রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শুধু ‘সৃষ্টিকর্তা’ কবিতার-ই সৃষ্টিকর্তার মাঝে স্থির থাকেন নি। ‘কড়ি ও কোমল’ (১২৯৩); কাব্যগ্রন্থে ‘প্রার্থনা’-কবিতায় আবার আকুল চিত্তে প্রকাশ করেন সৃষ্টিকর্তার প্রতি নিজের আকুলতা। যে আকুলতা এবং সুধা পিপাসা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাবনা ও গুরুগাম্ভীর্যে হয়ে ওঠে এক অনন্ত প্রজ্জ্বলন। যে প্রজ্জ্বলিত দীপ আর নিস্তব্ধ নয়। ‘প্রার্থনা’-কবিতায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেন:
‘তুমি কাছে নাই ব’লে হেরো, সখা তাই-
‘আমি বড়ো; আমি বড়ো করেছি সবাই।
সকলেই উঁচু হয়ে দাঁড়ায়ে সম্মুখে।
বলিতেছে, এ জগতে আর কিছু নাই।
নাথ, তুমি একবার এসো হাসিমুখে
এরা সবে ম্লান হয়ে লুকাক লজ্জায়
সুখ দুঃখ টুটে যাক তব মহাসুখে
যাক আলো-অন্ধকার তেমার প্রভায়।’
‘প্রার্থনা’, কবিতায় রবীন্দ্রনাথ আপন মনে আহবান করেন সৃষ্টিকর্তাকে। যে সৃষ্টিকর্তা বা ঈশ্বর সমতা বা সমভাবাপন্ন হ’য়ে রয়েছেন মানুষের মাঝে। রবীন্দ্রনাথের এই আকুলতা বা প্রার্থনা সঙ্গীত সাময়িক নয়, বরং তা দীর্ঘ ও সুদূরপ্রসারী। জগৎ এবং তাঁর মাঝে থাকা বা না থাকা বা বিরাজ করা বা না করা সবই হয় প্রার্থনার মধ্যে দিয়ে। যে প্রার্থনার আহ্বান পৌঁছে যায় ‘সৃষ্টিকর্তা’- কবিতা পর্যন্ত। ‘ধর্ম’ গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, আবার ঈশ্বর সন্তুষ্ট বা তুষ্টি দেখা দেয় ক্ষণিক প’রে। কিভাবে বা কী উপায়ে তিনি ঈশ্বরকে তুষ্ট করবেন সে চেষ্টায় বগ্র হ’য়ে উঠে। ধন, মান এবং মানসিকতা দিয়ে তিনি এগিয়ে যান সন্তুষ্টির দিকে। ‘ধর্ম’ (১৩১৫: ১৯০৯) গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আবার বলেন : ‘আমাদের পক্ষ হইতে ঈশ্বরকে যদি কিছু দিতে হয়ে তবে কী দিব, কী দিতে পারি? তাঁহার ধন তাঁহাকে দিয়া তো তৃপ্তি নাই-আমাদের একটি মাত্র আপনার ধন দুঃখ ধন আছে তাহাই তাঁহাকে সম্পূর্ণ করিতে হয়। এই দুঃখকেই তিনি আনন্দ দিয়া, তিনি আপনাকে দিয়া পূর্ণ করিয়া দেন-নাহিলে তিনি আনন্দ ঢালিবেন কোনখানে? আমাদের এই আপন ঘরের পাত্রটি না থাকিলে তাঁহার সুধা তিনি দান করিতেন কী করিয়া? ওই কথাই আমরা গৌরব করিয়া বলিতে পারি। দানেই ঐশ্বর্যের পূর্ণতা? হে ভগবান, আনন্দকে দান করিবার বর্ষণ করিবার প্রবাহিত করিবার-এই যে তোমার শক্তি ইহা তোমার পূর্ণতারই অঙ্গ। আনন্দ আপনাতে বদ্ধ হইয়া সম্পূণ হয় না, আনন্দ আপনাকে ত্যাগ করিয়াই সার্থক- তোমার সেই আপনাকে দান করিবার পরিপূর্ণতা আমরাই বহন করিতেছি, আমাদের দুঃখের দ্বারা বহন করিতেছি, এই আমাদের বড়ো অভিমান, এইখানেই তোমাতে আমাতে মিলিয়াছি, এইখানেই তোমার ঐশ্বর্যে আমার ঐশ্বর্যে যোগ-এইখানে তুমি আমাদের অতীত নহ। এইখানেই তুমি আমাদের মধ্যে নামিয়া আসিয়াছ, তুমি তোমার অগণ্য গ্রহ, সূর্য, নক্ষত্র খচিত মহাসিংহাসন হইতে আমাদের এই দুঃখের জীবনে তোমার লীলা সম্পূর্ণ করিতে আসিয়াছ। হে রাজা, তুমি আমাদের দুঃখের রাজা; হঠাৎ যখন অধরাতে তোমার রথচক্রের বজ্র গর্জনে মেদিনী বলির পশুর হৎপিন্ডের মতো কাঁপিয়া উঠে তখন জীবনে তোমার সেই প্রচন্ড আবির্ভাবের মহাক্ষণে যেন তোমার জয়ধ্বনি করিতে পারি, হে দুঃখের ধন, তোমাকে চাহি না এমন কথা সেদিন যে ভয়ে না বলি; সেদিন যেন দ্বার ভাঙিয়া ফেলিয়া তোমাকে ঘরে প্রবেশ করিতে না হয়- যেন সম্পূর্ণ জাগ্রত হইয়া সিংহদ্বার খুলিয়া দিয়া তোমার উদ্দীপ্ত ললাটের দিকে দুই চক্ষু তুলিয়া বলিতে পারি, হে দারুণ, তুমিই আমার প্রিয়।’
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, দুঃখ এবং তার সাথে ধর্মের সংমিশ্রন ঘটিয়োছেন পূর্বেই। দুঃখের মধ্যে দিয়ে যেমন তিনি সত্য ও সুন্দরকে দেখতে পান, সেই একইভাবে, সেই দুঃখের মধ্যে দিয়েও ধর্মের দিকটিও তু’লে ধরেন। যে ধর্ম শুধু নিজের ধর্ম নয়; বরং অন্য ধর্মের দিকেও সেই দুঃখ, শোক, অনুতাপ এবং তাঁর বহিঃপ্রকাশ ঘটান। ‘ধর্ম’ গ্রন্থে ‘খৃস্টান ধর্ম’ সম্পর্কে বলেন: ‘মানুষের সকল প্রকার পরিত্রানের একমাত্র মূল্যই সেই দুঃখ। মানুষের নিতান্ত আপন সামগ্রী যে দুঃখ, প্রেমের দ্বারা তাহাকে ঈশ্বরও আপন করিয়া এই দুঃখ সংগমে মানুষের সঙ্গে মিলিয়াছেন- দুঃখকে অপরিসীম মুক্তিতে ও আনন্দ উত্তীর্ণ করিয়া দিয়াছেন- ইহাই খৃস্টান ধর্মের মর্মকথা।’
