ছন্দ শব্দের ব্যুৎপত্তি ছন্দ ঃ ছন্দস> ছন্দ৷ ছন্দ আনন্দ দান করে, এই ছন্দের মাঝে আনন্দ দানের ক্ষমতা রয়েছে বলেই ছন্দ নামকরণ করা হয়েছে৷

ছন্দ শব্দের অর্থ— ইচ্ছা৷ সাহিত্যের ছন্দ হলো ভাষাগত ধ্বনিপ্রবাহের সৌন্দর্য, রূপগত নয়৷ কবিতার ছন্দ ধরা পড়ে আবৃত্তি বা পাঠকালে৷ ছন্দের প্রধান কাজ হলো— ভাষার ধ্বনি প্রবাহের সৌন্দর্য সৃষ্টি করা৷

* প্রবোধচন্দ্র সেন বলেন— "শিল্পীত বাকরীতির নামই ছন্দ৷"

* অমূল্যধন মুখোপাধ্যায় এর মতে— "যেভাবে পদ বিন্যাস করলে বাক্য শ্রুতিমধুর হয় এবং মনে রস সঞ্চার হয়, তাকে ছন্দ বলে৷"

* তারাপদ ভট্টাচার্য ছন্দের সংজ্ঞায় বলেন— "ভাষার অন্তর্গত প্রবাহমান ধ্বনি সৌন্দর্যই ছন্দ৷"

* আব্দুল কাদির বলেন— "শব্দের সুমতি ও সুনিয়ন্ত্রিত বাণী বিন্যাসকে ছন্দ বলে৷"

ছন্দের মাধ্যমে কাব্যের রস সৃষ্টি হয়৷ সাহিত্যের কাব্যশাখায় ছন্দের সম্পর্ক অচ্ছেদ্য৷

*ছন্দ মতে অক্ষর —এর আলোচনা৷

বাংলা কবিতার ছন্দরীতিগুলো প্রধানত তিন প্রকার—
১/ স্বরবৃত্ত ২/ মাত্রাবৃত্ত ৩/ অক্ষরবৃত্ত৷

অন্যান্যরীতিগুলো মিশ্ররীতি বা মিশ্রবৃত্ত৷ যেমন:—
১/ স্বরমাত্রিক ২/ স্বরাক্ষরিক ৩/ মাত্রাক্ষরিক ৪/ প্রাস্বরিক ৫/ ত্রিবৃত্ত ৬/ মুক্তক৷

স্বরবৃত্ত:— ছড়া ও গানের ছন্দ হলো স্বরবৃত্ত, ঘনঘন যতি পড়াতে এ রীতি তাই দ্রুতলয়৷ অর্থাৎ দ্রুততার সাথে আবৃত্তি করা হয়৷
এই রীতিতে মুক্তাক্ষর বা মুক্তস্বর ১মাত্রা যা অন্য দুই বৃত্তের মতো কিন্তু বদ্ধাক্ষর বা বদ্ধস্বরও ১মাত্রা যেটি অন্য দুই বৃত্ত থেকে আলাদা৷

মাত্রাবৃত্ত:— মধ্যমলয় ছন্দ৷ এ রীতি স্বরবৃত্ত থেকে ধীর, অক্ষরবৃত্ত থেকে দ্রুত অর্থাৎ মধ্যম গতিতে আবৃত্তি করা হয়৷ এই রীতিতে মুক্তাক্ষর ১মাত্রা, বদ্ধাক্ষর ২মাত্রা৷

অক্ষরবৃত্ত:— ধীরলয় ছন্দ৷ এই রীতিতে প্রত্যেক অক্ষরকে টেনে টেনে সময় নিয়ে আবৃত্তি করা হয়৷ অক্ষরবৃত্তে মুক্তাক্ষর ১মাত্রা, বদ্ধাক্ষর শব্দের শুরু ও মধ্যে হলে ১মাত্রা, শেষে হলে ২মাত্রা৷

