আমার বই প্রকাশ করার কাহিনি
মোঃ ইব্রাহিম হোসেন রাজশাহী
রচনাঃ ২০-১১-২০২৪ ইং
প্রকাশক ও লেখকের বই প্রকাশের উদ্যোম প্রচেষ্টার মধ্যে আকাশ পাতাল ব্যবধান!
লেখকের টাকা আর লেখা থাকলেই বই প্রকাশ করা সম্ভব নয়।
আর কোনো প্রকাশক আপনার / আমার লেখা বই আকারে এমনি এমনি প্রকাশ করেও দেবে না।
মনে রাখবেন, প্রকাশনা প্রকাশকের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। তারা কেউ চাইবে না প্রকাশনার নিজের খরচে আপনার লেখা বই ফ্রীতে প্রকাশ করতে। চাইবে না নিজের পকেটের টাকা খরচ করে পকেট খালি করতে। চাইবে না লোকসানের ঘানি টানতে। তারা চাইবে প্রকাশনার মাধ্যমে অর্থ সঞ্চয় করতে।
প্রত্যেক ব্যবসায়ীদের এটাই মূল নীতি।
এখানে তাদেরকে দোষারোপ করাও যাবে না।
কারণ, এটাও তারা অনেক অর্থ ব্যয়ে প্রতিষ্ঠা করেছে। এটা দিয়ে তারা তাদের সংসার চালায়। ছেলেমেয়েদের ভরণ-পোষণের খরচ বহন করে। নিজে ভালো থাকে এবং পরিবারকে ভালো রাখার চেষ্টা করে।
এটাই তাদের রুজিরোজগারের কারখানা।
তাই নিজের বই নিজেকেই খরচ বহন করে প্রকাশ করতে হয়।
অন্যদিকে লেখকেরা লিখে মনের আনন্দে। লেখাটা তাদের পেশা নয়। এক প্রকার নেশা। যারা এই নেশায় নেশাগ্রস্থ, তারা কখনোই লেখালেখি ছাড়তে পারবে না।
কারণ, লেখাটাই তাদের মনের ক্ষুধা নিবৃত্ত করে। এটাই তাদের মনের খোরাক।
এই লেখালেখিই পারে একজন লেখকের মনের দুঃখ-কষ্ট, জ্বালা-যন্ত্রণা, বিরহ-বেদনা মন থেকে মুছে ফেলতে। এ লেখার মধ্যেই উচ্ছ্বসিত হয়ে নিজেও আনন্দ উপভোগ করে এবং অন্যকেও মহাআনন্দের দুয়ারে পৌঁছে দিতে সক্ষম হয়। লেখার মধ্য দিয়ে করে তারা সমাজ সংস্কার। করে অন্যায়, অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, প্রতিকার। সমাজের মানুষের দুঃখ কষ্টগুলো তুলে ধরে কলম খোঁচানোর মাধ্যমে। এভাবেই তারা সমাজ ও দেশের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত রাখে। মনের মাঝে তীব্র দহন জ্বালার সংস্পর্শে সঙ্গ দেওয়ার মত তাদের সময়ই থাকে না। তারা কাজে-কর্মের মাধ্যমে বা অবসর সময়েও লেখার মাঝেই পড়ে থাকে। সময় কাটে ব্যস্তাতায়।
কাজেই তাদেরকে খুব সহজে দুঃখ-কষ্ট, জ্বালা-যন্ত্রণা গ্রাস করতে পারে না। ভুলে থাকে অতীতের তীব্র দহন, আত্মা পায় প্রশান্তি।