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ধর্মগ্রন্থ রচনার সমসময়ে রচনা করেন ‘গোরা’ (আষাঢ়: ১৩১৪-১৩১৬) উপন্যাস। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়: গোরা রচনা শুরু শিলাইদহে। ১৩১৪ সালের আষাঢ়ের শেষাধি থেকে ১৩১৬ সালের মাঘ/ফাল্গুন পর্যন্ত। যুক্তির মাধ্যমে তর্ক বিশ্লেষণকে প্রাধান্য দিয়ে ‘ধর্ম’ বিষয়টিকে রবীন্দ্রনাথ নিয়ে আসেন ‘গোরা’ উপন্যাসে। ‘গোরা’ উপন্যাস রচনা সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯৩১ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর (৭ আশ্বিন ঃ ১৯০৮) হেমন্ত বালা দেবীকে বলেন:‘একটা কথা মনে রেখো, গল্প ফোটোগ্রাফ নয়। যা দেখেছি যা জেনেছি তা যতক্ষন না মরে গিয়ে ভূত হয়, একটায় সঙ্গে আরেকটা মিশে গিয়ে পাঁচটায় মিলে দ্বিতীয়বার পঞ্চত্ব পায় ততক্ষণ গল্পে তাদের স্থানে হয় না। গোরা ও নৌকাডুবির কল্পনা সম্পূর্ণই আমার মাথার থেকে বেরিয়েছে। এমন ঘটনা ঘটেছে বলে জানি নে কিন্তু ঘটলে কী হতে পারত সেইটে ইনিয়েবিনিয়ে লিখেছি। বিদেশের উপাদান নিয়ে আমি কখনো কিছু লিখিনি। বাইরের থেকে মাল মসলা ধার নিয়ে লেখা আমার পক্ষে একেবারেই অসম্ভব।’
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘গোরা’ উপন্যাসে শুধু ধর্ম নিয়েই কথা বলেননি, বরং বলেছেন হিন্দু ধর্ম এবং গূঢ় মর্ম উপলব্ধি যেখানে শাস্ত্র এবং তার ব্যাপকতা আরো দীর্ঘ হ’য়ে উঠে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই কথোপকথন আরো সুদীর্ঘ হতে থাকে, ধর্ম এবং তাঁর যুক্তিতর্ক নিয়ে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেন: ‘কিন্তু কৃষ্ণদয়াল গোরার এই নতুন পরিবর্তনে যে খুশি হইলেন তাহা মনে হইল না। এমন কি, তিনি একদিন গোরাকে ডাকিয়া বলিলেন, “দেখো বাবা, হিন্দুশাস্ত্রে বড়ো গভীর জিনিস। ঋষিরা যে ধর্ম স্থাপন করে গেছেন তা তলিয়ে বোঝা যে-সে লোকের কর্ম নয়। আমার বিবেচনায় না বুঝে এ নিয়ে নাড়াচাড়া না করাই ভালো। তুমি ছেলে মানুষ, বরাবর ইংরেজি পড়ে মানুষ হয়েছ, তুমি যে ব্রাহ্ম সমাজের দিকে ঝুঁকেছিলে সেটা তোমার ঠিক অধিকারের মতোই কাজ করেছিলে। সেই জন্যেই আমি তাতে কিছুই রাগ করিনি, বরঞ্চ খুশিই ছিলুম। কিন্তু এখন তুমি যে পথে চলেছ এটা ঠিক ভালো ঠেকছে না। এ তোমার পথই নয়। “গোরা কহিল” বলেন কী বাবা? আমি যে হিন্দু। হিন্দুধর্মের গূঢ় মর্ম আজ না বুঝি তো কাল বুঝব- কোনোকালে যদি না বুঝি তবু এই পথ চলতেই হবে। হিন্দু সমাজের সঙ্গে পূর্ব জন্মের সম্বন্ধ কাটাতে পারিনি বলেই তো এ জন্মে ব্রাহ্মণের ঘরে জন্মেছি, এমনি করেই জন্মে জন্মে এই হিন্দু ধর্মেরও হিন্দু সমাজের ভিতর দিয়েই অবশেষে এর চরমে উত্তীর্ণ হব। যদি কখনো ভুলে অন্য পথের দিকে একটু হেলি আবার দ্বিগুণ জোরে ফিরতেই হবে।” কৃষ্ণদয়াল কেবলই মাথা নাড়িতে নাড়িতে কহিলেন, “কিন্তু বাবা হিন্দু বললেই হিন্দু হওয়া যায় না। মুসলমান হওয়া সোজা, খৃস্টান যে-সে হতে পারে- কিন্তু হিন্দু! বাস রে ও বড়ো শক্ত কথা। গোরা। সে তো ঠিক। কিন্তু আমি যখন হিন্দু হয়ে জন্মেছি, তখন তো সিংহদ্বার পার হয়ে এসেছি। এখন ঠিকমত সাধন করে গেলেই অল্পে অল্পে এগোতে পারব।”
কৃষ্ণদয়াল। বাবা তর্কে তোমাকে ঠিকটি বোঝাতে পারব না। তবে তুমি যা বলছ সেও সত্য। যার যেটা কর্মফল, নির্দিষ্ট ধর্ম, তাকে একদিন ঘুরে ফিরে সেই ধর্মের পথেই আসতে হবে-কেউ আটকাতে পারবে না। ভগবানের ইচ্ছে। আমরা কী করতে পারি। আমরা তো উপলক্ষ।
