হিন্দু নিজেকে ধর্মপ্রাণ বলে পরিচয় দেয়, মুসলমানও তাই দেয়। অর্থাৎ, ধর্মের বাহিরে উভয়েরই জীবনের অতি অল্প অংশই অবশিষ্ট থাকে। এই কারণে এরা নিজ নিজ ধর্ম দ্বারাই পরষ্পরকে ও জগতের অন্য সকলকে যথা সম্ভব দূরে ঠেকিয়ে রাখে। এই যে দূরত্বের ভেদ এরা নিজেদের চারিদিকে অত্যন্ত মজবুত করে গেঁথে রেখেছে, এতে করে সকল মানুষের সঙ্গে সত্যযোগে মনুষ্যত্বের যে প্রসার হয় তা এদের মধ্যে বাধাগ্রস্ত হয়েছে। ধর্মগত ভেদবুদ্ধি সত্যের অসৎ স্বরূপ থেকে তাদের সংকীর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে। এই জন্যেই মানুষের সঙ্গে ব্যবহারে নিত্যসত্যের চেয়ে বাহ্যবিধান কৃত্রিম প্রথা এদের মধ্যে এত প্রবল হয়ে উঠেছে।
পূর্বেই বলেছি, মানব জগৎ এই দুই সম্প্রদায়ের ধর্মের দ্বারা আত্ম ও পর এই দুই ভাগে অতিমাত্রায় বিভক্ত হয়েছে। সেই পর চিরকালই পর হয়ে থাকে হিন্দুর এই ব্যবস্থা; সেই পর, সেই স্লেচ্ছা বা অন্ত্যজ কোনো ফাঁকে তার ঘরের মধ্যে এসে ঢূকে না পড়ে এই তার ইচ্ছা। মুসলমানের তরফে ঠিক এর উল্টো। ধর্মগন্ডীর বহিবর্তী পরকে সে খুব তীব্রভাবেই পর বলে জানে, কিন্তু সেই পরকে, সেই কাফেরকে বরাবরকার মতো ঘরে টেনে এনে আটক করতে পারলেই সে খুশি। এদের শাস্ত্রে কোনো একটা খুঁটি বের করা শ্লোক কী বলে সেটা কাজের কথা নয়। কিন্তু লোক ব্যবহারে এদের এক পক্ষ শত শত বৎসর ধরে ধর্মকে আপন দুর্গম দূর্গ করে পরকে দূরে ঠেকিয়ে আত্মগত হয়ে আছে, আর অপর পক্ষ ধর্মকে আপন ব্যুহ বানিয়ে পরকে আক্রমণ করে তাকে ছিনিয়ে এনেছে এতে করে এদের মনঃপ্রকৃতি দুই রকম ছাঁদের ভেদবুদ্ধিতে একেবারে পাকা হয়ে গেছে। বিধির বিধানে এমন দুই দল ভারতবর্ষে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে প্রধান স্থান অধিকার করে নিয়েছে-আত্মীয়তার দিক থেকে মুসলমান হিন্দুকে চায় না, তাকে কাফের বলে ঠেকিয়ে রাখে, আত্মীয়তার দিক থেকে হিন্দুও মুসলমানকে চায় না, তাকে ম্লেচ্ছা বলে ঠেকিয়ে রাখে।”
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রধান দুটি জাতি ‘হিন্দু’ ও ‘মুসলমানকে’ একই সুত্রে গাঁথতে চেয়েছেন। টেনে এনেছেন ‘আত্মীয়তার সম্পর্ক’। যে আত্মীয়তায় রক্ষা পাবে উভয় পক্ষের নিবিড় সম্পর্কের মাধ্যমে। কিন্তু সে সম্পর্ক হয়ে ওঠে না দৃঢ় ও মজবুত, যা হয় তা হলো একটি থেকে আরেকটির মনও জাতিগত ব্যবধান। এই আত্মীয়তা কাছে টানে না প্রধান দু’টি জাতিকে, বরং ব্যবধান বা দূরত্ব তৈরি করে একটি থেকে আরেকটিকে। জাতিগত এই সমস্যা স্বল্প সমস্যা নয়, বরং এই সমস্যা হ’য়ে ওঠে শতাব্দী থেকে শতাব্দী পরম্পরায়। সংখ্যাগত দিক থেকে কালে কালে বিবিধ জাতি দেখা গেলেও, জাতিগত সমস্যা দেখা দেয় মুসলমানও হিন্দুতে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই প্রধান দুটি জাতিকে নিয়ে চিন্তায় মগ্ন থেকেছেন দীর্ঘ সময়। প্রধান দু’টি জাতিকে গাঁথতে চেয়েছেন একই সুতোয়। দেখতে চেয়েছেন মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ ক’রে।
হিন্দু-মুসলমান এর এই ভাবনা শুধু যে রবীন্দ্রনাথ-ই করেছেন তা নয়। এই ভাবনা ছিল তিরিশ প্রধান কবি জীবনানন্দ দাশ (১৮৯৯-১৯৫৪)-এর। ‘ঝরা পালক’ (১৯২৭) কাব্যগ্রন্থে ‘হিন্দু-মুসলমান’ কবিতায়। প্রকাশ করেন হিন্দুও মুসলমানের এক অপূর্ব সমন্বয়। তিনি বলেন:
“মহামৈত্রীর বরদ-তীর্থে-পুণ্য ভারতপুরে-
পূজার ঘন্টা মিশিছে হরষে নামাজের সুরে সুরে!
