আধুনিক বাঙলা কবিতা রচিত হওয়ার পর প্রয়োজন হ’য়ে প’ড়ে তার একটি উৎকৃষ্ট সংকলনের। তাই এই কাজটি আপন মনে করেন বুদ্ধদেব বসু। শুরু করেন ‘আধুনিক বাংলা কবিতা’ নামে এক গ্রন্থের কাজ; যে গ্রন্থে পাওয়া যাবে অনেক কবির, অনেকগুলো কবিতা একসাথে। আর যাদের কবিতা ওই গ্রন্থে পাওয়া যাবে তাঁরা পরিচিতি হবেন ‘আধুনিক কবি’ বলে। যারা আধুনিক কবি নন; নিশ্চিত, তাঁদের কবিতা অন্তভুর্ক্ত হবে না এ গ্রন্থে, যেহেতু এটা সম্পূর্ণভাবে আধুনিক বাঙলা কবিদের সংকলন। কিন্তু  সংকলনটিতে কি দেখতে পাই আমরা ? ব্যর্থ হয় সেই সংকলনটি; যা প্রশ্নবিদ্ধ ক’রে তোলে বুদ্ধদেব বসুকে এবং একই সাথে আধুনিক বাঙলা কবিতাকে। প্রশ্নবিদ্ধ হোন সেই সব কবিরা যারা কমবেশি জায়গা ক’রে নিয়েছিলেন ওই গ্রন্থে; সমালোচনা থেকে বাদ পড়েন অনেক কবি, যারা শুধুই আধুনিক কবি ছিলেন এবং রয়েছেন বর্তমান সময় পর্যন্ত। যারা ‘আধুনিক কবি’ বলে পরিচিত ছিলেন ‘আধুনিক বাংলা কবিতা’ (১৯৫৪)- এর গ্রন্থে; যার অনেকেই ছিলেন অকবি। এক প্রকার মিশ্রণ ঘটিয়েছিল ওই গ্রন্থটি কবি এবং অকবি নিয়ে। ওই গ্রন্থের অনেকেই অকবি ছিলেন; কিন্তু স্থান পেয়েছিলেন বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত ‘আধুনিক বাংলা কবিতা’ (১৯৫৪)–এর গ্রন্থে। এ গ্রন্থের পাঁচটি সংস্করণ বের হয় ১৯৭৩ পর্যন্ত। সংস্করণের পর সংস্করণে বৃদ্ধি পেতে থেকে  আধুনিক কবিদের সংখ্যা। যেনো  ওই সময় পর্যন্ত প্রতি বছর দেখা দিচ্ছে আধুনিক কবিদের সংখ্যা। যা আমরা তার পরবর্তী সময়ে আর দেখতে পাই না। কবিদের একটি উৎকৃষ্ট সময় যাচ্ছিল ওই দশকে, যেখানে আমরা পরিচিত হই নতুন নতুন কবিদের সাথে। তাঁরা কি কবি ছিলেন ? তা পরে বলবো। বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত ‘আধুনিক বাংলা কবিতা’ (১৯৫৪)- এর পাঁচটি সংস্করণ প্রকাশিত হয় বুদ্ধদেব বসুর জীবনদর্শায়। ১. প্রথম সংকলন : (ফালগুণ, ১৩৬০: মার্চ, ১৯৫৪);  ২. দ্বিতীয় সংস্করণ : (ফালগুণ, ১৩৬২: মার্চ , ১৯৫৬); ৩. তৃতীয় সংস্করণ : (আষাঢ়, ১৩৬৬: জুলাই, ১৯৫৯); ৪. চতুর্থ সংস্করণ : (ভাদ্র, ১৩৭০: আগস্ট, ১৯৬৩) এবং ৫. পঞ্চম সংস্করণ : (আশ্বিন, ১৩৮০ : সেপ্টেম্বর , ১৯৭৩)-এ সর্বশেষ সংস্করণটি। প্রথম সংস্করণ থেকে চতুর্থ সংস্করণ পর্যন্ত, প্রত্যেক সংস্করণের ব্যবধান দুই থেকে তিন বছর। বড় ব্যবধান দেখা দেয় চতুর্থ সংস্করণ থেকে পঞ্চম সংস্করণ পর্যন্ত। দশ বছর ব্যবধানে বের হয় পঞ্চম সংস্করণটি। কেন এতো কম সময়ে দেখা দেয় আধুনিক বাংলা কবিতার চারটি সংস্করণ ? তাহ’লে কি কবি ও তাঁদের রচিত কবিতার প্রবাহিত ধারা খুব বেশি দেখা দেয় এ সময় গুলোতে ? যার ফলশ্রুতিতে খুব দ্রুত সময়ে বের করতে হয় চারটি সংস্করণ ! যে সংস্করণগুলোতে ব্যাপকভাবে পরিবর্তন ঘটতে থাকে কবি ও কবিতার সংখ্যা। যে পরিবর্তন গুলো দৃশ্যমান হ’য়ে উঠে ‘আধুনিক বাংলা কবিতা’ নামে কবিতার একটি অসীমাবদ্ধ গ্রন্থে।

