নিতিনপুর ষ্টেশনটা ছেড়ে রেললাইন পেরোলেই-বস্তিটা,
একপাশে ছিল সখিনাবুদের বাসা,
সখিনাবুর বাবার ষ্টেশনে চাকরী,
আমাদের পাঠশালাটা,ঐ কটা কোয়ার্টার ছেড়ে।
ক্লাশ বললে বেশ বেখাপ্পা-মনে হয়,
দুটো ঘর নিয়ে ছিল আমাদের পাঠশালা্টা।
সখিনাবু,রুমু,কৃষ্ণা,
আমি,আকবর,নিতাই,বালুপাড়ার-আমরা সবাই।
পড়া বলতে ঐ সুর করে নামতা,
আর ‘অ তে অজগর’,খোঁজার খেলা,
কত হবে তখন-বড় জোর বছর সাত কি আট,
সকাল ছোটা পাঠশালার মুখ,আমরা।
দুপুরটা কাটতো রায়বাবুর বাগানে,
আম,কুল-লবণ লঙ্কার আসর,
মোচওয়ালা মালী দাদুর ছাপড়া জেলার গল্প,
আর পাড়ার নানান গুজব হাসির কথা।
রুমু সুর ধরে গাইতো,আকাশ ছোঁয়ার গান,
কথার কথায় ডানা মেলে নীল মেলার রাজ্যটায়।
রুমুর গলার সুরটা ছিল ভালই,
তবে ওটা বোধহয় সবকিছু ভাললাগার সময়।
ভুগোল নিতাই বলতো, ‘জানিস আকাশটার শেষ কোথায়?
পূর্নভবার গ্রামে-চল,যাবি একদিন ওখানে।
আর দাদুও বলে,নদীর ধার দিয়ে,
সাওতাল পাড়া ছাড়লেই আকাশ মাটি ছোঁয়া’।
সখিনাবুর কথা একটাই, ‘আমি এত কালো,কেনরে?
মা বলে,বিয়ে তো হবে না,লেখাপড়ায় যদি কিছু হয়।
আচ্ছা,বল এত সব নামতা ছড়ায় কি হবে?
বিয়ের কাজে ও গুলোর দরকার কোথায়?
সুন্দর রাজকুমারীর চেহারা,
না হয় চাই টাকা অলঙ্কার,
ধুর,অঙ্ক ছড়া,ও গুলো আবার পড়া,
টাকা থাকলে অভাব হবে না কিছুই’।
কৃষ্ণা মুচকি হেসে বলতো,
‘আরে ধুর বোকা,আমাকে দেখ মার নারকেল নাড়ু,
আর কিছু চাই না আমার।
বিয়ে করে বোকারা,
দাসী খাটবো কার বাড়ীতে?
আমি,ঘুরে বেড়াবো সারা পৃথিবী ছুটে’।
সময় চাকা কখন গড়ায়-কোথায়,
যোগাযোগ ছিল না,
তবে কথায় কথায়-কথা খুঁজে পাওয়া,
ছড়ানো ছিটকানো জীবনের গল্প।
রুমুর খবর তেমন একটা জানা নেই,
হয়তো রুমুর আকাশ ছোঁয়া হয়নি,
তার সুরের ছোঁয়াটাও ছড়ায়নি চারপাশ,
দেশ ধর্মের ভাগে কে জানে রুমু এখন কোথায়?
নিতাইও ঘর করেনি-মাটি ছোঁয়া আকাশ গ্রামে,
ভূগোল খুঁজছে প্রাইমারী স্কুলে।
আকবরের এখন নামতা শিখানোর পালা,
আমি অজানা খেলার আরেকজন।
সখিনাবুর দুঃখ,বদলায়নি
বিয়েটাও টিকেনি,
থাকে শহরের একপাশে,
গুজব আবার অনেক,
‘সখিনাবু এটা,সখিনাবু সেটা’।
পাঠশালাটা নেই,আছে স্মৃতির ধূলো,
ঝকঝকে দালানে-বড়লোক সাজানো এখন,
শুধু ভুবনবাবুর মোড় ছাড়ানো-হোমিওপ্যাথের ডিসপেন্সারীটা,
আর সবই বদলানো।
আমরা কেউ স্বপ্ন হতে পারিনি,
হতে পারিনি গল্পমুখের কথার কথা,
ভেঙ্গে পড়া জীবনটায় ভাবি,
এটাই কি বেঁচে থাকার গল্প?