(শুরুতে এডমিন এর বোঝার সুবিধার্থে বলে নেই, এটা কবিতা সম্পর্কিত লেখা, কোন গল্প নয়)
আমার ছোট চাচা, যাহাই তার ভালো লেগেছে তাহাই শিখতে তিনি মহা উত্সাহে লেগে পরেছেন। আর তার প্রতিটি শিক্ষা পর্বই ব্যপক উত্তেজনা নিয়ে লক্ষ্য করতাম আমরা যারা তখনো এক হাতে হাফ প্যান্টের পতন ঠেকাতে সদা ব্যস্ত। তিনি একদা বাড়িতে এক হারমনিয়াম নিয়ে আসলেন সেটা বাজিয়ে সকলে নাকি গান করে। আমরা ভীষণ উত্তেজিত। তিনি আমাদের উত্তেজনায় কোন রুপ ভ্রুক্ষেপ না করেই নিশ্চিন্তে খেয়ে দেয়ে ঘুমিয়ে পরলেন। আমরা যখন চোখ আর খোলা রাখা সম্ভব হচ্ছে না তখন এই যন্ত্রটার কাছ ছেড়ে ঘুমতে গেলাম। আর যন্ত্রের তান্ডবেই অথবা আমার চাচার রেওয়াজের তান্ডবেই ঘুম ভাঙল আমাদের। বিপুল উত্সাহ উদ্দিপনায় আমরা তাকে ঘিরে বসলাম। ঘুরে ফেরে একই কথা সা রে গা মা, সা রে গা মা। এই সা রে গা মা থেকে ই নাকি সুর তৈরী হবে। আমরা অধির আগ্রহে সুরের প্রতিক্ষা করতে থাকলাম। কিন্তু প্রতিদিন ঘুরে ফিরে চলতে থাকল সেই একই কথা। অচিরেই আমরা উত্সাহ হারিয়ে ফেল্লাম। আমার চাচা সারগাম শিখেছিলেন বেশ কিছু দিন কিন্তু সুরের খোঁজ পেয়েছিলেন বলে শুনিনি। কখনো কোন সুর ও তাকে বাজাতে শুনিনি। কিছুদিন পরে তিনিও আমাদের মত উত্সাহ হারিয়ে ফেল্লেন।
আমরা তখন নব উদ্যমে অপেক্ষা করতে শুরু করলাম এবার চাচা কি নিয়ে আসেন দেখার জন্যে। অপেক্ষা কখনই নিশ্ফল হয় নি। কিছু দিন বাদে চাচা এক জোড়া তবলা নিয়ে আসলেন। যথারিতি তিনি ঘুমতে গেলেন আমরা বহু কষ্টে চোখ টেনে সেই যন্ত্র ঘিরে বসে থাকলাম। সেখানেই ঘুম। মা এক সময় ঘুমন্ত আমাকে বিছানায় নিয়ে গেল। সকালে ঘুম ভাঙল তে রে কে টে তাক, তে রে কে টে তাক। প্রতিদিন একই ঘটনা। আমরা ভীষণ চিন্তিত চাচার আঙুলে কোন একটা সমস্যা হয়েছে কিছুতেই নাকি বোল উঠছে না। চাচাও মোটেই হারবার পাত্র নয় তিনি পাঁচ আঙুল সজোড়ে চালিয়ে যাচ্ছেন। ছোট্ট সুন্দর একটা হাতুড়ে এনেছেন সেটা দিয়েও মাঝে মাঝে তবলাটা হাতুড়ি পেটা করছেন। তবুও নাকি তবলায় বোল উঠছে না। তে রে কে টে তাক, তে রে কে টে তাক চলতেই থাকল। তালের দেখা আর পাওয়া গেল না। আমাদের উত্সাহে ভাটা পরে গেল কাহাতক তে রে কে টে আর ভালো লাগে। একদিন চাচাও উত্সাহ হারিয়ে ফেল্লেন।
তবে তিনি কখনই দমে যাবার পাত্র ছিলেন না। অনেক ভেবে চিন্তে তিনি গান গাইবেন বলে সিদ্ধান্ত নিলেন। এবার আরও এলাহি কান্ড শুরু হল। হারমনিয়াম এল এবং একজন এলেন যিনি এই যন্ত্রটা খুব সুন্দর বাজাতে পারেন। তিনি একবারও সা রে গা মা বাজালেন না। সুন্দর সুর বাজাতে লাগলেন। একজন তবলচি এলেন হারমনিয়াম এর সুরের সাথে কি সুন্দর তাল বাজাতে লাগলেন। এবার আমাদের উত্তেজনা আরো বেড়ে গেল। শুরু হল চাচার গান চর্চা। ফুলে ফুলে ঢোলে ঢোলে বহে কি বা মৃদু বায়...। চাচা গান কিছুটা গেয়েছেন অমনি তবলচি বাজনা থামিয়ে দিলেন। চাচা কে বললেন মনযোগ দাও তাল টা খেয়াল কর। হারমনিয়াম বাদক বল্লেন সঠিক লয়ে থাক। শুরু হল একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। তাল লয় কিছুতেই আর চাচার মাথায় ঢোকে না। এক সময় চাচার উত্সাহে ভাটার টান দেখা দিল। তিনি তাল লয় ছাড়াই গলা ছেড়ে গান গাওয়াকেই উত্তম বলে মেনে নিলেন। তবু শিল্পি হিসেবে আমার চাচার মর্যাদা আমাদের নিকট একটুও কমে গেল না। বরং আমরা তার গানের ভক্ত হয়েই থেকে গেলাম।
বেশ কিছুদিন ধরে আসরে ছন্দ সৃষ্টির বা রক্ষার বিভিন্ন টেকনিক নিয়ে সবাই বেশ আলোচনা করছেন। অক্ষর গণনা, মাত্রার হিসেব তাতেই কত ছন্দ এসে ধরা দিচ্ছে। আফসোস আমার চাচা কবিতা লিখতে শুরু করেন নি! মাত্রার হিসেব জানলেই ছন্দ বোঝা যায় এমন সহজ পথ তার অজানা থেকে গেল!
সারগাম যে সুর নয়, তবলার বোল যে তাল নয়, গানের সুরে কি করে যে তাল আর লয় মিশে থাকে তা বুঝতে অনেক বছর গেছে। ছন্দ কি, এখনো খটকা লাগে। রবি ঠাকুরের হঠাত দেখা কবিতাটা এখানে তুলে দিতে চেয়েছিলাম কিন্তু টাইপ করার কষ্ট এড়াতে সবাই কে একটু ইন্টারনেট থেকে পড়ে নিতে অনুরোধ করছি।
ছন্দ কোন কালেই কোন গণনা পদ্ধতির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। ছন্দের ধারনা ব্যপক থেকে ব্যপকতর হচ্ছে দিন দিন। আমাদের তাই সংকির্ণ কোন ধারনায় আটকে থাকার কোন সুযোগ নেই।