হে জগতের শ্রেষ্ঠ জীব,

কি গো চিনতে পারছো আমায়? আমি কেরলের সেই হতভাগিনী করিণী। তিনদিন ঘুরতে না ঘুরতেই ভুলে গেলে নাকি আমায়?
আমার পরলোকগমনের খবর রাষ্ট্র হতেই,
খুব তো সমবেদনা-আক্ষেপ-অনুশোচনা-আবেগের প্লাবনে ভাসালে দেশ।
সোশাল মিডিয়ায় তুললে তীব্র নিন্দার ঝড়।  
মানবতার প্রশ্নচিহ্নে হাতড়ালে মনুষ্যত্বের উত্তর।
কবিদের কলম ঝলসে উঠল তরবারির মতো।
সবই দেখছি আমি।
অতৃপ্ত ক্ষতবিক্ষত প্রাণে,এগুলোই লাগিয়েছে তৃপ্তির মলম।
কিন্তু তারপর....
তারপর একদিন,দুদিন যেতে না যেতেই সমাজের জনসমুদ্রে আবারো পড়ল বিবেকের ভাটা।
যে- কে-সেই।
ওদিকে হিমাচলের কোলে গর্ভবতী গো-বন্ধুর চোয়াল জ্বালিয়ে,হে তথাকথিত শিক্ষিত মানবসমাজ !-আবারো রাখলে নিষ্ঠুরতা-অশিক্ষার স্বাক্ষর।
উচ্ছৃঙ্খলতার উন্মত্ত তুফানে,স্বার্থপরতার উজানে বারংবার কোথায় তলিয়ে যায় মনুষ্যত্ব কে জানে!

বিশ্বাস করো সেদিন খিদে পেয়েছিল খুব,খুব খিদে।
ক্ষুধা-তৃষ্ণার তাড়নায়,গর্ভের সন্তানের মুখ চেয়ে বন ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলাম।
হিংসাত্মক অভিপ্রায় একদমই ছিল না আমার। আমরা জানতাম তোমরা বিশ্বাসী, দয়াময়,উদার। কিন্তু একি মানবতার ভগ্ন-নগ্ন রূপ !
ফলের উদরে বাজি গর্ভস্থ করে, আমাকে খাইয়ে এ কেমন প্রাণঘাতী উদারতা,রসিকতা তোমাদের! তোমাদের বিশ্বাস করেই হল কাল।
ফলাহারেই মিলল জীবনের অন্তিম ফলাফল।
'সভ্যের বর্বর লোভ'-এ, 'আপন নির্লজ্জ অমানুষতা' নগ্ন হল আবারো।

উফ্! দুহপ্তাব্যাপী সেকি অসহ্য জ্বালা যন্ত্রণা!
আমার 'ভাষাহীন ক্রন্দনে',দেহের রক্তে অরণ্য-পথের ধূলি, আবারো হল পঙ্কিল।
গ্ৰামে গ্ৰামে ঘুরে অবশেষে শান্তি খুঁজতে চেয়েছিলাম নদীবক্ষে।
কিছু খাওয়ার মতো শারীরিক সক্ষমতা ছিল না আমার।
বর্ণাতীত,অসহ্য সে জ্বালা।ক্রমে হৃৎপিণ্ডটা স্তব্ধ হয়ে এল...অবশেষে সবশেষ...

ভাগ‍্যের নির্মম পরিহাস- এক পরাজিতা মা,না পারলো বাঁচাতে নিজেকে,না পারলো বাঁচাতে তার দু'মাসের ভাবী সন্তানকে।
অমানবিকতার অন্ধকারে আগামী সন্তান দেখলোনা পৃথিবীর আলো,পেলোনা মাতৃপরশ।
বর্বরতার আগুনে ছাই হয়ে গেল অনাগত স্বপ্নের নন্দনকানন।
কী দোষ ছিল ওর,বলতে পারো?
জানি উত্তর নেই।
এমনি করেই এ-পোড়া দেশের আনাচেকানাচে অবলীলায় হারায় কত অবলাপ্রাণ।
খবর কে রাখে !
শত শত পাপের বাটখারায়,মেরুদণ্ডহীন মানবতার দাঁড়িপাল্লা,প্রতিনিয়ত ঝুঁকে পড়ছে।
হে পাশবিক-নির্মম মানবসমাজ,বিবেকের হাজারদুয়ারি খুলে আরেকবার মানুষ হও-
প্রকৃত মান-হুঁশ।
যে অন্তর্দহনের চুল্লীতে জ্বলে বিদায় নিলাম,সেই অঙ্গারেই ঢালো মনুষ্যত্বের শান্তিজল।
ক্ষমা করে দিয়ে গেলাম তোমাদের।
কিন্তু ঈশ্বর,প্রকৃতি মায়ের আদালতে তোমাদের জন্য যে কি শাস্তি-দণ্ড ধার্য হয়েছে তা সময়ই বলবে।
শুধু এটুকুই বলি-
নিজেরা শান্তিতে বাঁচো,অপরকেও শান্তিতে বাঁচতে দাও।
আমরা একটুখানি ভালোবাসা পেলে,বিনিময়ে শতগুণ ভালোবাসা  দিতে জানি।
তোমরা জগতের শ্রেষ্ঠ জীব,
তোমাদের এমন পশুত্ব মানায় না।
মানবরূপী পশু নয়,মানবরূপী মানুষই হও।
ভালো থেকো তোমরা,
ভালো থেকো।

-ইতি
এক অভাগিনী,গর্ভধারিণী করিণী