২৩ নভেম্বর, ১৯০২ সালে জোড়াসাঁকোতে ২৮ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন মৃণালিনী দেবী। রবীন্দ্রনাথের পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮১৭-১৯০৫) তখনও জীবিত আর রবীন্দ্রনাথের বয়স ৪১ বছর। ১৮ই অগ্রহায়ণ, ১৩০৯ সালে রবীন্দ্রনাথ, দীনেশচন্দ্র সেনকে একটি চিঠিতে লেখেন, ‘ঈশ্বর আমাকে যে শোক দিয়াছেন তাহা যদি নিরর্থক হয় তবে এমন বিড়ম্বনা আর কি হইতে পারে। ইহা আমি মাথা নিচু করিয়া গ্রহণ করিলাম। যিনি আপন জীবনের দ্বারা আমাকে নিয়ত সহায়বান করিয়া রাখিয়াছিলেন তিনি মৃত্যুর দ্বারাও আমার জীবনের অবশিষ্টকালকে সার্থক করবেন। তাহাঁর কল্যাণ স্মৃতি আমার সমস্ত কল্যাণ কর্মের নিত্য সহায় হইয়া আমাকে বলদান করিবে।’ সেই একই সময় রবীন্দ্রনাথ সত্যরঞ্জন বসুকে লেখেন অপর আর একটি চিঠি। চিঠির তারিখ হিশেবে আমরা পাই ১৮ই অগ্রহায়ণ, ১৩০৯। রবীন্দ্রনাথ লেখেন, ‘তোমার পত্রখানি পাইয়া আমার হৃদয় স্নিদ্ধ হইল। তুমি অল্পদিন এখানে থাকিয়াই তাহাঁর স্নেহপ্রবণ হৃদয়ের পরিচয় পাইয়াছ। তাহাঁর স্বভাব মাতৃভাবে পূর্ণ ছিল এবং তিনি তোমাকে আপন সন্তানের চক্ষেই দেখিয়াছিলেন। এখানকার বিদ্যালয়ে তুমি আসিবে এবং তাহাঁর যত্ন শুষসার অধীনে থাকিবে ইহার জন্য তিনি ঐৎসুকে্যর সহিত প্রতীক্ষা করিয়াছিলেন। তুমি তাহাঁর কাছে থাকিলে কখনো মাতার এক মুহূর্তের জন্যও অনুভব করিতে পারিতে না ইহা নিঃসন্দেহ। ঈশ্বর আমাকে যে শোক দিয়াছেন সেই শোককে তিনি নিষ্ফল করিবেন না- তিনি আমাকে এই শোকের দ্বার দিয়া মঙ্গলের পথে উত্তীর্ণ করিয়া দিবেন। তোমার কল্যাণ-কামনা আমার হৃদয়ে জাকরুক রহিয়াছে- তুমি সকল বাধা বিপত্তি সুখ দুঃখের ভিতর দিয়া পরিপূর্ণ মনুষ্যত্বের দিকে অগ্রস্র হইতে থাকো; স্বদেশের হিতানুস্ঠানের জন্য আপনার জীবনকে প্রস্তুত করিয়া তোল ইহাই আমি একান্তচিত্তে কামনা করি।
‘রবীন্দ্রনাথের জীবন ও সাহিত্য’ গ্রন্থে আমরা পাই আরও একটি চিঠি। রবীন্দ্রনাথ মূলত চিঠিটি কাকে লিখেছিলেন তার কোন সুস্পষ্ট চিহ্ন আমরা দেখতে পাই না। ইতি’তে রবীন্দ্রনাথ লেখেন আপনার ‘শ্রীরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর’। রবীন্দ্রনাথ লেখেন, ‘ঈশ্বর আমাকে গৃহ হইতে বহিষ্কৃত করিয়া দিয়াছেন-এক্ষণে আমাকে ভিক্ষুব্রত গ্রহণ করিতে হইবে। আপনার দ্বারে আমার এই প্রার্থনা যে বোলপুর ব্রহ্ম চর্যাশ্রমের একটি ছাত্রের ব্যয়ভার আপনাকে গ্রহণ করিতেই হইবে। অধিক নহে, বৎসরে ১৮০ টাকা। প্রতি বৎসর অগ্রাহায়ন মাসে যদি এই টাকাটি দেন তবে তাহা আমার পরলোকগত পত্নীর মৃত্যুবার্ষিক মঙ্গলদান বলিয়া আমি তৃপ্তিলাভ করিব এবং তাহাতে ঈশ্বর আপনারও কল্যাণ করিবেন।’ এই দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে রবীন্দ্রনাথ লিখছেন একটির পর একটি চিঠি; বিভিন্নজনকে। মোহিতচন্দ্রসেনকে; রবীন্দ্রনাথ লেখেন এই চিঠিটি। রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘আপনি বুঝি আমার পাঠিকাকেও খাটিয়ে নিচ্ছেন? তিনি যে দুটি নাম দিয়েছেন সে ঠিকই হয়েছে কিন্তু তাঁর নালিশ সম্বন্ধে আমার তরফে দুটি একটি কথা বলবার আছে। আমার এই কবিতাগুলি সবই খোকার নামে-তাঁর একটি প্রধান কারণ এই- যে ব্যক্তি