অশুভ সময়ে বসবাস করেও যিনি নিত্যসৃষ্টি ক’রে চলেছেন তিনি শামসুর রাহমান। বুদ্ধদেব বসু ছাড়া, তাঁর মতো এতো দীর্ঘ সময় কেউ কবিতায় ব্যয় করেনি। পাঁচ দশকেরও কিছু বেশি সময় যিনি কবিতায় নিজেকে উৎর্সগ করেছেন তিনি শামসুর রাহমান। অঝোর ধারায় কবিতা ঝ’রে পড়েছে তাঁর কলম থেকে। কখনো তা প্রকাশ পেয়েছে শোক, দুঃখ, আনন্দ, বেদনা, প্রেম, কাম, স্মৃতি, হতাশা এবং সর্বোপরি ইন্দ্রিয়ের সৌন্দর্য। তাঁর যত সংখ্যক কাব্যে আছে এতো সংখ্যক কাব্যে কোনকালে, কোন সময়ে, কোনে কবি সৃষ্টি করেনি। এতো সংখ্যক কবিতার যিনি অধিরাজ তিনি শামসুর রাহমান।
২০০১ -এ শামসুর রাহমানের প্রবন্ধ সংকলনটি প্রকাশ পায়। যাতে রয়েছে প্রায় তিরিশটি প্রবন্ধ। শামসুর রহমানের কোনো গদ্যের সাথে এটাই আমার প্রথম পরিচয়। প’ড়ে উঠছিলাম তাঁর গদ্যের শব্দগুলো, আর মনে পড়ছে ওই কবিতাগুলোর কথা; যে কবিতাগুলো পড়ার অনেক পূর্বেই কিংবদন্তী হ’য়ে উঠছিল। বিশেষ ক’রে আমি মনে করতে চাই শামসুর রাহমানের ওই কবিতাটির কথা যে কবিতাটি বাঙলার রক্তে মাংসে গেঁথে রয়েছে। ‘তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা’, কবিতাটি। যে কবিতাটি আমার জন্ম মাত্রই শুনে আসছি। ওই কবিতাটি এখন বাঙলার সর্বজনের। চমৎকার ওই কবিতাটির উজ্জ্বল শব্দগুলো কেমন লাগবে আমার? ওই কবিতার শব্দের মতো কী চমকে উঠবো আমি। নাকি আমার ইন্দ্রিয় কোনো সুখ-ই গ্রহণ করবে না ওই গদ্যে শব্দগুলোর থেকে। আমি ওই গদ্যেগুলো পড়ে উঠতে থাকি, কিন্তু কোন কাপন বোধ করি না। ওই গদ্যগুলো কোনো কাঁপন জাগায় না আমার মাঝে। বরং ওই গদ্যগুলো অনেক অজানাকে জানিয়ে দেয় আমাকে।
প্রাক্কথনে তিনি স্মরণ করেন সেই সব লেখক বা কবিদের, যাঁদের হাতের স্পর্শে ভাষা হয়ে উঠে নির্মল সুন্দর। শামসুর রাহমান তাঁর কলমে, তিনি তাঁদের ঋণ স্বীকার করেন। শামসুর রাহমানের ভাষায়: ‘চর্যার কবিদের হাত ধ’রে একদিন বাঙলা সাহিত্যের শুরু হয়েছিল। সেই সাহিত্য ‘মুকুন্দরাম’, ‘বড়– চন্ডীদাস’, ‘বিদ্যাপতি’, ‘ভারত চন্দ্র’ ‘মধূসূদন’, বঙ্কিমচন্দ্র’, ‘রবীন্দ্রনাথ’, ‘বুদ্ধদেব’, ‘জীবনানন্দ’, ‘মানিক’ ‘বিভূতিসহ’ অনেকের শ্রমে সমৃদ্ধ। আমার লেখালেখির পশ্চাদখভুম তৈরি ক’রে দিয়েছেন এঁরাই।
শামসুর রাহমানের এই প্রবন্ধগুলো পূর্বে কোথাও প্রকাশ পেয়েছে কিনা তা তিনি বলেননি। যদিও একটি থেকে আরেকটির রচনাকালের ব্যবধান অনেক।
