পৃথিবী তার সর্বাঙ্গে ধারণ করে আছে এক অনিবার্য রহস্য, এক অপ্রকাশিত আহ্বান; এক অব্যক্ত বেদনা ; শিল্পের অবলোহিত বিচ্ছুরণ দৃষ্টিগ্রাহ্য জগতের দূর্গম সীমানায় প্রচ্ছন্ন ভাবাবেগে প্লাবিত হয় — প্রকাশের তাড়নায় অন্তর্জগতের মায়াদর্পণে প্রতিনিয়ত প্রতিবিম্বিত হয় অগুণিত ভাবসমগ্র । প্রাণ আকুল হয়ে ওঠে প্রকাশের তাড়নায়। যা দৈনন্দিন আটপৌরে কথামালায় ব্যক্তকরণ দুরূহ — কবিহৃদয় সেই দুরূহ কথামালাকেই প্রকাশ করে এক বিমূর্ত ভাষায় ; এ ভাষা কেবলই কবিতার বশ্যতা স্বীকার করে। জগতের বাস্তবপ্রতিমূর্তি শিল্পীর ইন্দ্রিয় জগতে বিশেষ ভাবালুতার সৃষ্টি করে যার মূর্তরূপ কেবল সংগীত কিংবা কবিতার অধীনতা স্বীকার করে। পৃথিবীর বহু অগম্য প্রান্তে, অটল পর্বতে, নির্জন বনে কিংবা অতলান্তিক মহাসমুদ্রে যে মনি মুক্তার বিস্তর সমারোহ মানবের অজ্ঞাতসারে লুকায়িত আছে তেমনি কবিতার মহীরুহে আছে অসংখ্য কবির অনবদ্য কবিতাবলি, অগম্য সেই কবিতার জগৎ অনন্তকাল ধরেই অনাবিষ্কৃত। বস্তুত ঘটনার পারম্পর্যে দৈবের সন্ধিক্ষণে আমাদের চোখে কোনো বিশেষ মুহূর্তে বিশেষ ঘটনার সূত্র ধরে এমনই অজ্ঞাত কবির কবিতার জগৎ উন্মোচিত হয় যার কাব্যজগৎ বিশেষ ভাবরসে হৃদয়াকাশ আচ্ছন্ন করে রাখে। আলোচিত প্রবন্ধের বিষয়বস্তু চরু হকের কবিতায় 'নৈঃশব্দের পদধ্বনি'। এ আলোচনায় বিশেষভাবে কবির 'পাতা ঝরার শব্দ পাই' (২০০৯) কাব্যগ্রন্থটিই আলোচ্য।
কবিতাটির নামকরণ নিয়ে কিঞ্চিৎ আলোচনা অপরিহার্য। কবিহৃদয় তার কবিতার বিস্তৃত ভাবের কেন্দ্রাভিগামী একটি বিশেষ ভাবকে কাব্যগ্রন্থের নামরূপে উপস্থাপন করে, যদিও অনুভুতির নামকরণ করা দুঃসাহসিক প্রয়াস, কবিচিত্তের নিভৃতচারী হৃদয়ে যে ভাবের অভিক্ষেপে বিহ্বলপ্রায় অনুভূতিগুলো অন্তর্দেশে এক গভীর বেদনাবোধ জাগ্রত করে সেই বেদনার বিমোক্ষণ অপরিহার্য হয়ে পড়ে এবং এই বিমোক্ষণের সুমহান উদ্দেশ্য নিয়েই হৃদয়জাত অনুভূতি কাব্যদেহে স্থান লাভ করে। ' পাতা ঝরার শব্দ পাই ' কাব্যগ্রন্থটিতে কবিচিত্তের বিমোক্ষণ প্রত্যাশা পলায়মান জীবনবোধকে পরাবাস্তববাদী দৃষ্টিতে আপন অন্তরে ধারণ করে আছে (শেষাংশে আলোচ্য) ; যে জীবন বিগত হয়েছে অথচ হৃদয়ে রেখে গেছে এক গভীর ক্ষত — সেই জীবনকে, জীবনের গল্পকে কবি তার হৃদয়ে আজও নির্জন প্রকোষ্ঠে তালাবদ্ধ করে রেখেছেন অত্যন্ত সচেতনতার সাথে। তারপরেও কবির সচেতন সত্তার এর আড়ালে অবচেতনে যে নৈঃশব্দের পদধ্বনি শুনতে পাই তা তার কবিতার শব্দচয়নের আড়ালে বিবিধ সতর্কতার সাথে আত্মগোপন করে আছে। ইংরেজি ভাষায় একটা প্রাচীন প্রবাদ আছে —
Where are you going, Ezzy?
