কাক
হাঙরের মতো হা করে আছে বিরাট গহ্বর,
লকলকে জিভে চেটেপুটে খায় লেদ মেশিনটা
রৌদ্র ঝড় জলে মরিচাধরা লোহালক্কড়,
ভবনবল্লভীতে গাছের কড়কড়ে স্বরে ভেঙে পড়ে
রোদ-ঝলসান একজোড়া কাকের ডানা —
ক্লান্তিতে সে এই কংক্রীটে যখন আসে নেমে —যেন
হাওয়ার ধাক্কায় বুড়ো পাতা ঝরে পার্কের রাস্তায়।
কাক— এই কাক —
লৌহডানায় যান্ত্রিক নিয়মে অনেক উপর থেকে দেখে
নীচে পড়ে আছে শহরটা পতিতার শাড়ির মতন,
বিষাক্ত লালায় নদীগুলো আচ্ছন্ন হয়ে আছে
রোগক্লান্ত নগ্ন শিশুর অপুষ্টিতে ভোগা দেহের মতো।
কাক — এই কাক —
দেখে স্তূপে স্তূপে জমে আছে কলঙ্কের বোঝা অলিতে গলিতে,
স্তুপ ঘেঁটে ঘেঁটে দেখে রোজ, যত জঞ্জাল সব অহেতুক —
খাবার কোথাও নাই। হাপরের মতো ডানা ঝাপটিয়ে উড়ে যায়
অট্টালিকার পলেস্তারাখসা চিলেকোঠায়, মৌন ধ্যানীর মতো
নিশ্চুপ বসে বসে ভাবে —অপ্রয়োজনের এতো আয়োজন।
এই কাক—
অনেক ভিজেছে গলিত পঁচা খাবারের আশায় কত ডাস্টবিনে
অনেক আষাঢ়ে, অনেক শ্রাবণে। অনেক পুড়েছে নগরীর
ঝলসে যাওয়া গ্রীষ্মে বস্তির টিনের চালে, আয়নার মতো
মসৃন পিচঢালা রাস্তায়, ভারতে, মিশরে, এথেন্সে, মেসোপোটেমিয়ায়—
আরও কত স্থানে কত যুগ যুগ ধরে।
কাক—এই বার্ধক্যে নত কাক —
চোখ বুঝে ঝিমোয় বাদুরের মতো পাতাশূন্য এই মহানিম গাছে।
চোখে তার রোদের রূপালী ঝলকের মতো তারুণ্য আর নেই,
নখে আর নাই প্রথম যৌবনের বলিষ্ঠ প্রত্যয় — ঠোঁটে তার নেই আর
শক্তি আগের, কেবল আছে ক্লান্তি দেহমন জুরে আর অবসাদ,
অবসাদ, অবসাদ— পাহাড়!
কবি ‘কাক’ কবিতায় নাগরিক জীবনের যান্ত্রিকতা, নৈতিক অবক্ষয় এবং মানবজীবনের অর্থহীনতার যে গভীর চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন, তা আসলে কবির অস্তিত্বসংকটেরই প্রকাশ। এই অস্তিত্বসংকট ব্যক্তিগত দার্শনিক উপলব্ধি থেকে উদ্ভূত হলেও নাগরিক পরিবেশের সংকটময় বাস্তবতার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কবিতায় কাক কেবল একটি পাখি নয়; এটি একটি প্রতীক, যা আধুনিক সমাজের হতাশা, ক্লান্তি, এবং চিরন্তন সংকটকে উপস্থাপন করে।
অস্তিত্বসংকট হলো মানুষের জীবন ও সত্তার অর্থ নিয়ে এক গভীর প্রশ্ন। এটি বিশেষত তখনই প্রকট হয়, যখন ব্যক্তি উপলব্ধি করে যে তার চারপাশের পরিবেশ শূন্যতা এবং অর্থহীনতায় আচ্ছন্ন। কবিতায় কাককে প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করে কবি এই সংকটকে নাগরিক জীবনের প্রেক্ষিতে তুলে ধরেছেন।
"লৌহডানায় যান্ত্রিক নিয়মে অনেক উপর থেকে দেখে" কাক এখানে এক উদাসীন পর্যবেক্ষকের ভূমিকায়, যান্ত্রিক শহরের নিষ্প্রাণ ও অর্থহীন বাস্তবতাকে দূর থেকে প্রত্যক্ষ করছে।
"পতিতার শাড়ির মতন" শহরের উপমা, এটি নগরজীবনের কলুষতা ও নৈতিক অবক্ষয়ের প্রতীক। নগর সভ্যতার এই নৈতিক অধঃপতন কবির অস্তিত্বের সংকটকে আরও গভীর করে তোলে। কাকের এই দৃষ্টিভঙ্গি আসলে নাগরিক জীবনের যান্ত্রিক সংকট এবং কবির অন্তর্দহনকে তুলে ধরে।