কর্মফল এবং ভগবানের ইচ্ছা, সোহংবাদ এবং ভক্তিতত্ত্ব সমস্তই কৃষ্ণদয়াল সম্পূর্ণ সমান ভাবে গ্রহণ করেন-পরস্পরের মধ্যে যে কোনো প্রকার সমন্বয়ের প্রয়োজন আছে তাহা অনুভব মাত্র করেন না।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ধর্ম ভাবনা ও তাঁর চেতনা সংমিশ্রণের অভূতপূর্ব সমন্বয় ঘটিয়েছেন ‘গোরা’ উপন্যাসে। যেখানে ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রের সাথে একত্রিভূত হ’য়ে উঠে ধর্ম। যে ধর্ম নিজের নির্দিষ্ট ধর্ম নয়, বরং তা হয়ে উঠে সমস্ত ধর্মের সার ভূমিকা হয়ে। স্থানে স্থানে নির্দিষ্ট ক’রে উল্লেখ করেছেন ধর্মগুলো। ‘হিন্দু ধর্ম, ‘মুসলমান ধর্ম এবং ‘খ্রিস্টান ধর্ম’। যে সকল ধর্মের সারতত্ত্ব প্রকাশ পায় ধর্ম-এবং তাঁর তত্ত্ব প্রকাশের মাধ্যমে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘গোরা’ উপন্যাসে তৈরি করেন পৃথক তর্ক কাঠামো যেখানে ধর্ম বক্তব্যেই বেশি হয়ে দেখা দেয়। যিনি চেতনা সর্বস্ত দিয়ে ধারণ করেছেন ধর্ম এবং তার কর্মগুলো। যে কর্ম রবীন্দ্রকর্ম নয়, বরং হয়ে রয় ‘ধর্মকর্ম’ রূপে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর “গোরা” উপন্যাসে আবার বলেন: ‘বিনয়ের সহিত কহিল, “আমি দেশের কথা কখনো এমন করে, বড়ো করে, সত্য করে ভাবিনি। কিন্তু একটা আমি জিজ্ঞাসা করি-ধর্মের সঙ্গে দেশের যোগ কী? ধর্ম কি দেশের অতীত নয়?” গোরার কানে সুচরিতার মৃদু কণ্ঠের এই প্রশ্ন বড়ো মধুর লাগিল। সুচরিতার বড়ো বড়ো দুইটি চোখের মধ্যে এ প্রশ্নটি আরো মধুর করিয়া দেখা দিল। গোরা কহিল’, ‘দেশের অতীত যা, দেশের চেয়ে যা অনেক বড়ো, তাই দেশের ভিতর দিয়ে প্রকাশ পায়। ঈশ্বর এমনি করে বিচিত্র ভাবে আপনার অনন্ত স্বরূপকেই ব্যক্ত করছেন। যাঁরা বলেন সত্য এক, অতএব কেবলই একটি ধর্মই সত্য, ধর্মের একটি মাত্র রূপই সত্য-তাঁরা, সত্য যে এক কেবল এই সত্যটিই মানেন, আর সত্য যে অন্তহীন সে সত্যটা মানতে চান না। অন্তহীন এক অন্তহীন অনেকে আপনাকে প্রকাশ করেন জগতে সেই লীলাই তো দেখেছি।
সেই জন্যেই ধর্মমত বিচিত্র হয়ে সেই ধর্মরাজকে নানা দিক দিয়ে উপলব্ধি করাচ্ছে। আমি আপনাকে নিশ্চয় বলছি, ভারতবর্ষের খোলা জানলা দিয়ে আপনি সূর্যকে দেখতে পাবেন- সে জন্যে সমুদ্রে পারে গিয়ে খৃস্টান গির্জার জানলায় বসবার কোনো দরকার হবে না।’
‘সুচরিতা কহিল ‘আপনি বলতে চান, ভারতবর্ষের ধর্মতন্ত্র একটি বিশেষ পথ দিয়ে ঈশ্বরের দিকে নিয়ে যায়।’
‘গোরা’ উপন্যাসের প্রধান দু’টি চরিত্র ‘গোরা এবং ‘সুচরিতা’। যাদের কথোপকথোনের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে যায় ‘ধর্ম’ এবং তার অন্তনির্হিত তাৎপর্যময় দিকগুলো যেখানে ধর্ম এবং ব্রহ্ম এরকম আরো কতিপয় দিক উঠে আসে, ভাবনা ও চেতনা দ্বারা, যে ভাবনা এবং চেতনা ‘গোরা’ উপন্যাসকে আরো গতিময় ও তাৎপর্যশীল ক’রে তোলে।
সুচরিতার ধর্ম নয় বরং সম্পূর্ণ ভারতবর্ষের ধর্মতন্ত্র নিয়ে একটি বিশেষ প্রশ্ন করেন গোরার নিকট: ভারতবর্ষের ধর্মতন্ত্র একটি বিশেষ পথ দিয়ে ঈশ্বরের দিকে নিয়ে যায় এর বিশেষত্বটি কী?’ এরকম বহুমুখী এবং চেতনা সর্বস্ত প্রশ্ন ‘গোরা’কে বিচলিত না ক’রে বরং তার উত্তরে ‘গোরা’ যখন বলেন:“সেটা হচ্ছে এই যে, ব্রহ্ম যিনি নির্বিশেষ তিনি বিশেষের মধ্যেই ব্যক্ত। কিন্তু তাঁর বিশেষের শেষ নেই। জল তার বিশেষ, স্থল তাঁর বিশেষ, বায়ু, তাঁর বিশেষ, অগ্নি তাঁর বিশেষ, প্রাণ তাঁর বিশেষ, বুদ্ধি প্রেম সমস্তই তাঁর বিশেষ- গণনা করে কোথাও তাঁর অন্ত পাওয়া যায় না-বিজ্ঞান তাই নিয়ে মাথা ঘুরিয়ে মরছে। যিনি নিরাকার তাঁর আকারের অন্ত নেই। হ্রস্বদীর্ঘ-স্থূলসূক্ষ্মের অনন্ত প্রবাহই তাঁর। যিনি অন্তত বিশেষ তিনিই নির্বিশেষ, যিনি অন্তরূপ তিনিই অরূপ। অন্যান্য দেশে ঈশ্বরকে ন্যূনাধিক পরিমাণে কোনো একটি মাত্র বিশেষের মধ্যে বাঁধতে চেষ্টা করেছে-ভারতবর্ষে ও ঈশ্বরকে বিশেষের মধ্যে দেখবার চেষ্টা আছে বটে, কিন্তু সেই বিশেষকেই ভারতবর্ষ একমাত্র ও চূড়ান্ত বলে গণ্য করে না। ঈশ্বর যে সেই বিশেষকে অনন্ত গুনে অতিক্রম করে আছেন এ কথা ভারতবর্ষের কোনো ভক্ত কোনোদিন অস্বীকার করেন না।”