আহ্নিক হেথা শুরু হয়ে যায় আজান বেলার মাঝে,
মুয়াজ্জেনের উদাস ধ্বনিটি গগণে গগনে বাজে;
জপে ঈদগাতে তসবী ফকির, পূজারী মন্ত্র পড়ে
সন্ধ্যা-ঔষায় বেদবানী যায় মিশে কোরানের স্বরে;
সন্ন্যাসী আর পীর
মিলে গেছে হেথা,-মিশে গেছে হেথা মসজিদ, মন্দির।
কে বলে হিন্দু বসিয়ে রয়েছে একাকী ভারত জাকি?
-মুসলমানের হস্তে হিন্দু বেঁধেছে মিলন-রাখী”
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘কালান্তর’ গ্রন্থে এসে হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কে আবার বলেন:
“বাংলাদেশে স্বদেশী আন্দোলনে হিন্দুর সঙ্গে মুসলমান মেলেনি। কেননা বাংলার অখন্ড অঙ্গকে ব্যঙ্গ করার দুঃখটা তাদের কাছে বাস্তব ছিল না। আজ অসহকার- আন্দোলনে হিন্দুর সঙ্গে মুসলমান যোগ দিয়েছে, তার কারণ রোম-সাম্রাজ্যের অখন্ড অঙ্গকে ব্যঙ্গীকরনের দুঃখটা তাদের কাছে বাস্তব। এমনতরো মিলনের উপলক্ষটা কখনোই চিরস্থায়ী হ’তে পারে না। আমরা সত্যত: মিলি নি; আমরা একদল পূর্ব মুখ হয়ে, অন্যদল পশ্চিম মুখ হয়ে কিছুক্ষণ পাশাপাশি পাখা ঝাপটেছি। আজ সেই পাখার ঝাপট বন্ধ হল, এখন উভয়পক্ষের চঞ্চু এক মাটি কাপড়ে না থেকে পরস্পরের অভিমুখে সবেগে বিক্ষিপ্ত হচ্ছে। রাজনৈতিক অধিনেতারা চিন্তা করেছেন, কী দিয়ে এদের চঞ্চু দু’টোকে ভুলিয়ে রাখা যায়। আসল ভুলটা রয়েছে অস্থিতে মজ্জাতে, তাকে ভোলাবার চেষ্টা করে ভাঙ্গা যাবে না। কম্বল চাপা দিয়ে যে মনে ভাবে বরফটাকে গরম করে তোলা গেল সে একদিন দেখতে পায় তাতে করে তার শৈত্যটাকে স্থায়ী করা গেছে।”
হিন্দুতে মুসলমানে কেবল যে এই ধর্মগত ভেদ তা নয়, তাদের উভয়ের মধ্যে একটা সামাজিক শক্তির অসমকক্ষতা ঘটেছে। মুসলমানের ধর্মসমাজের চিরাগত নিয়মের জোরেই তার আপনার মধ্যে একটা নিবিড় ঐক্য জন্মে উঠেছে, আর হিন্দুর ধর্ম সমাজের সনাতন অনুশাসনের প্রভাবেই তার আপনার মধ্যে একটা প্রবল অনৈক্য ব্যাপ্তি হয়ে পড়েছে। এর ফল এই যে, কোনো বিশেষ প্রয়োজন না থাকলেও হিন্দু নিজেকেও মারে, আর প্রয়োজন থাকলেও হিন্দু অন্যকে মারতে পারে না। আর মুসলমান কোনো বিশেষ প্রয়োজন না ঘটলেও নিজেকে দৃঢ়ভাবে রক্ষা করে, আর প্রয়োজন ঘটলে অন্যকে বেদম মার দিতে পারে। তার কারণ এ নয়, মুসলমানের গায়ে জোর আছে, হিন্দুর নেই; তার আসল কারণ, তাদের সমাজের জোর আছে, হিন্দুর নেই। একদল আভ্যন্তরিক বলে বলী, আর একদল আভ্যন্তরিক দুর্বলতায় নির্জীব। তাদের মধ্যে সমকক্ষভাবে আপোষ ঘটবে কী করে। অত্যন্ত দুর্যোগের মুখে ক্ষনকালের জন্যে তা