্যবধান না থাকা দুই বা ততোধিক ব্যঞ্জনবর্ণকে বোঝায়। যেমন – প্রজ্ঞা। প্র অর্থাৎ প্ র্ অ – এখানে শেষে বিদ্যমান স্বরবর্ণ অকার গুরু হবে, কারণ পরে জ্ঞ - জ্ ঞ্ অ – একটি সংযুক্ত বর্ণ, কারণ জ্ এবং ঞ্ এই দুই ব্যঞ্জনবর্ণের মাঝে কোনো স্বরবর্ণ নেই।
3. সানুস্বার, বিসর্গান্ত – অনুস্বার ও বিসর্গযুক্ত স্বরবর্ণ গুরু হবে। যেমন রামঃ বা রামং এখানে মগত(ম্ অ) অকারের পরে বিসর্গ বা অনুস্বার থাকার জন্য অকার গুরু হবে। অনুস্বার এর স্থানে যদি ম থাকে তাহলেও তৎসংযুক্ত স্বরবর্ণ গুরু হবে।
4. প্রহ্রে বা – হ্রস্ববর্ণের পরে সংযুক্ত বর্ণ প্র বা হ্র থাকলে প্রয়োজনবশতঃ হ্রস্ববর্ণ লঘু বলেও বিবেচিত হয়। এটা শুধু প্র ও হ্র এর ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য, তাও আবার প্রয়োজনবশতঃ। অর্থাৎ প্রয়োজন না থাকলে সাধারণ নিয়মানুসারে প্র ও হ্র এর পূর্ববর্তী হ্রস্ববর্ণ লঘুই হবে।
5. দীর্ঘং চ – আ,ঈ,ঊ,ৠ,এ,ঐ,ও,ঔ এই দীর্ঘ বর্ণগুলি গুরু বলে অভিহিত হয়।
6. পাদান্তে বিদ্যমান লঘুবর্ণও প্রয়োজনে গুরু হতে পারে আবার গুরুবর্ণও প্রয়োজনে লঘু হতে পারে।
লঘুর চিহ্ন হলো - ‘v’ (প্রাচীন – ‘।‘)
গুরুর চিহ্ন হলে – ‘-’ (প্রাচীন – ‘S’)
* দশগণ
সংস্কৃত ছন্দ অধ্যয়নের দ্বিতীয় সোপান হল দশগণের জ্ঞান। ম,য,র,স,ত,জ,ভ,ন,গ,ল – এই দশটি গণের জ্ঞান থাকা জরুরী। গ এবং ল এই দুটি গণ একটি করে অক্ষর দিয়ে গঠিত। বাকি আটটি গণ তিনটি অক্ষর দিয়ে গঠিত। এক্ষেত্রে একটি শ্লোক কণ্ঠস্থ করা প্রয়োজন। শ্লোকটি হল –
মস্ত্রিগুরুস্ত্রিলঘুশ্চ নকারো ভাদিগুরুঃ পুনরাদিলঘুর্যঃ।
জো গুরুমধ্যগতো রলমধ্যঃ সো’ন্তগুরুঃ কথিতো’ন্তলঘুস্তঃ।।১।।
গুরুরেকো গকারস্তু লকারো লঘুরেককঃ।২।
শ্লোকার্থ: ম গণে তিনটি স্বরবর্ণই গুরু হয়, ন গণে তিনটি স্বরবর্ণই লঘু হয়, ভ গণে আদিস্বর গুরু, য গণে আদিস্বর লঘু, জ গণে মধ্যস্বর গুরু, র গণে মধ্যস্বর লঘু, স গণে অন্ত্যস্বর গুরু, ত গণে অন্ত্যস্বর লঘু। ১।।
গ গণে একটি স্বর থাকে এবং সেটি গুরু, ল গণে একটি স্বর থাকে এবং সেটি লঘু। ২।।