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘গোরা’ উপন্যাসে ভাবনা, প্রার্থনা, উপাসনা, ঈশ্বর, চেতনা, বিশ্বাস, অবিশ্বাস এবং আরো কতিপয় যুক্তিতর্কময় বিশ্লেষনের দিকগুলো তুলে আনেন আপন মানসে। যে মানসে শুধু ভাবনা নয়, বরং যুক্তিময় দিক উঠে আসে মন ও মানসিকতার। যে মানসিকতায় ঈশ্বর ভাবনা এবং চেতনা পরিপূর্ণ হ’য়ে রয় ঈশ্বরের বন্দনা দিয়ে। যে বন্দনা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নিকট হ’য়ে রয় সত্য ও সুন্দর রূপে। যে সত্য ও সুন্দর রবীন্দ্রনাথের নিকট ঈশ্বর প্রার্থনার-ই আর একটি দিক। ঈশ্বরের নিকট শুধু প্রার্থনা নয়, বরং সম্পূর্ণ এবং সর্বস্ত আত্ম সমর্পণ-ই হ’য়ে উঠে ভাবনার দিকটি। যা শুধু প্রার্থনা বা বিশ্বাসের মধ্যে আবদ্ধ থাকে নি, বরং হ’য়ে উঠেছে বিস্তৃত ব্যাপি।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘গোরা’ উপন্যাসে আবার বলেন: “উপাসনা শেষ হইয়া গেল। তখন সুচরিতার চোখ দিয়া জল পড়িতেছে, পরেশবাবু কহিলেন, ‘মা, পিছন দিকে ফিরে তাকিয়ো না, সম্মুখের পথে অগ্রসর হয়ে যাও-মনে সংকোচ রেখো না। যাই ঘটুক, যাই তোমার সম্মুখে উপস্থিত হোক, তার থেকে সম্পূর্ণ নিজের শক্তিতে ভালোকে গ্রহণ করবে এই পণ করে আনন্দের সঙ্গে বেড়িয়ে পড়ো। ঈশ্বরকে সম্পূর্ণরূপে আত্মসমপর্ণ করে তাঁকেই নিজের একমাত্র সহায় করো-তা হলে ভুল ত্রুটি ক্ষতির মধ্যে দিয়েও লাভের পথে চলতে পারবে। আর যদি নিজেকে আধা-আধি ভাগ করো, কতক ঈশ্বরের কতক অন্যত্রে, তা হলে সমস্ত কঠিন হয়ে উঠবে।ঈশ্বরে এই করুণ, তোমার পক্ষে আমাদের ক্ষুদ্র আশ্রয়ের আর যেন প্রয়োজন না হয়।”
ব্রাহ্ম সমাজ ও তাঁর ধর্ম এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যখন ভাবতে থাকেন তাঁর সংশ্লিষ্টতা এবং ধর্মমত নিয়ে। তিনি আবার বলেন:
‘আনন্দময়ী কহিলেন’ তোমাদের ব্রাহ্মাসমাজে ওকি মানুষের সঙ্গে মানুষকে মিলতে দেবে না? ঈশ্বর ভিতরে যাদের এক করেছেন তোমাদের সমাজ বাহির থেকে তাদের তফাত করে রাখবে? মা, যে সমাজে ছোটো অমিলকে মানে না, বড়ো মিলে সবাইকে মিলিয়ে দেয়, সে সমাজ কি কোথাও নেই? ঈশ্বরের সঙ্গে মানুষ কি কেবল এমনি ঝগড়া করেই চলবে? সমাজ জিনিসটা কি কেবল এই জন্যেই হয়েছে?’
ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্র, ধর্ম এ রকম নানাদিকগুলো তু’লে আনেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘গোরা’ উপন্যাসে। সমাজ এবং তাঁর সাথে সংশ্লিষ্ট ধর্ম মতের দিকগুলো এক হ’য়ে উঠে এই উপন্যাসে। যে উপন্যাস ভাবাবেগে বা স্রোত প্রবাহিত প্রেমের দীর্ঘ উপাখ্যান নয়। ‘গোরা’ উপন্যাসে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেন:“সমাজের প্রতি কর্তব্য স্মরণ করিয়াই বিনয় ব্রাহ্মবিবাহে সম্মত হয় নাই সে কথা সে বলিল না, তাহার তর্ক চড়িয়া উঠিল। সে কহিল ‘ঐ জায়গায় তোমার সঙ্গে বোধ হয় আমার মিল হবে না। আমি তো ব্যক্তির দিক টেনে সমাজের বিরুদ্ধে কথা বলেছি নে। আমি বলছি, ব্যক্তি এবং সমাজ দুইয়ের উপরেই একটি ধর্ম আছে। সেইটের উপরে দৃৃষ্টি রেখে চলতে হবে। যেমন ব্যক্তিকে বাঁচানোই আমার চরম কর্তব্য নয় তেমন সমাজকে বাঁচানোও আমার চরম কর্তব্য নয়, একমাত্র ধর্মকে বাঁচানোই আমার চরম শ্রেয়।”
ধর্ম, ব্যক্তি, সমাজ-এবং তার উপর টিকে থাকা মানব ধর্মের দিকগুলো আবার বড়ো হ’য়ে উঠে ‘গোরা’ উপন্যাসে। গোরার সেই বহুমুখি প্রশ্ন তুলে আনা হয় এই উপন্যাসে। ব্যক্তি, সমাজ, ধর্মকে কার উপর কতটা নির্ভরশীল তা আবার দেখা দেয় এখানে। গোরার প্রশ্নে আবার প্রকাশ পায়-ব্যক্তি ও সমাজের উপর ধর্ম, না ধর্মের উপর ব্যক্তি ও সমাজ, এই দ্বৈতমুখি প্রশ্ন জোড়ালো হয় ‘গোরা’ উপন্যাসে।রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই উপন্যাসে আবার বলেন:“ব্যক্তি ও নেই সমাজও নেই, অথচ ধর্ম আছে এমন ধর্মকে আমি মানি নে।” বিনয়ের চোখ চড়িয়া উঠিল। সে কহিল, ‘আমি মানি’। ব্যক্তি ও সমাজের ভিত্তির উপরে ধর্ম নয়, ধর্মের ভিত্তির উপরেই ব্যক্তি ও সমাজ। সমাজ যেটাকে চায় সেইটেকেই যদি ধর্ম বলে মেনে নিতে হয় তা হলে সমাজেরই মাথা খাওয়া হয়। সমাজ যদি আমার কোনো ন্যায়সংগত ধর্ম সংগত স্বাধীনতায় বাধা দেয় তা হলে সেই অসংগত বাধা লঙ্ঘন করলেই সমাজের প্রতি কর্তব্য করা হয়।”
ধর্মবিশ্বাস এবং তার ঐক্যের দিকগুলো নিয়ে আরো গতিশীল হ’তে থাকে ‘গোরা’ উপন্যাস। ‘ধর্ম’ ও ‘ব্রাহ্ম সমাজ’ নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আবার জাগিয়ে তোলেন একটি প্রশ্ন। যে প্রশ্ন প্রকাশ পায় ‘গোরা’ উপন্যাসের চরিত্র পরেশবাবুর মাধ্যমে। পরেশবাবু প্রশ্ন করেন, ধর্ম বিশ্বাস সম্বন্ধে ব্রাহ্মসমাজের সঙ্গে তোমার মতের ঐক্য আছে তো?
