হাফপ্যান্ট-পরা সকালে মারবেল খেলে আসছিলাম; হঠাৎ চোখ যেতে দেখি
আমার পরনে বড়দের পোশাক; শরীরের আনাচকানাচ দেখেও বিস্মিত হই।
ফলে দীর্ঘশ্বাস ফেলার সুযোগ না দিয়েই পাখি হয়ে যায় আমার মারবেল
খেলা প্রহরেরা। হয়তো হেসেছিলেন কেউ; কিন্তু স্বভাব যায় না ম’লে-
এ কথাটির লাশ রাস্তার পাশে পুতে রেখে আসতে পারিনি। আর হয়তো-বা
সেকারণেই বুড়ো বটের পরামর্শ ভুলে পথের মধ্যে নেমে পড়ি আর এক খেলায়-
যে খেলায় বাজি ধরতে হয় নিভৃত দুপুরের যাবতীয় রোদ- নিঃসঙ্গরাতের
অনুরক্ত অন্ধকার। একখানা আকাশের লোভে হাতছাড়া হয়ে যায় আমার
গোপন ট্রেজারির প্রতিটি টাকা, প্রতিটি আধুলি, প্রতিটি সিকি; সদ্যকেনা
অলৌকিক ডানা নিয়ে উড়তে থাকি আমি-- আহা উড়ন! মাঝে মাঝে
অস্তিত্বে শিরশিরানি লাগলেও নিজকে ঘুড্ডি ভাবতে মন্দ লাগতো না।
হালকা বোধ হতেই একসময় খেয়াল হয় সুতো কেটে গেছে। ডুরিছেঁড়া
ঘুড়ি হয়ে গেছি। আমি উড়ছি আকাশের এক প্রান্ত হতে আরেক প্রান্ত-
সাদামেঘ ছুঁয়ে যাচ্ছে হাওয়ায় ব্যাক ব্রাশ হয়ে যাওয়া আমার চুল।
নিচে কুয়াশালাগা সাপের মতো নদী; ঝোপের সমান গ্রাম; আর জোনাকির
আসরের মতো রাতের শহর; কিন্তু নীলিমার টানের কাছে যে তুচ্ছ এসবই!
উড়ছি বটে কিন্তু কোথাও একদণ্ডও বসা হচ্ছে না। বিস্মিত যে আকাশ
তার নক্ষত্রের উঠোনে আমার জন্য এতটুকু পীড়ি পেতে রাখেনি।
হতাশায় ভেঙে পড়ে একদিন নিজেকে আবিস্কার করি নদীর কোলে বালির
উঠোনে; কোমরে প্রচণ্ড ব্যথা, বুকে যন্ত্রণা; চোখের সামনে বালুচর
জুড়ে প্রবাদভুক্ত ফুলরাশির সমবেত নৃত্য। আমার অবস্থা আঁচ করে
তীরবর্তী কৃষক ও জেলেগণ নানাজন নানা কথা বলেছিল- কেউ এমনও
বলেছিল দেখিস্---এবার সব ঠিক হয়ে যাবে--- ছাতিমের চূড়োয় রোদের
রঙ লেগেছে না! কেউ কেউ হয়তো ভেবেছিল সাতপাঁচ আরো কত কী !
মারবেল খেলা সকাল কিংবা রোদেলা দুপুর নিয়ে আর ভাবতে চাই না;
আমার ঘুড্ডি হওয়ার সিলেবাসও খতম; অথচ বৃষ্টিহীন বর্ষার বিকেলে
শহর রক্ষা বাঁধের কাছে দাঁড়ালে, পদ্মার জলভরা আকাশ আজও বলাকার
পাখায় আমন্ত্রণলিপি পৌঁছে দিয়ে যায়; ফুয়েল ভরতি বিমানের মতো আমি
শিহরিত সময় গুনি--এই বুঝি গর্জে ওঠে গরুড়ের ঘুম! আমার মারবেল-খেলা
উঠোন গেছে; আমার যৌবনের যাবতীয় আবাদযোগ্য জমি হাতছাড়া হয়ে
গেছে মিছিলপ্রেমিক পরবর্তী প্রজন্মের একদল কৃষকের কাছে; আর জলকর
সে তো আইন করেই নিয়ে গেছে সরকার। জোটা বলতে এক চিলতে বসতবাটি-
একটি বৃক্ষ আর দু’একটি কবুতর। আমি জানি-- বন্ধকসূত্রে আমার আর
ডানা ধার নেয়া সমীচীন হবে না, যদি খুইয়ে বসি! আমি না হয় কিছু একটা
হলাম- সাধুর পায়ের ধুলো কিংবা ভাতারমারীর বিলের উধাও খঞ্জনা,
প্রবাদের ডানা ঝাপটালে তারা যাবে কোথায়! আমি অবশ্য এও জানি যে
ধৃতরাষ্ট্রের প্ররোচনার কাছে তার কোনো ঋণ নেই; আর উজাড়-হয়ে-যাওয়া
রহস্যের বনবাদাড়ের দেশে আমিও নই যুধিষ্ঠিরের ফটোকপি; তাছাড়া
তামাদি আইনের যাবতীয় ধারা হাতে দুয়ারে দাঁড়িয়ে জুরিবোর্ড; অধিকন্তু
পুরোনো জানালায় ইন্দ্রধনুর রঙ মেখে ভালোবাসা ডাকে আজো জুয়াড়ি গলায়!