সংস্কৃত ছন্দ সাধারণত অক্ষর বৃত্তির উপর নির্ভরশীল। সংস্কৃত একাক্ষরাবৃত্তি ও দ্বাক্ষরাবৃত্তি কখনো কবিতা হিসেবে প্রয়োগ হবে তা নাহয় নিয়তির কাছেই ছেড়ে দিলাম।
এবার আপনারাই বলুন একাক্ষর দ্বারা কবি তার কতটুকু ভাব ফুটিয়ে তোলবে? তথাপি একাক্ষরাবৃত্তি ছন্দ আছে তো। হ্যাঁ আছে, তা হলো বৈদিক যাগযজ্ঞে যেসব বীজমন্ত্র ব্যবহৃত হয় সেসব। এছাড়া কাপালিক, তামসিক, তান্ত্রিক ও মায়াবাদীরা এর ব্যবহার করেন।
সংস্কৃত একাক্ষরাবৃত্তি বা ১ বৃত্তীয় ছন্দ ১টি যথা -
শ্রী ছন্দ : এর গণ ১ টি
গণটি সংস্কৃতে গুরুবর্ণ
বনেদী ছন্দে রুদ্ধদল/বদ্ধাক্ষর/বদ্ধস্বর
আধুনিক বাংলায় একে ধিন বলা হয়ে থাকে।
প্রতীক : s বা - (ইংরেজি এস বা হাইফেন)
উদাহরণ: সংস্কৃতে : হ্রীং, শ্রীং, ক্লীং, ক্রীং, ঔঁং, ওঁম ইত্যাদি।
বাংলায় : রাম, নাম, গান ইত্যাদি।
সংস্কৃত দ্বাক্ষরাবৃত্তি বা ২ বৃত্তীয় ছন্দ ৪ টি যথা -
১. স্ত্রী ছন্দ : এর গণ ২ টি
সংস্কৃতে গুরু গুরু
বনেদী ছন্দে ব ব
আধুনিক বাংলায় ধিন ধিন
প্রতীক: s s বা - -
উদাহরণ: সংস্কৃতে : কৃষ্ণ ( কৃশ্ গু নো গু), বেমে ( বে গু মে গু)
বাংলায় : চঞ্চল (চন্ ধিন চল ধিন), সুনসান (সুন ধিন
সান ধিন) ইত্যাদি।
২. মধু ছন্দ: এর গণ ২ টি
সংস্কৃতে লঘু লঘু
বনেদী ছন্দে মুক্ত মুক্ত
আধুনিক বাংলায় তা তা
প্রতীক: v v বা | |
উদাহরণ: সংস্কৃতে : লহু( ল লঘু হু লঘু), জুঅ( জু লঘু অ লঘু)
বাংলায় : হাসি (হা তা সি তা), মাখা (মা তা খা তা ) ইত্যাদি।
৩.মহী ছন্দ: এর গণ ২ টি
সংস্কৃতে লঘু গুরু
বনেদী ছন্দে মুক্ত বদ্ধ
আধুনিক বাংলায় তা ধিন
প্রতীক: v s বা | -
উদাহরণ: সংস্কৃতে : লগো,( ল লঘু গো গু)
বাংলায় : বরণ (ব তা রণ ধিন), স্মরণ (স তা রণ ধিন) ইত্যাদি।
৪. সার ছন্দ : এর গণ ২ টি
সংস্কৃতে গুরু লঘু
বনেদী ছন্দে বদ্ধ মুক্ত
আধুনিক বাংলায় ধিন তা
প্রতীক: s v বা - |
উদাহরণ: সংস্কৃতে : গোবি ( গো গু বি লঘু) বেহু ( বে গু হু লঘু)
বাংলায় : শান্তি (শান্ ধিন তি তা), হালকা( হাল ধিন কা তা ) ইত্যাদি।
সহায়ক গ্রন্থ : ছন্দোমঞ্জরী - গঙ্গাদাস সূরী
পাণিনি শব্দশাস্ত্র - সত্যনারায়ণ চক্রবর্তী