“বিনয় এতটুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া কহিল” আপনাকে সত্য- কথা বলি, আগে মনে করতুম আমার বুঝি একটা কিছু ধর্ম বিশ্বাস আছে, তা নিয়ে অনেক লোকের সঙ্গে অনেক ঝগড়াও করেছি, কিন্তু আজ আমি নিশ্চয় জেনেছি, ধর্মবিশ্বাস আমার জীবনের মধ্যে পরিণতি লাভ করেনি। এটুকু যে বুঝেছি সে আপনাকে দেখে। ধর্মে আমার জীবনের কোনো সত্য প্রয়োজন ঘটেনি এবং তার প্রতি আমার সত্য বিশ্বাস জন্মে নি বলেই আমি কল্পনা এবং যুক্তিকৌশল দিয়ে এতদিন আমাদের সমাজের প্রচলিত ধর্মকে নানা প্রকার সূক্ষ্ম ব্যাখা দ্বারা কেবল মাত্র তর্ক নৈপুণ্যে পরিণত করেছি। কোন ধর্ম যে সত্য তা ভাববার আমার কোনো দরকারই হয় না; যে ধর্মকে সত্য বললে আমার জিত হয় আমি তাকেই সত্য বলে প্রমাণ করে বেড়িয়েছি। যতই প্রমাণ করা শক্ত হয়েছে, ততই প্রমাণ করে অহংকার বোধ করেছি। কোনোদিন আমার মনে ধর্ম বিশ্বাস সম্পূর্ণ সত্য ও স্বাভাবিক হয়ে উঠবে কি না তা আজও আমি বলতে পারি নে কিন্তু অনুকূল অবস্থা এবং দৃষ্টান্তের মধ্যে পড়লে সে দিকে আমার অগ্রসর হবার সম্ভাবনা আছে এ কথা নিশ্চিত। অন্তত যে জিনিস ভিতরে ভিতরে আমার বুদ্ধিকে পীড়িত করে, চিরজীবন তারই জয়পতাকা বহন ক’রে বেড়াবার হীনতা থেকে উদ্ধার পাব।”
‘গোরা’ উপন্যাসে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘গোরা’ চরিত্রের মধ্যে দিয়ে প্রকাশ করেন হিন্দু এবং তাঁর জাতি ধর্ম। ‘গোরা’ যখন প্রকাশ করেন ‘আমি হিন্দু’। হিন্দু তো কোনো দল নয়। হিন্দু একটা জাতি। এ জাতি এত বৃহৎ যে কিসে এই জাতির জাতিত্ব তা কোনো সংজ্ঞার দ্বারা সীমাবদ্ধ করে বলাই যায় না। সমুদ্রে যেমন ঢেউ নয়, হিন্দু তেমনি দল নয়।’
গোরা আবার যখন বলেন, ‘যে ঈশ্বর মানুষকে বিচিত্র করে সৃষ্টি করেছেন এবং বিচিত্রই রাখতে চান তাঁকেই আপনারা পূজা করেন এই কথা কল্পনা করেন। যদি সত্যই আপনারা তাঁকে মানেন তবে তাঁর বিধানকে আপনারা স্পষ্ট করে দেখতে পান না কেন, নিজের বুদ্ধির এবং দলের অহংকারে কেন এর তাৎপর্যটি গ্রহণ করছেন না?’
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই উপন্যাসে একক কোনো ধর্মকে না এনে বরং তুলে আনে হিন্দু ও খ্রিস্টান ধর্মের কথা। যে ধর্মের কথা বিরাজ করে ‘গোরা’ উপন্যাসে। ধর্ম এবং তাঁর বহুমুখিতা ভাব নিয়ে এগিয়ে যায় উপন্যাসটি। পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা জুঁড়ে থাকে ধর্ম নিয়ে তাঁর মর্ম কথা। বৈচিত্র্য এবং তাঁর বস্তুনিষ্ট ভাব আরো জোড়ালো হ’য়ে উঠে ওই ভাবের মাধ্যমে। যেখানে ধর্ম তাঁর বিচিত্রতম আরো বহুমুখী হয়ে ওঠে। স্থান, কাল, পাত্র, সময়, এবং তাঁর বহুমুখী কর্মগুলো গভীর হ’য়ে উঠে ‘গোরা’ উপন্যাসে। যে উপন্যাসে ব্যক্তি চরিত্র থেকে ভাববোধ ও ধর্মবোধ বা তাঁর তত্ত্ব বিশ্লেষণ আরো গভীর হ’য়ে দেখা দেয়। ‘গোরা’ উপন্যাসে গোরা বলেন :