যখন কোনো কিছু ভালো লাগে না, তখনই খাতা-কলম, মোবাইল বা কম্পিউটার নিয়ে বসে যায় গবেষণায় নতুন কিছু সৃষ্টির আশায়। এক লাইন, দু'লাইন করে লিখতে লিখতে হয়ে যায় একটা কবিতা, গল্প বা উপন্যাস। এই সৃষ্টির আনন্দ-উল্লাসে লেখকের মন প্রফুল্ল হয়ে ওঠে, হয়ে যায় নিজের সৃষ্টির উল্লাসে আত্মহারা। আবার কখনো কখনো নয়ন ভরে জল চলে আসে সৃষ্টির আনন্দে। শুকরিয়া জ্ঞাপন করে মহান আল্লাহ তা'য়ালার সমীপে।
লেখকরা তাদের প্রকাশিত বই বিক্রি করে সংসার চালায় না। নিজের লেখা বই বিক্রি করে তারা কোটিপতি হয় না। তাদের পেটের ক্ষুধা নিবৃত্ত হয় না এই লেখালেখির মাধ্যমে।
বরং এ লেখালেখির মধ্যেও তাদের পকেটের টাকা খরচ হয়, হয় মেধার ক্ষয় মূল্যবান সময়ের ব্যয়। এ লেখালেখির জন্য তাদেরকে সমাজে ও নিজের পরিবারে অনেক কথার খোঁটা শুনতে হয়। শুনতে হয় অনেকের লাঞ্ছনা ও গঞ্জনা।
নিজের স্ত্রী সেও বলে, কবিতায় পেটের ভাত দেবে না। ছেড়ে দাও এসব লেখালেখি। এগুলো করে লাভ কী? সামনে ভবিষ্যতের চিন্তা করো। ছেলেমেয়েদের মুখেও একই কথা। তারপরও তারা লেখা চালিয়েই যায় সব কিছু মুখ সহ্য করে।
লেখক এত সব কিছু সহ্য করেও বই প্রকাশ করতে আগ্রহী হয়।
কারণ একটাই যে, এত বাধাবিপত্তি অতিক্রম করে কষ্টের লেখাগুলো বইয়ের পাতায় সংরক্ষণ থাকবে।
শেষ কথা,
লেখকের টাকা আর লেখা থাকলেই বই প্রকাশ করা সম্ভব নয়।
লেখকের বই প্রকাশের প্রবল মনোভাব ও আগ্রহ থাকতে হবে।
তবেই শত কষ্টের মাঝেও একটা হলেও সে বই প্রকাশ করতে সক্ষম হবেই হবে ইনশাআল্লাহ।
যেমন আমি আমার কথাই বলি,
সাহিত্য জগতের মধ্যে আমার মনে হয় আমার মতো দরিদ্র লেখক আর কেউ নাই।
তবুও আল্লাহর রহমতে ভালো হোক, মন্দ হোক, দু'চারটি বই প্রকাশ করতে সক্ষম হয়েছি। আলহামদুলিল্লাহ।
আমার বই প্রকাশের কাহিনিঃ
প্রবল ইচ্ছা বই প্রকাশ করবো। কাছে টাকা নাই। সংসারের চাহিদাও সম্পূর্ণভাবে মেটাতে পারি না। পারি না স্ত্রী সন্তানকে ভালো পোশাক দিতে। পারি না ভালো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া করাতে। পারি না তাদের কোনো সাবজেক্টের কচিং করাতে।
আমি যেভাবে কোচিং, প্রাইভেট ছাড়াই একাএকা এক কলম, দু'কলম করে শিখেছি।
আমার সন্তানেরাও প্রায়ই তেমনই।
তারপরও বই প্রকাশ করতে হবে, করতেই হবে। প্রবল উদ্দীপনা মনের মধ্যখানে দোলা দেয়।
সংসারে স্ত্রীর হাতে টাকা দিয়ে বলি এটা দিয়েই তোমাকে সংসার চালাতে হবে। কীভাবে পারবা জানি না?
