রবীন্দ্রনাথের প্রতিষ্ঠা ও প্রতিভার পাশে কবি পত্নী মৃণালিনী দেবী নিতান্তই ম্লান হ’য়ে আছেন। কিন্তু কবির জীবনে মৃণালিনী দেবীর ভূমিকা নগণ্যমাত্র ছিল না। কবির জীবনের সাথে তিনি মিশে ছিলেন একান্ত হ’য়ে; হতে পেরেছিলেন আত্মার পরম আত্মীয়। শুধু রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য জীবনে নয়; তিনি হ’য়ে উঠেছিলেন রবীন্দ্রনাথের স্বপ্নের শান্তিনিকেতনের একজন নীরব সহকর্মী। সমালোচক প্রমথনাথ বিশী (১৯০১-১৯৮৫) যেমন বলেছেন, ‘শান্তিনিকতন স্থাপনে তিনি যেমন সর্বতোভাবে নিজের সাহচর্য, শক্তি, এমনকি অনটনের দিনগুলোতে নিজের অলঙ্কারগুলি পর্যন্ত সহায়তা করিয়াছিলেন, সংসারে তাহা একান্ত বিরল। এই বিদ্যালয়ের প্রাথমিক ইতিহাসের পাতায় ইহাদের স্মৃতি স্নেহের স্বর্ণাক্ষরে লিখিত। কবিপত্নী জীবিত থাকিলে বিদ্যালয় পরিবারটি নিশ্চয় আরও সুস্নিগ্ধ হইয়া উঠিত।’
মৃণালিনী দেবীর মৃত্যুর পর নীহাররঞ্জন দাশের ভগিনী অমলা দাশ ইন্দিরা দেবীকে লিখেছিলেন যে, রবীন্দ্রনাথের জীবনে মৃণালিনী দেবী যে কতখানি ছিলেন তাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে না মিশলে না জানবারই কথা। রান্নায়, অতিথি আপ্যায়নে তাঁর পারদর্শিতার কথা আমরা সকলেই জানি। রথীদ্রনাথ, মীরা দেবীর স্মৃতি কথায় তাঁর ইংরেজি নভেল পড়ার কথা জানা যায়। শুধু পাঠ্যপুস্তক অধ্যায়ণ নয়; অভিনয়ের ক্ষেত্রেও তাঁর সমান পারদর্শিতা ছিল। সবচেয়ে আসল কথা, ঘরের একজন গৃহিণী হ’য়েও, রবীন্দ্রনাথের সাথে মিশতে তাঁর কোন কষ্ট হয়নি। সর্বদা থাকতেন সাধারণভাবে। কোনো দিন তিনি ব্যবহার করেননি ভারি কোনো গয়না; এমনকি কোন প্রকার সাজসজ্জা। মৃণালিনী দেবীকে লেখা রবীন্দ্রনাথের ছত্রিশটি চিঠির সন্ধান আমরা পাই।
রবীন্দ্রনাথ-মৃণালিনী দেবীর পারস্পারিক সম্পর্ক বুঝে নিতে, তাঁদের ব্যক্তি সম্পর্ক কী রকম ছিল তার ব্যাপক ছায়া রয়েছে প্রকাশিত এই চিঠিগুলোর মধ্যে। স্বল্পতম সময়ে কবি রবীন্দ্রনাথকে পূর্ণরূপে আবিষ্কার করা যায় এই চিঠিগুলোর মধ্যে। সব ধরনের মানবিক ও তার মূল্যবোধের সুস্পষ্ট ছায়া ছড়িয়ে রয়েছে রবীন্দ্র রচিত এই চিঠিগুলোর মধ্যে। এ-ছাড়াও রয়েছে রবীন্দ্রনাথের রসবোধের পর্যাপ্ত দৃষ্টান্তও। চিঠির প্রত্যেক পঙক্তিতে সহজাত ভালোবাসার ছায়া রয়েছে। পরবর্তী কোন এক সময়ে, দীনেশচন্দ্র সেনকে, রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘যিনি আপন জীবনের দ্বারা আমাকে নিয়ত সহায়বান করিয়া রাখিয়াছিলেন তিনি মৃত্যু দ্বারাও আমার জীবনের অবশিষ্ট কালকে সার্থক করিবেন।’
রবীন্দ্রনাথ, তাঁর চিঠিতে মৃণালিনী দেবীকে ‘ভাই ছোট বৌ’, ‘ছোট ভাই গিন্নি’, ‘ভাই ছুটি’, ‘ছুটকি’ ইত্যাদি নামে সম্বোধন করেছেন। এ-পর্যন্ত স্ত্রীকে লেখা; রবীন্দ্রনাথের ৩৬টি চিঠির সন্ধান পাওয়া যায়। লিখিত চিঠির মধ্যে ৩১টিতে সম্বোধন করেছেন ‘ভাই ছুটি’ বলে। মৃণালিনী দেবীর ১৬ থেকে ২৭ বছর বয়সের মধ্যে (১৮৯০-১৯০২) রবীন্দ্রনাথ; এ-চিঠিগুলো তাকে লেখেন। শিলাইদহ, কুষ্টিয়া, কালিগ্রাম, সাজাদপুর থেকে লেখা হয় ১৯টি চিঠি। কলকাতা থেকে ৩টি, এলাহাবাদ থেকে ১টি, ম্যাসালিয়া জাহাজ থেকে ১টি, প্যারিস থেকে ১টি, মজঃফরপুর থেকে ৯টি এবং শান্তিনিকেতন থেকে লেখা হয় ১টি চিঠি। চিঠির বিষয়বস্তু হিশেবে পাওয়া যায় জমিদারী, সমাজ, সুখ-দুঃখ, প্রকৃতি এবং ভ্রমণ সম্পর্কিত।
মৃণালিনী দেবী স্মরণে রবীন্দ্রনাথ লেখেন একটি কবিতা, ‘দেখিলাম খানকায় পুরাতন চিঠি/স্নেহমুগ্ধ জীবনের চিহ্ন দু-চারিটি/স্মৃতির খেলেনা-কটি বহু যত্নেভরে/গোপনে সঞ্চয় করি রেখেছিলে ঘরে।/যে প্রবল কালস্রোতে প্রলয়ের ধারা/ভাসাইয়া যায় কত রবিচন্দ্রতারা,/তারি কাছ হতে তুমি বহু ভয়ে ভয়ে/এই কটি তুচ্ছ বস্তু চুরি করে লয়ে/লুকায়ে রাখিয়াছিলে; বলেছিলে মনে/‘অধিকার নাই কারো আমার এ ধনে।’/আশ্রয় আজিকে তারা পাবে কার কাছে !/জগতের কারো নয় তবু তারা আছে !/তাদের যেমন তব রেখেছিল স্নেহ/তোমারে তেমনি আজ রাখেনি নি কেহ ? [বোলপুরঃ ২পৌষ, ১৩০৯]
মৃণালিনী দেবীকে, রবীন্দ্রনাথ প্রথম চিঠিটি লেখেন ১৮৯০ সালের জানুয়ারি মাসে, সাহাজাদপুর থেকে। রসিকতায় পূর্ণ এ- চিঠিটি রবীন্দ্রনাথ শুরু করেন এভাবে, ‘যেমনি গাল দিয়েছি অমনি চিঠির উত্তর এসে উপস্থিত। কাকুতি মিনতি করলেই অমনি নিজমূর্তি ধারণ করেন আর দুটো গালমন্দ দিলেই একবারে জল, একেই তো বলে বাঙ্গাল। ছি, ছি ছেলেটাকে পর্যন্ত বাঙ্গাল করে তুল্লে গো। আজ এতক্ষণ একদল লোক উপস্থিত ছিল। তোমাদের চিঠি যখন এল তখন খুব কথাবার্তা চলছে, চিঠিও খুলতে পারিনে, উঠতেও পারিনে। একদল উকিল আর স্কুলের মাস্টার এসেছিল। আমার বই স্কুলে চালাবার জন্য কথাবার্তা কয়ে রেখেছি কেবল বই আর পাচ্ছিনে। কই আজও তো বই এসে পৌঁছল না। ভাল গেরোতেই ফেলেছে। রাজর্ষি যে ক খানা আমার কাছে ছিল তা সেইতেই ইন্সপেক্টরের হাতে দিয়েছি; নদিদির গল্পস্বল্প ও দিয়েছি। আবার ইন্সপেক্টরের গোলা ভেঙে গেছে বলে তাকে হোমিওপ্যাথি ঔষধ দিয়েছি-এতে অনেক ফল হতে পারে-তাঁর গোলা ভাঙা না সারলেও তবু মনটা প্রসন্ন থাকবে। দেখচ, বসে বসে কত উপার্জনের উপায় করচি। সকালে উঠেই বই লিখতে বসেছি তাতে কত টাকা হবে একবার ভেবে দেখ। ছাপাবার সমস্ত খরচ না উঠুক নিদেন দশ পঁচিশ টাকাও উঠবে। এই রকম উঠে পড়ে লাগলে তবে টাকা হয়। তোমরা তো কেবল খরচ করতে জানো। এক পয়সা ঘরে আনতে পার ? কুঞ্জ লিখেছে জিনিসপত্র বিরাহিমপুরে পাঠিয়েছে সেখান থেকে বোধ হয় কাল এখানে এসে পৌছতে পারে। আমাদের সাহেব আসবেন পরশুদিন। সেদিন আমার কি শুভদিন। আমার কি আনন্দ। আমার সাহেব আসবে আমার মেমও আসবে। হয়তো আমার ঘরে এসে খানা খেয়ে যাবে- নয়তো বলবে-বাবু আমার সময় নাই। আমার কত ভাগ্যি ! প্রার্থনা করি, যেন তাঁর সময় না থাকে। কিন্তু খাবার নাম শুনলেই যে সময়ের অভাব হবে এমনত আমার আশা হয় না।