তাঁর প্রবন্ধের নামগুলো আমি এখানে উল্লেখ করে দিলাম: এক. ‘আমার চৈতন্য রবীন্দ্রনাথ’, দুই. ‘বুদ্ধদেব বসু, তাঁর সৃষ্টির তীর্থ’, তিন. ‘আজও প্রাসঙ্গিক রবীন্দ্রনাথ’, চার. ‘একজন উড়নচন্ডে বিদ্রোহী এবং মহাকবি’, পাঁচ. ‘এইসব ধূসর নাম হয়’, ছয়. ‘নিঃসঙ্গ নির্মাণে যিনি অক্লান্ত, মননে অগ্রসর’, সাত. ‘মনীষায় দীপ্ত গ্রন্থাবলি আমাদের উজ্জ্বল উদ্ধার’; আট. ‘কেন পড়ব রবীন্দ্র রচনাবলী’, নয়. একজন বিস্মৃত কবির রেখাচিত্র’, দশ. নিজস্ব মাতৃভাষায়’, এগারো. ‘দুই দেশের দুই কবির মেলামেশা’, বারো. নিত্য কবিতা ছাড়া যিনি এখন কিছু বোঝেন না’, তেরো. ‘বাংলাদেশের উর্দু লেখক সম্প্রদায়’ চৌদ্দ. ‘উদার মানবতাবাদী এক কবি’, পনেরো. ‘তিনি আবার গিয়ে বসুন তাঁর লেখার টেবিলে’, ষোল. ‘একজন স্নিগ্ধ কবি’, সতেরো. ‘পরিচয় ও অন্যান্য কথা’, আঠারো. ‘কবি, সুকুমার রায়’, উনিশ. ‘অক্ষুন্ন তাঁর সৃজনশীলতা’, বিশ. ‘তুমি আমার জলস্থলের মাদুর থেকে নামো, তুমি বাংলা ছাড়ো’, একুশ. ‘তিনি বেঁচে আছেন অন্যদের সময়ে’, বাইশ. ‘পুরানো ও নতুন বইয়ের সন্ধানে’, তেইশ. ‘লিটল ম্যাগাজিনের উজ্জ্বল উপস্থিতি’, চব্বিশ. ‘সমর সেনঃ সাহস ও সততার প্রকৃতির’, পঁচিশ. ‘সেলুলয়েডের মহান কবি’, ছাব্বিশ. ‘আকাশের আড়ালে আকাশে’, সাতাশ. ‘কবিতার দায়’ এবং আটাশ. ‘আমাদের সমাজ এবং লেখকের স্বাধীনতা।’
শামসুর রাহমান, রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে লিখেছেন তিনটি প্রবন্ধ। এবং আরো ভালো লাগে যে তাঁর প্রবন্ধ সংকলনটি রবীন্দ্রনাকে দিয়েই শুরু হয়। প্রথম প্রবন্ধটি কখন এবং কিভাবে রবীন্দ্রনাথের স্পর্শ বুঝতে পারেন তার বর্ণনা রয়েছে। এবং রবীন্দ্রনাথ থেকে আমরা কী শিক্ষা গ্রহণ করতে পারি। রবীন্দ্র সম্পর্কিত এই প্রবন্ধটিতে আরো আলোচনা করা হয় শার্ল বোদলেয়ার তাঁর কবিতা এবং আমাদের বিচরণক্ষেত্র এলিয়ট থেকে এলুয়ার, আরগ, লোরকা আর নেরুদার কাব্যভান্ডার গ্রহণের ফলে আমরা কতটা রবীন্দ্রবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছি।প্রবন্ধটির নাম ‘আমার চৈতন্যে রবীন্দ্রনাথ হলেও রবীন্দ্রনাথ’ চৈতন্যের সংস্পর্শে হয়ে উঠে সর্বজনের।
শামসুর রাহমান বলেন : ‘নানা কারণে রবীন্দ্রদর্শনের সঙ্গে আধুনিক মানুষের আত্মিক মিল নেই, এ কথা আগেই বলেছি। কিন্তু যে রবীন্দ্রনাথের মধ্যে দেশাত্ববোধের উম্মীলন লক্ষ করি, যে রবীন্দ্রনাথ সামাজিক অচলায়তনকে ভেঙে ফেলে মানবিক বোধের প্রসার ক্লান্তিহীন ভাবে যত্নশীল, মানুষের সব রকমের সংকীর্ণতা ক্ষুদ্রতা দৈন্যের বিরুদ্ধে এক মহান প্রতিবাদ, সাম্রাজ্যবাদের অশুভ আগ্রাসন বিষয়ে সচেতন, এবং আমাদের মধ্যে বিশ্ববোধ জাগ্রত ক’রে আমাদের চিৎ প্রকর্ষকে উন্নীত করার জন্য তাঁর দীর্ঘ জীবনের অক্লান্ত সাধনা নিয়োজিত করেছেন, আমাদের জীবনবাদী এবং সৌন্দর্যপিপাসু করে তুলেছেন, সে রবীন্দ্রনাথকে আমরা অস্বীকার করব কী করে? তিনি শুধু শিল্পসৃষ্টি করে ক্ষান্ত হননি, নিজের জীবনকেও শিল্পের মতো রচনা করেছেন। এজন্যেই শ্রদ্ধেয় অন্নদাশঙ্কর রায় রবীন্দ্রনাথকে বলেছেন ‘জীবন-শিল্পী’। আজ যখন আমাদের সমাজের সর্বক্ষেত্রে কুরুচির নোংরা দন্তবিকাশ আর স্থুলতার আষ্ফালনের আমরা ভেতরে ভেতরে সেধিয়ে যাচ্ছি, প্রায় তখন প্রতিবাদী জীবন-শিল্পী রবীন্দ্রনাথের বড়ো প্রয়োজন আমাদের।’
