বিভূতিভূষণ গোস্বামী
এখনো অমূল্য মাতৃভাষা সুরক্ষিত রাখতে রাত জেগে প্রহরা দিতে হচ্ছে অসমের দক্ষিণ প্রান্তের এক নিরিবিলি ভূখণ্ড বরাক উপত্যকার মানুষকে। প্রায় ছয় দশক হয়ে গেলো, এখনো নিরাপদ নয় এখানকার মানুষের মুখের ভাষা। এমনি এক পরিবেশে এখানে যে ক'জন কবি-সাহিত্যিক নিরলসভাবে বাংলা ভাষার চর্চা করে চলেছেন, এখানে বাংলার স্রোতস্বিনীকে চিরবহমান রাখার কাজে ব্রতী রয়েছেন এঁদের মধ্যে অতীন দাশ অন্যতম। এঁদের জন্যই নানা প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যেও এখনো যথাসময়ে কৃষ্ণচূড়ার রঙে মাতাল হয় বরাকের আকাশ-বাতাস। হয়তো এখানকার সাহিত্যকর্মীদের কাছ থেকে রবীন্দ্রনাথের লাবণ্য, জীবনানন্দ দাশের বনলতা সেন কিংবা সুরঞ্জনা, বা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের নীরার মতো কোনো ভার্চুয়াল মানুষীকে আমরা পাইনি, কিন্তু সেই জায়গার দখল নির্বিবাদে করে নিয়েছে বরাক, তার ব্যাথা-বেদনা, ক্রন্দন ও সংগ্রাম। অতীন দাশ মূলতঃ কবি। তবে তাঁর ঝরঝরে, মেদবিহীন গদ্যের জন্যও তিনি জনপ্রিয়। তাঁর রাজনৈতিক বিশ্লেষণ, আত্মকথা, কয়েকটি ছোটগল্প ইত্যাদির বিষয়বস্তু পাঠকের কেমন লাগে, তা সময় বলবে। কিন্তু প্রতিটি লেখায় যে গদ্য তিনি পাঠককে উপহার দেন তা সুখপাঠ্য। তিনি যখন লেখেন, "দেখতে দেখতে বন্ধুরা কিভাবে শত্রু হয়ে যায় -- এমন অভিজ্ঞতা সাংবাদিক ছাড়া আর ক'জনের আছে। যারা সাংবাদিকতার মাধ্যমে শুধু জীবিকার্জন নয়, স্বধর্ম পালন তথা দেশ ও সমাজের জন্যে কিছু করতে চান, -- তাদের মত দুর্ভাগা, এযুগে খুব কমই আছেন। " -- আমরা তাঁর এক অনবদ্য স্বীকারোক্তি লক্ষ্য করি, সঙ্গে পাই একমুঠো ঝরঝরে গদ্য। রয়েছে মনের গভীরে থাকা সত্যি কথাটিকে অকপটে বলে দেওয়ার ক্ষমতা --- "কবি লিখেছেন -- 'পৃথিবীর গভীর, গভীরতর অসুখ এখন।' কিন্তু অসুখটা কি পৃথিবীর, নাকি এই সুন্দর অনুপম পৃথিবীতে বসবাসকারী অজস্র জীবজন্তুদের মধ্যে সবচেয়ে সেরা বলে দাবীকরা মানুষ নামক প্রজাতিটির ? সন্দেহ নেই, এই পৃথিবীর যত অসুস্থ মানুষ রয়েছে -- তার সবচেয়ে অধিক সংখ্যকের বাস ভারতবর্ষে।" আমি তাঁর গদ্য ভালোবাসি অন্য আরো অসংখ্য পাঠকের মতো। কিন্তু জানি, অতীন দাশ গদ্যে বেঁচে থাকবেন না। তাঁকে সত্যিকারের জানার জন্য তাঁর কবিতা পাঠ জরুরি। তাঁর গদ্যের যখন বিবর্তন ঘটে রাজনীতির পালাবদলের সঙ্গে তাল রেখে, কবিতার ধারা নিরবিচ্ছিন্নভাবে বয়ে যায় আত্মানুসন্ধানের মধ্য দিয়ে। লাঠি হাতে শীতের সকালে দ্রুতপায়ে বরাকের তীর বরাবর হেঁটে চলা অতীন দাশ যখন বলেন --
"আমি নতজানু হব কার কাছে
কে আমার ঐহিক ঈশ্বর
বারংবার বিড়ম্বনা
ভগবান, তোমার বিকল্প কিছু আছে ?
..............
অবিশ্বাসী হব তবে ? নাস্তিক পামর ?