বেলি খোকার জন্য এক একবার মনটা ভারি অস্থির বোধ হয়। বেলিকে আমার নাম করে দুটো অড খেতে দিয়ো। আমি না থাকলে সে বেচারাত নানা রকম জিনিস খেতে পায় না। খোকাকেও কোন রকম করে মনে করিয়ে দিও। আমার পশমের ছবি দেখে সে আমাকে চিনতে পারে এ শুনে আমি বড় খুশি হলুম না। আশু যে বলেছিল সেই একশো টাকা থেকে আমাকে বাঁচিয়ে দিবে-আবার টাকা চেয়েছে ?’ ‘শ্রীরবীন্দ্রনাথ’ বলে কবি এ-চিঠিটি শেষ করেন। চিঠিটিতে আমরা পাই পারিবারিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং সন্তানদের প্রতি রবীন্দ্রনাথের ভালবাসার বহিঃপ্রকাশ। আলাপ-আলোচনা আরও উঠে এসে অজ্ঞাত কিছু ব্যক্তির কথা, যাকে আমরা ঠিক চিনে উঠতে পারি না। তাঁরা সম্পর্কের বন্ধনে আবদ্ধ থাকে কবির সাথে। দীর্ঘ নয় মাস ব্যবধান রেখে আগস্টের শেষের দিকে দ্বিতীয় চিঠিটি স্ত্রীকে লেখেন রবীন্দ্রনাথ। এই চিঠিটি শুরু করেন ‘ভাই ছোট বৌ’ বলে। যা আমরা এর পূর্বেও লক্ষ্য করেছি। ‘আজ আমরা এডেন বলে এক জায়গায় পৌছব। অনেকদিন পর ডাঙা পাওয় যাবে। কিন্তু সেখানে নামতে পারব না। পাছে সেখান থেকে কোন রকম ছোঁয়াচে ব্যামো নিয়ে আসি। এডেনে পৌছে আর একটা জাহাজ বদল করতে হবে, সেই একটা মহা হাঙ্গামা রয়েছে। এবারে সমুদ্রে আমার যে অসুখটা করেছিল সে আর কি বলব-তিনদিন ধরে যা একটা কিছু মুখে দিয়েছি অমনি তখনি বমি করে ফেলেছি। মাথা ঘুরে গা ঘুরে অস্থির-বিছানা ছেড়ে উঠিনি-কি করে বেঁচে ছিলুম তাই ভাবি।’ এই একই চিঠিতে প্রকাশ পায় রবীন্দ্রনাথের ভাবনালোকের এক লুকায়িত কথা। রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘রবিবার দিন রাত্রে আমার ঠিক মনে হল আমার আত্মাটা শরীর ছেড়ে বেড়িয়ে জোড়াসাঁকোয় গেছে। একটা বড়ো খাটে একধারে তুমি শুয়ে রয়েছ আর তোমার পাশে বেলি খোকা শুয়ে। আমি তোমাকে একটু আধটু আদর করলুম আর বল্লুম ছোট বৌ মনে রেখ আজ রবিবার রাত্তিরে শরীর ছেড়ে বেড়িয়ে তোমার সঙ্গে দেখা করে গেলুম-বিলেত থেকে ফিরে গিয়ে জিজ্ঞাসা করব তুমি আমাকে দেখতে পেয়েছিলে কি না। তার পরে বেলি খোকাকে হাম দিয়ে ফিরে চলে এলুম। যখন ব্যামো নিয়ে পড়ে ছিলুম তোমরা আমাকে মনে করতে কি ? তোমাদের কাছে ফেরবার জন্য ভারি মন ছটফট করতো। আজকাল কেবল মনে হয় বাড়ির মত এমন জায়গা আর নেই-এবারে বাড়ি ফিরে গিয়ে আর কোথাও নড়বো না।’ এই একই চিঠিতে প্রকাশ পায় রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিগত ভ্রমণের ইচ্ছা-অনিচ্ছা নানা দিকগুলো। পরিবেশে সাথে নিজেকে মিশিয়েছেন একান্তরূপে।
তাই একই চিঠিতে আবার দেখতে পাই, ‘আজকাল যদিও সমুদ্রটা বেশ ঠাণ্ডা হয়েছে, জাহাজ তেমন দুলছে না, শরীরে কোন অসুখ নেই-সমস্ত দিন জাহাজের ছাতের উপর একটা মস্ত কেদারার উপরে পড়ে, হয় লোকেনের সঙ্গে গল্প করি, নয় ভাবি, নয় বই পড়ি। রাত্রিরেও ছাতের উপর বিছানা করে শুই। পারৎ পক্ষে ঘরের ভিতর ঢুকিনে। ঘরের মধ্যে গেলেই গা কেমন করে ওঠে। কাল রাত্তিরে আবার হঠাৎ খুব বৃষ্টি এল- যেখানে বৃষ্টির ছাঁট নেই সেইখানে বিছানাটা টেনে নিয়ে যেতে হল। সেই অবধি এখন পর্যন্ত ক্রমাগতই বৃষ্টি চলছে। কাল বড্ড রৌদ্র ছিল। আমাদের জাহাজে দুটো-তিনটে ছোট ছোট মেয়ে আছে। তাঁদের মা মরে গেছে; বাপের সাথে বিলেত যাচ্ছে।
বেচারাদের দেখে আমার বড় মায়া করে। তাদের বাপটা সর্বদা তাদের কাছে কাছে নিয়ে বেড়াচ্ছে-ভাল করে কাপড় চোপড় পরাতে পারে না, জানে না কি রকম করে কি করতে হয়। তাঁরা বৃষ্টিতে বেড়াচ্ছে। বাপ এসে বারণ করলে, তারা বল্লে আমাদের বৃষ্টিতে বেড়াতে বেশ লাগে। বাপটা একটু হাসে, বেশ আমোদে খেলা করছে দেখে বারণ করতে বোধ হয় মন সরে না। তাদের দেখে আমার নিজের বাচ্চাদের মনে পড়ে। কাল রাত্তিরে বেলিটাকে স্বপ্নে দেখেছিলুম। সে যেন ষ্টীমারে এসেছে। তাকে এমনি চমৎকার ভাল দেখাচ্ছে সে আর কি বলব। দেশে ফেরবার সময় বাচ্চাদের জন্য কি রকম জিনিস নিয়ে যাব বল দেখি। এ চিঠিটা পায়েই যদি একটা উত্তর দাও তা হলে বোধ হয় ইংল্যান্ডে থাকতে থাকতে পেতেও পারি। মনে রেখ মঙ্গলবার দিন বিলেতে চিঠি পাঠাবার দিন।’
রবীন্দ্রনাথের চিঠিগুলো ভালভাবে পড়লে একটি দিক সুস্পষ্ট দেখতে পাই, তিনি চিঠি লেখার পর তার উত্তর না পেয়েও; পরের চিঠি লেখা শুরু করেন। পূর্বে যেটা লিখেছিলেন, তার উত্তরের অপেক্ষায় আর থাকেন না। হয়তো কোন একসময় তার উত্তর আসবে; নচেৎ না। উল্লেখ্য যে, তরুণ রবীন্দ্রনাথ প্রথম বিলেত জান ১৮৭৮ সালের অক্টোবরে। ব্যারিস্টার বা আইসিএস হওয়ার জন্য। ১৮৮০ সালেই আবার তিনি দেশে ফিরে আসেন শিক্ষা অসমাপ্ত রেখেই। ১৮৮১ সালের ২২ এপ্রিলে; রবীন্দ্রনাথ দ্বিতীয়বার বিলেত যাত্রা করেন, কিন্তু বিলেত যাওয়া হ’য়ে উঠেনি; মাদ্রাজ থেকেই ফিরে আসেন। ১৮৯০ সালে আবার যখন দ্বিতীয়বার বিলেত জান সেই ভ্রমণকালীন সময়েই ‘ম্যানিলা’ জাহাজ থেকে মৃণালিনী দেবীকে লেখেন তৃতীয় চিঠিটি। প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় (১৮৯২-১৯৮৫) রচিত ‘রবীন্দ্রজীবনী’র প্রথম খণ্ডতে ‘বিলাতে দ্বিতীয়বার, মানসীর শেষপালা’ শিরোনামের লেখাতে উল্লেখ রয়েছে এই বিলেত ভ্রমণের কথা।
জীবনীকার বলেন, ‘১৮৯০ সালের আগস্ট মাসে গোড়ার দিকে রবীন্দ্রনাথকে অকস্মাৎ সোলাপুরে আবির্ভূত হতে দেখি। সত্যেন্দ্রনাথ বিশেষ ছুটি লইয়া বিলাত যাইতেছেন, লোকেন পালিত ও সঙ্গী রবীন্দ্রনাথও যাইবেন স্থির করিলেন। সোলাপুরে যে কয়দিন ছিলেন, তিনটি কবিতা লেখেন-‘গোধূলি’ , ‘উচ্ছ্রৃঙ্খল’ ও ‘আগন্তুক’। শেষ দুইটি কবিতা লিখিবার (২০ আগস্ট, ১৮৯০); দুইদিন পরে বিলাত যাত্রা করেন। দুই দিন পরে তরণী ‘অকুল সাগর মাঝে চলেছে ভাসিয়া’; তিনজনে সত্যেন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথ ও লোকেন পালিত। লোকেন পালিত রবীন্দ্রনাথের বাল্যবন্ধু, যৌবনের সুহৃদ, সাহিত্যের রসজ্ঞ সমালোচক, কিন্তু চরিত্রজীবনে রবীন্দ্রনাথের বিপরীত লোকে ছিল তাহাঁর বাস। বোম্বাই হইতে শ্যাম (Siam) জাহাজে রওনা হইলেন। স্বল্পপরিসর জলযানের মধ্যে মানুষের সর্ববিধ সুখ- স্বাচ্ছান্দ্যদানের জন্য কী অপরিসীম চেষ্টা চলিতেছে, কী নিয়ম-নিষ্ঠার সহিত সমস্ত কাজকর্ম সুচারুভাবে নিষ্পন্ন হইতেছে। এই ঘটনাগুলি জাহাজে উঠিলেই কবির মনে হয়। এবারও একটা কথা মনে হইতেছে, ‘অভাব যত অধিক, জীবিকাসংগ্রাম যত দুরূহ, সভ্যতা যত জটিল, মানবমনের বিচিত্রা বৃত্তির আলোড়ন ততই বেশি।’