অক্ষর:— বাগযন্ত্রের সল্পতম প্রয়াসে একবারে শব্দের যে অংশ উচ্চারণ হয়, তাকে অক্ষর (syllable) বলে৷

অক্ষর দুই প্রকার, ১/ মুক্তাক্ষর, ২/ বদ্ধাক্ষর৷

১/ মুক্তাক্ষর(open syllable):— মুক্তাক্ষরকে স্বরান্ত অক্ষরও বলা হয়, আমরা মুক্তাক্ষর বলবো৷ মুক্তাক্ষর হলো- যে অক্ষর উচ্চারণে মুখ খোলা থাকে এবং তাকে যতো ইচ্ছা লম্বা করা যায়৷ কেউ মুক্তাক্ষরকে মুক্তদল, কেউ অযুগ্মধ্বনি বলেন৷

২/ বদ্ধাক্ষর(closed syllable):— বদ্ধাক্ষরকে ব্যঞ্জনান্ত অক্ষরও বলা হয়, আমরা বদ্ধাক্ষর বলবো৷ বদ্ধাক্ষর হলো— যে অক্ষর উচ্চারণে মুখ বন্ধ হয়ে যায় এবং ইচ্ছা মতো লম্বা করা যায় না৷ বদ্ধাক্ষরকে কেউ রুদ্ধদল, কেউ যুগ্মধ্বনি বলেন৷

উদাহরণ:-
১/ মুক্তাক্ষর— বাবা, দাদা, নানা, খালা, ফুফু, মা, জননী, হ্যাঁ, ইত্যাদি
এখানে দেখুন— "বা" অক্ষরটি উচ্চারণে মুখ বন্ধ হবে না, খোলাই থাকে আর "বা" অক্ষরকে যতো ইচ্ছা লম্বা করতে পারবেন; এভাবে সবগুলো অক্ষর৷ বা১+বা১=২ ( দুটিই মুক্তাক্ষর), দা১+দা১=২, না+না=২, খা+লা=২, ফু+ফু=২, জ+ন+নী=৩(তিনটি মুক্তাক্ষর)

২/ বদ্ধাক্ষর— আজ, লাজ, কাজ, তাজ, চঞ্চল, ফালগুন, নয়, খায় ইত্যাদি
এখানে দেখুন— "তাজ" দুটি বর্ণ হলেও অক্ষর একটি৷ উচ্চারণে মুখ বন্ধ হয়ে যায়, যতো খুশি লম্বাও করা যায় না৷ স্বরবৃত্তে বদ্ধাক্ষর ১মাত্রা, মাত্রাবৃত্তে ২মাত্রা, অক্ষরবৃত্তে কখনো ১মাত্রা আবার কখনো ২মাত্রা যা ওপরে আলোচনা করেছি৷ প্রবোধচন্দ্র অক্ষর না বলে দল বলেন৷

আমরা এখানে বুঝার সুবিধার্থে অক্ষর —এর মাত্রা স্বরবৃত্তের নিয়মে ধরবো বা গুনবো৷

আজ=১ (বদ্ধাক্ষর তাই), লাজ=১, কাজ=১ চঞ্চল= চন১+চল১(দুইটি বদ্ধাক্ষর), "ফালগুন"- ফাল১+গুন১=২ কারণ এখানে ২টি বদ্ধাক্ষর৷

"আজ" ১টি একক বদ্ধাক্ষর৷ স্বরবৃত্তে ১মাত্রা, মাত্রাবৃত্তে ও অক্ষরবৃত্তে ২মাত্রা৷

দুই প্রকার অক্ষরের মিশ্রিত উদাহরণ-
আমার=(আ— মুক্তাক্ষর, মার— বদ্ধাক্ষর)
আ১+মার১= ২মাত্রা স্বরবৃত্তে,
সত্য=(সততো) সত১+তো১= ২মাত্রা স্বরবৃত্তে৷