সেই ভালো, একিলাস
সময় অঙ্গনে খুঁজো সমস্ত উত্তর।" ---
অতীন দাশকে কি কিছুটা দ্বান্দ্বিক মনে হয় ? হয়তো বা। নাকি এটাই তাঁর আসল স্বত্বা ? ছিলেন মার্ক্সবাদী। আমরা দেখেছি গত অর্ধশতকে ক্রমেই তার সেই অনুভব ফিকে হয়েছে। উপত্যকার পাঠককূল লক্ষ্য করেছেন অতীনবাবু হয়তোবা এই মুহূর্তে এক দক্ষিণপন্থী ব্যক্তিত্ব। না, তাঁর কবিতা পাঠে এই ধারণা জন্মানো অসম্ভব। কবিতাকে তিনি সযত্নে আগলে রেখেছেন তাঁর রাজনৈতিক বিশ্বাসের ক্ষেত্র থেকে। শুধু যারা তাঁর রাজনৈতিক বিশ্লেষণ নিয়মিত পড়েন তারাই সময়ে সময়ে টের পেয়ে যান অতীনবাবুর সমাজ ও রাজনৈতিক ভাবনা এখন কোন খাতে বইছে। কিন্তু এতে তাঁর কবিতার পাঠকদের কিছু যায় আসে না। তবু কবির কবিতা নিয়ে আলোচনার ক্ষেত্রে তাঁর সমসময়ের প্রতি আলোকপাত খুবই জরুরি। সেটা জরুরি নয় যে তিনি শিলচরের কবি বা বিশ্বের অন্য কোনো প্রান্তের। তবু প্রশ্ন দেখা দেয়, অতীনবাবুর দীর্ঘদিনের বাসভূমি বরাক উপত্যকা তাঁর কবিতার কল্পচিত্রে কতটা ধরা পড়েছে। জানি ভাবপ্রবণতা ছাড়া কাব্যই হয় না। তবু বরাক নয়, বার বার সুরমা যেন ঘুরেফিরে আসে অতীন দাশের কবিতায়।
"ভাদ্রের কোমল জ্যোৎস্না সুরমার দুই কূলে হাসেঅজস্র শিশির ঝরে করুণা ছড়ায় ঘাসে ঘাসে।
......................
এক নদী, এক আকাশ নক্ষত্র তারার এক সুর
আমরা তবু এক নই এপারে ওপারে বহু দূর। "
ভারতের স্বাধীনতার সমবয়সী তিনি। এপারেও আছেন ৫০ বছরের বেশি কাল। জন্মভুমির সঙ্গে বিচ্ছেদের বেদনা আমরা বুঝি। তাঁর মতো আরো অনেক কবি-লেখকই এই বেদনা নিয়েই কাটিয়েছেন জীবনের বড় অংশ। তবু মনে হয় কাব্যে যেন কোথাও বরাক নামক ভূখণ্ড -- যা প্রকৃতির লীলাভূমি অথচ রাজনৈতিক ও ভৌগোলিক কারণে দুর্ভাগ্যপীড়িত, -- খানিকটা উপেক্ষিত থেকে গেছে এই শক্তিশালী কবির কবিতায়। এমন আহত প্রত্যাশার সঙ্গত কারণ আছে বৈকি। নিজে ইংরেজি সাহিত্যের কবি। তবু স্কটিশ গর্ব ও স্বতন্ত্র ঝেড়ে ফেলতে পারেননি স্কটল্যান্ডে জন্ম নেওয়া রবার্ট বার্নস। "O Scotia! my dear, my native soil!
For whom my warmest wish to Heaven is sent,
Long may thy hardy sons of rustic toil
Be blest with health, and peace, and sweet content!"
এমনকি তাঁর ইংরেজি ভাষার কবিতায় স্কটিশ উপভাষার মেদুরতা ছিল তীব্রভাবে উপভোগ্য। আমাদের বরাকের কবিদের অনেকেই এমনটি নন। শুধু মাতৃভাষাকে ভালোবাসলেই দেশকে ভালোবাসা যায় না, আমরা তাই মনে করি।
অথচ এমনও কি হয়, যখন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উপেন বলেন,
"নমোনমো নম, সুন্দরী মম জননী বঙ্গভূমি!
গঙ্গার তীর, স্নিগ্ধ সমীর জীবন জুড়ালে তুমি।"
আবার পাশাপাশি তাঁর ধিক্কার জাগে মনে ---
"ধিক্ ধিক্ ওরে, শত ধিক্ তোরে নিলাজ কুলটা ভূমি,
যখনি যাহার তখনি তাহার – এই কি জননী তুমি!"