এর পর তিনি লিখিতেছেন, ‘দুর্বলের জন্য সুখ নয়-সুখ বলসাধ্য, সুখ দুঃখসাধ্য। মানসিক জীবনে সুখ...আমাদের দাহ করে।’ কথাগুলি সংক্ষেপে লিখিত হইতেছে সত্য, কিন্তু ইহার পশ্চাতে একটি বিরাট ঐতিহাসিক তত্ত্ব রহিয়াছে। বহুকাল হইতে মানুষ জানিয়া আসিয়াছে যে নদীমাতৃক দেশই আদি মানবসভ্যতার উৎসকেন্দ্র; কিন্তু এখন পণ্ডিতেরা বলিতেছেন the beautiful is diddicult-সুন্দরের সাধনা কঠিন; high quality involves hard work-কঠিন শ্রমদান না করিলে সর্বোত্তম ফল পাওয়া যায় না। জাহাজে সী-সিকনেস প্রভৃতির যেভাবে কষ্ট পান, তাহার যে রসবর্ণনা ‘য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি’তে লিখিয়াছেন, তাহা উপভোগ্য। সাহিত্যিক রবীন্দ্রনাথ ডায়ারিতে যাহাই লিখুন, মানুষ রবীন্দ্রনাথ স্ত্রীকে যেটি লিখিতেছেন, সেইটি মনের কথা। সমুদ্র পাড়ির সময়ে বাড়ির কথা খুবই মনে হইতেছিল; স্ত্রীকে লিখিতেছেন, ‘রবিবার দিন রাত্রে আমার ঠিক মনে হল আমার আত্মাটা শরীর ছেড়ে বেড়িয়ে জোড়াসাঁকোতে গেছে।….যখন ব্যামো নিয়ে পড়ে ছিলুম তোমরা আমাকে মনে করতে কি ? তোমাদের কাছে ফেরবার জন্য ভারি মন ছটফট করত। আজকাল কেবল মনে হয় বাড়ির মতো এমন জায়গা আর নেই- এবারে বাড়ি ফিরে গিয়ে আর কোথাও নড়বো না।’ দেশ হইতে বাহির হইবার জন্য যেমন ব্যস্ততা, বাহির হইয়াই ঘরে ফিরিবার জন্য তেমনি ব্যাকুলতা।
এডেনে পৌঁছালেন। জ্যোৎস্না রাত্রি। নিস্তরঙ্গ সমুদ্র এবং জ্যোৎস্নাবিমুগ্ধ পর্বতবেষ্টিত তটচিত্র আমাদের আলস্য বিজড়িত অর্ধনিমীলিত নেত্রে স্বপ্ন মরীচিকার মতো লাগছে। এমন সময় শোনা গেল এখনই নতুন জাহাজে চড়তে হবে। সে জাহাজ আজ রাত্রেই ছাড়বে। ক্যাবিনের মধ্যে স্তূপাকার বিক্ষিপ্ত জিনিসপত্র যেমন-তেমন করে চর্মপেটকের মধ্যে প্রবিষ্ট করিয়ে দিয়ে তার উপরে তিন-চারজনে দাঁড়িয়ে নির্দয়ভাবে নৃত্য করে বহুকষ্টে চাবি বন্ধ করা গেল। কল্পনায় দৃশ্যটি উপভোগ্য। অস্ট্রেলিয়ান যাত্রী জাহাজ ‘ম্যাসিলিয়া’তে সকলে গিয়া উঠিলেন। জাহাজখানি খুবই বড় এবং ভিড়ও বেশি। জাহাজের জনতা তাহাকে বিব্রত করে। তিনি একখানি পত্রে লিখিতেছেন- ‘নীচেকার ডেকে বিদ্যুতের প্রখর আলোক, আমোদ-প্রমোদের উচ্ছ্বাস, মেলা- মেশার ধূম, গান-বাজনা এবং কখনো কখনো ঘূর্ণিনৃত্যর উৎকট উম্মত্ততা। এদিকে আকাশের পূর্বপ্রান্তে ধীরে ধীরে চন্দ্র উঠছে, তারাগুলি ক্রমে ম্লান হয়ে আসছে, সমুদ্র প্রশান্ত ও বাতাস মৃদু হয়ে এসেছে, অপার সমুদ্রতল থেকে অসীম নক্ষত্রলোক পর্যন্ত এক অখণ্ড নিস্তব্ধতা, এক অ নির্বচননীয় শান্তি নীরব উপাসনার মতো ব্যাপ্ত হয়ে রয়েছে। আমার মনে হতে লাগলো। যথার্থ সুখ কাকে বলে এরা ঠিক জানে না। সুখকে চাবকে চাবকে যতক্ষণ মত্ততার সীমায় না নিয়ে যেতে পারে ততক্ষণ এদের যথেষ্ট হয় না।
প্রচণ্ড জীবন অদের যেন অভিশাপের মতো নিশিদিন তাড়া করছে; ওরা একটা মস্ত লোহার রেলগাড়ির মতো চোখ রাঙিয়ে, পৃথিবী কাপিয়ে, হাঁপিয়ে, ধুইয়ে, জ্বলে, ছুটে প্রকৃতির দুইধারের সৌন্দর্যের মাঝখান দিয়ে হুস করে বেড়িয়ে চলে যায়। কর্ম বলে একটা জিনিস আছে বটে, কিন্তু তারই কাছে আমাদের মানবজীবনের সমস্ত স্বাধীনতা বিকিয়ে দেবার জন্যই আমরা জন্মগ্রহণ করিনি-সৌন্দর্য আছে, আমাদের অন্তঃকরণ আছে, সে দুটো খুব উঁচু জিনিস। জাহাজখানি য়ুরোপের মধ্যধরণী-সাগরে প্রবেশ করিয়া আইওনিয়া দীপাবলির ভিতর দিয়া গেল। ব্রিন্দিসিতে নামিয়া পূর্ববারের ন্যায়ই ইতালির মধ্যে দিয়া চলিতেছে। বিচিত্র দৃশ্য দেখিতে দেখিতে ও বিবিধ অভিজ্ঞতা অর্জন করিতে করিতে অবশেষে প্যারিসে পৌঁছাইলেন। প্যারিসে একদিন থাকা হয়, ইহার মধ্যে সদ্যনির্মিত বিখ্যাত ইফেল তোরণের উপর উঠিয়া মহানগরীর উপর চোখ বুলাইয়া লইবার অবকাশ করিয়া লইলেন।’
তৃতীয় চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ লেখেন, ‘পরশু তোমাকে একটা চিঠি পাঠিয়েছি। আজ আবার একটা লিখছি; বোধ হয় এ দুটো চিঠি একদিনেই পাবে- তাতে ক্ষিতি কি ? কাল আমরা ডাঙায় পৌছব-তাই আজ তোমাকে লিখে রাখছি। আবার সেই ইংল্যান্ডে পৌঁছে তোমাদের লেখবার সময় পাব। যদি যাতায়াতের গোলমালের এর পরের হপ্তায় চিঠি ফাঁক যায় তাহলে কিছু মনে করো না। জাহাজে চিঠি লেখা বিশেষ শক্ত নয়- কিন্তু ডাঙায় উঠে যখন ঘুরে বেড়াব, কখন কোথায় থাকবো তার ঠিকানা নেই। তখন দু-একটা চিঠি বাদ জেতেও পারে। আমরা ধরতে গেলে পরশু থেকে য়ুরোপে পৌঁচেছি।
মাঝে মাঝে দূর থেকে য়ুরোপের ডাঙা দেখতে পাওয়া যায়। আমাদের জাহাজটা এখন ডান দিকে গ্রীস আর বা দিকে একটা দ্বীপের মাঝখান দিয়ে চলেছে। দ্বীপটা খুব কাছে দেখাচ্ছে। কতগুলো পাহাড়, তার মাঝে মাঝে বাড়ি। এক জায়গায় খুব একটা মস্ত শহর, দুরবিন দিয়ে তার বাড়িগুলো বেশ স্পষ্ট দেখতে পেলুম-সমুদ্রের ঠিক ধারেই নীল পাহাড়ের কোলের মধ্যে সাদা শহরটি বেশ দেখাচ্ছে। তোমার দেখতে করছে না ছুটকি ? তোমাকে একদিন এই পথ দিয়ে আসতে হবে তা জান ? তা মনে করে তোমার খুশি হয় না ? যা কখনো স্বপ্নেও মনে করনি সেই সমস্ত দেখতে পাবে। দুদিন থেকে বেশ একটু ঠাণ্ডা পড়ে আসছে। খুব বেশি নয়- কিন্তু যখন ডেকে বসে থাকি, এবং জোরে বাতাস দেয় তখন একটু শীত শীত করে। অল্প স্বল্প গরম কাপড় পড়তে শুরু করেছি। আজকাল রাত্তিরে ডেকে শোওয়াটাও ছেড়ে দিতে হয়েছে। জাহাজের ছাতে শুয়ে লোকেনের দাঁতের গোঁড়া ফুলে ভারি অস্থির করে তুলেছিল। আমরা যে সময়ে এসেছি নিতান্ত অল্প শীত পাব-দার্জিলিঙে যেরকম শীত ছিল তার চেয়ে ঢের কম। ছাড়বার সময় সময় একটু শীত হবে হয়তো। আমি অনেকগুলি অদরকারি কাপড় চোপড় এবং সেই বালাপোষখানা মেঝবৌঠানের হাত দিয়ে তোমাকে পাঠিয়ে দিয়েছি-সেগুলো পেয়েছ তো ?