I don’t know —
Ask my horse.
কবি তার আপন হৃদয়ে উদ্ভূত ভাব সম্পর্কে যে সবসময় সতর্ক থাকে তা কিন্তু নয়,আমাদেরকে কবির কবিতারূপ সরসীতে ডুব দিতে হয়, কবির কাব্য কখন কোনদিকে গমন করে তা কবিচিত্তকে প্রশ্ন না করে কবিতাকেই যদি প্রশ্ন করা হয় তবেই যথাযথ উত্তর পাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। যন্ত্রীর মুখাবয়বে বিহ্বল না হয়ে যন্ত্রের সুরলহরী শ্রবণ করলেই সংগীত এবং সুরের গূঢ়ার্থ অনুধাবনযোগ্য হয়। নৈর্ব্যক্তিক দৃষ্টকোন কোনো কবির পক্ষে জীবনকে পর্যবেক্ষণপূর্বক কাব্য রচনা সম্ভবপর নয় বিশেষত আত্মহত অনুভূতির অনুধ্যানই কবিতা। চরু হকের কবিতায় ও নৈর্ব্যক্তিক পর্যবেক্ষণ দুর্লক্ষ্য। 'পাতা ঝরার শব্দ পাই ' এই নামকরণের পশ্চাতে ধ্বনিত - প্রতিধ্বনিত হয় এক গভীর বেদনাবোধ। সাহিত্যে 'ঝরে যাওয়া' প্রসঙ্গটি নৈঃশব্দের প্রতিনিধি, ঝরে যাওয়া বস্তুত স্তব্ধ হয়ে যাওয়া, জীবনের অন্তরালে চলে যাওয়ার দ্যোতক। এ কাব্যে কবিহৃদয়ের পুঞ্জীভূত কত আশা, ভালোবাসা, প্রত্যাশার ঝরে যাওয়ার শব্দে কবিতার পঙতিগুলো হয়ে ওঠে বিষাদ বাষ্পে ভারাক্রান্ত। 'ঝরা পাতার শব্দ শুনি' চেতনার পদধ্বনি, নৈঃশব্দের স্তিমিত অনুভব,অতৃপ্ত হৃদয়ের অন্তর্দাহ এবং চেতনালোকে বাস্তবকে প্রতিষ্ঠিত করে এক পরাবাস্তব অনুভববের জগতের বিনির্মাণ নিয়ত পরিদৃশ্যমান।
চরু হকের 'পাতা ঝরার শব্দ পাই ' কাব্যগ্রন্থে যে বিষয়টি প্রাসঙ্গিকভাবে এবং অত্যন্ত প্রবলভাবে প্রতীয়মান হয় নিঃসন্দেহে তা নৈঃসঙ্গবোধ। কবিসত্তা এক সুগভীর নিঃসঙ্গ যাপিত জীবনের অন্তর্লোকে বিচরণ করে নিরন্তর পলাতকা জীবনের বিগত দিবসগুলোকে বর্তমান সময়ের ঘাত-প্রতিঘাতে ক্ষত বিক্ষত রূপে আবিষ্কার করে চলেছেন —
এত অন্তর্লীন সংঘাত
পালক খসার মত খসে পড়ছে চারদিকে।
অভয়ারণ্যের গান থেমে গেছে বহু আগেই [......]