                 বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত ‘আধুনিক বাংলা কবিতা’ (১৯৫৪)- এর গ্রন্থটি বহন ক’রে কোনো না  কোনো প্রকার ত্রুটি। যে ত্রুটি অন্য অনেকের কাছে হয়তো  আর ত্রুটি ব’লে  মনে হয় না। যেহেতু তাঁরা রয়েছেন ওই গ্রন্থে। এ গ্রন্থে কবিদের সংখ্যাগত দিকটি আমাকে বেশ ভাবিত ক’রে তোলে। এ গ্রন্থের পাঁচটি সংস্করণে যে দিকটি খুব স্পষ্ট হ’য়ে  উ’ঠে তা হলঃ প্রথম সংস্করণে কবির সংখ্যা ৪৯, কবিতা নেওয়া হয় ১৭৬টি; দ্বিতীয় সংস্করণে কবির সংখ্যা ৫৫, কবিতা নেওয়া হয় ১৯৬টি; তৃতীয় সংস্করণে কবির সংখ্যা ৫৭, কবিতা নেওয়া হয় ২০১টি; চতুর্থ সংস্করণে কবির সংখ্যা সেই একই অর্থাৎ ৫৭, কবিতা নেওয়া হয় ২০৮টি; এবং পঞ্চম সংস্করণে কবির সংখ্যা ৬৭, কবিতা নেওয়া হয় ২৩৯টি।

                  বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত ‘আধুনিক বাংলা কবিতা’ (১৯৫৪)- এর গ্রন্থে প্রথম সংকলনে যেখানে আমরা  দেখতে পাই কবির সংখ্যা ৪৯ জন; এবং তার পর মুহূর্তে দ্বিতীয় সংস্করণে  সেই কবির সংখ্যা বেড়ে হয় ৫৫ জনে। তাহ’লে আমরা দেখতে পাই আধুনিক বাঙলা কবিতায় আরও আগমন ঘটে নতুন ৬ জন কবি। এই ছয়জন নতুন কবি হলেনঃ অরুণ মিত্র, বিরাম মুখোপাধ্যায়, গোপাল ভৌমিক, রাম বসু, লোকনাথ ভট্টাচার্য এবং অরবিন্দ গুহ। কবিদের এই বৃদ্ধি শুধু তালিকা মাত্র নয়; তাঁরা কি দেখা দেবেন বাঙলা কবিতায় মেধা ও মননশীলতায় ? দ্বিতীয় সংস্করণ থেকে তৃতীয় সংস্করণে বৃদ্ধি পায় দু’জন কবি। এভাবে সংস্করণ পর্যায় বৃদ্ধি পেতে থেকে  কবিদের সংখ্যা। চতুর্থ সংস্করণ থেকে পঞ্চম সংস্করণ এ বৃদ্ধি পায় দশজন কবি। এবং এ দু’টি সংস্করণের সময়ের ব্যবধানও দশবছর। গড় হিসাবে প্রতি বছর আধুনিক কবিতায় নতুন ক’রে এসেছেন একজন কবি। এবং এই দশ বছরে আধুনিক বাঙলা কবিতায় সংযুক্ত হয়েছে ৩১টি কবিতা। প্রথম সংস্করণ ও পঞ্চম সংস্করণের মধ্যে কবিতার ব্যবধান ৬৩টি। যদি আধুনিক বাংলা কবিতার আর কোনো সংস্করণ প্রকাশ না পেত তাহ’লে কবির সংখ্যা  যেমন কম হতো একই ভাবে কবিতার সংখ্যাও কমে আসতো। সেটা কতটা গ্রহণযোগ্য হতো আধুনিক বাঙলা কবিতায় ? বুদ্ধদেব বসু  দ্বিতীয় সংস্করণের ভূমিকায় লিখলেনঃ ‘এই নতুন সংস্করণটি  