না পেয়ে থাকতো চেয়ে নিও। সেগুলো একবার লক্ষ্মীর হাতে পড়লে সমস্ত মেঝবৌঠানের আলমারির মধ্যে প্রবেশ করবে। বেলির জন্য আমি একটা কাপড় আর পাড় কিনে মেঝবৌঠানের সঙ্গে পাঠিয়েছি। সেটা এতদিনে অবশ্য পেয়েছ-খুব টুকটুকে লাল কাপড়-বোধহয় বেলিবুড়িকে তাতে বেশ মানাবে-পাড়টাও বেশ নতুন রকমের না ? মেঝবৌঠানও বেলির জন্য তার একটা প্রাইজের কাপড় নিয়েছেন- নীলেতে শাদাতে-সেটাও বেলু রানুকে বেশ মানাবে। সেটা যে রকমের ভাবুনে, নতুন কাপড় পেয়ে বোধ হয় খুব খুশি হয়েছে। আমাকে কি সে মনে করে ? খোকাকে ফিরে গিয়ে কি রকম দেখব কে জানে। ততদিনে সে বোধ হয় দুটো চারটে কথা কইতে পারবে। হয়তো এমন ঘোর সাহেব হয়ে আসব তোমরাই চিনতে পারবে না। আমার সেই আঙ্গুল কেটে গিয়েছিল এখন সেরে গেছে-কিন্তু খুব দুটো গর্ত হয়ে আছে- ভয়ানক কেটে গিয়েছিল। অনেকদিন বাদে কাল পরশু দুদিন স্নান করেছি- আবার পরশু প্যারিসে পৌঁছে নাবার বন্দোবস্ত করতে হবে। সেখানে টার্কিশ বাথ বলে একরকম নাবার বন্দোবস্ত আছে তাতে খুব করে পরিষ্কার হওয়া যায়-বোধ হয় আমার ‘য়ুরোপ প্রবাসীর পত্রে’ তার বিষয়ে পরেছ-যদি সময় পাই তো সেইখেনে নেয়ে নেব মনে করছি।
আমার শরীর এখন বেশ ভাল আছে-জাহাজে তিনবেলা যে রকম খাওয়া চলে তাতে বোধ হচ্ছে আমি একটু মোতা হয়ে উঠছি। আমি ফিরে গিয়ে তোমাকে যেন বেশ মোটাসোটা সুস্থ দেখতে পাই ছোটবউ। গাড়িটা ত এখন তোমারি হাতে পড়ে রয়েছে রোজ নিয়মিত বেড়াতে যেয়ো, কেবলি পরকে ধার দিয়ো না। কাল রাত্তিরে আমাদের জাহাজে ছাতের উপর স্টেজ খাটিয়ে একটা অভিনয়ের মত হয়ে গেছে। নানা রকমের মজার কাণ্ড করেছিল-একটা মেয়ে বেশ নেচেছিল। তাই কাল শুতে অনেক রাত হয়ে গিয়েছিল। আজ জাহাজে শেষ রাত্তির কাটাব। তোমাদের সকলকে হামি দিয়ে চিঠি বন্ধ করি।’ তার তিনদিন পর ৯ সেপ্টেম্বর, ১৮৯০-এ চতুর্থ চিঠিটি মৃণালিনীকে লেখেন রবীন্দ্রনাথ। প্যারিসে আসা মাত্র তিনি এ চিঠিটি লেখেন। রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘ভাই ছোট বউ, আমরা ইফেল টাওয়ার বলে খুব একটা উঁচু লৌহস্তম্ভের উপর উঠে তোমাকে একটা চিঠি পাঠালুম। আজ ভোরে প্যারিসে এসেছি। লন্ডনে গিয়ে চিঠি লিখব।’
প্যারিস থেকে ফিরে এসে ১৮৯০ সালের ডিসেম্বরে ‘কালিগ্রাম’ থেকে পরবর্তী চিঠিটি লিখেন তিনি। গ্রাম, প্রকৃতি, পরিবেশ-তার অপরূপ সৌন্দর্য যেন ধরা পড়ে রবীন্দ্রনাথের এই চিঠিতে। বিল হিসেবে নাম পাওয়া যায় ‘চলন’ বিলের। চলন বিলটা যে রবীন্দ্রনাথের পছন্দ হয়নি তার প্রকাশ পাই এই চিঠিতে। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, ‘প্রথমে বড় নদী- তার পর ছোট নদী, দু ধারে গাছপালা, চমৎকার দেখতে- তারপরে নদী- ক্রমেই সংকির্ন হয়ে আসে, নিতান্ত খালের মত, দুধারে উঁচু পাড়, ভারি বন্ধ ঠেকে। তার পরে এক জায়গায় ভয়ানক তড়ে জল বেড়িয়ে আসছে, ২০-২৫ জন লোকে ধরে আমাদের নৌকো টেনে নিয়ে এল। একটা মস্ত বিল আছে, তার নাম চলন বিল। সেই বিলের থেকে জল নদীতে আসে পরছে।তার পরে ঠেলে ঠূলে অনেক কষ্টে এবং অনেক বিপদ এড়িয়ে বিলের মধ্যে এসে পড়লুম। চারদিকে জল ধু-ধু করছে, মাঝে মাঝে ঝোপঝাপ ঘাস জমি। একটা মস্ত মাঠে বর্ষার জল দাঁড়ালে যে রকম হয়। মাঝে মাঝে বোট মাটিতে ঠেকে জায়। প্রায় একঘণ্টা-দেড় ঘণ্টা ধরে ঠেলাঠেলি করে তবে তাকে জ্বলে ভাসাতে পারে। তোমাদের ওখানে শীত নেই ? আমাকে ত শীতে ভারি কাপিয়ে তুলেছে। কেবল কাল রাত্তিরে কোন একটা বদ্ধ জায়গায় নৌকো রেখেছিল, আর সমস্ত পর্দা ফেলেছিল। তাই গরমে জেগে উঠেছিলুম-তার উপরে আবার কানের কাছে একদল লোক সেই একটা দুটো রাত্তিরে গান জুড়ে দিল ‘কত নিদ্রা দিবে আর উঠ উঠ প্রাণপ্রিয়ে।’ রবীন্দ্রনাথ, পরবর্তী বছর ১৮৯১ সালে, সাহাজাদপুর থেকে মৃণালিনী দেবীকে পরবর্তী চিঠিটি লিখেন।
কিন্তু ১৮৯১-এর কোন সময় চিঠিটি লেখা হয় তার সুস্পষ্ট কোনো চিহ্ন আমরা দেখতে পাই না। এই চিঠিতে প্রকাশ পায় রবীন্দ্রনাথের মজার একটি ঘটনা। রবীন্দ্রনাথ শুরু করেন এভাবে, ‘আজ সকালে এ অঞ্চলের একজন প্রধান গনৎকার আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল। সমস্ত সকাল বেলাটা সে আমাকে জ্বালিয়ে গেছে। বেশ গুছিয়ে লিখতে বসেছিলুম বকে বকে আমাকে কিছুতেই লিখতে দিলে না। আমার রাশি এবং লগ্ন শুনে কি গুনে বল্লে জান ? আমি সুবেশী, সুরূপ, রংটা শাদায় মেশানো শ্যামবর্ণ, খুব ফুটফুটে গৌর বর্ণ নয়। আশ্চর্য ! কি করে গুনে বলতে পারলে বল দেখি ? তার পরে বল্লে আমার সঞ্চয়ী বুদ্ধি আছে, কিন্তু আমি সঞ্চয় করতে পারব না। খরচ অজস্র করব কিন্তু কৃপণতার অপবাদ হবে- মেজাজটা কিছু রাগী, এটা বোধ হয় আমার তখনকার মুখের ভাবখানা দেখে বলেছিল। আমার ভার্যাটি বেশ ভাল। আমার ভাইয়ের সঙ্গে ঝগড়া হবে- আমি যাদের উপকার করব তারাই আমার অপকার করবে। ষাট-বাষট্টি বৎসরের বেশি বাঁচব না। যদি বা কোন মতে সে বয়স কাটাতে পারি তবু সত্তর কিছুতেই পেরতে পারব না। শুনে ত আমার ভারি ভাবনা ধরিয়ে দিয়েছে। এই ত সব ব্যাপার। যা হোক তুমি তাই নিয়ে যেন বেশি ভেবো না। এখনো কিছু না হোক ত্রিশ চল্লিশ বৎসর আমার সংসর্গ পেতে পারবে। ততদিনে সম্পূর্ণ বিরক্ত ধরে না গেলে বাঁচি। আমার ঠিকুজিটা সঙ্গে থাকলে তাকে দেখানো যেতে পারত। সেটা আবার প্রিয়বাবুর কাছে আছে। সে বল্লে বর্তমানে আমার ভাল সময় চলছে, বৃহস্পতির দশা-ফালগুণ মাসে রাহুর দশা পড়বে। ভাল অবস্থা কাকে বলে তা ঠিক বুঝতে পারি না।’
রবীন্দ্রনাথের এ-পর্বের বেশ কিছু চিঠি, মৃণালিনী দেবীকে লেখা হয় সাহাজাদপুর থেকে। এবং বেশি সংখ্যক চিঠি লেখা হয় ‘জুন’ মাসেই। সপ্তম সংখ্যক চিঠিতে প্রাধান্য পায় পারিবারিক আলাপচারিতা এবং অতীত স্মৃতিমধুরতা। অষ্টম চিঠি, ২০শে জুন ১৮৯১,সাহাজাদপুর থেকে মৃণালিনী দেবীকে লেখেন, ‘আজ আমার প্রবাস জীবনের ঠিক একমাস হল। আমি দেখেছি যদি কাজের ভীড় থাকে তা হলে আমি কোন মতে একমাস কাল বিদেশে কাটিয়ে দিতে পারি। তার পর থেকে, বাড়ীর দিকে মন টানতে থাকে। কাল সন্ধের সময় এখানে বেশ একটু রীতিমত ঝড়ের মত হয়ে গেছে। বাতাসের গর্জনে অনেকক্ষণ ঘুমোতে দেয়নি। তোমাদের ওখানেও বোধ হয় এ ঝড়টা হয়ে গেছে। কাল দিনের বেলাও খুব বৃষ্টি হয়ে গেছে। নদীর জলও অনেকখানি বেড়ে উঠেছে। শস্যের ক্ষেত সমস্তই জলে ডুবে গেছে। জল আর একফুট বাড়লেই আমাদের বাগানের কাছে আসে। যেদিকে চেয়ে দেখি খানিকটা ডাঙা আর খানিকটা জল। মেয়েরা আপনার বাড়ীর সামনের জলেই বাসন মাজা এবং অন্যান্য নিত্য ক্রিয়া সম্পন্ন করছে। সভ্যতার অনুরোধে শরীর যতখানি কাপড়ে আবৃত থাকা উচিত তার চেয়েও আঙুল চার-পাঁচ উপরে কাপড় তুলে মেয়ে পুরুষ সকলেই রাস্তা দিয়ে চলেছে। গ্রীষ্মকালে এখানে যেমন জলকষ্ট, বর্ষাকালে ঠিক তার উল্টো। আমাদের তেতলাতে ও বোধ হয় বৃষ্টি হলে কতকটা এই রকমের দৃশ্যই দেখা যায়। বারান্দায় যে পরিমাণে জল দাঁড়ায় তাতে বোধ হয় অনায়াসে চৌকাঠের কাছে বসে স্নান, বাসন-মাঝা প্রভৃতি চলে যায়। আজকাল তুমি দুবেলা খানিকটা করে ছাতে পায়চারি করে বেরাচ্ছ কি না আমাকে বল দেখি। এবং অন্যান্য সমস্ত নিয়ম পালন হচ্ছে কি না , তাও জানাবে। আমার খুব সন্দেহ হচ্ছে তুমি সেই কেদারাটার উপর পা ছড়িয়ে বসে একটু একটু করে পা দোলাতে দোলাতে দিব্যি আরামে নভেল পড়ছ। তোমার যে মাথা ধরত এখন কি রকম আছে ?।’
