প্রথম প্রেমের অনুভূতি
মোঃ ইব্রাহিম হোসেন - রাজশাহী
রচনাঃ ০৬-১০-২০২৪ ইং

সালটা ছিলো ১৯৯৯।
দুই বছরের সিনিয়র ছিলাম আমি।
সেই খুব ছোটবেলায় হাফ প্যান্ট পরা অবস্থায় তার সাথে কত খেলাধুলা, হাসি-ঠাট্টা করতাম!
প্রাইমারিতে পঞ্চম শ্রেণিতে থাকতেই নিজের অজান্তেই তাকে ভালো লেগে যায়।
আস্তে আস্তে কৈশোর পাড়ি দিয়ে উচ্চ বিদ্যালয়ে পদার্পণ করলাম।

হাজারও মেয়ের ভীড়ে তার মাঝেই মন হারালাম, মনে মনে তিনটি বছর।
ভ্রমর লাগলো যেন তার পেছনে, ভাবলাম কথাটা বলতেই হয়।

একদিন তাকে ইশারায় ডাকলাম,
সে-ও আমার ডাকে আসলো।
আমি শুকনো ঠোঁটে, অধর যুগল কাঁপতে কাঁপতে বললাম,
এই! শোনো,
সে বললো, কী বলবেন? বলেন।
আমি বললাম, রাগ করবা না?
সে বললো, না, বলেন।

আমি বললাম, ভয় লাগছে যে,
থাক অন্যদিন বলবো।
সে বললো, কোনো ভয় নাই, বলতে পারেন।
সেদিন হাজার চেষ্টা করে বলতে গিয়েও বলতে পারলাম না।
বললাম, ঠিক আছে, আজকে যাও, অন্যদিন বলবো।

সে আমি আরও কয়েকজ তার ফুফুর বাড়ি যেতাম। তার ফুফু দর্জির কাজ করতো। আমরা তাকে সেলাইয়ের কাজে সহযোগিতা করতাম। একদিন তাদের বাড়িতে আমি চেয়ারে বসা ছিলাম।
চেয়ারর থেকে উঠেছি নাক জাড়া দেওয়ার জন্য। আবার গিয়ে বসবো।

নাক ঝাড়া দিয়ে চেয়ারর দিকে না তাকিয়েই চেয়ারে বসতে গেলাম।
এরই ফাঁকে সেই মেয়েটি চেয়ারটা সরিয়ে নিয়েছে।
আমি বসতে গিয়েই চিৎপটাং হয়ে উল্টে পড়ে গেলাম আঙ্গিনায়। সেখানে ছোট ছোট ভাঙড়ি ইটও ছিলো, আমি ব্যথা পেলাম।
পরনে ছিলো লুঙ্গি। ভাগ্য ভালো খুলে যায়নহ। কিন্তু খোলার উপক্রম হয়ে গিয়েছিলো।

সবাই হাসতে লাগলো। আমিও হাসতে লাগলাম। সে-ও হাসছে।
কিশোর বেলার অবস্থা। আমার মনে মনে একটু রাগ হলো।
আমি ভাবলাম,  তোমাকে একটা শিক্ষা দেবো।

আমরা কয়েকজন মিলে আবার হাতের সেলাইয়ের কাজ শুরু করলাম।
তার মাথায় অনেক লম্বা লম্বা রেশমি কালো চুল ছিলো। সে আনমনে ছিলো।
আমি পাশে ছিলো। কাঁচিটা নিয়ে চুলের নিচের অংশ থেকে চার ইঞ্চি বরাবর চুলের কিছু অংশ কেটে দিলাম। অনেক সময় দুষ্টুমি মারাত্মক ক্ষিতি সাধন করে।

সে কাঁদতে লাগলো। আমাকে সবাই বকা দিলো। তার কান্নায় আমারও কান্না চলে আসলো। আমিও অনেক কাঁদলাম।
বললাম, আমাকে ক্ষমা করে দাও, আমার ভুল হয়েছে। তার কাটা চুলগুলো একটা ন্যাকড়ায় গিট মেরে সংরক্ষণে রেখে দিলাম। মাঝেমাঝে গিট খুলে দেখতাম আর কাঁদতাম। 

এভাবে যেতে যেতে চলে আসলো রমজান মাস। আমরা কথা বলি, খেলাধুলা করি। একসাথে মক্তবেই যাই কোরআন শিখতে।
আমি যখন কোরআন পড়ি,তখন কায়দা পড়ে।

দিনের পর দিন যায়, মাসের পর যায়।
আর যেন নিজেকে ধরে রাখতে পারছি না।
কথাটা তাকে বলতেই হবে।
নইলে পরে অন্য কারো খাঁচার পাখি হয়ে যেতে পারে। মনের মাঝে ভীষণ ভয়!