[এখনি সময়, পাতা ঝরার শব্দ পাই ]
জীবনের গভীরে আছে বোধের এক দুর্লঙ্ঘ জগৎ , আগেই উক্ত হয়েছে কবিতার কাছে কবি নিতান্ত অসহায়, কবিতা ঠিক কবিকে ঐ ভাবেই উদ্দেশহীন গন্তব্যে নিয়ে যায় যেমন করে ইংরেজি প্রবাদের ঘোড়া 'ইজি' কে বহন করে নিয়ে যায় দুরধিগম্য চেতনার এক জগতে। ভাবের বিহ্বলতা কবিচিত্তের নিবিরতম প্রদেশের কথাটুকু গোপন করার স্পর্ধাকে পদানত করে, ফলত কবি তার অজান্তেই রূপক, চিত্রকল্পের আবরণে খুলে দেন তার অন্তর্নিহিত চেতনার সিংহদুয়ার। উদ্ধৃত পঙতিমালায় কবি হৃদয়ে উদ্ভূত দ্বন্দ্বের আভাস পরিদৃষ্ট হয়, পালক খসার মত এই দ্বন্দ্ব খসে পড়ার রূপকটি দ্বন্দ্ব কিংবা মনোজাগতিক সংঘাত থেকে অবমুক্তির স্বীকারোক্তি নয়, বরং পালক খসে পাখি যেমন তার স্বাতন্ত্র্য অর্থাৎ আকাশবিহারের বাসনা বঞ্চিত হয়ে জীবন মরণের সন্ধিক্ষণে ঝুলে থাকে, তেমনি কবির অন্তর্লীন সংঘাত তার হৃদয়কে কোনো এক বিস্রস্ত ভাবনায় নিমগ্ন করে রাখে। পালক খসা বিহঙ্গের নিকট উড়ন্ত বিহগের কোলাহলকে হলাহল বলেই মনে হবে, তাই অরণ্যের এই গান থেমে যাওয়ার নান্দনিক চিত্রকল্পটি কবিহৃদয়ের বিহ্বলপ্রায়, সংঘাতময় হৃদয়ে নৈঃশব্দের প্রতিনিধিত্বকারীরূপে আবির্ভূত হয়। এই নৈঃশব্দ কবিহৃদয়ে রণন-অনুরণনের অন্তর্গত প্রতিধ্বনি , সেই পথ গভীর নির্জন পথ, নিস্তব্ধ গ্রীষ্মের দূপুরের বায়ুহীন স্তব্ধতার মতই উত্তপ্ত এবং অসহ্য এক জগৎ।
কবির হৃদয় সরসীতে যে ব্যথার উৎপল সদা দোদুল্যমান , হৃদয়ে বেদনার প্রাবল্য তা বিশেষ ভাবে ব্যঞ্জিত হয়েছে 'অন্ধরাত' কবিতাটিতে। কবির বিপরীতে দণ্ডায়মান অদৃশ্য কোনো একজনের উপস্থিতি পরিলক্ষিত হয়,
তোমার সীমানা আমাতেই মেশে
আমার সীমানা দূর নীলাকাশে।
মনের কি বা দরকার বলো
মন শুধু খান খান হয়ে যায়
যে জলরং মাটিতে গড়ায়
যে অনাবিল হু হু ধানক্ষেত
যেন এই পথ শুধু হাহাকার
জলতরঙ্গ বোনা।
[অন্ধরাত, পাতা ঝরার শব্দ পাই ]
সীমা, অসীমের যে চিরন্তন দ্বন্দ্বে মানবাত্মা বিক্ষুব্ধ — উদ্ধৃত পঙক্তিমালায় তার সদম্ভ বহিঃপ্রকাশ। কবিসত্তা আপন অন্তরে বিলীয়মান বলে যে সত্তাকে ধারণ করেছেন অথচ সেই সত্তার সীমানার বহিঃপ্রদেশে কবিসত্তার স্থিথি আপাত বিরোধাভাস সংকটে উত্তীর্ণ । কবি যে সত্তাকে আপন অন্তঃপুরে, অন্তঃকরণে অনুভব করেছেন অথচ একইসাথে সেই সত্তা কবিহৃদয়ের বহির্মুখে বিচরণশীল। কবিহৃদয়ের অভ্যন্তরে যে চিরন্তন দ্বন্দ্ব, গ্রহণ-বর্জন বিসর্পিত দ্বন্দ্ব পরিশেষে বিসর্জনের সর্পিল পথ পরিক্রমায় বাহ্যজগৎ থেকে মহামুক্তি লাভ করলেও