“যে হিন্দুধর্ম মায়ের মতো নানাভাবের নানা মতের লোককে কোল দেবার চেষ্টা করেছে, অর্থাৎ, কেবল হিন্দু ধর্মই জগতে মানুষকে মানুষ বলেই স্বীকার করেছে, দলের লোক বলে গণ্য করেনি। হিন্দুধর্ম মূঢ়কেও মানে, জ্ঞানীকেও মানে, এবং কেবলমাত্র জ্ঞানের এক মূর্তিকেই মানে না, জ্ঞানের বহু প্রকার বিকাশকে মানে। খৃস্টানরা বৈচিত্র্যকে স্বীকার করতে চায় না,তারা বলে এক পারে খৃস্টানরা ধর্ম আর এক পারে অনন্ত বিনাশ, এর মাঝখানে কোনো বিচিত্রতা নেই। আমরা সেই খৃস্টানের কাছ থেকেই পাঠ নিয়েছি। তাই হিন্দুধর্মের বৈচিত্র্যের জন্য লজ্জা পাই। এই বৈচিত্র্যের ভিতর দিয়েই হিন্দুধর্ম যে এককে দেখবার জন্যে সাধনা করছে সেটা আমরা দেখতে পাই না। এই খৃস্টানি শিক্ষার পাক মনের চারিদিক থেকে খুলে ফেলে মুক্তি লাভ না করলে আমরা হিন্দু ধর্মের সত্য পরিচয় পেয়ে গৌরবের অধিকারী হব মা।”
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, এই উপন্যাসে শুধু ধর্মবোধ নয়, সেই সাথে পূজা, ভক্তি, অর্চনা, সমর্পণ ইত্যাদি দিকগুলো জ্ঞানের সাথে সংমিশ্রণে করেন। যে সত্য এবং তার সাথে মূর্তিপূজা এবং ধর্মের একাগ্রতা নিয়ে সেটা আরো গভীর থেকে গভীরে জোড়ালো হ’য়ে দেখা দেয়।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেন: “ধর্ম সম্বন্ধে আমার নিজের কোনো বিশেষ সাধনা নেই, কিন্তু সাকার পূজা এবং পৌত্তলিকতা যে একই, মূর্তিপুজাতেই- যে ভক্তিতত্ত্বের একটি চরম পরিনতি নেই, এ কথা আমি নিতান্ত অভ্যস্ত বচনের মতো চোখ বুজে আওড়াতে পারব না। শিল্পে সাহিত্য এমন কি বিজ্ঞানে, ইতিহাসেও মানুষের কল্পনাবৃত্তির স্থান আছে, একমাত্র ধর্মের মধ্যে তার কোনো কাজ নেই এ কথা আমি স্বীকার করব না। ধর্মের মধ্যেই মানুষের সকল বৃত্তির চূড়ান্ত প্রকাশ। আমাদের দেশের মূর্তি পূজায় জ্ঞান ও ভক্তির সঙ্গে কল্পনার সম্মিলন হবার যে চেষ্টা হয়েছে সেটাতে করেই আমাদের দেশের ধর্ম কি মানুষের কাছে অন্য দেশের চেয়ে সম্পূর্ণতর সত্য হয়ে ওঠে নি?”
‘গোরা’ উপন্যাসে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘সূচরিতা’ ও ‘গোরার’ কথোপকথনের মাধ্যমে তু’লে আনেন শুধু স্বধর্ম নয়, বরং তাঁর আচার এবং মূর্তিপূজাও ধর্ম-কর্মের দিকগুলো।
‘গোরা’ উপন্যাসে সুচরিতার এক প্রশ্ন: ‘গ্রীসে রোমেও তা মূর্তিপূজা ছিল’। এর উত্তরে গোরা প্রকাশ করেন ধর্মবোধ এবং একটি সুষ্পষ্ট প্রতিউত্তর।
“সেখানকার মূর্তিতে মানুষের কল্পনা সৌন্দর্যবোধকে যতটা আশ্রয় করেছিল জ্ঞানভক্তিকে ততটা নয়। আমাদের দেশে কল্পনা জ্ঞান ও ভক্তির সঙ্গে গভীররূপে জড়িত। আমাদের কৃষ্ণ রাধাই বলো, হর পার্বতীই বলো, কেবলমাত্র ঐতিহাসিক পূজার বিষয় নয়, তার মধ্যে মানুষের চিরন্তন তত্ত্বজ্ঞানের রূপ রয়েছে। সেই জন্যই রামপ্রসাদের; চৈতন্যদেবের ভক্তি এই সমস্ত মূর্তিকে অবলম্বন করে প্রকাশ পেয়েছে। ভক্তির এমন একান্ত প্রকাশ গ্রীস রোমের ইতিহাসে কবে দেখা দিয়েছে? আবার যখন প্রশ্ন করেন, ‘কালের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ধর্ম ও সমাজের কোনো পরিবর্তন আপনি একেবারে স্বীকার করতে চান না?”
উত্তরে ‘গোরা’ বলেন, “কেন চাইব না? কিন্তু পরিবর্তন তো পাগলামি হলে চলবে না। মানুষের পরিবর্তন মনুষ্যত্বের পথেই ঘটে-ছেলে মানুষ ক্রমে বুড়ো মানুষ হয়ে ওঠে, কিন্তু মানুষ তো হঠাৎ কুকুর বিড়াল হয় না। ভারতবর্ষের পরিবর্তন ভারতবর্ষের পথেই হওয়া চাই, হঠাৎ ইংরাজি ইতিহাসের পথ ধরলে আগাগোড়া সমস্ত পর্যন্ত ও নিরর্থক হয়ে যাবে। দেশের শক্তি, দেশের ঐশ্বর্য, দেশের মধ্যেই সঞ্চিত হয়ে আছে সেইটে আমি তোমাদের জানাবার জন্যই আমার জীবন উৎসর্গ করেছি। আমার কথা বুঝতে পারছ?”