অই একই বছরে লেখা হয় নবম চিঠিটি; কিন্তু সময় উল্লেখ থাকে না কোন মাসে লেখা হয়েছে চিঠিটি। চিঠিটি লেখা হয় সাহাজাদপুর থেকে। রবীন্দ্রনাথ, চিঠিটি শুরু করেন এভাবে, ‘ভাই ছুটি, আজ যদি বিরাহিমপুরের পেস্কার সেখানকার ফটিক মজুমদারের মকদ্দমায় প্রতিবাদীর পক্ষের উকিল বক্তৃতায় আমাদের বিরুদ্ধে কি কি কথা বলেছে বিবৃত করে একখানি চিঠি না লিখত তাহলে ডাকে আমার একখানিও চিঠি আসত না এবং আমি এতক্ষণ বসে বসে ভাবতুম আজ এখনো ডাক এলো না বুঝি। তোমাদের মত এত অকৃতজ্ঞ আমি দেখিনি। পাছে তোমাদের চিঠি পেতে একদিন দেরি হয় বলে কোথাও যাত্রা করবার সময় আমি একদিনে উপরি উপরি তিনটে চিঠি লিখেছি। কিন্তু আজ থেকে নিয়ম করলুম চিঠির উত্তর না পেলে আমি চিঠি লিখব না।
এ রকম করে চিঠি লিখে লিখে কেবল তোমাদের অভ্যাস খারাপ করে দেওয়া হয়। এতে তোমাদের মনেও একটুখানি কৃতজ্ঞতার সঞ্চার হয় না। তুমি যদি হপ্তায় নিয়মিত দুখানি করে চিঠিও লিখতে তা হলেও আমি যথেষ্ট পুরস্কার জ্ঞান করতুম। এখন আমার ক্রমশ বিশ্বাস হয়ে আসছে তোমার কাছে আমার চিঠির কোন মূল্য নেই এবং তুমি আমাকে দু’ছত্র চিঠি লিখতে কিছু মাত্র কেয়ার কর না। আমি মূর্খ কেন যে মনে করি তোমাকে রোজ চিঠি লিখলে তুমি হয়তো একটু খানি খুশি হবে এবং না লিখলে হয়তো চিন্তিত হতে পার, তা ভগবান জানেন। বোধ হয় ওটা একটা অহংকার। কিন্তু এ গর্বটুকু আর ত রাখতে পারলুম না। এখন থেকে বিসর্জন দেওয়া যাক। আজ সন্ধে বেলায় শ্রান্ত শরীরে বসে বসে এই রকম লিখলুম, আবার হয়তো কাল দিনের বেলায় অনুতাপ হবে, মনে হবে পৃথিবীতে পরের কাজ নিয়ে পরকে ভৎসনা করার চেয়ে নিজের কাজ নিজে করে যাওয়াটা ভাল। কিন্তু একটু সুযোগ পেলেই পরের ত্রুটি নিয়ে খিটিমিটি করা আমার স্বভাব এবং তোমার অদৃষ্টক্রমে তোমাকে চিরজীবন এটা সহ্য করতে হবে। ভৎসনাটা প্রায় চেঁচিয়ে করি আর অনুতাপটা মমে মনে করি, কেউ শুনতে পায় না।’
মৃণালিনী দেবীকে, রবীন্দ্রনাথ পরের চিঠিটি লেখেন ২৬ জুন ১৮৯২ সালে, সাহাজাদপুর থেকে। সাহাজাদপুরের প্রকৃতি বর্ণনায় ভরপুর এই চিঠিটি। প্রকৃতির সাথে যে, রবীন্দ্রনাথের এক গভীর সম্পর্ক রয়েছে তার স্পষ্টচিত্র আমরা দেখতে পাই এই চিঠিতে। রবীন্দ্রনাথ শুরু করেন, ‘এখানে কাল থেকে কেমন একটু ঝোড়ো রকমের হয়ে আসছে। এলোমেলো বাতাস বইছে, থেকে থেকে বৃষ্টি পড়ছে, খুব মেঘ করে রয়েছে। গনৎকার যে বলেছে, ২৭ জুন, অর্থাৎ কাল একটা প্রলয় ঝড় হবার কথা, সেটা মনে হয় একটু একটু বিশ্বাস হচ্ছে। আমার ইচ্ছে করছে কালকের দিনটা তোমরা তেতালা থেকে নেমে এসে দোতলায় হলের ঘরে যাপন কর। কিন্তু আমার এ চিঠিটা তোমরা পরশু পাবে। যদিও সত্যিই কাল ঝড় আমার এ পরামর্শ কোন কাজে লাগবে না। তেমন ঝড়ের উপক্রম দেখলে তোমরা কি আপনিই বুদ্ধি করে নীচে আসবে না ? যা হোক, দৈবের উপর নির্ভর করে থাকা যাক। তোমার কালকের একটা চিঠি পেয়ে আমার মন একটু খারাপ হয়ে গিয়েছিল। আমরা যদি সকল অবস্থাতেই দৃঢ় বলের সঙ্গে সরল পথে সত্য পথে চলি তাহলে অন্যর অসাধু ব্যবহারে মনের অশান্তি হবার কোন দরকার নেই। বোধ হয় একটু চেষ্টা করলেই মনটাকে তেমন করে তৈরি করে নেওয়া যেতে পারে।
এভাবেই মনের আরও কিছু অব্যক্ত কথা লিখেই রবীন্দ্রনাথ এই চিঠিটি শেষ করে। প্রায় এক মাস পরে; শিলাইদহ থেকে ১৮৯২-এর জুলাইতে লেখেন পরের চিঠিটি। ব্যক্তিগত জীবনের নৌকাডুবির ঘটনা রবীন্দ্রনাথ নিজেই প্রকাশ করেন এ চিঠিতে। রবীন্দ্রনাথ শুরু করেন এভাবে, ‘আজ এর একটু হলেই আমার দফা নিকেশ হয়েছিল। তরীর সঙ্গে দেহতরীর আর একটু হলেই ডুবেছিল। আজ সকালে প্যানটি থেকে পাল তুলে আসছিলুম। গোরাই ব্রিজের নীচে এসে আমাদের বোটের মাস্তুল ব্রিজে আটকে গেল। সে ভয়ানক ব্যাপার। একদিকে স্রোতে বোটকে ঠেলছে আর একদিকে মাস্তুল ব্রিজে বেঁধে যাচ্ছে। মড়মড় মড়মড় শব্দে মাস্তুল হেলতে লাগলো একটা মহা সর্বনাশ হবার উপক্রম হল এমন সময় একটা খেয়া নৌকো এসে আমাকে তুলে নিয়ে গেল এবং বোটের কাছে নিয়ে দুজন মাল্লা জলে ঝাঁপিয়ে সাঁতরে ডাঙায় গিয়ে টানতে লাগলো। ভাগ্যি সেই নৌকো এবং ডাঙায় অনেক লোক সেই সময় উপস্থিত ছিল তাই আমরা উদ্ধার পেলুম, নইলে আমাদের বাঁচার কোন উপায় ছিল না। ব্রিজের নীচে জলের তোড় খুব ভয়ানক-জানিনে, আমি সাঁতরে উঠতে পারতুম কি না কিন্তু বোট নিশ্চয় ডুবত।
এ যাত্রায় দু-তিনবার এই রকম বিপদ ঘটলো। প্যানটিতে যেতে একবার বটগাছে বোটের মাস্তুল বেঁধে গিয়েছিল সেও কতকটা এই রকম বিপদ। কুষ্টিয়ার ঘাটে মাস্তুল তুলতে গিয়ে দড়ি ছিঁড়ে মাস্তুল পড়ে গিয়েছিল আর একটু হলেই ফুলচাঁদ মারা গিয়েছিল। মাঝিরা বলল এবার অযাত্রা হয়েছে। খুব ঘন মেঘ করে এসেছে-সমস্ত নদী তরঙ্গিত হয়ে উঠেছে- সুন্দর দেখতে হয়েছে-কিন্তু দেখবার সময় নেই-দুপুর বাজে -এই বেলা নাইতে যাই। বর্ষাকালে নদীতে ভ্রমণ না করলে নদীর শোভা দেখা যায় না। কিন্তু বর্ষাকালে জলে বেড়ানো প্রায় ঘটে ওঠে না। এবারে তা হল। যাই নাইতে যাই।’
রবীন্দ্রনাথের জীবনে ঘটে যাওয়া এই ঘটনার সময় তাঁর বয়স ছিল একত্রিশ বছর। ১৮৯১ সালে গ্রহণ করেন পারিবারিক জমিদারের দায়িত্ব। ১৮৯০-৯১ থেকে মূলত রবীন্দ্রনাথ, উত্তরবঙ্গে পারিবারিক জমিদারি বিরাহিমপুর ও ইসবশাহি পরগণার কাছারি বাড়ি শিলাইদহ ও সাহজাদপুর পরিদর্শন কালেই মৃণালিনী দেবীকে লিখেছিল এই পত্রগুলো। বলা চলে; এই জমিদারের দায়িত্ব পরিচালনা সময়কালে; পরিভ্রমণের সময় চলতে থাকে ১৮৯০ থেকে ১৯০২ সাল পর্যন্ত। শিলাইদহ এবং সাহাজাদপুর এর ঘটনা বার বার ফিরে আসে মৃণালিনী দেবীকে লিখিত চিঠির মধ্যে। শিলাইদহের নদীপথে পরিভ্রমণকালে, স্ত্রী মৃণালিনী দেবীকে লেখেন বারো সংখ্যক চিঠিটি। রবীন্দ্রনাথ শুরু করেন এভাবেই, ‘আজ শিলাইদহ ছাড়বার আগেই তোমার চিঠিটা পেয়ে মন খারাপ হয়ে গেল। তোমরা আসছ এক হিসেবে আমার ভালোই হয়েছে, নইলে কলকাতায় ফিরতে আমার মন যেত না, এবং কলকাতায় ফিরেও আমার অসহ্য বোধ হত। তা ছাড়া আমার শরীরটা তেমন ভাল নেই। সেই জন্য তোমাদের কাছে পাবার জন্য আমার প্রায়ই মনে মনে ইচ্ছে করত। কিন্তু আমি বেশ জানি যতদিন তোমরা সোলাপুরে থাকবে ততদিন তোমাদের পক্ষে ভাল হবে। ছেলেরা অনেকটা শুধরে এবং শিখে এবং ভাল হয়ে আসবে এই রকম আমি খুব আশা করে ছিলুম। যাই হোক সংসারের সমস্তই ত নিজের সম্পূর্ণ আয়ত্ত নয়। যে অবস্থার মধ্যে অগত্যা থাকতেই হবে তার মধ্যে যতটা পারা যায় প্রাণপরে নিজের কর্তব্য করে যেতে হবে। তারই মধ্যে যতটা ভাল করা যায় চা ছাড়া মানুষ আর কি করতে পারে বল। অসন্তোষকে মনের মধ্যে পালন কর না ছোট বৌ। ওতে মন্দ বই ভাল হয় না। প্রফুল্ল মুখে সন্তুষ্ট চিত্তে অথচ একটা দৃঢ় সংকল্প নিয়ে সংসারের ভিতর দিয়ে যেতে হবে- আমি নিজে ভারি অসন্তোষটো স্বভাব, সেই জন্য আমি অনেক অনর্থক কষ্ট পাই-কিন্তু তোমাদের মনে অনেকখানি প্রফুল্লতা থাকা ভারি আবশ্যক। নইলে সংসার বড় অন্ধকার হয়ে আসে। যা চেষ্টা করবার তা যত দূর সাধ্য করব- কিন্তু তুমি মনে মনে অসুখী অসন্তোষটো হয়ে থেকো না ছুটি। জান ত ভাই, আমার খুঁতখুঁতে স্বভাব, আমার নিজেকে ঠাণ্ডা করতে যে কত সময় নির্জনে বসে নিজেকে কত বোঝাতে হয় তা তুমি জান না- তুমি আমায়ে সেই খুঁতখুঁতে ভাবটা দূর করে দিয়ো, কিন্তু তুমি আবার তাতে যোগ দিয়ো না। যদি তোমরা ইতিমধ্যে ছেড়ে থাকো তাহলে ত এবার কলকাতায় গিয়ে তোমার সঙ্গে দেখা হবে- চেষ্টা করব উড়িষ্যায় যদি আমার সঙ্গে নিয়ে যেতে পারি।