সমম্ভব, কিন্তু যে দিন অধিকারের ভাগ-বাটোয়ারার সময় উপস্থিত হয় সেদিন সিংহের ভাগটা বিসদৃশ রকম বড়ো হয়ে ওঠে, তার কারণটা তার থাকার মধ্যে। গত য়ুরোপীয় যুদ্ধে যখন সমস্ত ইংরেজ জাতের মুখশ্রী পাংশুবর্ণ হয়ে উঠেছিল। তখন আমাদের মতো ক্ষীণপ্রান জাতিকেওতারা আদর করে সহায়তার জন্য ডেকেছিল। শুধু তাই নয়, ঘোর বিষয়ী লোকেরও যেমন শ্মশান বৈরাগ্যে কিছুক্ষণের জন্য নিষ্কাম বিশ্বপ্রেম জন্মায়, তেমনি যুদ্ধশেষের কয়েক দন্ড পরেও রক্ত আহুতি যজ্ঞে তাদের সহযোগী ভারতীয়দের প্রতি তাদের মনে দাক্ষিণ্যের ও সঞ্চার হয়েছিল। যুদ্ধের ধাক্কাটা এল নরম হয়ে আর তারপরেই দেখা দিল জালিয়ান বাগে দানবলীলা; আর তার এল কেনিয়ার সাম্রাজ্যের সিংহদ্বারে ভারতীয়দের জানা অর্ধচন্দ্রের ব্যবস্থা। রাগ করি বটে, কিন্তু সত্য সমকক্ষ না হয়ে উঠলে সমকক্ষের ব্যবহার পাওয়া যায় না। এই কারণেই মহাত্মাজি খুব একটা ঠেলা দিয়ে প্রজাপক্ষের শক্তিটাকে রাজপক্ষের অনুভরযোগ্য করে তোলবার চেষ্টা করেছেন। উভয় পক্ষের মধ্যে আপোষ নিষ্পত্তিই তাঁর লক্ষ্য ছিল। এই আপোষ নিষ্পত্তি সবল-দুর্বলের একান্ত ভেদ থাকলে হতেই পারে না। আমরা যদি ধর্মবলে রাজার সিংহাসনে ভূমিকম্প ঘটাতে পারতুম, তা হলে রাজার বাহুবল একটা ভালোরকম রফা করবার জন্য আপনিই আমাদের ডাক পড়ত। ভারতবর্ষ হিন্দুতে মুসলমানে প্রতিনিয়তই পরষ্পরই রফানিষ্পত্তির কারণ ঘটবে। অসমকক্ষতা থাকলে যে নিষ্পত্তি নিয়তই বিপত্তির আকার ধারণ করবে। ঝরনার জল পানের অধিকার নিয়ে একটা বাঘ ও মেষের মধ্যে একটা আপোষের কনফারেন্স বসেছিল, ঈশপের কথামালায় তার ইতিহাস আছে। উপসংহারে প্রবলতার চতুষ্পদটি তর্কের বিষয়টাকে কি রকম অত্যান্ত সরল করে এনেছিল সে কথা সকলেরই জানা আছে। ভারতবর্ষের কল্যাণ যদি চাই তা হলে হিন্দু-মুসলমানে কেবল যে মিলিত হতে হবে তা নয়, সমকক্ষ হতে হবে। সেই সমকক্ষতা তাল ঠোকা পালোয়ানির ব্যক্তিগত সমকক্ষতা নয়, উভয় পক্ষের সামাজিক শক্তির সমকক্ষ। মালাবারে মোপলাতে-হিন্দুতে যে কুৎসিত কান্ড ঘটেছিল সেটা ঘটেছিল খিলাফৎ সূত্রে হিন্দু মুসলমানের সন্ধির-ভরা জোয়ারের মুখেই। যে দুই পক্ষে বিরোধ তারা সুদীর্ঘকাল থেকেই ধর্মের ব্যবহারকে নিত্য ধর্মনীতির বিরুদ্ধে প্রয়োগ করে এসেছে। নম্বুদি ব্রাক্ষসের ধর্ম মুসলমানকে ঘৃনা করেছে, মোপলা মুসলমানের ধর্ম নম্বুদ্রি ব্রাহ্মনকে অবজ্ঞা করেছে আজ এই দুই পক্ষের কনগ্রেসনজ্ঞ-ঘটিত ভ্রাতৃভাবের জীন মসলার দ্বারা তাড়াতাড়ি অল্প কয়েক দিনের মধ্যে খুব মজবুত করে পোলিটিক্যাল সেতু বানাবার চেষ্টা বৃথা। অথচ আমরা বার বারই বলে আসছি, আমাদের সনাতন ধর্ম যেমন আছে তেমনিই থাক্ আমরা অবাস্তবকে দিয়েই বাস্তব ফল লাভ করব, তার পরে ফললাভ হলে আপনিই সমস্ত গলদ সংশোধন হয়ে যাবে। বাজিমাৎ করে দিয়ে তারপরে চালের কথা ভাবব, আগে স্বরাট হব, তার পরে মানুষ হব।”