বহু পরিবর্তন করা হ’লো; ছয়জন নতুন কবি যুক্ত হলেন, এবং কোনো কোনো পুরনো কবি সম্প্রতি যাঁদের অনেক লেখা বেরিয়েছে- তাঁদের রচনা নতুন করে নির্বাচন করলাম। এক মাত্র গোপাল ভৌমিক ব্যতীত সবাই জড়িত ছিলেন ‘কবিতা’ পত্রিকার সাথে’। তাহ’লে কি আমরা বলতে পারি না; আধুনিক কবিরা আর কিছু করুক আর নাই করুক, রচনা করেছেন কবিতার পর কবিতা। সবচে আশ্চর্য লাগে যে; প্রথম থেকে পঞ্চম সংস্করণ পর্যন্ত কবি ও কবিতার অনুপাত থেকে প্রায় একই রকম। যেমনটা আমরা দেখতে পাই কবি ও কবিতার অনুপাত ১: ৩.৬। সংখ্যাগত দিক থেকে প্রথম থেকে পঞ্চম সংস্করণ পর্যন্ত  এগিয়েছে কবি ও কবিতার সংখ্যা; কিন্তু তাঁদের অনুপাত থেকে স্থির।  
  
              বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত ‘আধুনিক বাংলা কবিতা’ (১৯৫৪)- এর প্রথম সংকলনের কবিরা হলেনঃ  রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রমথ চৌধুরী, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, যতীন্দ্রমোহন বাগচী, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, সুকুমার রায়, যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত, মোহিতলাল মজুমদার, সুধীরকুমার রায় চৌধুরী, কাজী নজরুল ইসলাম, জীবনানন্দ দাশ, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, মনীশ ঘটক, অমিয় চক্রবর্তী, জসীম উদ্দিন, প্রমথনাথ বিশী, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, প্রেমেন্দ্র মিত্র, অন্নদাশঙ্কর রায়, হেমচন্দ্র বাগচী, রাধারানী দেবী, বিমলা প্রসাদ মুখোপাধ্যায়, হুমায়ুন কবির, অজিত দত্ত, সুনীলচন্দ্র সরকার, বুদ্ধদেব বসু, নিশিকান্ত, বিষ্ণু দে, সঞ্জয় ভট্টাচার্য, অশোকবিজয় রাহা, বিমলচন্দ্র ঘোষ, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ মৈত্র, চঞ্চল কুমার চট্টোপাধ্যায়, দিনেশ দাস, মৃণালকান্তি, সমর সেন, বিশ্ব বন্দোপাধ্যায়, কামাক্ষী প্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, কিরণশঙ্কর সেনগুপ্ত, হরপ্রসাদ মিত্র, মনীন্দ্র রায়, বাণী রায়, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, মঙ্গলাচরন চট্টোপাধ্যায়, অরুণকুমার সরকার, নরেশ গুহ, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী এবং সুকান্ত ভট্টাচার্য। এ সংকলনে মোট পাওয়া যাবে ৪৯ জন কবির ১৭৬টি কবিতা। এবং যারা জায়গা ক’রে নিয়েছেন ‘আধুনিক বাংলা কবিতা’ নামের গ্রন্থটিতে। এ সংকলনে বেশি সংখ্যক কবিতা নেওয়া হয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের। তাঁর