লিখেছে সে আজ চল্লিশ বছর খোকাই ছিল, দুর্ভাগ্যক্রমে খুকি ছিল না। তার সেই খোকা জন্মের অতি প্রাচীন ইতিহাসে থেকে যা কিছু উদ্ধার করতে পেরেছে তাই তার লেখনীর সম্বল-খুকীর চিত্ত তার কাছে এত সুস্পষ্ট নয়। তা ছাড়া আর একটি কথা আছে- খোকা এবং খোকার মার মধ্যে যে ঘনিষ্ঠ মধুর সম্বন্ধও, সেইটে আমার গৃহস্মৃতির শেষ মাধুরী- তখন খুকি ছিল না-মাতৃশয্যার সিংহাসনে খোকাই তখন চক্রবর্তী সম্রাট ছিল-সেই জন্য লিখতে গেলেই খোকা এবং খোকার মার ভাবটুকু সূর্যাস্তের পরবর্তী মেঘের মত রঙে রাঙিয়ে ওঠে-সেই অস্তমিত মাধুরীর সমস্ত কিরণ এবং বর্ণ আকর্ষণ করে আমার অশ্রুবাষ্প এই রকম খেলা খেলছে- তাকে নিবারণ করতে পারিনে।’
মোহিতচন্দ্র সেনকে লিখিত অপর কোন এক চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘ঈশ্বর আমার শোককে নিষ্ফল করিবেন না। তিনি আমার পরম ক্ষতিকেও সার্থক করিবেন তাহা আমার হৃদয়ের মধ্যে অনুভব করিয়াছি। তিনি আমাকে আমার শিক্ষালয়ের এক শ্রেণী হইতে আর এক শ্রেণীতে উত্তীর্ণ করিলেন।’ হেমন্তবালা দেবীকে লিখিত কোন এক চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘বহুদিন পূর্বে একদিন নাটোরের মহারাজ পদ্মতীরে আমার বোটে আতিথ্য গ্রহণ করিলেন। তাঁর সঙ্গে কথা ছিল প্রতিদিন তাকে একটা কিছু সম্পূর্ণ নতুন জিনিষ খাওয়াব। মীরার মা ছিলেন এই চক্রান্তের মধ্যে- তিনি খুব ভাল রাঁধতে পারতেন। কিন্তু নতুন খাদ্য উদ্ভাবনের ভার নিয়েছিলুম আমি। সেই সকল অপূর্ব ভোজের বিবরণসহ তালিকা আমার স্ত্রীর খাতায় ছিল। সেই খাতা আমার বড় মেয়ের হাতে পড়ে। এখন তারা দুজনেই অন্তর্হিত। আমার একটা মহৎ কীর্তি বিলুপ্ত হল। রূপকার রবীন্দ্রনাথের নাম টিকতেও পারে, সুপকার রবীন্দ্রনাথকে কেউ জানবে না।’ হেমন্তবালা দেবীকে লিখিত অপর কোন এক চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘একদা পদ্মার চরে নাটোরের মহারাজ জগদিন্দ্র কিছুকাল আমার অতিথি ছিলেন- প্রতিদিন তাঁর জন্য নতুন একটা করে ভোজ্য আমি উদ্ভাবন করেছি-সেটা প্রস্তুত করবার ভার ছিল যার পড়ে তাঁরও কিছু কৃতিত্ব তাঁর সঙ্গে সংযুক্ত ছিল। এ সব তিনি লিখে রেখেছিলেন খাতায়, সেই খাতা দখল করেছিল আমার বড় মেয়ে- সেও নেই, খাতাও অদৃশ্য-গৌড়জন যাহে আনন্দে করিবে ভোগ খাদ্য নিরবধি, তাঁর উপায় রইল না, অথচ রইল কতগুলো কবিতা।’
শান্তিনিকেতন বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত এবং তার জন্য বিভিন্নজনের নিকট সাহায্য চেয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। হীরেন্দ্রনাথ দত্তকে লিখিত ১৩ই অগ্রহায়ণ, ১৩০৯-এর কোন এক চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘আপনার সহিত আমার অনেকটা পরিচয় হইয়াছে বলিয়া বিশ্বাস জন্মিয়াছে। সেই জন্য সঙ্কোচ পরিহারপূর্বক আপনার কাছে একটি ভিক্ষা লইয়া উপস্থিত হইলাম। শান্তিনিকেতন ব্রহ্মচর্যাশ্রমে কয়েকটি দরিদ্র বালককে বিনা বেতনে পড়াইয়া থাকি। তাহাদের ব্যয়ভার আমরা বান্ধবদের মধ্যে পরস্পর ভাগ করিয়া লইবার জন্য উদ্যত হইয়াছি। একটি বালকের ভার আপনি যদি গ্রহণ করেন তবে উপকৃত হইব। হিসাব করিয়া দেখা গেছে প্রত্যেক বালকের খাইখরচের জন্য মাসে প্রায় ১৫ টাকা অর্থাৎ বৎসরে ১৮০ টাকা লাগে। প্রতিবর্ষে অগ্রহায়ণ মাসে এই ১৮০ টাকা বার্ষিক দান পাইবার জন্য আমি সুহৃদগণের দ্বারে সমাগত। আপনাকে বলিতে সঙ্কোচ করিব না আমার পরলোকগত পত্নীর কল্যাণকামনার সঙ্গে আমি এই ভিক্ষাব্রত জড়িত করিয়াছি। আর একটি কথা আমি পূর্বেই বলিয়াছি আমার বিদ্যালয়ের সঙ্গে আপনার যোগ আমি কামনা করি। আপনাদের পরামর্শ ও সহযোগিতা ব্যতীত এ বিদ্যালয়েরে প্রতিষ্ঠা সুদৃঢ় হইবে না।’