শামসুর রাহমান রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কিত দ্বিতীয় প্রবন্ধটি ‘আজও প্রাসঙ্গিক রবীন্দ্রনাথ।’
এখানে পাওয়া যাবে রবীন্দ্রনাথের সাথে তিরিশি কবিদের কবিতায় তাঁর কতটা আগমন ঘটেছে এবং কবি শামসুর রাহমানের সাথে রবীন্দ্রনাথের রচনার সামঞ্জস্য থাকবে কী থাকবে না। একটি স্থান জুঁড়ে রয়েছে রবীন্দ্র শত বার্ষিকী উৎসব। যে উৎসব উৎযাপিত হয় ১৯৬১ সালে। সেই সময় রবীন্দ্র শত বর্ষ উৎযাপন কতটা কষ্টকর হ’য়ে দেখা দিয়েছিল সেটা না পড়লে বুঝা যায় না। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে তাঁর শেষ লেখাটি ‘কেন পড়বো রবীন্দ্র রচনাবলী’। আজ অন্তত একুশ শতকে দাঁড়িয়ে আমরা বলতে পারি রবীন্দ্ররচনাবলীতে কী আছে আর কী নেই, কেন-ই বা পড়বো না রবীন্দ্র রচনাবলী। ‘সাহিত্যের মানুষ এবং রবীন্দ্রনাথ’ তাঁর কষ্টসহিষ্ণু রচনাবলী সম্পর্কে আরো বিভিন্ন অজানা দিকগুলো তু’লে ধরেছেন শামসুর রাহমান।
শামসুর রাহমান তাঁর প্রবন্ধ গ্রন্থে তিরিশি কবিদের দুই জনকে বেছে নেন। বুদ্ধদেব বসু যার কাছে বাঙলা কবিতা আজোও চিরকৃতজ্ঞ। বুদ্ধদেব বসুর কঙ্কাবতী তাঁর প্রবন্ধ গ্রন্থে ‘দয়মন্ত্রীলেখা’, (ভুলটা কেন হলো ঠিক বুঝতে পারলাম না), ‘দ্রৌপদ্রীর শাড়ি’, ‘শীতরাত্রির প্রার্থনা’, ‘বসন্তের উত্তর’, ‘যে আধার আলোর অধিক’, ‘মরচে-পড়া পেরেকের গান’, ইত্যাদি। কাব্যে গ্রন্থগুলো তিনি পড়ে উঠতে থাকেন ক্রমান্বয়ে।
তিনি শামসুর রাহমান, যিনি একান্তভাবে অভ্যন্তরে প্রবেশ করান বুদ্ধদেব বসুকে। শামসুর রাহমান সেই সৌভাগ্যবান কবি, যিনি কবিতা পত্রিকায় নিজের কবিতা ছাপেন। তাই তিনি বাহ্যিক এবং অভ্যন্তরীণ দু’ভাবেই কৃতজ্ঞ বুদ্ধদেবের কাছে। কবিতা পত্রিকার সাথে কতোটা গভীর সম্পর্ক গ’ড়ে উঠেছিল তা এ প্রবন্ধটি না পড়লে বুঝা সম্ভব নয়। শামসুর রাহমান প্রকাশ করেন এভাবে:
‘আগেই উল্লেখ করেছি দূর থেকে আমি বুদ্ধদেব বসুকে তাঁর অজ্ঞাত সারেই আমার একজন শিক্ষক হিসেবে সবিনয় শ্রদ্ধায় গ্রহণ করেছিলাম। কবিতায় আমার ছয় সাতটি লেখা প্রকাশিত হওয়ার পর আমার তারিফ করার সঙ্গে সঙ্গে আমার মতো একজন নতুন কবির দোষত্রুটি দেখিয়ে, নানা পরামর্শ দিয়ে প্রকৃত গুণী শিক্ষকের ভূমিকা পালন করেছেন আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম কালজয়ী স্থপতি। শুধু আমাকেই নয় আরওু কিছু সংখ্যক প্রতিশ্রুতিশীল তরুণকে তিনি সস্নেহ পরামর্শ দিয়ে দুর্বলতা শুধরে নিতে সাহায্য করেছেন। আমার এ কথার সঙ্গে, আশা করি, কবি বন্ধু সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ও সুর মেলাবেন।’