কবি অতীন দাশ কালের আঘাতে সমসাময়িক জীবন ও সমাজকে বার বার বিপর্যস্ত হতে দেখেও নিজে যেমন হারিয়ে যাননি, তেমনি নব নব ব্যঞ্জনায় জীবনকে দেখতে শিখেছেন। তিনি আশাবাদী, কবির হৃদয়ের মর্মমূলে যে ক্ষীণ স্বচ্ছতোয়া সদা উৎসারিত তার প্রতিধ্বনি মেলে তার কোনো কোনো কবিতায়। দুৰ্ভাবনাকে সাময়িক বিভ্রম বলেই মনে করেন তিনি। ---
"অথচ আপন ছন্দে চলবে সংসার
ভাঙাগড়া, গড়ে উঠে নতুন পলিতে জনপদ
নির্ভর প্রার্থীরা সব ভেসে যায়
এমন তো হয় না কখনো
অযথাই দুর্ভাবনা, অযথাই অপচয়
সময় ও শরীর।"
আমরা মনে করি বরাক উপত্যকার ঐতিহ্যশালী সুদীর্ঘ কাব্যচর্চ্চার ইতিহাসে মেধাবী ও বর্ণময় কবিদের তালিকায় হয়তো একেবারে প্রথম দিকে নন কবি অতীন দাশ। তাঁর কবিতার সামগ্রিক যে আহ্বান এবং ব্যঞ্জনা, তার রসময়তা তুলনামূলকভাবে অন্যধারার বলেই মনে হয় যখন শক্তিপদ ব্রহ্মচারীর মত কোনো শক্তিমান কবিকে সামনে এনে দাঁড় করাই। শক্তিপদ অমোঘ ব্যঞ্জনায় বলেন --- "আর একবার একটা দেহাতি মেয়ে সমস্ত শরীরে ঢেউ তুলে হঠাৎ পাথরে পা ঠেকিয়ে সামনের দিকে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। আমি স্পষ্ট শুনতে পেলাম ওর আর্তনাদের মধ্যে কোনো প্রার্থনা ছিল না।"
শক্তিপদ ফের মায়ার জাল বিছানো ছন্দে লিখেন --
"তোমাতে নই, আমাতে নই, বিষয়ে আছি লিপ্ত লাগামছেঁড়া তিনটে ঘোড়া ভীষণ রকম ক্ষিপ্ত। বিজন মাঠ বধ্যভূমি ধরতে গেলাম, তখন তুমি সরে দাঁড়াও অশ্ববাহন, এবং বলদৃপ্ত রক্তে নাচাও মাতাল ঘোড়া তিনটে সমান ক্ষিপ্ত। "
উপমা, রূপক, উৎপ্রেক্ষায় শক্তিপদ যেখানে তাঁর সৃষ্টিকে অলংকৃত করতে নিবিষ্ট ছিলেন, সেখানে অতীন দাশকে যেন বেশ কেজো মনে হয়। তার কারণ অতীন দাশ তাঁর কাব্যেও নিজেকে বিষয়ী, আপাদমস্তক এক সমাজ সচেতন ও উদ্বিগ্ন নাগরিকের পরিচয় প্রকট করেছেন। কাব্যে তিনি মোটেও রোমান্টিক নন, ভাষাকে অলংকৃত করার সেই কাব্যধারা থেকে নিজেকে হয়তো সচেতনভাবেই দূরে রেখেছেন। মাতৃভূমির (অধুনা বাংলাদেশ) প্রতি, তাঁর "সূর্যসম পিতার" জন্য লেখায় বার বার ঝরে পড়েছে আকুতি। কিন্তু কখনো তাঁর কবিতায় লক্ষ্য করিনি এমন হৃদয় নিংড়ানো আকাঙ্খা -- "আবার আসিব ফিরে ধানসিড়ির তীরে — এই বাংলায় হয়তো মানুষ নয় —" (জীবনানন্দ দাশ)
কবি অতীন দাশ বরং কবিতায় সর্বদা নিজের চোখ-কান সজাগ রেখেছেন বয়ে চলা সময়ের প্রতি। কটাক্ষ করেছেন এই ব্যবস্থাকে, ক্রুর ঘটনাবলীকে। নিজে ছিন্ন-ভিন্ন হয়েছেন। আঘাত করেছেন এই সমাজকে। কটাক্ষ করেছেন লোভী-শ্বাপদদের। তিনি তাই লিখেন ---
"আমরা ভালোই থাকি, জেনে শুনে ভাবের ঘরে চুরি
দু'দিক সামলে চলি খাই দাই জমাই সম্পদ --
মজলিশে মিলাই গলা, ততটুকুই বলি -- যাতে থাকি নিরাপদ
সভ্যতার শীর্ষরেখ -- একুশ শতকের এই দ্বিতীয় দশক
বাড়ছে অজানা রোগ, ধর্মীয় সন্ত্রাস আর জাপানি মশক। "
