গৌতম ঘোষের ‘আবার অরণ্যে’ সিনেমার সেই অসীমের চাঁচাছোলা উক্তি মনে আছে – “বাঙ্গালী ছেলেরা একটা বয়সে সবাই কবিতা লেখে। প্রেমে পড়লে কিংবা প্রেমে আপ্সেট হলে। কিন্তু আমি কখন লিখিনি।“ অসীম না লিখতে পারে, তবে বাংলায় সত্যি অন্তত কবিতার যে অভাব নেই এটুকু জানার জন্য বেশী পড়াশোনা করবার দরকার পড়েনা। ভালো, খারাপ, মাঝারী নিম্ন অতিনিম্ন মায় সব স্তরের কবিতা বিপুল পরিমাণে বিদ্যমান। এ সমস্ত কবিতা যেমন আছে ছাপার অক্ষরে গ্রন্থ, পুস্তক বা পত্রিকায় তেমন আছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ই-বুক, সোশ্যাল মিডিয়া, ব্লগ ও ই-ম্যাগাজিনে।
তবে অসীমের উক্তিতে যে প্রেমে পড়া আর আপ্সেট হবার কথা আছে, আমাদের কবিকুল কিন্তু শুধু তাতে থেমে নেই। একথা সত্যি যে গুনতি করলে হয়ত প্রেমের কবিতা সবার উপরেই থাকবে কিন্তু প্রেমিক কবি ছাড়াও বাংলা জুড়ে আছেন অনেক রকম কবি আর তাঁদের স্বভাব সুলভ কবিতা। যেমন আছেন বিদ্রোহী কবি। সমাজের সকল বিষয়ে তাঁদের বিদ্রোহের আগুনে আমরা সেঁকে থাকি। বন্দুক, গুলি, চড়-থাপ্পড় থেকে শুরু করে মিছিল থেকে প্রতিকার - সব শব্দ তাঁদের কবিতায় আমরা হামেশাই পেয়ে থাকি। তাঁরা যেসব কবিতা লেখেন উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে এমন – ওরে ওরে উজবুক এই দেখ বন্দুক/ এক চাপে করে দেব ছারখার তোর বুক।
আরেক ধরনের কবি আছেন এঁরা হলেন দুঃখী কবি। রাস্তার প্লাস্টিকের সংসার এর দুঃখ থেকে শুরু করে কর্পোরেশনের জল না পড়া তাঁদের কবিতায় ফুটে ওঠে। তাঁরা অনায়াসেই এমন লাইন লিখতে পারেন, - কাল খাব কী জানিনা বলে আজগের খিদে মুলতবী নেই/ রাস্তার জলে ক্ষুন্নিবৃত্তি/ রুটির গন্ধ শুধু স্বপ্নেই।
আরেক ধরনের কবির নাম সচেতন কবি। বিশ্বশুদ্ধ বিষয়ে তাঁদের সচেতনতায় আমাদের প্রায় অচেতন হবার অবস্থা। অবশ্য ওই যে আগেই বললাম সমস্ত স্তরের কবিতাই বিদ্যমান। এঁরা এমন একটা উদাহরণ দি। কৃষক জমিতে কী চাষ করছে তা নিয়েও এদের মতামতের শেষ নেই। অনায়াসে তাঁরা লেখেন - ধানের জমিতে আজ ধান বুনে যা চাষি ভাই/মালিকের পানের বরজ চাই?/ পান খেয়ে মৌতাতের এ সময় নয়।
আরেক প্রকারের কবি আছেন রাজনৈতিক কবি। এদের কবিতা বেশীর ভাগ কোন বিখ্যাত কবিতার প্যারডি হয়। আবার কখন কখন চুটকির মতন শোনায়। আর প্রয়োজনে মৌলিক কবিতারও প্রচলন দেখা যায়। যে কোন একটি রাজনৈতিক দলের পক্ষে এঁরা মুখ গুঁজে লিখে যান। পাছে মুখ তুললে অন্য কিছু দেখে ফেলেন। যা লিখছেন অবিশ্বাসের ছায়া আসে মনে।
আরেক প্রকারের কবি আছেন পালটি কবি। এরা সময়ের সাথে সাথে নিজেদের ভেক পালটান। এঁরা অনেকটা রাজনৈতিক কবিদের মতন তবে নেতাদের মতন দল পালটান। পাল বুঝে তাল দেন। নির্বাচনের সময় এ সমস্ত কবিরা একটু গুছিয়ে নেন।
আরও অনেক প্রকার কবি আছেন তবে এ আলোচনা যেহেতু কবির প্রকার নিয়ে না তাই এটা বলেই প্রসঙ্গে আসি। এই শেষ প্রকার কবির নাম ‘আপডেট’ কবি বা অত্যাধুনিক কবি। এদের কবিতার মধ্যে প্রচুর পাণ্ডিত্যের প্রকাশ থাকে। তা দু ভাবেই থাকতে পারে বলাই বাহুল্য। প্রকাশ আতরের মত সুঘ্রাণ ছড়িয়ে দিতে পারে শব্দে শব্দে, আবার পাণ্ডিত্য ঠিক কোথা দিয়ে বেরবে বুঝতে না পেরে যেখানে সেখানে কবিতায় ফোড়া পুঁজ এসব হয়ে দুর্বোধ্য হয়ে যাবার সম্ভাবনা থাকে। যেমন ধরুন এমন একটা কবিতা – তোর চোখটা দেখে আমি হয়ে গেছি ট্যান/ বিম্বিসার অশোকের কিংবা চলচ্চিত্রে ক্যান/ আমি ছুটে যাই লুটে যাব বলে/ যেন ঠিক বাসন্তী শোলে।