আমি তার এক আত্মীয়ের সহযোগিতা নিলাম। বেলা ১০টা ১১ টার দিকে তাদের বাড়ি গেলাম, সে-ও গেলো।
আমি তাকে কথা বলার সুযোগ পেলাম না।
এক প্রকার না বলেই চলে গেলো।
আমি কাঁদছি, খুব কাঁদছি।

আমি তার সে আত্মীয়ের ঘরে কাটে উপর শুয়ে গেলাম। বালিশ বুকে নিয়ে নীরবে হিপেহিপে কাঁদছি ।
আর নিজের হাত নিজেই কামড়াচ্ছি।
আমার কান্না তারা জানালা দিয়ে দেখেছে।
বেলা একটা বেজে গেলো।

আমাকে তার আত্মীয় বললো,
তুই এখন যা, মা চলে আসবে। বিকালে আসিস, সে-ও আসবে।
আমি তার কথায় চলে গেলাম। গাও গোসল করে যোহরের নামাজ পড়লাম, কোরআন তিলাওয়াত করলাম।

ঠিক কথা যা, কাজ তা।
আমি বেলা তিনটার সময় তাদের বাড়ি গেলাম, সে-ও তার হাসিমাখা বদন নিয়ে হাসতে হাসতে আসলো।
আমাকে তার আত্মীয় বললো,
আমি গেলাম, তোরা কথা বল।

বাড়িতে কেউ নাই। ঘরের ভেতর আমরা দু'জন। ঘরের দরজা বন্ধ করে দিলাম।
সে বললো, দরজা বন্ধ করলেন কেন?
আমি বললাম, কথা আছে, অনেক কথা।
সে বললো, কী বলবেন?  বলেন।

আমার ঠোঁট কাঁপছে, আমি যেন কিছু বলতে পারছি না। বুকটাও থরথর কাঁপছে।
সে আমাকে বারবার জিজ্ঞেস করছে,
কী বলবেন? বলেন।

আমি বললাম, দাঁড়িয়ে না, পাশে বসো।
সে খাটের উপর  আমার পাশে বসলো।
আমরা দু'জন পাশাপাশি বসা। 
বললাম, তোমাকে একটা কথা বলবো।
সে বললো, কী বলবেন?  বলেন।

আমি বললাম, আমি তোমাকে, আমি তোমাকে,আমি তোমাকে,,,, আর বলতে পারছি না।
সে বললো, বারবার আমি তোমাকে, আমি তোমাকে, আমি তোমাকে,,,
আমি তোমাকে কী?  বলবেন তো!
এবার আমি বলেই ফেললাম,
আমি তোমাকে,  আমি তোমাকে ভালোবাসি।
সে তো নীরব!

আমি তার হাত ধরে আমার মনের কথাগুলো বলতে লাগলাম। আমার চোখ দিয়ে পানিও ঝরতে লাগলো।
রোজাও আছি। তবুও আবেগ সামলাতে না পেরে তাকে বুকের সাথে জড়িয়ে নাম ধরে কান্নাভেজা কণ্ঠে বলতে লাগলাম,

আমি তোমাকে আমার জীবনের চেয়েও অনেক অনেক বেশি ভালোবাসি--
অনেক দিন চেষ্টা করেছি, বলতে পারিনি।
মনে মনে তোমাকে তিনটি বছর ভালোবেসে আসছি। কিন্তু বলার সাহস পাইনি।
আমার অন্তরে শুধু তোমার নামই জপ করে সকাল, সন্ধ্যা, সারাবেলা।

যেদিকে তাকাই, শুধু তোমাকেই দেখি।
তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচবো না প্রিয়া।
সে-ও তার কম্পিত ঠোঁটে বললো,
আমিও আপনাকে ভালোবাসি। তবে একটা শর্ত কিন্তু মানতে হবে।