এই সমাজেরই একজন -- সাংবাদিক, সমাজকর্মী অতীন দাশ কী ভাবে ভুলে থাকতে পারেন পৃথিবীর গভীর অসুখের কথা। এক সুনিশ্চিত প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের দিকে প্রবহমান আমাদের এই সবুজ পৃথিবী। অথচ সত্যি বড় উদাসীন আমরা। এইসব দুর্ভাবনা কবিকে কুরে কুরে খায় নিত্যদিন। তিনি নিরুদ্বেগ থাকেনই বা কী করে। ---
"চারদিকে হালচাল ভাল নয়
প্রকৃতিও নিতে পারে শোধ
এই সত্য বুঝে না নির্বোধ
অকস্মাৎ যদি ভাঙে মেঘ
তবে ধ্বংস, শুধু ধ্বংস
সুপ্ত থাকে অজানা উদ্বেগ। "
আবার বলেন --- "কিন্তু মানুষই মানুষের বড় শত্রুতাঁর প্রতিপদে কাঁটা, গলায় কলঙ্কের হার"
এই পরিবেশে নিছক রোমান্টিকতার সুযোগই বা কোথায় তাঁর। উদ্বিগ্ন কবি তাই বলেন ---
"বেড়াতে যাচ্ছো -- যাও
মনে রেখো, দিনকাল ভালো নয়
ভালো থাকা ভীষণ কঠিন
কখন যে কী ঘটে যায়
দুঃসংবাদ ছড়ায় বাতাস"
কবি অতীন দাশ তাঁর জীবনের ৭০ টি বছর অতিক্রম করেছেন সম্প্রতি। এই সময়ে জীবন সংগ্রামের পাশাপাশি তিনি যেমন উপত্যকায় এক সফল পাঠক আন্দোলন গড়ে তুলেছেন, তেমনি নিজেকে রাজনৈতিক ঘটনাবলীর সঙ্গে কলমের সাহায্যে রেখেছেন ওতঃপ্রোতভাবে জড়িত। তাঁর মতাদর্শে কেউ খুশি, কেউ নন। এটাই তো নিয়ম। হয়তো তিনি কাউকে খুশি করতে চান, কাউকে নয়। কিন্তু সবশেষে তো তিনি কবি -- যাদের মনুষ্য-গোত্র ভিন্ন অন্য কোনো পরিচয় হয় না। তাই "ভালোবাসার বিকল্প নেই" কবিতায় তাঁকে পাই এক মানবতাবাদী পরিচয়ে, যাঁর ধিক্কার বর্ষিত হয় সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে। তিনি বলেন --
"আমার সমস্যা প্রতিবেশীদের নিয়ে
যারা ধর্মের ষাঁড়দের প্ররোচনায়
মিস্ত্রি মজুরের তৈরি মন্দির মসজিদের কাজিয়ায়
ঈশ্বরের তৈরী মানুষের গায়ে হাত দেয়
আমার দুঃস্বপ্ন তাদের নিয়ে
যারা ধর্মের নামে প্রতিবেশীদের ঘরে আগুন দেয়
হত্যার খেলায় উন্মত্ত হয়....."
এই সমস্যাদীর্ণ জীবন ও ভূখণ্ডে তবু অনাগত ভবিষ্যতের স্বপ্ন রচনা করেন কবি। কবিতায় গড়েন ভালোবাসার এক অমলিন অঙ্গন। --
"অবরুদ্ধ অশ্রু চোখে
তবু স্বপ্ন রচি
জিঘাংসা ঘৃণার শেষে
ভালোবাসা হবে চিরজয়ী। "
এ যেন উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের প্রতিধ্বনি, "Kill me with spites, yet we must not be foes."
ঈশানবাংলার কাব্য-ভুবনে অতীন দাশের জায়গা তাঁর কবিতা না গদ্যের জন্য স্থায়ী হয়ে থাকবে, তার বিচার করবে ইতিহাস। অনেকে মনে করেন, বেশি করে রাজনৈতিক-নিবন্ধ-মনস্কতা তাঁর কাব্য আবহের জলীয়বাষ্প অনেকখানি শুষে নিয়েছে। হয়তো জীবিকার প্রয়োজনে এর কোনো বিকল্প ছিল না। কিন্তু আমরা এখনো আশ্বান্বিত হই যখন লক্ষ্য করি কবির আত্মবিশ্বাসী স্বীকারোক্তি --- "কবিতা নাছোড়বান্ধা
প্রভুভক্ত কুকুরের মত --
পায়ে পায়ে ফেরে
মহাপ্রস্থানের পথে যুধিষ্ঠির
অন্তিমেও বিশ্বস্থ সুহৃদ। "
xxxxxxx