"আমার" এ শব্দে দুইটি অক্ষর বা দল আছে; আ+মার৷ স্বরবৃত্তে ২মাত্রা, মাত্রাবৃত্তে ৩মাত্রা, অক্ষরবৃত্তে ৩মাত্রা৷ নিয়ম অনুযায়ী স্বরবৃত্তে বদ্ধাক্ষর ১মাত্র৷ মাত্রাবৃত্তে বদ্ধাক্ষর যেখানেই হোক ২মাত্রা৷ অক্ষরবৃত্তে বদ্ধাক্ষর শব্দের প্রথমে ও মধ্যখানে ১মাত্রা, শেষে হলে ২মাত্রা, "আমার" শব্দে বদ্ধাক্ষর শব্দের শেষে আছে তাই ২মাত্রা হবে৷

"সত্য" এ শব্দে দুটি অক্ষর আছে সত+তো৷ স্বরবৃত্তে ২মাত্রা৷ মাত্রাবৃত্তে ৩মাত্রা৷ অক্ষরবৃত্তে ২মাত্রা, কারণ 'সত' বদ্ধাক্ষরটি শব্দের প্রথমে রয়েছে তাই অক্ষরবৃত্তের নিয়ম অনুযায়ী ১মাত্রা৷
অক্ষরবৃত্তে শব্দের প্রথমে ও মধ্যখানে বদ্ধাক্ষর বা বদ্ধদল থাকলেও দুই মাত্রা ধরার বিশেষ নিয়ম আমার লেখা অক্ষরবৃত্তের নিয়মে পাবেন৷

অনেকে যুক্তবর্ণকে যুক্তাক্ষর ভেবে ভুল করেন, যেমন— "দ্বন্দ্ব" উচ্চারণ—
(দনদো) দ্বন+দ্ব= ২টি অক্ষর৷ স্বরবৃত্তে ২মাত্রা, মাত্রাবৃত্তে ৩মাত্রা, অক্ষরবৃত্তে ২মাত্রা৷

শব্দের প্রথমে যুক্তবর্ণ থাকলে মাত্রা গণনায় তা ১ মাত্রা হয় সকল বৃত্তে৷ শব্দের শেষে বা মাঝেও যদি যুক্তবর্ণ আসে আর তার উচ্চারণ না হয় তবে মাত্রা হিসাবে আসবে না৷
আমি এখানে অক্ষরের কথা বলছি না, বলছি বর্ণের কথা৷ আরো কিছু উদাহরণ দেই, যেমন—

স্কুল=১,(বদ্ধাক্ষর)
স্মৃতি=( স্মৃ১+তি১, দুইটি মুক্তাক্ষর)
প্রাণ=১( র-ফলা থাকা সত্বেও এক অক্ষর আর তা বদ্ধাক্ষর)
সত্য=২, য-ফলার উচ্চারণ আছে সে জন্যে,
কিন্তু, ন্যায়=১ য-ফলার পূর্ণ উচ্চারণ নেই আর তা শব্দের প্রথমেও আছে,
ন্যায় —এর পূর্বে একটি বর্ণ যোগ করি—
অন্যায়=অন+নায়( দুইটি বদ্ধাক্ষর হয়ে গেলো তাই ২অক্ষর এবং স্বরবৃত্তে ২মাত্রা, মাত্রাবৃত্তে ৪মাত্রা, অক্ষরবৃত্তে ৩মাত্রা৷

মাত্রা:—
মাত্রা গণনার জন্য উচ্চারণ শর্ত,
ধ্বনি পরিমাপের একক'কে ছন্দশাস্ত্রে মাত্রা বলে৷

বিঃদ্রঃ প্রকৃত অর্থে ছন্দের ভাগ বা প্রকার হয় না৷ প্রকারগুলো বৃত্ত বা রীতির৷

—আশরাফুল ইসলাম
বড়ফেছি, জগন্নাথপুর, সুনামগঞ্জ, সিলেট৷