সে জায়গাটা ভারি স্বাস্থ্যকর। আমি বাবা মশায়কে আমার ইচ্ছে কতকটা জানিয়ে রেখেছি তিনিও কতকটা বুঝেছেন, আর দুই একবার বল্লে কিছু ফলও হতে পারে- কিন্তু আগে থাকতে বেশি আশা করে বসা কিছু না। আমার মনে হচ্ছে এ চিঠিটাও তুমি সোলাপুর অঞ্চলে পাবে। আজ যাব কাল যাব করে নির্দিষ্ট দিনের পরেও নিদেন তোমাদের দিন আষ্টেক দশ কেটে যাবে। দেখা যাক। সমস্ত দিন বোট চলছে- সন্ধে হয়ে গেছেকিন্তু এখনো ত পাবনায় পৌছলুম না। সেখানে গিয়ে আবার ক্রোশ দেড়েক পাল্কীতে করে যেতে হবে।’ ১৮৯৩ সালের শুরুর দিকে লিখেন পরের চিঠিটি। পুরীর পথে যাত্রাকালে এ চিঠি লেখা হয় তা প্রকাশ করেন রবীন্দ্রনাথ। বলেন, ‘আজ এগারটার মধ্যে খাওয়া-দাওয়া সেরে বেরতে হবে। আজ রাত্তির পথের মধ্যে একটা ডাক বাঙলায় কাটাতে হবে, তারপরে কাল বোধ হয় সন্ধের মধ্যে পুরীতে গিয়ে পৌঁছতে পারব। Mrs. Gupta এবং তার ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা যাচ্ছেন, সে জন্য তাঁদের বিস্তর জিনিস পত্র বোঁচকাবুচকি গরুর গাড়ি বোঝাই হয়ে চলেছে। বিহারীবাবু ত নানা রকম বন্দোবস্ত করতে করতে এই তিন চার দিন একেবারে ক্ষেপে যাবার য হয়েছেন। Mrs. Gupta ভারি নিরুপায় গোছের মেয়ে- তিনি কিছুই গুছিয়ে গাছিয়ে করেকর্মে নিতে পারেন না-তিনি বেশ ঠাণ্ডা হয়ে চুপচাপ করে বসে থাকেন- বলেন, আমি পারিনে, আমার মাথায় কিছু আসে না। বিহারীবাবুর অনেকটা আমার মত ধাত আছে দেখলুম। তিনি সকল বিষয়েই ভারি ব্যস্ত এবং চিন্তিত হয়ে পড়েন। এই যে কদিনের জন্য পুরীতে যাচ্ছেন, মানুষ সাত সমুদ্র তেরো নদীর পারে যেতে হলেও এত উদ্বিগ্ন হয়ে উঠে না। কেবল তিনি আমার খুঁৎ খুঁৎ, খিটমিট করেন না- সেটা তার স্ত্রীর পক্ষে একটা মহা সুবিধা। সমস্ত খুব চুপচাপ প্রশান্ত ভাবে সহ্য করতে পারেন।
এ রকম স্বামী আমার মনে হয় পৃথিবীতে অতি দুর্লভ। বিহারীবাবু ভারি গৃস্থ প্রকৃতির লোক- ছেলেপুলেদের খুব ভালোবাসেন, আমার দেখতে বেশ লাগে। আমাদের এমন যত্ন করেন- ঠিক যেন ঘরের লোকের মত- খুব যে বেশি আদর দেখিয়ে ব্যস্ত করে তোলা তা নয়- আমরা আমাদের ঘরে সমস্ত দিন যা খুশি তাই করতে সময় পাই। যে যতটুকু করেন বেশ সহজ স্বাভাবিকভাবে। কিচ্ছু বাড়াবাড়ি নেই। এমনকি বলুকেও অনেকটা বাগিয়ে আনতে পেরেছেন- সে বেচারা যদিও এখনো ক্রমাগত মাথা নিচু করে লজ্জায় লালা হয়ে গেল। খাওয়া- দাওয়া ত একরকম বন্ধ করেছে। ওরা যা খেতে বলেন তাতেই মাথা নাড়ে। ভাগ্যি ওরা দুজনে মিলে অনেক পীড়াপীড়ি করেন তাই মুখে দুটি অন্য ওঠে। নইলে এতদিনে শুকিয়ে যেত। পথের মধ্যে যদি দুদিন চিঠি লিখতে না পারি ত কিছু ভেব না, এবং এ কথা মনে রেখো যে কটক থেকে যত দিনে চিঠি পাও পুরি থেকে তার চেয়ে আরও দুদিন দেরি হয়- সে আরও দূরে। তা হলে তিন চারদিন চিঠি না পেতেও পার...’।
একই সমসময়ে রবীন্দ্রনাথ লেখেন পরের চিঠিটি। জুন বা জুলাই এর কোনো এক সময় লেখা হয় চিঠিটি। তার নির্দিষ্ট কোন তারিখ আমরা দেখতে পাই না। শিলাইদহ থেকে রচিত চিঠিটি রবীন্দ্রনাথ শুরু করেন, ‘ভাই ছুটি, ‘কাল দিকিন্সন্দের বাড়ি থেকে আবার তাগিদ দিয়ে আমার কাছে এক একশো বিরাশি টাকার বিল এবং চিঠি এসেছে। আবার আমাকে সত্যর শরণাপন্ন হতে হল। তা হলে তার কাছে আমার নশো টাকার ধার থাকলো। সে কি তোমাকে চারশো টাকা দিয়েছে। আমাকে ত এখনো সে সম্বন্ধে কিছুই লেখেনি। আজকের বিবির চিঠিতে তোমাদের কতকটা বিবরণ পেলুম। সে লিখেছে তোমরা প্রায়ই সেখানে যাও- এবং আমার ক্ষুদ্রতম কন্যাটি মেজবৌঠানের কোলে পড়ে পড়ে নানাবিধ অঙ্গভঙ্গি এবং অস্ফুট কলধ্বনি প্রকাশ করে থাকে। তাকে আমরা দেখতে ইচ্ছে করে। আমি যদি আষাঢ় মাস মফস্বলে কাটিয়ে যাই তাহলে ততদিনে তার অনেক পরিবর্তন এবং অনেক রকম নতুন বিদ্যা শিক্ষা হবে।
বেলির সঙ্গে খোকা কি গান শিখছে না ? তার গোলা কি রকম ফুটছে ? কেবল সারে গামা না শিখিয়ে তার সঙ্গে একটা কিছু গান ধরানো ভাল-তা হলে ওদের শিখতে ভাল লাগবে- নইলে ক্রমেই বিরক্ত ধরে যাবে। মনে আছে ছেলেবেলায় যখন বিষ্ণুর কাছে গান শিখতুম তখন সারে গামা শিখতে ভারি বিরক্ত বোধ হত। যে দিন সে নতুন কোন গান শেখানো ধরাত সেই দিন ভারি খুশি হতুম। তুমিও তোমার পুত্রকন্যাদের সঙ্গে একত্রে বসে সারে গামা সাধতে আরম্ভ করে দাও না-তার পরে বর্ষার দিনে আমি জখনফিরে যাব তখন স্বামী-স্ত্রীতে দুজনে মিলে বাদলায় খুব সঙ্গীতালোচনা করা যাবে। কি বল ? বিদ্যভূষণ আজকাল তোমার কাজকর্মে কি রকম করছে ? ইদানীং তাকে ধমকে দেওয়ার পর কি তার স্বভাবের কিছু পরিবর্তন হয়েছে- বেচারার সুন্দরী স্ত্রীর সঙ্গে অনেক দিন পরে সম্মিলন হয়েছে সেটা মনে রেখ- তোমার মার খবর কি ?’
এই চিঠির শেষে একটি জিনিস স্পষ্ট হ’য়ে উঠে। পরিবার ব্যতীত কারও খবর জানার ইচ্ছা প্রকাশ করেন রবীন্দ্রনাথ। যা সচরাচর চোখে পড়ে না। তাই বলে উঠেন, ‘তোমার মার খবর কি ?’ পনের সংখ্যক চিঠিটি মৃণালিনী দেবীকে লেখেন ৭ জুলাই, ১৮৯৩ সালে। রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘ভাই ছুটি’, আজ আহারান্তে ঢুলতে ঢুলতে তোমাকে একখানি চিঠি লিখেছি তারপরও আবার খানিকক্ষণ ঢুলতে ঢুলতে গড়াতে গড়াতে সাধনার কাজ করছি। তারপরেও যখন এখানকার প্রধান কর্মচারীরা বড় বড় কাগজের তাড়া নিয়ে এসে প্রণাম করে মুখের দিকে চেয়ে দাঁড়ালেন তখন আমার ঘুমের ঘোর আমার সুখের স্বপন একেবারে ছুটে গেল। একবার মনে মনে ভাবলুম, যদি এদের মধ্যে কেউ হঠাৎ সুর করে গেয়ে উঠে- ‘ওগো দেখি আঁখি তুলে চাও/ তোমার চোখে কেন ঘুমঘোর’। তা হলে ও গানটা বোধ হয় মায়ার খেলার দ্বিতীয় সংস্করণ থেকে একেবারে উঠিয়ে দিই। কিন্তু সে রকম সুর করে গান গাবার ভাব কারও দেখলুম না। দুই একজনের একটুখানি কাঁদুনির সুর ছিল কিন্তু তাঁদের বক্তব্য বিষয়টা ঘুমের ঘোর প্রেমের ডোর নিয়ে নয়-তারা বেতন বৃদ্ধি চায়। তাঁদের অনেকগুলি ছেলেপুলে, হুজুরের শ্রীচরণ ছাড়া তাঁদের আর কোন ভরসা নেই, হুজুর তাঁদের মাতা এবং পিতা।