মোট কবিতার সংখ্যা ১৬টি। অমিয় চক্রবর্তীর ১৩টি; জীবনানন্দ দাশের ১০টি; বুদ্ধদেব বসুর ১০টি; সমর সেনের ৯টি; অজিত দত্তের ৮টি; বিষ্ণু দে ও সুধীন্দ্রনাথ দত্তের ৭টি করে; প্রেমেন্দ্র মিত্র ও নজরুলের নেওয়া হয় ৬টি ক’রে কবিতা। এ সংকলনে  গড় হিশেবে একজন কবির নেওয়া হয় তিনের অধিক কবিতা। প্রথম সংকলনের কবিদের তালিকার সাথে দ্বিতীয় সংস্করণের আরও যুক্ত করা হয় ৬জন নতুন কবি। দ্বিতীয় সংস্করণে ৫৫ জন কবির নেওয়া হয় ১৯৬টি কবিতা। যার গড় হিশেবে একজন কবির  নেওয়া হয় তিনের অধিক কবিতা। তৃতীয় সংস্করণে আরও নতুন ক’রে দেখা দেন দু’জন কবি। এ দু’জন হলেন  রমেন্দ্রকুমার আচার্য চৌধুরী  এবং অলোকরঞ্জন দাসগুপ্ত। তৃতীয় সংস্করণে মোট কবির সংখ্যা এসে দাড়ায় ৫৭ জনে; এবং তাঁদের নেওয়া হয় ২০১ টি কবিতা। চতুর্থ সংস্করণে কবিদের সংখ্যা আর বৃদ্ধি না পেয়ে অপরিবর্তিত থেকে যায়; কিন্তু পরিবর্তন ঘটে কবিতার সংখ্যাতে। এ সংস্করণে নেওয়া হয় ২০৮টি কবিতা; যা পূর্বের থেকে ৭টি কবিতা বেশি। কবি ও কবিতার গড় অনুপাত ঠিক থাকে সেই পূর্বের ন্যায়; অর্থাৎ একজন কবির নেওয়া হয় তিনের অধিক কবিতা। অন্যান্য সংস্করণ থেকে বৃহৎ সংস্করণ হ’য়ে দেখা দেয় পঞ্চমটি। যা পূর্বের সকল সংস্করণ থেকে কবি ও কবিতার সংখ্যাগত দিক থেকে এগিয়ে যায়। পঞ্চম সংস্করণে নেওয়া হয় ৬৭ জন কবিকে; এবং তাঁদের অন্তর্ভুক্ত কবিতার সংখ্যা ২৩৯ টি। যা নিশ্চয়, বৃহৎ হ’য়ে দেখা দেয় আধুনিক বাঙলা কবিতার সংস্করণটি। আধুনিক বাঙলা কবিতার এ সংস্করণটির দিকে দৃষ্টি দিলে আমরা দেখতে পাই দ্রুতি গতিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে আধুনিক বাঙলা কবিতা ও কবিদের সংখ্যা। যেহেতু এ গ্রন্থের প্রথম সংস্করণটি শুরু হয়েছিল ৪৯ জন কবিদের নিয়ে। ঠিক তার দেড় দশকের কিছু বেশি সময় প’রে আমরা দেখতে পাই কবি ও কবিতার সংখ্যাগত দিকটির ব্যাপক পরিবর্তন। এটা আধুনিক বাঙলা কবিতার জন্য কতোটা সুফল ব’য়ে আনবে তা আমাদের বোধগম্য নয়। যেখানে অন্য কেউ নয়; কবিই হ’য়ে উঠে কবিতার একক রূপকার। যাঁদের চিন্তা, চেতনা, ভাবনা ও নিবিড় অনুশীলনে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটতে থাকে আধুনিক বাঙলা কবিতার সংখ্যাগত দিকটি। সেই সব আধুনিক কবিতা কি সকল কালের কবিতা হ’য়ে দেখা দিবে ? না, দেখা দিবে সময়ের দায়িত্ব প্রাপ্ত কোনো এক কবির দারুণ যন্ত্রণাময় কর্মসমাপ্তি ! যেখানে তিনি কবিদের জন্য হ’য়ে উঠেন এক অঝোর আদিম দেবতা; যিনি তাদেরকে নিয়ে যাবেন উজ্জ্বলময় আলো থেকে আরও প্রগাঢ় আলোতে।