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘গোরা’ উপন্যাস শেষ করেন এক পবিত্র ভাব গাম্ভীর্যের মধ্যে দিয়ে। যেখানে ‘ধর্ম’ এবং ‘সত্য’ এক হয়ে রয়। গোরার মধ্যে দিয়ে যখন প্রকাশ পায় ঃ
“কাল রাতে আমি বিধাতার কাছে প্রার্থনা করেছিলাম যে আজ প্রাতঃকালে আমি যেন নূতন জীবন লাভ করি।
এতদিন শিশুকাল থেকে আমাকে যে-কিছু মিথ্যা যে কিছু অশুচিতা আবতৃ করেছিল আজ যেন তা নিঃশেষে ক্ষয় হয়ে গিয়ে আমি নবজন্ম লাভ করি। আমি ঠিক যে কল্পনার সামগ্রী প্রার্থনা করেছিলুম ঈশ্বর সে প্রার্থনায় কর্ণপাত করেননি। তিনি তাঁর নিজের সত্য হঠাৎ একেবারে আমার হাতে এনে দিয়ে আমাকে চমকিয়ে দিয়েছেন।”
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘শান্তিনিকেতন’ গ্রন্থটি রচনা করেন (১৯০৯-১৯১৬) এবং তা সমসময়েই প্রকাশিত হয়। ১৩১৫ থেকে ১৩২১ পৌষ-পর্যন্ত শান্তিনিকেতন মন্দিরে ও অন্যান্য বিভিন্ন অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথ যে সকল উপদেশ দিয়েছিলেন তার অধিকাংশই এই গ্রন্থে গ্রন্থিত হয়। রবীন্দ্রনাথের ‘শান্তিনিকেতন’-এর উপদেশগুলির অনেকগুলি মৌখিক ভাষণ, পরে বক্তা কর্তৃৃক নূতন করে লিখিত। কতগুলি মূলতই লিখিত ভাষণ।‘সংশয়’, ‘আত্মার দৃষ্টি’, ‘পাপ’, ‘দুঃখ’, ‘ত্যাগ’, ‘প্রেম’, ‘প্রার্থনা’, ‘মানুষ’, ‘ভাঙাহাট’, ‘দিন’, ‘রাত্রি’ ‘প্রভাতে’, ‘বিশেষ ইচ্ছা’, ‘সৌন্দর্য’, ‘প্রার্থনার সত্য’, ‘বিধান’, ‘পার্থক্য’ ইত্যাদি আরো অনেক লেখা জড়ো হয় শান্তিনিকেতন গ্রন্থে।
(২৯ অগ্রহায়ণ: ১৩১৫ সনে রচিত।) “সামঞ্জস্য” নামক রচনায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রেমকে উপলক্ষ্য করে রচনা করেন প্রেম নির্ভর কিছু লেখা। যেখানে তিনি বলেন:
“আমাদের প্রকৃতির মধ্যেও এই স্থিতি ও গতির সামঞ্জস্য আমরা একটি মাত্র জায়গায় দেখতে পাই, সে হচ্ছে প্রেম। এই চঞ্চল সংসারের মধ্যে যেখানে আমাদের প্রেম, কেবলমাত্র সেইখানেই আমাদের চিত্তের স্থিতি- আর সমস্তকে আমরা ছুঁই আর চলে যাই, ধরি আর ছেড়ে দিই, যেখানে প্রেম সেইখানেই আমাদের মন স্থির হয়। অথচ সেইখানেই তার ক্রিয়াও বেশি। সেইখানেই আমাদের মন সকলের চেয়ে সচল। প্রেমেতেই যেখানে স্থির করায় সেইখানেই অস্থির করে। প্রেমের মধ্যেই স্থিতি গতি এক নাম নিয়ে আছে।”
প্রেম এবং তাঁর অপার সৌন্দর্য থেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আবার সেই নিবন্ধেই আলোচনা করেন ‘ঈশ্বর এবং তাঁর ভাবনা নিয়ে। সকল ইন্দ্রিয় জুঁড়ে রয়েছে তার অপার সৌন্দর্য হয়ে। ‘সামঞ্জস্য’ (২৯ অগ্রহায়ণ: ১৩১৫) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেন-
“ঈশ্বর তা কেবলমাত্র মুক্ত নন, তা হলে তো তিনি একেবারে নিস্ক্রিয় হতেন। তিনি নিজেকে বেঁধেছেন। না যদি বাঁধতেন, তা হলে সৃষ্টিই হত না এবং সৃষ্টির মধ্যে কোনো নিয়ম কোনো তাৎপর্যই দেখা যেত না। তাঁর যে আনন্দরূপ, যে রূপে তিনি প্রকাশ পাচ্ছেন, এই তো তাঁর বন্ধনের রূপ। এই বন্ধনেই তিনি আমাদের কাছে আপন। আমাদের কাছে সুন্দর। এই বন্ধন তার আমাদের সঙ্গে প্রণয়বন্ধন। এই তাঁর নিজকৃত স্বাধীন বন্ধনেই তো তিনি আমাদের সখা, আমাদের পিতা। এই বন্ধনে যদি তিনি ধরা না দিতেন তা হলে আমরা বলতে পারতুম না যে, স এর বন্ধুজর্নিতা স বিধাতা, তিনিই- বন্ধু তিনিই পিতা তিনিই বিধাতা, এত বড়ো একটা আশ্চর্য কথা মানুষের মুখ দিয়ে বের হতেই পারত না। কোনটা বড়ো কথা? ঈশ্বর শুদ্ধ বুদ্ধ মুক্ত, এইটে?”
না তিনি আমাদের সঙ্গে পিতৃত্বে সখিত্বে পতিত্বে বদ্ধ-এইটে? দুটোই সমান বড়ো কথা। অধীনতাকে অত্যন্ত ছোটো করে দেখে তার সম্বন্ধে আমাদের একটা হীন সংস্কার হয়ে গেছে। এরকম অন্ধ সংস্কার আরো আমাদের অনেক আছে। যেমন আমরা ছোটোকে মনে করি তুচ্ছ। বড়োকেই মনে করি মহৎ-যেন গণিত শাস্ত্রের দ্বারা কাউকে মহত্ব দিতে পারে। তেমনি সীমাকে আমরা গাল দিয়ে থাকি। যেন সীমা জিনিসটা যে কি, তা আমরা কিছুই জানি? সীমা একটি পরমাশ্চর্য রহস্য। এই সীমাই তো অসীমকে প্রকাশ করছে। এ কী অনিবচর্নীয়। এর কী আশ্চর্যরূপ কী আশ্চর্য গুণ, কী আশ্চর্য বিকাশ। একরূপ থেকে আর এক রূপ, এক গুণ হতে আর এক গুণ, এক শক্তি হতে আরেক শক্তি- এরই বা নাশ কোথায়। এরই বা সীমা কোনখানে।”