মৃণালিনী দেবী মারা যান ১৩০৯ সালের ৭ অগ্রহায়ণে। তাঁর স্মৃতির উদ্দেশ্য; রবীন্দ্রনাথ যে কবিতাগুলি রচনা করেন তার অধিকাংশই বঙ্গদর্শনেই (নবপর্যায়), মাসিকপত্রের ১৩০৯ অগ্রহায়ণ-ফাল্গুন সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। পরে সেগুলি মোহিতচন্দ্র সেন সম্পাদিত কাব্যগ্রন্থবলীতে (১৩১০) সংকলিত হয়, অধিকাংশই স্মরণ বিভাগে এবং বর্তমান স্মরণ গ্রন্থের তিনটি কবিতা মরণ বিভাগে। স্মরণ স্বতন্ত্র গ্রন্থকারে প্রকাশিত হয় অনেক পরে, ১৩২১ সালে। স্মরণের কবিতাগুলো তাই বার-বার যেন মৃণালিনী দেবীর কথাই আমাদের মনে করিয়ে দেয়। তাই এ-স্মৃতির শুরুতেই মনে পড়ে বোলপুর থেকে রচিত, ২ পৌষ, ১৩০৯-এ স্মরণে’র ১৪ সংখ্যক কবিতাটি ‘দেখিলাম খানকয়েক পুরাতন চিঠি–/স্নেহমুগ্ধ জীবনের চিহ্ন দু-চারিটি/স্মৃতির খেলনা-ক’টি বহু যত্নভরে/গোপনে সঞ্চয় করি রেখেছিলে ঘরে।/যে প্রবল কালস্রোতে প্রলয়ের ধারা/ভাসাইয়া যায় কত রবিচন্দ্রতারা,/তারি কাছ হতে তুমি বহু ভয়ে ভয়ে/এই ক’টি তুচ্ছ বস্তু চুরি করে লয়ে/লুকায়ে রাখিয়াছিলে, বলেছিলে মনে,/’অধিকার নাই কারো আমার এ ধনে’।/আশ্রয় আজিকে তারা পাবে কার কাছে?/জগতের কারো নয়, তবু তারা আছে।/তাদের যেমন তব রেখেছিল স্নেহ,/তোমারে তেমনি আজ রাখে নি কি কেহ? এ-চিঠির আবেদন রবীন্দ্রনাথের নিকট চিরকাল যেন অম্লান হ’য়ে রইল। সেই হারানো ধন আবার কবি যখন ফিরে পেলেন, তাকে আশ্রয় দিলেন মনের গভীরে। সেই স্মৃতি যেন কোন ভাবেই মুছে যাচ্ছে না কবির নিকট হতে। তা যেন দিন-দিন আরও সুখের পরশ হ’য়ে বেঁচে আছে রবীন্দ্রনাথের নিকট। স্মরণে’র প্রথম কবিতাই আমাদের মনে দাগ কেটে যায় কোন এক অজানার স্মৃতির চিত্র ভেসে উঠা অবয়ব নিয়ে। তাই রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘আজি প্রভাতেও শ্রান্ত নয়নে/রয়েছে কাতর ঘোর।/দুখশয্যায় করি জাগরণ/রজনী হয়েছে ভোর।/নবফুটন্ত ফুলকাননের/নব জাগ্রত শীতপবনে/সাথি হইবারে পারে নি আজিও/এ দেহ-হৃদয় মোর।/আজি মোর কাছে প্রভাত তোমার/করো গো আড়াল করো-এ খেলা এ মেলা এ আলো এ গীত/আজি হেথা হতে হরো।/প্রভাত জগৎ হতে মোরে ছিঁড়ি/ করুণ আঁধারে লহো মোরে ঘিরি,/উদাস হিয়ারে তুলিয়া বাঁধুক/তব স্নেহবাহুডোর। এ-স্মৃতি যেন কোন ভাবেই ভুলে যাওয়ার নয়। একটি দিক খুব সুস্পষ্ট হ’য়ে উঠে; এ-কাব্যের মধ্যে দিয়েই মৃণালিনী যেন বেঁচে আছেন অনন্ত কাল ধরে, রবীন্দ্রনাথের হৃদয়ে।
