বাবা, পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছো তুমি দূরে-
যেখানে পৌঁছাতে পারে না-
পদার্থবিজ্ঞানের ইস্কেপ ভেলোসিটি
যেখানে পৌঁছাতে পারে না-
রোমান্টিক কবিতার অবারিত কল্পনা।
তুমি চলে গেছো বাবা,
তোমার খাটটা রয়ে গেছে---
জলশূন্য নদীর খোলস;
মেঘ ঝরে গেছে নিঃশেষে
রয়ে গেছে---
এক টুকরো পারিবারিক আকাশ
যার নিচে
সোনালি শস্যে ভরা ছড়ানো ছিটানো মাঠ
নদীর সুরেলা বুক
লাউয়ের মাচানের স্নিগ্ধছায়া
তিলাঘুঘুর অন্ত্যমিল কবিতা।


এতদিনে বুঝেছি বাবা, আমি এক--
ভাগ্যবান সন্তানের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত
আমার মারবেল-শৈশবকে তুমি
দিনেদিনে ভরে তুলেছিলে
কবিতার অলৌকিক সৌরভে,
রূপকথার লাল-নীল রোমাঞ্চে।
মসনবীর স্বর্গীয় সুবাস
দেওয়ানের রহস্যমাতাল ঘ্রাণ
মহারাজপুরের তিলখাজার মতো
গুলিস্তা-বোস্তার মচমচে মজা
হাতেম তাঈ ও আরব্য উপন্যাসের
লোমহর্ষক সাসপেন্স
তোমার খাটটাকে করে তুলেছিল
এক মুগ্ধবালকের স্বপ্নের আকাশে
ঝুলন্ত আনন্দের বাগান।
তুমি বলে যেতে--
আর আমি পাশে শুয়ে থেকে
কখনো উত্তেজনায় উঠে বসে
বালিশ চেপে ধরে বুকে
কখনোবা খাটের খুরা ধরে
মাথা দোলাতে দোলাতে
আরব্য উপন্যাসের বাদশার মতো
মাতাল শ্রোতা হয়ে উঠতাম
“ তারপর কি হলো আব্বু!
আর একটা বলো! আরেকটা।”


আচ্ছা বাবা, তুমি কি কখনো মাকে
শোনাতে এসব-
কাহিনী-কবিতা-রূপকথা?
অন্তত যখন সে সরল বালিকা বধু হয়ে এসেছিল
বোবা শ্রোতার দুটি কান আর ভয়ে ভরা
একটি কচিমন নিয়ে-
তোমাদের ইয়া বড় একটি যৌথ সংসারে!
কিংবা চেরাগ নিভে গেলে যখন সে তার
ছোট দেহখানি নিয়ে
গুটিসুটি বেঁধে শুয়ে পড়তো
কবিতায় গুঞ্জরিত
তোমার প্রাপ্তবয়স্ক বুকের পাশ ঘেঁষে!
শুনে কষ্ট পাবে বাবা, চৌদ্দটি নদীর জন্ম দিয়ে
মা এখন নিজেই মরা নদী!
তার শরীরের আনাচে কানাচে চরের উৎপাত
বুকে ভাঙনের বেদনা
রাতের নিঃসঙ্গতায় স্মৃতির ছলছলানি
বলা যায়----
স্মৃতিচারণই তার এখনকার দিনরাতের
একমাত্র সিলেবাস-
যেখানে তুমিই মূল অধ্যায়;
মা এখন তোমার স্মৃতির মালা
জপতে জপতে ভুলে যায়
তার ডানহাতের আঙুলের ডগায় খেলতে থাকা
রুপালি তসবী-দানাগুলোর কথা;
যাকে কাছে পায়, পাশে বসিয়ে শোনাতে চায়
অজস্র ঘটনার এলোমেলো পুনরাবৃত্তি-
এর বিয়ে-
ওর মৃত্যু,
স্বামীর ভালোবাসা,
পদ্মার ভাঙন..
এবং আরও কত কি !
কিন্তু কই, মা তো কখনো তোমার কাছে
কোনো কবিতা শোনার কথা বলে না!
“এই খাটে একবার শো-রে ব্যাটা!
এই খাটে শুয়ে থাকতো তোমার বাপ
সারাদিন খালি পড়ে থাকে,-
ভাল্লাগে না!"