কবির অন্তর্লোকে কোথাও সেই বিসর্জিত মূর্তির পূজার্চনা আজও অবসিত হয়নি। আজও কোনো গভীর নির্জন সময়ে চেতনার বেদিতে ফুলে, মাল্যে, প্রেমে, চেতনে, অবচেতনে নিরন্তর পূজার হোমে অগ্নি স্ফুলিঙ্গ সৃষ্টি হয়, সমস্ত লোকচক্ষুর আড়ালে একান্ত সংগোপনে দেহাতীত এক জগতে কল্পলোকে কবি সত্তা বিচরণ করে এবং বাস্তবজগতে যখন পুনরায় ফিরে আসে তখন হৃদয় জুরে বিরাজ করে এক মানসিক হাহাকার। বস্তুজগৎ সসীম এবং চেতনা জগৎ অসীম, বস্তু জগতে মানবমন যুক্তির, কার্যকরণের পদতলে মাথা অবনত করতে বাধ্য হয় কিন্তু চেতনার রাজ্যে সব পাওয়া যায়, যা কখনো পাওয়ার নয় সেই অপ্রাপ্তিকেও চেতনার রঙে প্রাপ্তিতে পরিবর্তন করা যায়, কবিসত্তা এই প্রাপ্তি - অপ্রাপ্তির টানাপোড়েনে ক্ষত বিক্ষত হয়ে বলে ওঠে 'মন শুধু খান খান হয়ে যায় '। 'যেন এই পথ শুধু হাহাকার' এখানে এই পথ বাস্তবের কঠিন শিলাতলের পথ যেখানে আছে কাটাতূল্য, ব্যথাসম দ্বিধা-দ্বন্দ্ব।
বিশেষ মুহূর্তে মানুষের মন বিশেষ ভাবনায় আচ্ছন্ন হয়ে যায়, যাপিত জীবনের স্মৃতিগুলো কখনো বিমূর্তরূপে হৃদয়ে বিশেষ চিত্ররূপে মূর্ত হয়ে ওঠে আবার কখনো অনাগত দিনের স্বপ্নভাবালুতা বর্তমানের দেহে বিচিত্র কারুকার্য এঁকে দিয়ে বর্তমানের নিকট ভবিষ্যতকে এক কাল্পনিক আরাধ্য জগতের মাহাত্ম্য দান করে। তাই মানব হৃদয় প্রায়শই বর্তমানকে অতিক্রম করে ভবিষ্যতের অজ্ঞাত সময়কে চেতনার রঙে রাঙিয়ে তোলে আপন অনুধ্যানে।
চুপি চুপি কারা কথা কয়?
চুপি চুপি জ্যোৎস্না ফুল ঝরে
মায়াবী ফুলের গন্ধে নত হয় দিন
এমন দিনেই শুধু পথ ভুলে চলে যাওয়া যায়
অন্য কোন দ্বারে
অন্য কোন অন্তরীক্ষে
দূরতম পিপাসার পারে।
[শুধু, পাতা ঝরার শব্দ পাই ]
এমন' দিনে যা ব্যক্ত করা যায় তা সত্যই অন্যদিনে কিংবা অন্যক্ষণে ব্যক্ত করা সম্ভব নয়। পূর্বেই বিবৃত হয়েছে মানুষের মনে বিশেষ ক্ষণে বিশেষ চেতনার আবির্ভাব ঘটে, আর এই ভাব অতিমাত্রায় সংবেদনশীল এবং ক্ষণস্থায়ী যা সেই সময়ে ব্যক্ত না করা হলে হয়তো আর কখনোই হবে না। 'চুপি চুপি কারা কথা কয়?' বস্তুত এই কথোপকথন একান্ত কবিহৃদয়ের নিভৃত অন্তরালের কথা, বাহ্যজগতে তার অস্তিত্ব নাই, এ কেবল কবির সাথে কবি হৃদয়ের কথোপকথন। তেমনি কবিহৃদয়ে জ্যোৎস্নাফুল ঝরে, বাস্তবে যার অস্তিত্ব নাই অথচ এই চিত্রকল্পটি নির্মাণের পেছনে আছে এক নান্দনিক অভিপ্রায়। কবির নৈঃশব্দবোধ তার অন্তরের কথাকে অন্তরে ধ্বনিত -প্রতিধ্বনিত করছে [পূর্বোক্ত ]। পরিশেষে বর্তমানকে অতিক্রম করে মুহুর্তেই চেতনার বিগলিত ধারা