কবিতায় নাগরিক জীবনকে এমন এক স্থান হিসেবে দেখানো হয়েছে, যা ব্যক্তির শারীরিক ও মানসিক শক্তিকে শুষে নেয়। "অপ্রয়োজনের এতো আয়োজন" আধুনিক শহরের বাহ্যিক চাকচিক্য এবং অভ্যন্তরীণ শূন্যতা এখানে স্পষ্ট। নাগরিক জীবনের প্রতিটি আয়োজন অর্থহীন, যা অস্তিত্বের সংকটের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। "নগরীর ঝলসে যাওয়া গ্রীষ্মে বস্তির টিনের চাল" নগর জীবনের দুঃসহ চিত্র এখানে ফুটে উঠেছে। এটি মানুষের ক্লান্তি, দারিদ্র্য এবং পরিবেশের প্রতিকূলতাকে ইঙ্গিত করে। এই ক্লান্তিকর বাস্তবতা কবির অভ্যন্তরীণ বেদনার সঙ্গে মিলে যায় এবং তার অস্তিত্বের সংকটকে আরও প্রকট করে তোলে।
কাকের বার্ধক্য আসলে মানুষের জীবনযাত্রার ক্লান্তি, অবসাদ এবং সময়ের ভারকে চিত্রায়িত করে। "চোখে তার রোদের রূপালী ঝলকের মতো তারুণ্য আর নেই" তারুণ্যের শক্তি ও প্রত্যয় হারিয়ে গিয়ে কেবল ক্লান্তি আর অবসাদ রয়ে গেছে। "অবসাদ, অবসাদ—পাহাড়!" অবসাদ শব্দটির পুনরাবৃত্তি নাগরিক জীবনের অর্থহীন সংগ্রামের গভীর হতাশা প্রকাশ করে।
কাকের এই অবস্থা কবির ব্যক্তিগত অস্তিত্বের সঙ্কটেরই প্রকাশ। আধুনিক নগর জীবনের শূন্যতা তাকে ক্লান্ত করে তুলেছে, এবং জীবন থেকে তারুণ্যের ঝলক হারিয়ে গিয়ে কেবল অবসাদ রয়ে গেছে।
কাকের উপস্থিতি শুধু একটি নির্দিষ্ট সময় বা স্থানের নয়, এটি সভ্যতার দীর্ঘ ইতিহাসের সাক্ষী। "ভারতে, মিশরে, এথেন্সে, মেসোপটেমিয়ায়"প কবি এখানে দেখিয়েছেন যে সময় ও স্থান বদলালেও মানুষের অস্তিত্বের সংকট একই রকম রয়ে গেছে। কাক সভ্যতার প্রতিটি পর্যায়ে একই সংকটের সাক্ষী থেকেছে, আর এটি মানবজীবনের অস্তিত্বগত প্রশ্নগুলোকেও চিরন্তন করে তুলেছে। কবি নিজেকে এই দীর্ঘ ইতিহাসের অংশ হিসেবে দেখছেন, যেখানে ব্যক্তির অস্তিত্বের শূন্যতা সময়ের স্রোতে মিশে গেছে।
কাকের নিঃসঙ্গতা এবং "পাতাশূন্য মহানিম গাছে" বসে থাকা নাগরিক পরিবেশে প্রকৃতির বিলুপ্তির প্রতীক। "গলিত পঁচা খাবারের আশায় কত ডাস্টবিনে" কাকের জীবনসংগ্রাম মানুষ ও প্রকৃতির চিরন্তন সংঘাতের প্রতিফলন। নাগরিক জীবনে মানুষের অস্তিত্ব প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে, যা অস্তিত্বসংকটকে আরও তীব্র করে তুলেছে।
কবি এই সংঘাতে প্রকৃতির পক্ষে থাকলেও নাগরিক বাস্তবতার অন্তর্নিহিত যন্ত্রণা তাকে প্রতিনিয়ত বিচলিত করে।
কবিতার প্রতিটি স্তবকেই জীবনের অন্তর্নিহিত অর্থহীনতা এবং নাগরিক জীবনের অন্তঃসারশূন্যতাকে তুলে ধরা হয়েছে। "স্তূপে স্তূপে জমে আছে কলঙ্কের বোঝা" সমাজের অবক্ষয়, কলুষতা এবং অপচয় ব্যক্তিকে তার নিজস্ব অস্তিত্বের দিকে প্রশ্ন করতে বাধ্য করে। "খাবার কোথাও নাই" এটি শুধু কাকের শারীরিক ক্ষুধা নয়, বরং মানবজীবনের গভীর অভাব এবং অপূর্ণতার প্রতীক।
এই অর্থহীন সংগ্রাম কবিকে অস্তিত্বের শূন্যতার মুখোমুখি দাঁড় করায়।
‘কাক’ কবিতাটি একাধারে নাগরিক জীবনের যান্ত্রিক সংকট এবং কবির অস্তিত্বের শূন্যতা ও হতাশার প্রকাশ। এখানে নাগরিক বাস্তবতা কেবল বাহ্যিক নয়, এটি কবির অভ্যন্তরীণ জীবনেও গভীর প্রভাব ফেলেছে। কাকের ক্লান্তি, অবসাদ, এবং বার্ধক্য কবির অস্তিত্ব সংকটেরই রূপক।
কবি নাগরিক জীবনের বাস্তবতাকে অস্তিত্বের সংকটের সঙ্গে মিলিয়ে গভীর দার্শনিক বোধের প্রকাশ ঘটিয়েছেন। ‘কাক’ এখানে জীবনের শূন্যতা, ক্লান্তি, এবং অর্থহীনতার প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা আধুনিক নাগরিক কবিসত্তার এক নিখুঁত প্রতিচ্ছবি।