এ ছাড়া কতকগুলি সাবেক ইজারাদারের নামে বাকি খাজনার ডিগ্রি করা হয়েছে তারা সুদ খরচা মাপ নিয়ে কিস্তিবন্দী করে টাকা দিতে চায় এবং তাঁদের দেনার মধ্যে যে সমস্ত ওজর আছে তার একটা সদ্বিচার প্রাথর্না করে। এর মধ্যে করুণ রস এবং অশ্রুজল যথেষ্ট আছে, অনেকে হয়তো বাড়ি ঘর দোর নিলেম করে সর্বস্বান্ত হতে বসেছে কিন্তু এতে সুর বসিয়ে অপেরা হবার যো নেই- কিন্তু নলিন নয়নের কোণে একটুখানি ছল ছল করে আসুক দেখি অমনি কবির কবিতা গাইয়ের গান বাজিয়ের বাজনা সমস্ত ধবনি হয়ে উঠবে, অমনি দর্শক স্রোতা এবং পাঠকের বক্ষস্থল অশ্রুজলে ভেসে যাবে। এমনি এই সংসার ! সমুদ্রতীর এবং সমুদ্রতরঙ্গের উপর যখন কবিতা লিখছি তখন আর কাঠা বিঘের জ্ঞান থাকে না, তখন অনন্ত সমুদ্র অনন্ত তীর চৌদ্দ অক্ষরের মধ্যে। আর সেই সমুদ্রের ধারে একটি ছোট বাঙলা বানাতে যাও, তখন ইঞ্জিনিয়র কন্ট্রাক্টর এসটিমেট চিন্তা পরামর্শ- ধার এবং টোইয়েল্ভ পারসেন্ট সুদ- তার উপরে আবার কবির স্ত্রীর পছন্দ হয় না, লোকসান বোধ হয়-স্বামীর মস্তিকের অবস্থার উপর সন্দেহ উপস্থিত হয়। কবিত্ব এবং সংসার এই দুটোর মধ্যে বনিবনাও আর কিছুতে হয়ে উঠল না দেখছি। কবিত্বে এক পয়সা খরচ নেই।’ এ ভাবেই শেষ করেন রবীন্দ্রনাথ তার এই চিঠিটি।
এ-পর্বের চিঠিটিও রবীন্দ্রনাথ লেখেন শিলাইদহ থেকে। তারিখ হিসেবে পাওয়া যায় ১৮৯৮ সালের জুন মাস। রবীন্দ্রনাথ বলেন, ’আজ ঢাকা থেকে ফিরে এসে তোমার চিঠি পেলুম। আমি তাহলে একবার শীঘ্র কালিগ্রামের কাজ সেরে কলকাতায় গিয়ে যথোচিত বন্দোবস্ত করে আসবো। কিন্তু ভাই, তুমি অনর্থক মনকে পীড়িত কর না। শান্ত স্থির সন্তস্ট চিত্তে সমস্ত ঘটনাকে বরণ করে নেবার চেষ্টা কর। এই একমাত্র চেষ্টা আমি সরবদামনে বহন করি এবং জীবনে পরিণত করবার সাধনা করি। সব সময় সিদ্ধিলাভ করতে পারিনে- কিন্তু তোমরাও যদি মনের এই শান্তিটি রক্ষা করতে পারতে তাহলে বোধ হয় পরস্পরের চেষ্টায় সবল হয়ে আমিও সন্তোষের শান্তি লাভ করতে পারতুম। অবশ্য তোমার বয়স আমার চেয়ে অনেক অল্প, জীবনের সর্বপ্রকার অভিজ্ঞতা অনেকটা সীমাবদ্ধ এবং তোমার স্বভাব এক হিসাবে আমার চেয়ে সহজেই শান্ত সংযত এবং ধৈযশীল। সেই জন্য সর্বপ্রকার ক্ষোভ হতে মনকে একান্ত যত্নে রক্ষা করবার প্রয়োজন তোমার অনেক কম। কিন্তু সকলেরই জীবনে বড় বড় সঙ্কটের সময় কোন না কোন কালে আসেই- ধৈযজ্যর সাধনা, সন্তোষের অভ্যাস কাজে লাগেই। তখন মনে হয় প্রতিদিনের যে সকল ছোট খাট ক্ষতি ও বিঘ্ন, সামান্য আঘাত ও বেদনা নিয়ে আমরা মনকে নিয়তই ক্ষুণ্ণ ও বিচলিত করে রেখেছি সে সব কিছুই নেই।
ভালবাসব ও ভাগ করব- এবং পরস্পরের প্রতি কর্তব্য সুমিষ্ট প্রসন্নভাব সাধন করব- এর উপরে যখন যা ঘটে ঘটুক। জীবনও বেশি দিনের নয় এবং সুখদুঃখও নিত্য পরিবর্তনশীল। স্বার্থহানি, ক্ষতি, বঞ্চনা- এ সব জিনিসকে লঘুভাবে নেওয়া শক্ত, কিন্তু না নিলে জীবনের ভার ক্রমেই অসহ্য হতে থাকে এবং মনের উন্নত আদর্শকে অটল রাখা অসম্ভব হয়ে পড়ে। তাই যদি না হয়, যদি দিনের পর দিন অসন্তোষে অশান্তিতে, অবস্থার ছোট ছোট প্রতিকূলতার সঙ্গে অহরহ সংঘর্ষেই জীবন কাটিয়ে দিই- তা হলে জীবন একেবারেই ব্যর্থ। জীবন, গভীর চিন্তা, মানবিক মূল্যবোধ আর জীবনের নানা দিকগুলোর চিত্র তুলে ধরেন এ চিঠিতে। এ ভাবেই শেষ হয় এই চিঠিটি। অই বছর আর কোন চিঠি লেখেন না রবীন্দ্রনাথ। পরের চিঠির তারিখ পাওয়া যায় ১৮৯৯- এর আগস্ট, এবং এটি লেখা হয় কলকাতা থেকে। রবীন্দ্রনাথ এ চিঠিতে বলেন, ‘আমাদের শোকদুঃখ, বিরাগ, অনুরাগ, ভালোলাগা না লাগা, ক্ষুধাতৃষ্ণা, সংসারের কাজকর্ম, সমস্তই আমাদের বাইরে;-আমাদের যথার্থ আমি এর মধ্যে নেই- য়াই বাইরের জিনিষকে বাইরের মত করে দেখতে পারলে তবেই আমাদের সাধনা সম্পূর্ণ হয়- সে খুব শক্ত বটে কিন্তু পদে পদে সেইটে মনে রেখে দেওয়া চাই। যখনি কাউকে খারাপ লাগে, যখনি কোন ঘটনায় মনে আঘাত পাওয়া যায় তখনি আপনাকে আপনার অমরত্ব স্মরণ করিয়ে দেওয়া চাই। একদিন রাত্রে বৈঠকখানায় ঘুমচ্ছিলুম সেই অবস্থায় আমার পায়ে বিছে কামড়ায়- যখন খুব যন্ত্রণা বোধ হচ্ছিল আমি আমার সেই কষ্টকে, আমার দেহকে আমার আপনার থেকে বাইরের জিনিষ বলে অনুভব করতে চেষ্টা করলুম- ডাক্তার যেমন অন্য রোগীর রোগযন্ত্রণা দেখে, আমি তেমনি করে আমার পায়ের কষ্ট দেখতে লাগলুম- আশ্চয্য ফল হল- শরীরে কষ্ট হতে লাগলো অথচ সেটা আমার মনকে এত কম ক্লিষ্ট করলে যে আমি সেই যন্ত্রণা নিয়ে ঘুমতে পারলুম। তার থেকে আমি যেন মুক্তির একটা নতুন পথ পেলুম।
এখন আমি সুখ দুঃখকে আমার বাইরের জিনিষ এই ক্ষণিক পৃথিবীর জিনিষ বলে অনেকসময় প্রত্যক্ষ উপলব্ধি করতে পারি- তার মত শান্তি ও সান্ত্বনার উপায় আর নেই। কিন্তু বারম্বার পদে পদে এইটেকে মনে এনে সকল রকমের অসহিষ্ণুতা থেকে নিজেকে বাঁচাবার চেষ্টা করা চাই- মাঝে মাঝে ব্যর্থ হয়েও হতাশ হলে হবে না- ক্ষণিক সংসারের দ্বারা অমর আত্মার শান্তিকে কোন মতেই নষ্ট হতে দিলে চলবে না- কারণ, এমন লোকসান আর কিছুই নেই- এ যেন দুপসার জন্য লাখটাকা খোয়ানো। গীতায় আছে- লোকে যাকে উত্তেজিত করতে পারে না এবং লোককে যে উত্তেজিত করে না-যে হর্ষ বিষাদ ভয় এবং ক্রোধ থেকে মুক্ত সেই আমার প্রিয়।’ পরের চিঠিটি পাওয়া যায় অসমাপ্ত হিশেবে; এবং নির্দিষ্ট কোন তারিখ উল্লেখ দেখতে পাই না চিঠিটিতে। এই চিঠিটি রবীন্দ্রনাথ শুরু করেন এভাবে, ‘ ভাই ছুটি, ‘আজ আমার যাওয়া হয়নি সে খবর তুমি বেলার চিঠিতে পেয়েছে। বাড়িতে রয়ে গেলুম- ডাকের সময় ডাক এল –খান তিনেক চিঠি এল- অথচ তোমার চিঠি পাওয়া গেল না। যদিও আশা করিনি তবু মনে করেছিলুম যদি হিসাবের ভুল করে দৈবাৎ চিঠি লিখে থাক। দূরে থাকার একটা প্রধান সুখ হচ্ছে চিঠি- দেখাশুনার সুখের চেয়েও তার একটু বিশেষত্ব আছে। জিনিসটি অল্প বলে তার দামও বেশী- দুটো চারটে কথাকে সম্পূর্ণ হাতে পাওয়া যায়, তাকে ধরে রাখা যায়, তার মধ্যে যতটুকু যা আছে সেটা নিঃশেষ করে পাওয়া যেতে পারে। দেখাশোনার অনেক কথাবার্তা ভেসে চলে যায়- যত খুশি প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায় বলেই তার প্রত্যেক কথাটাকে নিয়ে নাড়াচাড়া করা যায় না।
বাস্তবিক মানুষে মানুষে দেখাশোনার পরিচয় থেকে চিঠির পরিচয় একটু স্বতন্ত্র- তার মধ্যে একরকমের নিবিড় গভীরতা এক প্রকার বিশেষ আনন্দ আছে। তোমার কি তাই মনে হয় না ?’ রবীন্দ্রনাথ এর পরের চিঠিটি লেখেন ১৯০০ সালের নভেম্বরে, কলকাতা থেকে। চিঠিতে বলেন, ‘ভাই ছুটি, তুমি করছ কি ? যদি নিজের দুর্ভাবনার কাছে তুমি এমন করে আত্মসমর্পণ কর তা হলে এ সংসারে তোমার কি গতি হবে বল দেখি ? বেঁচে থাকতে গেলেই মৃত্যু কতবার আমাদের দ্বারে এসে কত জায়গায় আঘাত করবে- মৃত্যুর চেয়ে নিশ্চিত ঘটনা ত নেই- শোকের বিপদের মুখে ঈশ্বরকে প্রত্যক্ষ বন্ধু জেনে যদি নির্ভর করতে না শেখ তাহলে তোমার শোকের অন্ত নেই। নীতু ভাল আছে এবং ক্রমশই ভালর দিকে যাচ্ছে। ক’দিন একজন ডাক্তার সমস্ত রাত আমাদের সঙ্গে থেকে ওষধপত্র দিত-কাল তার দরবারে ছিল না বলে সে আসে নি- সুতরাং সমস্ত রাতটা একলা আমার ঘাড়েই পড়েছিল। এখন তার জ্বর ৯৯, কাশী সরল, হাঁপানি অনেক কম, নাড়ী সবল, সুতরাং আশা করবার সময় এসেছে- কিন্তু যখন নিশ্চয় কোন কথা বলা যায় না তখন সকল অবস্থার জন্য প্রস্তুত থাকাই উচিত। আজ থেকে ডাক্তার কেবল দু’বেলা আসবেই। এ কদিন চারবার করে ডাকতে হচ্ছিল তা ছাড়া রাত্রে একজন হাজির থাকত। তুমি কেবল শোকেই শ্রান্ত, আমি কর্মে অবসন্ন। আমি আজকাল মৃত্যুর কোন মূর্তিকেই তেমন ভয় করি নে কিন্তু তোমার জন্য আমার ভাবনা হয়-তমার মত অমন সর্বসহায়বিহীন হতাশ্বাস গতাশ্রয় মন আমার কাছে অত্যন্ত শোচনীয় বলে বোধ হয়।’ বিশ সংখ্যক চিঠিটি রবীন্দ্রনাথ লেখেন ১৯০০ সালের ডিসেম্বরের দিকে; কলকাতা থেকে। ব্য