প্রবাহিত হয় 'দূরতম পিপাসার পারে(পাড়ে?) ' অর্থাৎ ভবিষ্যতের কোনো স্বপ্নিল ভাবসমুদ্রের পাড়ে ; আর এখানেই বর্তমান ভবিষ্যতের রঙে রঙীন হলো সত্য, কিন্তু বর্তমান নিয়ে কবির অতৃপ্তির লক্ষণও অনতিবিলম্বেই চিত্রকল্পের আঁধারে গুপ্ত হয়ে রইল। বর্তমানের পরিতুষ্ট কেউ নিশ্চয় ভবিষ্যতে ধাবিত হওয়ার জন্য আকুল হয়ে রইবে না। কবির কৃতিত্ব তার অন্তরাত্মায় উন্মীলিত জীবন ও বোধের তীব্রতা তার কবিতাকে করেছে রহস্যে নিমজ্জিত। আর এই নৈঃশব্দের পদধ্বনি তার 'পাতা ঝরার শব্দ পাই ' কাব্যগ্রন্থে অধিকাংশ কবিতায় অত্যন্ত প্রবলভাবেই বিরাজিত।
কাল রাতে ছিল অস্থিরতার কারুকার্য
একে একে পুড়ে গেল জলের সোহাগ, মাটি,
ঘাসের পৃথিবী।
যেন পৃথিবীর কোনো দাবানল
হাত পা ছুড়ছে, মুখ খিচোচ্ছে।
একটা মরুভূমি
একটা গভীর ক্ষত
একফোটা তৃষ্ণার জল
জলের ভেতর হৃৎপিণ্ডের লাশ।
[কাল রাতে ছিল, পাতা ঝরার শব্দ পাই]
জীবনের যাত্রাপথে এক বিস্মৃত বিস্ময় সহসা মর্মের মণিকোঠায় সুবিশাল অভিব্যপ্তিতে আবির্ভূত হয় যা কারুকার্যচীত সৌন্দর্যবোধে ধরা দেয় — বিশ্ব আকাশের সুবিশাল বিস্তৃতি নিয়ে 'কাল রাতের অস্থির কারুকার্য মন্ডিত সুবিশাল মানবিক রাত' অনূভুত হয়। কিন্তু বাস্তবতার নিষ্করুণ আঘাতে আবার দিনের আলোয় তীর্যক ব্যঙ্গোক্তির কষাঘাতে পুড়ে যায় জলের সোহাগ, মাটি,ঘাসের পৃথিবী। আর সেই অন্তর্নিহিত উত্তাপটুকু মাখনের মত কারুকার্য মন্ডিত সুক্ষ হৃদয় অনুভুতির মর্মমূলে মৃদু অসন্তোষের সতেজ সরিষা-পুষ্প-মধু মিশিয়ে দেয়।কবির কবিতা এখানেই আত্মবোধকে অতিক্রম করে মানবাত্মায় সমর্পিত হয়, মানবের হৃদয়ের নান্দনিক বোধের সুতীব্র বাসনা পরম তৃপ্তির সাথে বিঘোষিত হয়। তার আস্বাদ্য অনুভবের অপ্রাপ্তি রূপকার্থে 'হৃদয়ের লাশ' এর প্রতিভূ। এইখানেই কবির পরাবাস্তব চেতনার সদম্ভ বহিঃপ্রকাশ। চরু হকের কবিতায় পরাবাস্তবতা বিস্তৃত পরিসরে প্রকটিত নয় তা যেমন সত্য তেমনি প্রায় অধিকাংশ কবিতায় অল্প বিস্তর পরাবাস্তবের উপস্থিতি পরিদৃশ্যমান। পরাবাস্তববাদ কোনো তত্ত্বীয় আকারে কবির কবিতায় বিধৃত হয় নি, তবে কবি চেতন কিংবা অবচেতন মনের তাড়না কিংবা প্রেরণায় চিত্রকল্প উপস্থাপনে বিশেষ এই প্রতীভা তাঁর কবিতাকে মাহাত্ম্যের মুকুট পরিয়েছে। সুমহান আহ্বান নিয়ে বিশ্ব মানবের যে অনুভূতি কবির ব্যক্তিজীবনকে আচ্ছন্ন করে আছে তার এমন সুভাষণ 'হৃদয়ের লাশ'। কালের মহাক্ষণে নৈঃশব্দের কবির সৃষ্টিলীলা অনন্তকাল বর্তমান থাকুক, সৃষ্টি হোক সমৃদ্ধ থেকে সমৃদ্ধতর।