রবীন্দ্রনাথ বার-বার যেন ভুলে যেতে চান সেই করুণ কষ্টের স্মৃতিগুলো; কিন্তু কোন ভাবেই তা আর ভুলে যেতে পারেন না। শান্তিনিকেতন থেকে ২৩ পৌষ, ১৩০৯-এ রচিত স্মরণে’র ২৬ সংখ্যক কবিতাটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় মৃণালিনী দেবীর সেই বিদায়ের কথা; তাই রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘আজিকে তুমি ঘুমাও, আমি জাগিয়া রবদুয়ারে–/রাখিব জ্বালি আলো।/তুমি তো ভালো বেসেছ, আজি একাকী শুধু আমারে/বাসিতে হবে ভালো।/আমার লাগি তোমারে আর হবে না কভু সাজিতে,/তোমার লাগি আমি/এখন হতে হৃদয়খানি সাজায়ে ফুলরাজিতে রাখিব দিনযামী।/তোমার বাহু কত-না দিন শ্রান্তি-দুখ ভুলিয়া/গিয়েছে সেবা করি,/আজিকে তারে সকল তার কর্ম হতে তুলিয়া/রাখিব শিরে ধরি।/এবার তুমি তোমার পূজা সাঙ্গ করি চলিলে সঁপিয়া মনপ্রাণ,/এখন হতে আমার পূজা লহো গো আঁখিসলিলে–আমার স্তবগান।’ রবীন্দ্রনাথের এই কষ্ট, স্মৃতি, ভাবনা আর হৃদয়ের উজ্জ্বল চিহ্নগুলো বেঁচে আছে কোন এক গাঢ় বিষাদের একাকী মননে। যেখান থেকে কোন ভাবেই তিনি যেন ফিরে আসতে পারছেন না। তাই বার-বার আমরা দেখতে পাচ্ছি, রবীন্দ্রনাথের মননে সেই স্মৃতি যেন বাসা বেঁধে বসে আছে। যেখান থেকে বের হওয়া খুবই কষ্টকর। একই কাব্যের ১২ সংখ্যক কবিতাটিতে চোখ রাখি। যা রবীন্দ্রনাথ রচনা করেন শান্তিনিকেতন থেকে; ৪ পৌষ, ১৩০৯ সালে। রবীন্দ্রনাথের সমস্ত অস্তিত্ব যেন একাকার হ’য়ে আছে এ-কবিতাটিতে। ‘আপনার মাঝে আমি করি অনুভব/পূর্ণতর আজি আমি। তোমার গৌরব/মুহূর্তে মিশায়ে তুমি দিয়েছ আমাতে।/ছোঁয়ায়ে দিয়েছ তুমি আপনার হাতে/মৃত্যুর পরশমণি আমার জীবনে।/উঠেছ আমার শোকযজ্ঞহুতাশনে/নবীন নির্মল মূর্তি; আজি তুমি, সতী,/ধরিয়াছ অনিন্দিত সতীত্বের জ্যোতি,/নাহি তাহে শোকদাহ, নাহি মলিনিমা–/ক্লান্তিহীন কল্যাণের বহিয়া মহিমা/নিঃশেষে মিশিয়া গেছ মোর চিত্ত-সনে।/তাই আজি অনুভব করি সর্বমনে–/মোর পুরুষের প্রাণ গিয়েছে বিস্তারি/নিত্য তাহে মিলি গিয়া মৃত্যুহীন নারী।’ মৃণালিনী দেবীকে হারানো স্মৃতি যেন রবীন্দ্রনাথের মনে এক বিষাদের ক্ষত হ’য়ে আছে। হারানো স্মৃতির মধ্যেই যেন তাকে খুঁজে ফিরেন। ৫ সংখ্যক কবিতাটিতে তাই দেখতে পাই। ‘আমার ঘরেতে আর নাই সে যে নাই—/যাই আর ফিরে আসি, খুঁজিয়া না পাই।/আমার ঘরেতে নাথ, এইটুকু স্থান—/সেথা হতে যা হারায় মেলে না সন্ধান।/অনন্ত তোমার গৃহ, বিশ্বময় ধাম,/হে নাথ, খুঁজিতে তারে সেথা আসিলাম।/দাঁড়ালেম তব সন্ধ্যা-গগনের তলে,/চাহিলাম তোমা-পানে নয়নের জলে।/কোনো মুখ, কোনো সুখ, আশাতৃষা কোনো/যেথা হতে হারাইতে পারে না কখনো,/সেথায় এনেছি মোর পীড়িত এ হিয়া—/দাও তারে, দাও তারে, দাও ডুবাইয়া।/ঘরে মোর নাহি আর যে অমৃতরস/বিশ্ব-মাঝে পাই সেই হারানো পরশ।’ রবীন্দ্রনাথের এই গভীর ভাবনার মধ্যে যখন শুনতে পাই, ‘আমার ঘরেতে আর নাই সে যে নাই...যাই আর ফিরে আসি, খুঁজিয়া না পাই’।
হারিয়ে যাওয়া এবং তাকে নিজের মাঝে খুঁজে নেওয়ার এই নিরন্তর প্রবণতা থেকে রবীন্দ্রনাথ কখনোও মুক্তি পাননি। হারিয়ে যাওয়ার মাঝেই যেন তিনি আবার ফিরে আসেন তার আপন সত্ত্বায়।স্মরণে’র ১৫ সংখ্যক কবিতাটি পড়া যাক, ‘এ সংসারে একদিন নববধূবেশে/তুমি যে আমার পাশে দাঁড়াইলে এসে,/রাখিলে আমার হাতে কম্পমান হাত,/সে কি অদৃষ্টের খেলা, সে কি অকস্মাৎ?/শুধু এক মুহূর্তের এ নহে ঘটনা,/অনাদিকালের এ আছিল মন্ত্রণা।/দোঁহার মিলনে মোরা পূর্ণ হব দোঁহে,/বহু যুগ আসিয়াছি এই আশা বহে।/নিয়ে গেছ কতখানি মোর প্রাণ হতে,/দিয়ে গেছ কতখানি এ জীবনস্রোতে!