কিছু বুঝলেন? আমিও খুব বুঝেছি এমন বলার জোর পাচ্ছি কই।
যাই হোক। এইবার আসি আর এক প্রকার কবির আলোচনায়। এদের কথা বলব বলেই এত ভূমিকা বা ভণিতা যাই বলেন না কেন। এদের নাম হল চোর কবি। এঁরা কেমন? স্বখ্যাত, স্বপরিচিত (যাকে বলে সেলফ এক্সপ্লেনেটরি।) এনারা সারাদিন বিভিন্ন ই-ম্যাগাজিন সোশ্যাল মিডিয়ায় বিচরণ করেন। আর কবিতা দেখলেই পছন্দ হলে টপাটপ কপি করে ঝেপে দেন নিজের নামে প্রকাশ করে। আগেই বলেছি বাংলায় কবির আর কবিতার সংখ্যা নিয়ে অন্তত কোন দুর্ভিক্ষ নেই। তাই বেচারি কবি সে উপরের যে প্রকারেরই হোক না কেন তিনি জানতেও পারেন না তাঁর প্রিয় কবিতা অন্যের নাম নিয়ে মান পেয়ে চলেছে। যারা লাইক দিচ্ছেন তারাও এই চোর কবির “কপি আর ঝাপি”র মন্ত্রের গুনে টেরও পেলেন না এ আসলে কার লেখা। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হল চোরের উপর বাটপাড়ির মত সোশ্যাল মিডিয়ায় বিশেষ করে এমনও হয়ে চলেছে যে চোর কবির পাতা থেকে গজিয়ে উঠছে আরেক চোর যা আগের চোর জানতে পারল না। এইভাবে গজিয়ে ওঠে ‘হাজার হাজার হাজরা’র মত হাজার হাজার চোর কবি।
আমার সত্যি জানা নেই এই ‘কপি আর ঝাপি’ বন্ধ করা যায় কিনা আজগের যুগে। তবে এটুকু বোঝা যায় কবিতা নামক বস্তুটি চর্চা করতে গেলে চর্চা-কারীর চর্চা বস্তুটি চুরি হলে চোরকে চুরমার করে দেবার শক্তি খুব কম কবিরই আছে। আইন অবশ্য আছে। কিন্তু সে রাস্তা কত জনার জানা আছে। আর যে জানতেই পারল না তাঁর লেখাটা নিয়ে দিব্বি একজন কবি সেজে বসে আছেন?
কবিতা একটা বিষয় যা নিয়ে কিছু মানুষ নিরন্তর চর্চা চালিয়ে যাচ্ছেন এর ক্রমোন্নতির জন্য। এঁরা ঐ বর্ডারে থাকা সৈনিকের থেকে কিছুমাত্র কম গুরুত্বপূর্ণ নয় এ সমাজের কাছে। কারণ একটা ভাল কবিতা আজও আমাদের সকলকে বিমুঢ করে রেখে দিতে পারে, আমাদের সচেতন করতে পারে আবার আমাদের ভিতরকার শক্তি স্ফুরণ ঘটাতে পারে। সবসময় এমন কবিতা আমাদের সামনে আসছে তা নয়। রোজই কী আর সৈনিককে যুদ্ধ করতে হয়। কিন্তু চর্চার কোন ছেদ পড়েনা এতে। একটা কবিতা রচনায় যেমন মেধা লাগে তেমন লাগে প্রাণ। যেমন ছন্দ লাগে তেমন লাগে তান। পরশপাথর খোঁজার মত এক একটা শব্দ কবি খুঁজে বেড়ান তাঁর মননের পাঁজরে পাঁজরে। অজান্তে। কাউকে অসুবিধায় না ফেলে। ভাবা যায় আমরা প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যে কিংবা রাত পর্যন্ত আমাদের নিজের কাজ করে চলেছি আমাদের জন্য আর আমাদের সাথে সাথে এক কবির চোখ তা সমানে তাঁর শব্দের মায়াজালে রচনা করে চলেছে আমাদের জীবন গাথা আমাদেরকেই চিরায়ত করবার জন্য। এ কী চুরি করবার মত কিছু। তাই এই আশাটুকু নিয়েই থাকি, যে একজন সামান্য চোর দু চারটে কবিতা চুরি করে একজন কবিতা চর্চা-কারীকে থামাতে পারবে না। যিনি ব্রত নিয়েছেন শব্দের সুরমন্ডলে, যার চৈতন্য জাগরূক, যার কস্টদুয়ার খুলে গেছে বিচিত্র মানুষের মায়ার মিছিল থেকে সন্ন্যাসী কুটীরে, সে বৃষ্টি আসুক কী না আসুক, নিরলস চাষির মত ধান বুনে যাবে, লিখে যাবেই তাঁর নিজস্ব কবিতার কোমল-গান্ধার।
----------------------------
(আলোচনা পাতায় এটাই আমার আপাতত একমাত্র লেখা। চারধারের কান্ড-কারখানা দেখে এটা লিখতেই হল। আশারাখি এটা আপ্রাসঙ্গিক্ প্রবন্ধ নয় এই বিভাগের। তবে বলাই বাহুল্য এডমিন মনে করলে সরিয়ে দিতে পারেন।)