আমি বললাম, কী শর্ত?
সে বললো, এখন আমরা কিছু করবো না।
তুমিও লেখাপড়া শিখবে, আমিও লেখাপড়া শিখবো। তারপর প্রয়োজনে আমিই বাবা-মাকে বলবো।

আমি বললাম, ব্যাস, আলহামদুলিল্লাহ।
আমি তো এটাই চাই। আমাদের দু'জনের মুখেই মধুর হাসি ফুটে উঠলো।
এমন সময় তার নানি তাকে ডাক দিলো।
তার আত্মীয় এসে তার নাম ধরে বললো,
এই মাকসুদা!  তোকে ডাকছে, তাড়াতাড়ি যা।
আমি বললাম,
এই, এখন যাও। বিকেলে আবার আসবো।

আমার যেন সময় কাটছে না।
বিকাল বেলা। আসর নামাজের পর
আমরা দু'জন আবার তাদের বাড়ি গেলাম।
তার আত্মীয় ইফতারের আয়োজন করছে।
সেখানে আমরা কথা বলছি, তার আত্মীয় মুচকি মুচকি হাসছে। 
আমরাও হাসছি। সে এখন চলে যাবে।

আমি বললাম,
এই! দাঁড়াও, কথা আছে।
সে বললো, কী কথা? বলেন।
আমি অতি আনন্দে কোনো দিশা না পেয়ে বললাম,
তোমার হাতের এক গ্লাস শরবত খাবো।
সে বললো, দাঁড়ান, আমি বাড়ি থেকে চিনি নিয়ে এসে বানিয়ে দিচ্ছি, বলেই
সে এক দৌড় দিয়ে তাদের বাড়িতে থেকে চিনি নিয়ে আসলো এবং সুন্দর করে এক গ্লাস শরবত বানালো।

ইফতারের সময় ঘনিয়ে আসলো।
আমি বারান্দায় বসা।
সে নিজ হাতে শরবতের গ্লাস নিয়ে বললো,
শরবত খান।
আমি তো অবাক!
সে আবার বলল, কী ব্যাপার? খাচ্ছেন না যে, শরবত খান।

আমি বললাম, তুমি যদি খাইয়ে দাও, তবেই খাবো।
সে বললো, খাবেন তো?
আমি বললাম, হ্যাঁ, খাবো
সে বললো, আমি খাইয়ে দেবো,
কিন্তু রোজা ভাঙলে আমি দায়ী নই।
আমি বললাম, ঠিক আছে।

আর মাত্র ৫-১০ মিনিট পরেই মাগরিবের আযান হবে।
সে শরবতের গ্লাস আমার মুখের সামনে ধরে বললো, খান।
আমি তো নিরুপায়। তাকে খাইয়ে দেওয়ার কথা বললাম, সে তো রাজি।
আমি খুব চিন্তিত, এখন কী করবো?
সে শরবতের গ্লাস আমার ঠোঁটের সামনে নিয়ে বারবার বলছে, শরবত খান,
কী হলো? খান।

আমি তো নীরব! কিছু ভেবে পাচ্ছি না।
তারপরও মনে হচ্ছে তার হাতের শরবতটুকু খেয়েই নিই।
হঠাৎ তার আত্মীয় আমাকে ইশারায় হাত নাড়া দিয়ে বললো,
এই! শরবত খাসনে, একটু পরেই আযান হবে।
তখন আমি বললাম,
প্লিজ, শরবতটুকু রেখে দাও, আমি ইফতার করে খাবো।
মাগরিবের আযান হবে হবে মুহূর্ত।

আমরা দু'দৌড় দিয়ে দু'জনের বাড়ি চলে গেলাম। আমাদের বাড়ি ছিলো খুব কাছাকাছি। দু'জনের বাড়ির মাঝখানে একটি বাড়ি ও একটি মসজিদ ছিলো।
বাড়িতে মায়ের কাছে গিয়ে মা ও ছেলে একসাথে ইফতার করলাম।

তারপর মাগরিবের নামাজ পড়ে তার সেই আত্মীয়ের বাড়ি গেলাম।
তার আত্মীয় আমাকে বললো,
তোর শরবত ঐখানে ঢাকা আছে, খেয়ে নে।
আমি তার বানানো শরবতটুকু খেলাম।
সত্যি কথা বলতে কী, সেই শরবতে এত এত এত স্বাদ ছিলো যে, আমি আজ পর্যন্ত সেই শরবতের স্বাদ কোথাও খুঁজে পাইনি।