শামসুর রাহমান প্রকৃত নাম সরিয়ে রেখে লিখেছেন একাধিক প্রবন্ধ। যে প্রবন্ধের নামটি থেকে বোঝা সম্ভব নয় কাকে নিয়ে লেখা হয়েছে। একজন ‘উড়চন্ডে বিদ্রোহী’ এবং ‘মহাকবি’ প্রবন্ধটিতে মহাকবি ব্যবহার করে ব্যক্তিটি বেশ স্পষ্ট হয়ে উঠে আমাদের সামনে। বুঝে নিতে কষ্ট হয় না তিনি কে। কিন্তু ‘একজন উড়নচন্ডে বিদ্রোহী’ বললে আমি না পড়েই বুঝে নিতাম ‘নজরুল’কে। কারণ, ‘বিদ্রোহী’ নজরুলের আয়ত্তে। তাই নাম থেকে শামসুর রাহমানের প্রবন্ধের ধারণা সৃষ্টি করা সম্ভব নয়। প্রবেশ করতে হয় তাঁর গহীন ভিতরে। এ রকম আরো বেশ কয়েকটি, (কয়েকটি বললে সম্ভবত ভুল হবে, একাধিক বলাই ভালো। প্রবন্ধ রয়েছে, যেমন : নিঃসঙ্গ নির্মাণে যিনি অক্লান্ত, মননে অগ্রসর (শওকত ওসমানকে নিয়ে), একজন বিস্মৃত কবির রেখাচিত্র (চৌধুরী ওসমানকে উদ্দেশ্য করে), নিত্য কবিতা ছাড়া যিনি এখন কিছু বোঝেন না। (সিকদার আমিনুল হককে নিয়ে)।
উদার মানবতাবাদী এক কবি (নজরুল ইসলামকে নিয়ে), তিনি আবার গিয়ে বসুন তাঁর লেখার টেবিলে (রশীদ করিমকে নিয়ে), একজন স্নিগ্ধ কবি (আহসান হাবিবকে নিয়ে) ইত্যাদি। এটাকে আমি আর দীর্ঘ করলাম না। শামসুর রাহমানের প্রবন্ধ স্পর্শ ক’রে অনেক কবি এবং কর্ম জীবনে কবিদের সাথে তাঁর সুসম্পর্কের অধ্যায়নগুলো খুব ভালোভাবে জানা হ’য়ে গেল। যেটা হয়তো তিনি ছাড়া অন্য কারো কাছ থেকে সম্ভবপর হ’য়ে উঠতো না। কেননা, তিনি হ’য়ে উঠেছেন কালের বা সময়ের স্বাক্ষী।
শামসুর রাহমান, হুমায়ুন আজাদকে নিয়ে লিখেন নাতিদীর্ঘ একটি প্রবন্ধ। নাম দেন ‘তিনি বেচেঁ আছেন অন্যদের সময়ে’। নামটি হুমায়ুন আজাদের পঞ্চম কাব্যে গ্রন্থ ‘আমি বেঁচে ছিলাম অন্যদের সময়ে’-এর প্রথম কবিতা ‘আমি বেঁচে ছিলাম অন্যদের সময়ে’-এর শিরোনাম থেকে। কবিতাটি দীর্ঘ, তাই সম্পূর্ণ কবিতাটি ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও উল্লেখ করছি না। উল্লেখ করলাম কবিতাটির প্রথম দিকের কিছু অংশ:
“আমি বেঁচি ছিলাম অন্যদের সময়ে।
আমার খাদ্যে ছিল অন্যদের আঙুলের দাগ,
আমার পানীয়তে ছিল অন্যদের জীবাণু,
আমার বিশ্বাসে ছিলো অন্যদের ব্যাপক দূষণ।
আমি জন্মেছিলাম আমি বেড়ে উঠেছিলাম।
আমি বেঁচে ছিলাম অন্যদের সময়ে
আমি দাঁড়াতে শিখেছিলাম অন্যদের মতো।,
আমি পোশাক পরতে শিখেছিলাম অন্যদের মতো ক’রে
আমি চুল আঁচড়াতে শিখেছিলাম অন্যদের মতো ক’রে