আর সেখান থেকে ৫০০ / ১০০০ টাকা চুরি করে কেটে রেখে দিই। এভাবে করতে করতে কিছু টাকা জমা হলে উদ্যোগ নিই প্রথম উপন্যাস "ইতি কথা" প্রকাশের। কিন্তু আরও টাকা লাগবে, এ টাকায় হবে না।
এরপর প্রতি হাজারে ১০০টাকা হারে লাভ দিয়ে ১০ হাজার টাকা ঋণ নিই এবং গোছানো টাকা ও ঋণের টাকা একত্রিত করে বইটি প্রকাশ করি। তারপরও বাকি টাকা প্রাকশককে অনুরোধ করি মাসিক কিস্তিতে নিতে। আস্তে আস্তে ঋণের টাকা ৬ মাস পর্যন্ত লাভ দিতে থাকি এবং তার সাথে মাসে মাসে আরও ৫০০/১০০০ করে পরিশোধ করতে থাকি।
স্ত্রীকে সংসারে টাকা কম দিই। সংসারে টান পড়ে, স্ত্রীর বকবকানি শুনতে হয়। হাসিমুখে মেনে নিই, গায়ে লাগতেই দিই না।
একদিন তাকে সাহস করে বলেই ফেললাম।
এই আর জানো, আমি একটি বই প্রকাশ করেছি। সেখানে কিছু টাকা এখনো ঋণ আছে। তাই পরিশোধ করতে হয় তোমাকে টাকা কম দেওয়া হয়। কিছু মনে করো না। এ টাকাটা শোধ হয়ে গেলেই তোমাকে পূরো টাকা দেবো। তাছাড়া আমার কাছে শুধু খরচের টাকা ছাড়া তো অতিরিক্ত টাকা রাখি না। তোমাকেই সব দিয়ে দিই। তারপরও জানি সংসার চালাতে কষ্ট হয়।
সে আমাকে বললো, আমাকে কষ্ট দিয়ে তুমি বই প্রকাশ করছো? আমি সব আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দেবো।
আমি বললাম, সেগুলোই আমার জান, আমার দেহের নিঃশ্বাস, আমার কলিজা।
তুমি নষ্ট করে ফেলবা?
আমার স্ত্রী বললো, তাহলে তুমি তোমার বইকেই বৌ করে নিয়ে থাকো। আমার কী দরকার? বকাঝকার পর বললো,
আগে তুমি ঋণ পরিশোধ করো।
তখন আমি আমার স্ত্রীর সহযোগিতায় অনুপ্রাণিত হয়ে বইয়ের সমস্ত ঋণ পরিশোধ করে দিলাম।
সে আবার কবিতা পছন্দ করে না।
কিন্তু "ইতি কথা" উপন্যাসটি তার খুব ভালো লেগেছে। সে আমার অগোচরে বইটি দুইবার পড়ে আমাকে জানালো,
"ইতি কথা" বইটি খুব সুন্দর হয়েছে। আমাকে খুব ভালো লেগেছে। তুমি এত সুন্দর লিখতে পারো? কীভাবে লিখেছো এত লেখা ?
আমি মুচকি হাসি দিয়ে বললাম- আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহ পাকের ইচ্ছায় আর তোমার অনুপ্রেরণায়। বইয়ের প্রথমেই দেখো তোমার নাম ও অনুপ্রেরণার কথা লেখা আছে।
ঠিক এভাবেই আমি আমার বইগুলো প্রকাশ করতে সক্ষম হয়েছি। আল্লাহ আমার আশা পূরণ করেছেন। আলহামদুলিল্লাহ।
তাই বলি, টাকা থাকলেই বই প্রকাশ করা যায় না। অনেক লেখক আছে, তাদের কোনো টাকা পয়সার অভাব নাই। বড় মাইনেতে চাকরি করে। বেতনও পায় ৮০-৯০ হাজার টাকা। পকেটে টাকা থেকেও নিজের বইয়ের জন্য খরচ করতেও কৃপণতা করে।
আর দুখ কান্দে টাকা নাই, টাকা নাই বলে।
আমি যদি ৮০-৯০ হাজার টাকা বেতনে চাকরি করতাম, তবে প্রতি মাসে একটা করে বই প্রকাশ করার উদ্যোগ নিতাম।
তাই তো বলি টাকা থাকলেই বই প্রকাশ করা সম্ভব নয়। যদি না থাকে লেখকের বই প্রকাশের প্রবল ইচ্ছা, মনোভাব, আগ্রহ ও প্রচেষ্টা।