মা’র অনুরোধে তোমার খাটে শুয়ে আছি বাবা,
শৈশব এসে জড়ো হয়েছে জানালায়
তোমার কণ্ঠের অজস্র কবিতা কলরব করছে
আমার কানের দুপাশে:--
“সৌভাগ্যের দ্বার খোলা অনিবার
আছে সকলের তরে
উদ্যোগী যে-জন কর্মপরায়ণ
প্রবেশিতে সেই পারে।’’


সূর্যাস্তের আলোর মতো পৃথিবী সরে যাচ্ছে দূরে..
আমি ছাড়া আর কোনো শ্রোতা নেই-
না  দোয়েল, না টিকটিকি!
কবিতা শুনতে শুনতে বুজে আসবে
আমার চোখ
উঁকি দিতে এসে মা নিভিয়ে দিয়ে যাবে লাইট
“ও রে আমার ধন, ঘুমাও !”,--
তখন যদি অন্ধকার ঘরটা
আরবসাগর হয়ে যায়
খাটটা কোনো সওদাগরি জাহাজ, এবং
ফ্যানের বাতাসে দোলা শাদা মশারিটা
রঙ-বেরঙের সাত ফর্দ পাল,
আর আমি স্বপ্নের সিন্দাবাদ হয়ে
ভাসতে ভাসতে
একবার এই ঘাটে
একবার ওই ঘাটে
একবার এই বন্দরে
একবার ওই বন্দরে
এমনি করে তোমার কাছে পৌঁছে যাই বাবা,
-যেখানে তোমার খালি পা ছুঁয়ে উচ্ছলিত
শিশিরসিক্ত ভোরের ঘাস
সোনার আলো মেখে ডানায়
পাখিরা গোল হয়ে ঘিরে আছে
তোমার চারপাশ
চারণকণ্ঠে তুমি শোনাচ্ছো তাদের-
অমৃতের বর্ণমালায় রচা খনার বচন-
“ যদি বর্ষে মাঘের শেষ,
ধন্য রাজার পুণ্য দেশ !..”
বেলা বাড়ার সাথে সাথে
তোমার হৃদয়ে বাজতে শুরু করবে-
মা’র ভালোবাসাভরা খুনসুটি-
“এনামুলের বাপ-নাস্তা খাবে না!
দুপ্পহর হয়ে গেল যে! খালি পড়া আর পড়া!”
আর আমি পাখিদের ভিড় ঠেলে
নিঃশব্দ চরণে
পরিচিত দুটি চোখের কেন্দ্রে পৌঁছে গিয়ে
তোমার হাতে তুলে দিই
মাকে ও তোমাকে উৎসর্গ করা
আমার ‘কবিতাসমগ্র’
“এই নাও বাবা ! মনে আছে তোমার,
আমার বাল্যপদ্য শুনে বলেছিলে-
‘আমার ছেলে একদিন কবি হবে!”
শুনে মা শুধু মুখ টিপে হেসেছিল,
দ্যাখো---
আমি কিন্তু সত্যি সত্যি কবি হয়েছি!’
তুমি কি “সাবাশ ব্যাটা !”--বলে
আমাকে জড়িয়ে ধরবে তোমার বুকে
এবং অতঃপর পরিচয় করিয়ে দেবে
একে একে
তোমার চারপাশে স্তব্ধবাক
স্বর্গকণ্ঠ পাখিদের সাথে?
নাকি  “তোমার মা, কেমন আছে?
তোমার মাকে নিয়ে আসোনি কেন?”---
বলে---
গভীর এক ডুব দিবে তোমার-
আশি বছরময়--
সরলসুখে সমৃদ্ধ দাম্পত্যস্মৃতির সাগরে?