আমি কথা বলতে শিখেছিলাম অন্যদের মতো।”
শামসুর রাহমান, যাঁর কবিতায় উঠে আসে গ্রাম্যভাবধারা থেকে আরো অনেক বেশি নাগরিক জীবন। নগর জীবনের সুখ, দুঃখ, আনন্দ, বেদনা সর্বোপরি তার জীবন চরিত্র হ’য়ে উঠে কবিতার প্রধান উপাদান।
হুমায়ুন আজাদের ‘আমি বেঁচে ছিলাম অন্যদের সময়ে’ প্রকাশ পায় ১৯৯০-এ। শামসুর রাহমান এই গ্রন্থটি পড়ার পর অপেক্ষা করতে থাকেন পরবর্তী গ্রন্থের জন্যে। আজাদ তাই আবার দেখা দেন ১৯৯৮-এ ‘কাফনে মোড়া অশ্রুবিন্দু, নিয়ে। শামসুর রাহমানের প্রবন্ধের গ্রন্থটি প্রকাশ পায় ২০০০-এ। শামসুর রাহমান গ্রন্থটির শেষে উপস্থাপন করেন এক দীর্ঘ প্রবন্ধ। নাম দেন আমাদের সমাজ এবং লেখকের স্বাধীনতা। এটিই এই গ্রন্থের সবচেয়ে দীর্ঘ প্রবন্ধ। লেখক এবং লেখকের স্বাধীনতা আজ আমাদের কতোটা প্রয়োজন তা এটি না পড়লে বুঝা সম্ভব নয়। এটি সম্ভবত লেখকের স্বাধীনতা নিয়ে আমার পড়া দ্বিতীয় প্রবন্ধ। এর আগে লেখকের মত এবং স্বাধীনতা নিয়ে আরেকজনকে উচ্চারিত হ’য়ে দেখেছি, তিনি হুমায়ুন আজাদ। যতদূর মনে পড়ে...‘নারী’ গ্রন্থের বাজেয়াপ্ত বিষয় নিয়ে তিনি লেখক এবং লেখকের স্বাধীনতার মত প্রকাশের বিষয় নিয়ে এতোটা উচ্চারিত হ’য়ে পড়েন, যা অন্য কারো মাঝে দেখি না।
লেখাটার শুরুতেই শামসুর রাহমান ব্যক্তিগত কিছু বক্তব্য উপস্থাপন প্রকাশ করেন। শামসুর রাহমান শুধু স্বাধীনতা বিষয়ক ব্যাপারের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেননি। একেক করে এনেছেন লেখক, কবি, সাংবাদিক, সাহিত্যিক এবং তাদের বিভিন্ন দিক। শুরুতেই যে নামটি পাই তিনি নওসের আলী খাঁ, ইউসুফ জয়ী। এরপর মীর মশাররফ হোসেন, মুনীর চৌধুরী, নজরুল ইসলাম, মোহাম্মদ রিয়াজউদ্দীন আহমদ, মুস্তাফা নূরউল ইসলাম এবং আরো অনেকে। বেগম রোকেয়ার ‘আমাদের অবনতি’ থেকে অংশ বিশেষ উদ্ধৃতি করে সে সময়কার ‘সময়চিত্র নিয়ে লেখেন বেশ অংশ জুঁড়ে। এই লেখাটির সবচেয়ে বড় দিক হচ্ছে সে সময়কার বিভিন্ন উঁচুস্বরে যে সব পত্রিকা বা সাময়িক ছিল, তাতে যে সব লেখক লেখা পাঠাতেন তাদের সাথে কবি শামসুর রাহমানের যে সুসম্পর্ক গ’ড়ে উঠেছিল তা তিনি খুব সুন্দর ভাবে প্রকাশ করেছেন।
শামসুর রাহমান ব্যক্তি, সমাজ, সমাজ চেতনা, তার ভিতরকার কিছু মানুষ, এবং তাদের মত প্রকাশের ধরণ যে এক নয় তা গভীর ভাবে তু’লে ধরেছেন। মনে করি তিনি লেখার মাধ্যমে তাদেরই নাম নিতে চেয়েছেন যাঁদের নাম হয়তো অন্যেরা কখনও নিত কিনা সেটা সন্দেহ থেকে যেত। বড় হওয়ার দায়বোধ যে কত বড় হতে পারে তা এই রচনা না পড়লে কখনো বুঝা যেত না। শামসুর রাহমান, তাঁদের-ই স্মরণ করেছেন যাঁরা চেতনায় আজও উজ্জ্বল।