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘শান্তিনিকেতন’-গ্রন্থের “সংশয়” (২৩ অগ্রহায়ণ: ১৩১৫)-এ এসে আবার সেই ধর্ম এবং তাঁর মনত্বাত্তিক দিকগুলো তুলে আনেন। যা ‘ধর্ম’ এবং তাঁর সংশয়বাদ নিয়ে আরো জোড়ালো হয়ে ওঠে। সংশয় বা আশ্রয় নয় বরং তিনি স্বচিত্তে প্রকাশ করেন মানুষ এবং তাঁর ধর্মবোধের অন্তর দিকটি।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, এই প্রথম মানুষের অভ্যন্তরের বিশ্বাসের জায়গাটি প্রকাশ করেন বিশ্বাস আর অবিশ্বাস দিয়ে নয় বরং তা প্রকাশ পায় আস্তিক আর নাস্তিক রূপে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেন: “আমরা মনে করি যে ব্যক্তি নাস্তিক সেই সংশয়ী, কিন্তু আমরা যেহেতু ঈশ্বরকে স্বীকার করি অতএব আমরা আর সংশয়ী নই। এই বলে আমরা নিশ্চিন্ত হয়ে বসে আছি- এবং ঈশ্বর সম্বন্ধে যাদের সঙ্গে আমাদের মতে না মেলে তাদেরই আমরা পাষণ্ড বলি, নাস্তিক বলি, সংশয়াত্ব বলি। এই নিয়ে সংসারে কত দলাদলি কত বিবাদ বিরোধ কত শাসন পীড়ন তার আর অন্ত নেই। আমাদের দল এবং আমাদের দলের বাহির, এই দুইভাগে মানুষকে বিভক্ত ক’রে আমরা ঈশ্বরের অধিকারকে নিজের দলের বিশেষ সম্পত্তি বলে গণ্য করে আরামে বসে আছি। এ সম্বন্ধে কোনো চিন্তা নেই সন্দেহ নেই। এই বলে কেবল কথাটুকুর মধ্যে ঈশ্বরকে স্বীকার করে আমরা সমস্ত সংসার থেকে তাঁকে নির্বাসিত করে দেখছি। আমরা এমনভাবে গৃহে এবং সমাজে বাস করছি যেন সে গৃহে সে সমাজে ঈশ্বর নেই। আমরা জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত এই বিশ্বজগতের ভিতর দিয়ে এমনভাবে চলে যাই যেন এ জগতে সেই বিশ্বভূবনেশ্বরের কোনো স্থান নেই। আমরা সকাল বেলায় আশ্চর্য আলোকের অভ্যুদয়ের মধ্যে জাগ্রত হয়ে সেই অদ্ভূত আবির্ভাবের মধ্যে তাঁকে দেখতে পাই নে, এবং রাত্রিকালে যখন অনিমেষ জাগ্রত নিঃশব্দ জ্যোতিস্কলোকের মাঝখানে আমরা নিদ্রার গভীরতার মধ্যে প্রবেশ করতে যাই তখন এই আশ্চর্য শয়নাগারের বিপুল মহিমান্বিত অন্ধকার শয্যাতলের কোনো এক প্রান্তেও সেই বিশ্বজননীর নিস্তব্ধ গম্ভীর স্নিগ্ধমূর্তি অনুভব করে সে। এই অনির্বচনীয় অদ্ভূত জগৎ কে আমরা নিজের জমিজমা ঘরবাড়ির মধ্যেই সংকীর্ণ করে দেখতে সংকোচবোধ করি নে। আমরা যেন ঈশ্বরের জগতে জন্মই নি-নিজের ঘরেই জন্মেছি-এখানে আমি আমি আমি ছাড়া আর কোনো কথাই নেই-তবু আমরা বলি আমরা ঈশ্বরকে মানি, তাঁর সম্বন্ধে আমার মধ্যে কোন সংশয় নেই।”
পূর্বেই বলেছি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ঈশ্বর ভাবনা এবং তাঁর প্রতি প্রেমময় ভাবনা আরো অনেক বেশি গতিশীল ক’রে তোলেন। যে ভাবনা রবীন্দ্রনাথের অর্ন্তমুখী ভাবনা নয় বরং তা হ’য়ে ওঠে বহিঃমুখী ভাবনার চেতনার বিস্তার। যে চেতনার দ্বারা কিছুটা অবমুক্ত হোন রবীন্দ্রনাথ নিজেই।
‘সংশয়’ এ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আবার বলেন: “ঈশ্বর যে আছেন এবং সর্বত্রই আছেন এ কথাটা যে আমার জানার অভাব আছে তা নয়, কিন্তু আমি অহরহ সম্পূর্ণ এমনভাবেই চলি যেন তিনি কোনোখানেই নেই। এর কারণ কী? তাঁর প্রতি আমার প্রেম জন্মেনি, সুতরাং তিনি থাকলেই বা কী, না থাকলেই বা কী? তাঁর চেয়ে আমার নিজের ঘরের অতি তুচ্ছ বস্তুও আমার কাছে বেশি করে আছে। প্রেম নেই-বলেই তাঁর দিকে আমাদের সমস্ত চোখ চায় না, আমাদের সমস্ত কান যায় না, আমাদের সমস্ত মন খোলে না। এই জন্যেই যিনি সকলের চেয়ে আছেন তাঁকেই সকলের চেয়ে পাই নে-তাই এমন একটা অভাব জীবনে থেকে যায় যা আর কিছুতেই কোনোমতেই পোরাতে পারে না। ঈশ্বর থেকেও থাকেন না-এত বড়ো প্রকান্ড না থাকা আমাদের পক্ষে আর কী আছে। এই না থাকার ভাবে আমরা প্রতি মুহূর্তেই মরছি। এই না থাকার মানে আর কিছুই না, আমাদের প্রেমের অভাব। এই না-থাকার শুষ্কতায় জগতের সমস্ত লাবণ্য মারা গেল, জীবনের সমস্ত সৌন্দর্য নষ্ট হল। যিনি আছেন তিনি নেই, এতবড়ো ক্ষতি কী দিয়ে পূরণ হবে। কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। দিনে রাত্রে এই জন্যেই যে গেলুম। সব জানি সব বুঝি, কিন্তু সমস্তই ব্যর্থ-প্রেম আলোকে প্রকাশো জগপতি হে।”
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর “বিশেষ” (১৬ পৌষ : ১৩১৫) শিরোনামে যে অনুচ্ছেদটি রচনা করেন তা-ও হ'য়ে ওঠে ঈশ্বর নির্ভর বা ভাববিশিষ্ট নির্ভর। পরোক্ষভাবে আহ্বান নয়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, এখানে উপস্থিত হন একজন প্রার্থনাকারী হিসেবে। যিনি প্রার্থনা করেন একজন সরল-সোজা মানুষ হিশেবে, যাঁর কাজ-ই যেন অকুণ্ঠচিত্তে প্রার্থনা করা। যে প্রার্থনা যেন চিত্তে জমা থাকা দীর্ঘ দিনের দুঃখ, কষ্ট, শোকগুলো প্রকাশ পায় সচিত্রে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেন:“হে আমার প্রভু, সেই একলা আমি, বিশেষ আমি, তার মধ্যে তোমার বিশেষ আনন্দ, বিশেষ আর্বিভাব আছে- সেই বিশেষ আর্বিভাবটি আর কোনো দেশে কোনো কাল নেই। আমার সেই বিশিষ্টতাকে আমি সার্থক করব প্রভু। আমি নামক তোমার সকল হতে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র এই যে একটি বিশেষ লীলা আছে, এই বিশেষ লীলায় তোমার সঙ্গে যোগ দেব। এইখানে একের সঙ্গে এক হয়ে মিলব।”