/কত দিন কত রাত্রে কত লজ্জাভয়ে/কত ক্ষতিলাভে কত জয়ে পরাজয়/রচিতেছিলাম যাহা মোরা শ্রান্তিহারা/সাঙ্গ কে করিবে তাহা মোরা দোঁহে ছাড়া?। রবীন্দ্রনাথ কবিতাটি লেখেন শান্তিনিকেতন থেকে; ২ পৌষ, ১৩০৯ সালে। কবিতাটির শুরুতেই রবীন্দ্রনাথ বলে দিয়েছেন মনের লুকানো সমস্ত কথাগুলো। ‘এ সংসারে একদিন নববধূবেশে, তুমি যে আমার পাশে দাঁড়াইলে এসে’-এ অভিব্যক্তি রবীন্দ্রনাথ মৃণালিনী দেবীকেই উদ্দেশ্য করে বলেছেন। রবীন্দ্রনাথ মনে রেখেছেন সেই প্রথম দিনের স্মৃতিগুলো; যেদিন এ সংসারে প্রবেশ করেছিলেন মৃণালিনী দেবী; রবীন্দ্রনাথের সহধর্মীরূপে।
২০ সংখ্যক কবিতাটি লেখেন শান্তিনিকেতন থেকে, ২৮ পৌষ, ১৩০৯ সালে। এই পৌষেই রবীন্দ্রনাথ রচনা করেন বেশির ভাগ কবিতা।স্মরণে’র এই কবিতাটি পড়া যাক, ‘এসো, বসন্ত, এসো আজ তুমি/আমারও দুয়ারে এসো।/ফুল তোলা নাই, ভাঙা আয়োজন,/নিবে গেছে দীপ, শূন্য আসন,/আমার ঘরের শ্রীহীন মলিন/দীনতা দেখিয়া হেসো।/তবু, বসন্ত, তবু আজ তুমি/আমারও দুয়ারে এসো।/আজিকে আমার সব বাতায়ন/রয়েছে, রয়েছে খোলা।/বাধাহীন দিন পড়ে আছে আজ,/নাই কোনো আশা, নাই কোনো কাজ,/আপনা-আপনি দক্ষিণবায়ে/দুলিছে চিত্তদোলা,/শূন্য ঘরে সব বাতায়ন/আজিকে রয়েছে খোলা।/কত দিবসের হাসি ও কান্না/হেথা হয়ে গেছে সারা।/ছাড়া পাক তারা তোমার আকাশে,/
নিশ্বাস পাক তোমার বাতাসে,/নব নব রূপে লভুক জন্ম/বকুলে চাঁপায় তারা।/গত দিবসের হাসি ও কান্না/যত হয়ে গেছে সারা।/আমার বক্ষে বেদনার মাঝে/করো তব উৎসব।/আনো তব হাসি, আনো তব বাঁশি,/ফুলপল্লব আনো রাশি রাশি,/ফিরিয়া ফিরিয়া গান গেয়ে যাক/যত পাখি আছে সব।/বেদনা আমার ধ্বনিত করিয়া/করো তব উৎসব।/সেই কলরবে অন্তর-মাঝে/পাব, পাব আমি সাড়া।/দ্যুলোকে ভূলোকে বাঁধি এক দল/তোমরা করিবে যবে কোলাহল,/হাসিতে হাসিতে মরণের দ্বারে/বারে বারে দিবে নাড়া/সেই কলরবে অন্তর-মাঝে/পাব, পাব আমি সাড়া।’ এই বসন্তে রবীন্দ্রনাথ; মৃণালিনী দেবীকে আহ্বান করেছেন তাঁর অন্তর মাঝে আসার জন্য। এই আসা যেন স্বাভাবিক নয়; অন্ধকারে উজ্জ্বল হ’য়ে উঠুক তাঁর পদধ্বনি। যার অপেক্ষায় ছিলেন দীর্ঘক্ষণ ধরে। তাই মনের মাঝে লুকানো সমস্ত গাঢ় বেদনা যেন প্রকাশ পায় আপন মনে। স্মরণে’ র ৪ সংখ্যক কবিতাটি একটু পড়ে নেওয়া যাক, ‘তখন নিশীথরাত্রি; গেলে ঘর হতে/যে পথে চল নি কভু সে অজানা পথে।/যাবার বেলায় কোনো বলিলে না কথা,/লইয়া গেলে না কারো বিদায়বারতা।/সুপ্তিমগ্ন বিশ্ব-মাঝে বাহিরিলে একা—/অন্ধকারে খুঁজিলাম, না পেলাম দেখা।/মঙ্গলমুরতি সেই চিরপরিচিত/অগণ্য তারার মাঝে কোথায় অন্তর্হিত !/গেলে যদি একেবারে গেলে রিক্ত হাতে?/এ ঘর হইতে কিছু নিলে না কি সাথে?/বিশ বৎসরের তব সুখদুঃখভার/ফেলে রেখে দিয়ে গেলে কোলেতে আমার!/প্রতিদিবসের প্রেমে কতদিন ধরে/যে ঘর বাঁধিলে তুমি সুমঙ্গল-করে/পরিপূর্ণ করি তারে স্নেহের সঞ্চয়ে,/আজ তুমি চলে গেলে কিছু নাহি লয়ে?/তোমার সংসার-মাঝে, হায়, তোমা-হীন/এখনো আসিবে কত সুদিন-দুর্দিন—/তখন এ শূন্য ঘরে চিরাভ্যাস-টানে/তোমারে খুঁজিতে এসে চাব কার পানে?/আজ শুধু এক প্রশ্ন মোর মনে জাগে—/হে কল্যাণী, গেলে যদি, গেলে মোর আগে,/মোর লাগি কোথাও কি দুটি স্নিগ্ধ করে/রাখিবে পাতিয়া শয্যা চিরসন্ধ্যা-তরে?’