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ভাবনার জগতে দীর্ঘ সময় জুঁড়ে রয়েছে ধর্ম ভাবনা। যে ধর্ম-ভাবনা শুধু ভারতীয় হিন্দু ধর্ম নয়, বরং তা হ’য়ে ওঠে সমস্ত ধর্ম ভাবনার সারসত্তা। যে ধর্মীয় ভাবনা শুধু জাগ্রত করে না, তা ব্যক্তির অভ্যন্তরে স্থান ক’রে নেয় দীর্ঘ সময়ের জন্য, যে সময়ে রবীন্দ্রনাথ ব্যক্তিকে গ’ড়ে তোলেন আরো বেশি বিশ্বমানসলোকে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘কালান্তর’ (অগ্রহায়ণ : ১৩৩২) এ বলেন:
[ক.] ‘ধর্ম’ আমাদের কাছে ত্যাগ দাবি করে। সেই ত্যাগে আমাদের দৈন্য নয়, আমাদের গৌরব। ধর্ম আমাদের দেশে ব্রাহ্মণ ক্ষুদ্র সকলকেই কিছু না কিছু ত্যাগের পরামর্শ দিয়েছে। ব্রাহ্মণকেও অনেক ভোগ বিলাস ও প্রলোভন পরিত্যাগ করার উপদেশ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তার সঙ্গে ব্রাহ্মণ প্রচুর সম্মান পেয়েছিল। না পেলে সমাজে সে নিজের কাজ করতেই পারত না। ক্ষুদ্র ও যথেষ্ট ত্যাগ স্বীকার করেছে, কিন্তু সমাদর পায় নি। তবুও সে কিছু পাক আর না পাক, ধর্মের খাতিরে হীনতা স্বীকার করার মধ্যেও তার একটা আত্ম প্রসাদ আছে।”
[খ.] “বস্তুত জীবিকা নির্বাহকে ধর্মের শ্রেণীতে ভুক্ত করা-তখনই চলে যখন নিজের প্রয়োজনের উপরেও সমাজের প্রয়োজন লক্ষ্য থাকে। ব্রাহ্মণ ভাতে-ভাত খেয়ে বাহ্য দৈন্য স্বীকার করে নিয়ে সমাজের আধ্যাত্মিক আদর্শকে সমাজের মধ্যে বিমুগ্ধ যদি রাখে তবে তার দ্বারা তার জীবিকা নির্বাহ হলেও সেটা জীবিকা নির্বাহের চেয়ে বড়ো, সেটা ধর্ম। চাষী যদি চাষ না করে তবে একদিনও সমাজ টেনে না। অতএব, চাষী আপন জীবিকাকে যদি ধর্ম বলে স্বীকার করে তবে কথাটাকে মিথ্যা বলা যাবে না। অথচ এমন মিথ্যা সান্ত্বনা তাকে কেউ দেয়নি যে, চাষ করার কাজ বাহ্মণের কাজের সঙ্গে সম্মানে সমান। যে-সব কাজে মানুষের উচ্চতর বৃত্তি খাটে, মানব সমাজে স্বভাবতই তার সম্মান শারীরিক কাজের চেয়ে বেশি, এ কতা সুষ্পষ্ট।”
[গ.] “যে দেশে জীবিকা অর্জনকে ধর্মকর্মের সামিল করে দেখে না সে দেশেও নিম্ন শ্রেণীর কাজ বন্ধ হলে সমাজের সর্বনাশ ঘটে। অতএব সেখানেও অধিকাংশ লোককেই সেই কাজ করতেই হবে। সুযোগের সংকীর্ণতাবশত সে রকম কাজ করবার লোকের অভাব ঘটে না, তাই সমাজ টিকে আছে। আজকাল মাঝে মাঝে যখন সেখানকার শ্রমজীবিরা সমাজের সেই গরজের কথাটা মাথা নাড়া দিয়ে সমাজের নিষ্কর্মা বা পরাসও বা বুদ্ধিজীবিদের জানান দেয় তখন সমাজে একটা ভূমিকম্প উপস্থিত হয়। তখন কোথাও বা কড়া রাজ্য শাসন, কোথাও বা তাদের আর্জি-মঞ্জুরির দ্বারা সমাজ রক্ষার চেষ্টা হয়। আমাদের দেশে বৃত্তিভেদকে ধর্মশাসনের অন্তর্গত করে দেওয়াতে এ রকম অসন্তোষ্ট ও বিপ্লব চেষ্টায় গোড়া নষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এতে করে জাতিগত কর্মধারা গুলির উৎকর্ষ সাধন হয়েছে কি না ভেবে দেখবার বিষয়।”
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘ধর্ম’, ‘হিন্দু’, ‘মুসলমান’-ইত্যাদি ব্যাপরগুলো নিয়ে ভেবেছেন সাড়া জীবন ব্যাপী। এসব বিষয় নিয়ে লিখেছেন পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা। কিন্তু সেই ভারতবর্ষে হিন্দু-মুসলমান সমস্যার সমাধান কোথায়? সেই সমস্যার সমাধান কি সম্পূর্ণ বরীন্দ্রনাথ ঠাকুরের না পুরো ভারতবর্ষের? রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পুরো ভারতবর্ষের এই জাতিগত সমস্যার সমাধান দিবেন নিজের ভাবনা-চেতনা বিশ্লেষণ থেকে, যে চেতনার দ্বারা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হ’য়ে উঠবেন একজন পুরোহিত হ’য়ে, না একজন জাতিগত সমস্যার সমাধানকারী হিশেবে?
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘কালান্তর’-গ্রন্থে (শ্রাবণ : ১৩২৯)-এ ‘হিন্দু-মুসলমান’ সম্পর্কে বলেন: “পৃথিবীতে দুটি ধর্মসম্প্রদায় আছে অন্য সমস্ত ধর্মমতের সঙ্গে যাদের বিরুদ্ধতা অত্যুগ্র-সে হচ্ছে খৃস্টান আর মুসলমান-ধর্ম। তারা নিজের ধর্মকে পালন করেই সন্তুষ্ট নয়, অন্য ধর্মকে সংহার করতে উদ্যত। এই জন্য তাদের ধর্ম গ্রহণ করা ছাড়া তাদের সঙ্গে মেলাবার অন্য কোনো উপায় নেই। খৃস্টান ধর্মাবলম্বীদের সম্বন্ধে একটা সুবিধার কথা এই যে, তারা আধুনিক যুগের বাহন: তাদের মন মধ্যযুগেরগন্ডির মধ্যে আবদ্ধ নয়। ধর্মমত একান্তভাবে তাদের সমস্ত জীবনকে পরিবেষ্টিত করে নেই। এই জন্য অপর ধর্মালম্বীদের তারা ধর্মের বেড়ার দ্বারা সম্পূর্ণ বাধা দেয় না। য়ুরোপীয় আর খৃস্টান এই দুটো শব্দ একার্থক নয়। ‘য়ুরোপীয় বৌদ্ধ’ বা ‘য়ুরোপীয় মুসলমান’ শব্দের মধ্যে স্বতোবিরুদ্ধতা নেই। কিন্তু ধর্মের নামে যে জাতির নামকরণ ধর্মমতেই তাদের মুখ্য পরিচয়। মুসলমান বৌদ্ধ বা মুসলমান খৃস্টান শব্দ স্বতই অসম্ভাব। অপর পক্ষে হিন্দু জাতিও এক হিসাবে মুসলমানদেরই মতো। অর্থাৎ, তারা ধর্মের প্রকারে সম্পূর্ণ পরিবেষ্টিত। বাহ্য প্রভেদটা হচ্ছে এই যে, অন্য ধর্মের বিরুদ্ধতা তাদের পক্ষে সকর্মক নয়/অহিন্দু সমস্ত ধর্মের সঙ্গে তাদের হড়হ-ারড়ষবহঃ, হড়হ-পড়-ড়ঢ়বৎধঃরড়হ, হিন্দুর ধর্ম মুখ্যভাবে জন্মগত ও আচার মূলক হওয়াতে তার বেড়া আরো কঠিন। মুসলমান ধর্ম স্বীকার করে মুসলমানের সঙ্গে সমানভাবে মেলা যায়, হিন্দুর সে পথও অতিক্রম সংকীর্ণ। আহারে-ব্যবহারে মুসলমান অপর সম্প্রদায়কে নিষেধের দ্বারা প্রত্যাখান করে না, হিন্দু সেখানেও সর্তক। তাই খিলাফৎ উপলক্ষে মুসলমান নিজের মসজিদে এবং অন্যত্র হিন্দুকে যত কাছে টেনেছে হিন্দু মুসলমানকে তত কাছে টানতে পারেনি। আচার হচ্ছে মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্বন্ধের সেতু, সেইখানেই পদে পদে হিন্দু নিজের বেড়া তুলে রেখেছে। আমি যখন প্রথম আমার জমিদারি কাজে প্রবৃত্ত হয়েছিলুম তখন দেখেছিলাম কাছারিতে মুসলমান প্রজাকে বসতে দিতে হলে জাজিমের এক প্রান্ত তুলে দিয়ে সেইখানে তাকে স্থান দেওয়া হত। অন্য-আচার অবলম্বীদের অশুচি বলে গণ্য করার মতো। মানুষের সঙ্গে মানুষের মিলনের এমন ভীষণ বাধা আর কিছু নেই। ভারতবর্ষের এমন কপাল যে, এখানে হিন্দু মুসলমানের মতো দুই জাত একত্র হয়েছে, ধর্মমতে হিন্দুর বাধা প্রবল হয়, আচারে-প্রবল; আচারে মুসলমানের বাধা প্রবল নয়, ধর্মমতে প্রবল। এক পক্ষের যে দিকে দ্বার খোলা, অন্য পক্ষের সে দিকে দ্বার রুদ্ধ। এরা কী করে মিলবে। এক সময়ে ভারতবর্ষে গ্রীক পারসিক শক নানা জাতির অবাধ সমাগম ও সম্মিলন ছিল। কিন্তু মনে রেখো সে হিন্দু যুগের-পূর্ববর্তীকালে। হিন্দুযুগ হচ্ছে একটা প্রতিক্রিয়ার যুগ-এই যুগ ব্রাহ্মণ্য ধর্মকে সচেষ্টভাবে পাকা করে গাঁথা হয়েছিল। দুর্লঙ্ঘ্য আচারের প্রাকার তুলে এক দু®প্রবেশ্য করে তোলা হয়েছিল। একটা কথা মনে ছিল না, কোনো প্রাণবান জিনিসকে একেবারে আটঘাট বন্ধ করে সামলাতে গেলে তাকে মেরে ফেলা হয়। যাই হোক, মোট কথা হচ্ছে, বিশেষ এক সময়ে বৌদ্ধযুগের পরে রাজপুত প্রভৃতি বিদেশীয় জাতিকে দলে টেনে বিশেষ অধ্যবসায়ে নিজেদেরকে পরকীয় সংশ্রব ও প্রভাব থেকে সম্পূর্ণ রক্ষা করবার জন্যেই আধুনিক হিন্দু ধর্মকে ভারতবাসী প্রকান্ড একটা বেড়ার মতো করেই গড়ে তুলেছিল-এর প্রকৃতিই হচ্ছে নিষেধ এবং প্রত্যাখান। সকল প্রকার মিলনের পক্ষে এমন সুনিপুর্ন কৌশলে রচিত বাধা জগতে আর কোথাও সৃষ্টি হয়নি। এই বাধা কেবল