স্মরণের প্রতি পঙক্তিতে যেন ছড়িয়ে আছে বিষাদের গাঢ় বেদনা। তাই যত হারানো চিহ্ন যেন দেখতে পাই এ গ্রন্থে। স্মরণের উনিশ সংখ্যক কবিতাটি রবীন্দ্রনাথ রচনা করেন শান্তিনিকেতন থেকে, ২৫ পৌষ, ১৩০৯ সালে। কবিতাটি একটু পড়া যাক।
‘পাগল বসন্তদিন কতবার অতিথির বেশে/তোমার আমার দ্বারে বীণা হাতে এসেছিল হেসে/লয়ে তার কত গীত, কত মন্ত্র মন ভুলাবার,/জাদু করিবার কত পুষ্পপত্র আয়োজন-ভার।/কুহুতানে হেঁকে গেছে, খোলো ওগো, খোলো দ্বার খোলো।/কাজকর্ম ভোলো আজি, ভোলো বিশ্ব, আপনারে ভোলো।/এসে এসে কত দিন চলে গেছে দ্বারে দিয়ে নাড়া-/আমি ছিনু কোন্ কাজে, তুমি তারে দাও নাই সাড়া।/আজ তুমি চলে গেছ, সে এল দক্ষিণবায়ু বাহি-/আজ তারে ক্ষণকাল ভুলে থাকি হেন সাধ্য নাহি।আনিছে সে দৃষ্টি তব, তোমার প্রকাশহীন বাণী,/মর্মরি তুলিছে কুঞ্জে তোমার আকুল চিত্তখানি।/মিলনের দিনে যারে কতবার দিয়েছিনু ফাঁকি/তোমার বিচ্ছেদ তারে শূন্যঘরে আনে ডাকি ডাকি।’ এই কষ্ট যেন রবীন্দ্রনাথের একার নয়; একাকার হ’য়ে উঠে আমাদের হৃদয়েও। তাই তাঁর সাথে আমরাও মিশে যাই সেই গভীর দুঃখের সাথে। একই কাব্যের একুশ সংখ্যক কবিতাটি পড়া যাক, ‘বহুরে যা এক করে, বিচিত্রেরে করে যা সরস,/প্রভূতেরে করি আনে নিজ ক্ষুদ্র তর্জনীর বশ,/বিবিধপ্রয়াসক্ষুব্ধ দিবসেরে লয়ে আসে ধীরে/সুপ্তিসুনিবিড় শান্ত স্বর্ণময় সন্ধ্যার তিমিরে/ধ্রুবতারাদীপদীপ্ত সুতৃপ্ত নিভৃত অবসানে,/বহুবাক্যব্যাকুলতা ডুবায় যা একখানি গানে/বেদনার সুধারসে-সে প্রেম হতে মোরে, প্রিয়া,/রেখো না বঞ্চিত করি; প্রতিদিন থাকিয়ো জাগিয়া;/আমার দিনান্ত-মাঝে কঙ্কণের কনককিরণ/নিদ্রার আঁধারপটে আঁকি দিবে সোনার স্বপন;/তোমার চরণপাত মোর স্তব্ধ সায়াহ্ন-আকাশে/নিঃশব্দে পড়িবে ধরা আরক্তিম অলক্ত-আভাসে;/এ জীবন নিয়ে যাবে অনিমেষ নয়নের টানে/তোমার আপন কক্ষে পরিপূর্ণ মরণের পানে।’ কবিতাটি রবীন্দ্রনাথ রচনা করেন শান্তিনিকেতন থেকে, ১৬ পৌষ, ১৩০৯ সালে। স্বপ্ন, সৌন্দর্য, অভাববোধ সব যেন মিশে আছে এ-কবিতাটিতে। একই গ্রন্থের আর একটি কবিতা পড়া যাক, ভালো তুমি বেসেছিলে এই শ্যাম ধরা,/তোমার হাসিটি ছিল বড়ো সুখে ভরা/মিলি নিখিলের স্রোতে/জেনেছিলে খুশি হতে,হৃদয়টি ছিল তাই হৃদিপ্রাণহরা।/তোমার আপন ছিল এই শ্যাম ধরা।/আজি এ উদাস মাঠে আকাশ বাহিয়া/তোমার নয়ন যেন ফিরিছে চাহিয়া।/তোমার যে হাসিটুক,/সে চেয়ে-দেখার সুখ/সবারে পরশি চলে বিদায় গাহিয়া/এই তালবন গ্রাম প্রান্তর বাহিয়া।/তোমার সে ভালো-লাগা মোর চোখে আঁকি/আমার নয়নে তব দৃষ্টি গেছ রাখি।/আজি আমি একা-একা/দেখি দু-জনের দেখা–/তুমি করিতেছ ভোগ মোর মনে থাকি/আমার তারায় তব মুগ্ধ দৃষ্টি আঁকি।/এই-যে শীতের আলো শিহরিছে বনে,/শিরীষের পাতাগুলি ঝরিছে পবনে–/তোমার আমার মন/খেলিতেছে সারাক্ষণ/এই ছায়া-অলোকের আকুল কম্পনে/
এই শীতমধ্যাহ্নের মর্মরিত বনে।/ আমার জীবন তুমি বাঁচো, ওগো বাঁচো।/তোমার কামনা মোর চিত্ত দিয়ে যাচো–/যেন আমি বুঝি মনে/অতিশয় সংগোপনে/তুমি আজি মোর মাঝে আমি হয়ে আছ।/আমারি জীবনে তুমি বাঁচো, ওগো বাঁচো!’।
এ- কবিতাটি রবীন্দ্রনাথ রচনা করেন ১ পৌষ, ১৩০৯ সালে। একই গ্রন্থের আরও একটি কবিতা পড়া যাক, ‘যত দিন কাছে ছিলে বলো কী উপায়ে/আপনারে রেখেছিলে এমন লুকায়ে?/ছিলে তুমি আপনার কর্মের পশ্চাতে/অন্তর্যামী বিধাতার চোখের সাক্ষাতে।/প্রতি দণ্ড-মুহূর্তের অন্তরাল দিয়া/নি:শব্দে চলিয়া গেছ নম্র-নত-হিয়া।/আপন সংসারখানি করিয়া প্রকাশ/আপনি ধরিয়াছিলে কী অঞ্জাত বাস!/আজি যবে চলি গেলে খুলিয়া দুয়ার/পরিপূর্ণ রূপখানি দেখালে তোমার।/জীবনের সব দিন সব খণ্ড কাজ/ছিন্ন হয়ে পদতলে পড়ি গেল আজ।/তব দৃষ্টিখানি আজি বহে চিরদিন/চির-জনমের দেখা পলকবিহীন।’ মৃণালিনী দেবী ছাড়া রবীন্দ্রনাথ যেন নিঃসঙ্গহীন। তাই বার-বার যেন চোখের সামনে ফিরে আসে সেই চিত্র; যার থেকে রবীন্দ্রনাথ যেন কোন ভাবেই মুক্তি পেতে পারেন না। তাই আমরা দেখতে পাই কোন না কোন ভাবেই সেই চিত্রই রবীন্দ্রনাথের সামনে এসে উপস্থিত হয়। শন্তিনিকেতন থেকে, ৩ পৌষ, ১৩০৯ সালে রবীন্দ্রনাথ লেখেন এ- কবিতাটি, স্বল্প-আয়ু এ জীবনে যে-কয়টি আনন্দিত দিন/কম্পিত-পুলকভরে, সংগীতের-বেদনা-বিলীন,/লাভ করেছিলে, লক্ষ্মী, সে কি তুমি নষ্ট করি যাবে?/সে আজি কোথায় তুমি যত্ন করি রাখিছ কী ভাবে/তাই আমি খুঁজিতেছি। সূর্যাস্তের স্বর্ণমেঘস্তরে/চেয়ে দেখি একদৃষ্টে-সেথা কোন্ করুণ অক্ষরে/লিখিয়াছ সে জন্মের সায়াহ্নের হারানো কাহিনী!/আজি এই দ্বিপ্রহরে পল্লবের মর্মররাগিণী/তোমার সে কবেকার দীর্ঘশ্বাস করিছে প্রচার!/আতপ্ত শীতের রৌদ্রে নিজহস্তে করিছ বিস্তার/কত শীতমধ্যাহ্নের সুনিবিড় সুখের স্তব্ধতা!/আপনার পানে চেয়ে বসে বসে ভাবি এই কথা–/কত তব রাত্রিদিন কত সাধ মোরে ঘিরে আছে,/তাদের ক্রন্দন শুনি ফিরে ফিরে ফিরিতেছ কাছে।’
রবীন্দ্রনাথের ভ্রাতুষ্পুত্রবধূ হেমলতা দেবীর লেখাতেও আন্তরিকভাবে উঠে এসেছে পত্নীবিয়োগের পর কবির জীবনযাত্রার চিত্র। পত্নীবিয়োগের পর কবি বহু বছর নিরামিষ খেতেন। এমনকি ভাতের বদলে ছোলা ভিজানো, মুগডাল ভিজানো খেয়েও দিন অতিবাহিত করতেন। আবার কখনোও শাশুড়ির কাছে গেলে তার হাতের মাছের পদ রবীন্দ্রনাথ খেয়ে নিতেন, যাতে তার মেয়ের কথা মনে করে শাশুড়ি যেন কষ্ট না পান। সেই শাশুড়িও যখন মারা গেলেন; রবীন্দ্রনাথ তাতে অনেক কষ্ট পেলেন। হেমলতা দেবীর স্মৃতিচারণ থেকে আমরা আরও জানতে পারি; কবি মাথায় হাত বুলাতে-বুলাতে করুণভাবে শাশুড়ির মৃত্যুর কথা বলেছিলেন। স্ত্রীর ছোট-ছোট নানা কথা কত গভীরভাবে কবির মনে গেঁথে ছিল তা স্পষ্ট হয় হেমলতার লেখাতে। হেমলতা দেবী আবার বলেন, ‘শান্তিনিকেতনে কুঠির দোতলায় একদিন বিকালে চায়ের টেবিলে কবি খেতে বসেছেন। ঘরে ভাল মিষ্টি কাকামশায়ের জন্য তৈরি করা হোক বলায় কবি হঠাৎ বলে ফেললেন, ‘ঘরের মিষ্টি আর আমার দরকার নেই।’ বুঝলুম কাকিমার হাতের মিষ্টির কথা মনে পড়ে তাঁকে ব্যথা দিল। অন্তরের ব্যথা চেপে রাখেন কবি, কেবল সেদিন কথাটুকু মুখ ফসকে বেড়িয়ে পড়েছিল।’ মনে যন্ত্রণা থাকলেও বৃহত্তর কর্ম জগতে কোন ফাঁক ছিল না রবীন্দ্রনাথের। মংপুতে বাসকালীন রবীন্দ্রনাথ একবার মৈত্রেয়ী দেবীর কোন ব্যক্তিগত শোক নিবারণ প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘একজন মানুষ থাকবে না বলে আর একজনের জীবন শূন্য হয়ে যাবে, এ কথাকে তুমি আবার justify কর? তোমাকে কে বলেছে, দুঃখ শোক মানুষের জীবন ব্যর্থ হয় তাদের, যারা অমন করে নিজেকে দুঃখের কাছে অসহায়ভাবে সমর্পণ করে, এবং তাতেই গৌরব বোধ করে। শোককে চিরকাল শোক করে রেখে নিজেকে সেইখানে জীবন্ত সমাধি দেওয়াটাকে আমাদের দেশের লোকেরা বলেন সতীত্ব। একটি ক্ষনকালীন স্মৃতিকে শঙ্খঘণ্টা বাজিয়ে অক্ষয় করতে হবে, এবং সেই জন্য উজ্জ্বল আনন্দময় পৃথিবী থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে যদি ঘরে দরজা বন্ধ কর তাতে কি গৌরব ? তোমার মনে কর সেটা একটা মস্ত বড় ত্যাগ ? কিন্তু কিসের জন্য ত্যাগ ? ত্যাগ তখনই মহিমান্বিত, যখন সে জীবনের কাজে উৎসর্গিতও। মৃত্যুর অন্ধকার জীবনে ঘনীভূত করে তোলা সংসারে দুঃখ বেদনার কাছে নিরাশ্রয়ভাবে আত্মসমর্পণ, নিরতিশয় শ্রীহীন।
মানুষকে কোন একটা স্থানে screw up করে ফেলে সেখানেই জীবন শেষ করে দেওয়া বিধাতার উদ্দেশ্য নয়, বাঁশের বাধার মধ্যে বাঁশি যেমন বাজে, তেমনি দুঃখতাপের দহনের মধ্যে বাজিয়ে চলতে হবে সুর। সংসারের পথ কুসুমার্তিন নয়, তার পদে পদে কাঁটা, সেই কন্টাকাকীর্ণ পথেই হাসিমুখে আনন্দিত হয়ে চলতে হবে, এই তো মানুষের পরীক্ষা। বেদনাকে বোধনায় পরিণত করতে হবে, অম্লতাকে মাধুর্যে। জীবনে দুঃখ পাবার একটি গভীর প্রয়োজনীয়তা আছে, সেই দুঃসহ তাপের মধ্যেই পরিচয় ঘটে অন্তরতম নিত্য ‘আমি’র সঙ্গে। তাছাড়া তাকিয়ে দেখ দেখি আজ জগত জুড়ে কি কাণ্ডটাই চলছে। সেই দুঃসহ দুঃখের দক্ষও-যজ্ঞের কাছে তোমাদের ব্যক্তিগত দুঃখ সুখ কি তুচ্ছ হয়ে যায় না ? তাকে প্রাধান্য দিতে সংকোচ বোধ হয় না ? আমার যাদের সঙ্গে স্নেহের যোগ আছে, আমি তাদের কাছে সেই আত্মবিজয়ী সাধনা প্রত্যাশা করি আশা করি তোমাদের আপন ব্যক্তিগত চিন্তার গণ্ডি থেকে আপনাকে উর্ধেব তুলতে পারবে।’ মৈত্রেয়ী দেবীও অন্যান্য সাধারণ মানুষের মতই ব্যক্তিগত জীবনে নানা অবাঞ্ছিত দুঃখ-বেদনার সম্মুখীন হয়েছিলেন। কিন্তু কবির আশাকে সার্থক করে তিনি সেই সবের উর্ধেব উঠতে পেরেছিলেন। শুধু নিজের ক্ষুদ্র পরিবারটিকেই যে সুন্দর করে গড়ে তুলেছিলেন তা নয়, তার সঙ্গে-সঙ্গে সমাজের নিম্মবিত্তের খেটে খাওয়া মানুষের কল্যাণ কর্মেও উৎসর্গ করেছিলেন নিজেকে। রবীন্দ্রনাথের লেখা ও তার বক্তব্য থেকে জীবন সম্পর্কে যে ইতিবাচক ধারণা আলোকিত হয় তা কবির নিজের জীবনেরই আলো। মৃত্যুর পদযাত্রা প্রায় কখনই থামেনি এই কবির জীবনে। কিন্তু তার সৃষ্টিধারা অব্যাহত ছিল আমৃত্যু পর্যন্ত। যে সৃষ্টি শুধু তাকেই আলোকিত করে নি, করেছে সমস্ত বাঙলা সাহিত্যকে।