হিন্দু-মুসলমানে তা নয়। তোমার-আমার মতো মানুষ যারা আচারে স্বাধীনতা রক্ষা করতে চাই, আমরাও পৃথক, বাধাগ্রস্ত। সমস্যা তো এই, কিন্তু সমাধান কোথায়। মনের পরিবর্তনে, যুগের পরিবর্তনে, যুগের পরির্বতনে। য়ুরোপ সত্যসাধনা ও জ্ঞানের ব্যাপ্তির ভিতর দিয়ে যেমন করে মধ্যযুগের ভিতর দিয়ে আধুনিক যুগে এসে পৌঁচেছে হিন্দুকে মুসলমানকেও তেমনি গন্ডির বাইরে যাত্রা করতে হবে। ধর্মকে কবরের মতো তৈরি করে তারই মধ্যে সমগ্র জাতিকে ভূতকালের মধ্যে সর্বতোভাবে নিহিত করে রাখলে উন্নতির পথে চলবার উপায় নেই, কারও সঙ্গে কারও মেলবার উপায় নেই। আমাদের মানস প্রকৃতির মধ্যে যে অবরোধ রয়েছে তাকে ঘোচাতে না পারলে আমরা কোনো রকমের স্বাধীনতাই পাব না। শিক্ষার দ্বারা, সাধনার দ্বারা সেই মূলের পরিবর্তন ঘটাতে হবে-ডানার চেয়ে খাঁচা বড়ো এই সংস্কারটাকেই বদলে ফেলতে হবে-তারপরে আমাদের কল্যাণ হতে পারে। হিন্দু-মুসলমান মিলন যুগ পরিবর্তনের অপেক্ষায় আছে। কিন্তু এ কথা শুনে ভয় পাবার কারণ নেই, কারণ অন্য দেশে মানুষ সাধনার দ্বারা যুগ পরিবর্তন ঘটিয়েছে; গুটির যুগ থেকে ডানা মেলার যুগে বেরিয়ে এসেছে। আমরাও মানসিক অবরোধ কেটে বেরিয়ে আসব, যদি না আমি তবে নান্যঃ পন্থা বিদ্যতে অয়নায়।”
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (শান্তিনিকেতন : ১৬ পৌষ ১৩১৫)-‘বিশেষ’ অধ্যায় বলেন: “জগতের সর্ব সাধারণের সঙ্গে সাধারণভাবে আমার মিল আছে- ধূলির সঙ্গে পাথরের সঙ্গে আমার মিল আছে, ঘাসের সঙ্গে গাছের সঙ্গে আমার মিল আছে; পশুপক্ষীর সঙ্গে আমার মিল আছে, সাধারন মানুষের সঙ্গে আমার মিল আছে, কিন্তু এক জায়গায় একেবারে মিল নেই-যেখানে আমি হচ্ছি বিশেষ। আমি যাকে আজ আমি বলছি এর আর কোনো দ্বিতীয় নেই। ঈশ্বরের অনন্ত বিশ্বসৃষ্টির মধ্যে এ-সৃষ্টি সম্পূর্ণ অপূর্ব-এ কেবলমাত্র আমি একলা আমি, অনুপম অতুলনীয় আমি। এই আমির যে জগৎ সে একলা আমারই জগৎ-সেই মহা বিজনলোকে আমার অন্তর্যামী ছাড়া আর কারও প্রবেশ করবার কোনো পথ নেই।
হে আমার প্রভু, সেই যে একলা আমি, বিশেষ আমি, তার মধ্যে তোমার বিশেষ আনন্দ, বিশেষ আবির্ভাব আছে-সেই বিশেষ আর্বিভাবটি আর কোনো দেশে কোনো কালে নেই। আমার সেই বিশিষ্ট তাকে আমি সার্থক করব প্রভু। আমি নামক তোমার সকল হতে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র এই যে একটি বিশেষ লীলা আছে, এই বিশেষ লীলায় তোমার সঙ্গে যোগ দেব। এইখানে একের সঙ্গে এক হয়ে মিলব।
পৃথিবীর ক্ষেত্রে আমার এই মানবজন্ম তোমার সেই বিশেষ লীলাটিকে যেন সৌন্দর্যের সঙ্গে সংগীতের সঙ্গে পবিত্রতার সঙ্গে মহত্বের সঙ্গে সচেতন ভাবে বহন করে নিয়ে যায়।
আমাতে তোমার যে একটি বিশেষ অধিষ্ঠান আছে সে কথা যেন কোনোদিন কোনোমতেই না ভোলে। অনন্ত বিশ্বসংসারে এই যে একটি আমি হয়েছি মানবজীবনে এই আমি সার্থক হোক। আমি সেখানে জগতের শামিল যেখানে তোমাকে জগদ্বীশ্বর বলে মানি, তোমার সব নিয়ম পালন করবার চেষ্টা করি, না পালন করলে তোমার শাস্তি গ্রহণ করি-কিন্তু আমিরূপে তোমাকে আমি আমার একমাত্র বলে জানতে চাই সেইখানে তুমি আমাকে স্বাধীন করে দিয়েছ-কেননা স্বাধীন না হলে প্রেম সার্থক হবে না, ইচ্ছার সঙ্গে ইচ্ছা মিলবে না। লীলার সঙ্গে লীলার যোগ হতে পারবে না। এই জন্যে এই স্বাধীনতার আমি ক্ষেত্রেই আমার সব দুঃখের চেয়ে পরম দুঃখ তোমার সঙ্গে বিচ্ছেদ অর্থাৎ অহংকারের দুঃখ আর সব দুখের চেয়ে পরম সুখ তোমার সঙ্গে মিলন, অর্থাৎ প্রেমের সুখ। এই অহংকারের দুঃখ কেমন করে ঘুচবে সেই ভেবেই বুদ্ধ তপস্যা করে ছিলেন এবং এই অহংকারের দুঃখ কেমন করে ঘোচে সেই জানিয়েই খৃষ্ট প্রাণ দিয়েছিলেন। এই দুঃখ ও সুখ বিচ্ছেদ ও মিলন অমৃত ও মৃত্যু, এই তোমার দক্ষিণ ও বাম দুই বাহু, এর মধ্যে সম্পূর্ণ ধরা দিয়ে যেন বলতে পারি, আমার সব মিটেছে , আমি আর কিছুই চাই নে।”
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার বিশ্বমানসলোকে ও চেতনায় ধর্ম বিশ্বাস বোধটি ধারণ করেছিলেন দৃঢ়ভাবে। এবং তার দায়িত্বের রূপটি ছিল সম্পূর্ণ জীবনব্যাপী। রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস ছিলেন সৃষ্টিকর্তার ও তাঁর সৃষ্টিতে। লিখেছেন একের পর এক বিশ্বাস’ ও ‘প্রার্থনা’ শিরোনামে একাধিক লেখা। যে লেখাগুলোতে সুষ্পষ্টরূপে প্রকাশ পায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিশ্বাসের দিকটি। লিখেছেন ‘প্রার্থনার সত্য’, ‘বিধান’, ‘জগত মুক্তি’, বিশ্বব্যাপী’, ‘মৃত্যুর প্রকাশ’, ‘ভাবুকতা’, ‘পবিত্রতা’, ‘অন্তর বাহির’, ‘তীর্থ’ ‘নিত্য ধর্ম’, ‘প্রার্থনা’, ‘বিশ্বাস’, ‘মরণ’, ‘সত্যকে দেখা’, ‘সৃষ্টি’, ‘মৃত্যুও অমৃত’, ‘অহং’, ‘আত্মার প্রকাশ’, ‘আদেশ’, ‘সাধন’, পূর্ণতা’ ইত্যাদি শিরোনামে একাধিক লেখা। যে লেখাগুলোতে ফুটে উঠেছে রবীন্দ্রনাথের বিশ্বাস-ধর্মবোধ-জাতীয়তা সর্বোপরি চরমরূপে ঈশ্বর বিশ্বাসী একজন রবীন্দ্রনাথ। যিনি মনে-প্রাণে তৈরি করেছেন বিশ্বাসের এক স্তম্ভ, যে স্তম্ভয়ের উপর তিনি দাঁড় করিয়েছেন বিশ্বাসের এক দীর্ঘ প্রাসাদ এবং বসোবাস করেছেন তাঁর-ই অভ্যন্তরে।