ক্তিগত দিক থেকে ১৯০০ সালেই প্রকাশিত হয় রবীন্দ্রনাথের কয়েকটি কাব্যগ্রন্থ। শান্তিনিকেতনের প্রচলিত শিক্ষা ও তার ছাত্র–ছাত্রীর প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থার নানা দিকগুলো নিয়ে এ-চিঠিটি রচিত হয়। এ-চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘ওরা আমাদের সন্তান বটে তবু ওরা স্বতন্ত্র-ওদের সুখদুঃখ পাপপুণ্য কাজকর্ম নিয়ে যে পথে অনন্তকাল ধরে চলে যাবে সে পথের উপর আমাদের কোন কর্তৃত নেই- আমরা কেবল কর্তব্য পালন করব কিন্তু তার ফলের জন্য কাতরভাবে সম্প্রিক্তভাবে অপেক্ষা করব না, ওরা যে রকম মানুষ হয়ে দাঁড়াবে সে ঈশ্বরের হাতে- আমরা সে জন্য মনে মনে কোনরকম অতিরিক্ত আশা রাখবনা। আমার ছেলের উপর আমার যে মমতা এবং সে সব চেয়ে ভাল হবে বলে আমার যে অত্যন্ত আকাঙ্ক্ষা সেটা অনেকটা অহংকার থেকে হয়। আমার ছেলের সম্বন্ধে বেশী করে প্রত্যাশা করবার কোন অরহিকার আমার নেই। কত লোকের ছেলে যে কত মন্দ অবস্থায় পড়ে, আমরা তার জন্য কতটুকুই বা ব্যথিত হই ? সংসারে চেষ্টা যে যতই করুক অবস্থা ভেদে তার ফল নানা রকম ঘটে থাকে- সে কেউ নিবারণ করতে পারে না, অতএব আমরা কেবল কর্তব্য করে যাব এইটুকুই আমাদের হাতে- ফলাফলের দ্বারা অকারণ নিজেকে উত্তেজিত হতে দেব না।
ভাল মন্দ দুই অত্যন্ত সহজে গ্রহণ করবার শক্তি অর্জন করতে হবে- ক্রমাগত পদে পদে রাত্রিদিন এই অভ্যাসটি করতে হবে- যখনি মনটা বিকল হতে চাইবে তখনি আয়নাকে সংযত স্বাধীন করে নিতে হবে, তখনি মনে আনতে হবে সংসারের সমস্ত সুখদুঃখ ফলাফল থেকে আমি পৃথক- আমি একমাত্র এই সংসারের নই- আমার অতীতে যে অনন্তকাল ছিল সেখানে আমার সঙ্গে এই সংসারের কি যোগ ছিল, এবং আমার ভবিসাত্তে যে অনন্তকাল পড়ে আছে সেখানেই বা এই সমস্ত সুখদুঃখ ভালমন্দ লাভ অলাভ কোথায় ! যেখানে যে কয়দিন থাকি সেখানকার কাজ কেবল সযত্নে সম্পূর্ণ করতে হবে- আর কিছুই আমাদের দেখবার দরকার নেই-সর্বদা প্রসন্নতা রাখতে হবে, চারিদিকের সকলকে প্রসন্নতা দান করতে হবে- সকলে যাতে সুখী হয় এবং ভাল হয় আমি প্রফুল্লমুখে এবং অশ্রান্ত চিত্তে সেই চেষ্টা করব- তার পড়ে বিফল হই তাতে আমার কি ? – ভাল চেষ্টার দ্বারাতেই জীবন সার্থক হয়- ফল সম্পূর্ণ ঈশ্বরের হাতে। কেবল কর্তব্য করেই প্রফুল্ল হতে হবে-ফল না পেয়েও প্রফুল্লতা রাখতে হবে-তার একমাত্র উপায় মনকে সর্বপ্রকার আশা আকাঙ্ক্ষা থেকে সর্বদা মুক্ত করে রাখা।’ এই বছরের ডিসেম্বরই রবীন্দ্রনাথ লেখেন একাধিক চিঠি। এবং প্রতিটি চিঠির ব্যবধান থাকে খুব কম সময়ের।
পরের চিঠিটি লেখেন কলকাতা থেকে ১৬ ডিসেম্বর, ১৯০০ সালে, যখন রবীন্দ্রনাথের বয়স চল্লিশের কাছাকাছি। রবীন্দ্রনাথ লেখেন, ‘ভাই ছুটি’ , কাল ত তোমার চিঠি পাওয়া যায়নি। আজও তোমার চিঠি পাই নি মনে করে টেলিগ্রাফ করতে উদ্যত হয়েছিলুম। তার পড়ে স্নান করে বেড়িয়ে এসে তোমার চিঠি পাওয়া গেল কিন্তু তাতে কাল চিঠি লেখনি এমন কোন খবর দেখলুম না- ঠিক বোঝা গেল না। কাল নগেন্দ্রকে প্রিয়বাবু নিমন্ত্রণ করেছিলেন সেই সঙ্গে আমাদেরও ছিল। কাল প্রায় ১টা থেকে রাত্রি সারে সাতটা পর্যন্ত রিহাসৃল ছিল, তার পরে প্রিয়বাবু ওখানে গিয়ে নিমন্ত্রণ থইয়ে অনেক রাত্রি বাড়ি আসতে হল। নীতু কাল রাত্রে ঘুমিয়েছে। তার লিভারের বেদনা প্রায় গেছে। জ্বর আজ ১০০’র কাছাকাছি আছে। লিভারটা পরীক্ষা করে ডাক্তার বলছেন অনেক কমেছে। আজ বিকালে আমাদের অভিনয়। ডাক্তার বেচারা দেখবার জন্য লুব্ধ হওয়াতে আজ তাকে একখানা টিকিট দিয়েছি- নগেন্দ্রও যাবে। ডাক্তার ও নগেন্দ্র কাল সকালে চলে যাবে-নগেন্দ্রকে এখন এখানে রাখলে কাজের ক্ষতি হবে। গিরিশঠাকুর এসেছিল। সে ইংরাজি বাংলা সব রকম বেশ ভাল রাঁধতে পারে- কিন্তু বেশি মাইনে নেবে কিন্তু কেউ এলে খাওয়াবার কোন ভাবনা থাকবে না। তুমি কি বল ? এবারে আমি ফিরে গিয়েই চরে আড্ডা করব- সে তোমাদের খুব ভাল লাগবে আমি জানি।
ইতিমধ্যে নীতু একটু সেরে উঠলে তাকে মধুপুরে পাঠিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত হতে পারি। তোমার মাকে ১৫ টাকা পাঠিয়ে দিতে যদুকে বলে দিবে। বিপিন অনেকটা সেরে উঠেছে- এখনো সে নুয়ে কাজ করতে পারে না- কিন্তু চলতে ফিরতে পারছে। বেহারাটা দুই একদিনের মধ্যে শিলাইদহে যেতে পারবে। তোমার নতুন ছোকরা চাকরিটা কি রকম কাজের হয়েছে ? আজ ত পয়লা- এখনো ৭ই পৌষের লেখায় হাত দিতে পারিনি বলে মনটা উদ্বিগ্ন হয়ে আছে। কাল যেমন করে হোক লিখতে বসতে হবে।’ রবীন্দ্রনাথ পরের চিঠিটি লেখেন ডিসেম্বরে, ১৯০০ সালে।
১৮৯৯-১৯০০ সালে, রবীন্দ্রনাথের বয়স হয় ৩৮-৩৯। তখন প্লেগ’য়ের বিস্তার ঘটেছিল কলকাতায়। এই সময়ে বেশ কিছু ঘটনা ঘটে রবীন্দ্রনাথের জীবনে। ১৮৯৯-এ, সেবা কার্যে ভগিনী নিবেদিতার সঙ্গে থাকেন তিনি। বলেন্দ্রনাথের মৃত্যু ঘটে এই বছরেই; স্বদেশী শিল্পও- ব্যবসায়ের অবসান ঘটে এই সময়ের মধ্যেই। ‘কণিকা’ , ‘কথা’ , ‘কাহিনী’ , ‘কল্পনা’ , ‘ক্ষণিকা’ , ‘গল্পগুচ্ছ’ ইত্যাদি গ্রন্থগুলো দেখা দেয় এই সময়েই। এই চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘তোমার সন্ধ্যা বেলাকার মনের ভাবে আমার কি কোন অধিকার নেই ? আমি কি কেবল দিনের বেলাকার ? সূর্য অস্ত গেলেই তোমার মনের থেকে আমার দৃষ্টিও অস্ত যাবে ? তোমার যা মনে এসেছিল আমাকে কেন লিখে পাঠালে না ? তোমার শেষের দু চার দিনের চিঠিতে আমার যেন কেমন একটা খটকা রয়ে গেছে। সেটা কি ঠিক analyze করে বলতে পারিনে কিন্তু একটা কিসের আচ্ছাদন আছে। যাগ গে ! হৃদয়ের সূক্ষ্মতত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করাটা লাভজনক কাজ নয়। মোটামুটি সাদাসিধে ভাবে সব গ্রহণ করাই ভাল। আজ নীতু ভাল আছে। অল্প জ্বর আছে- প্রতাপ বাবু বলেন অমাবস্যাটা গেলে সেটা ছেড়ে যেতেও পারে। জ্বরটা গেলেই তার মতে বিলম্ব না করে মধুপুরে পাঠিয়ে দেওয়াই কর্তব্য। তাই ঠিক করেছি। লিভারের আয়তন এবং বেদনা অনেকটা কমে এসেছে। কাল রাত্রে প্রায় সমস্ত রাত ধরে স্বপ্ন দেখেছি যে তুমি আমার উপরে রাগ করে আছ এবং কি সব নিয়ে আমাকে বকচ। যখন স্বপ্ন বই নয় তখন সু স্বপ্ন দেখলেই হয়- সংসারে জাগ্রত অবস্থায় সত্যকার ঝঞ্জাট অনেক আছে- আবার মিথ্যাও যদি অলীক ঝঞ্জাট বহন করে আনে তাহলে ত আর পারা যায় না।
সেই স্বপ্নের রেশ নিয়ে আজ সকালেও মনটা কি রকম খারাপ হয়েছিল। তার উপরে আজ সমস্ত সকাল ধরে লোকসমাগম হয়েছিল- ভেবেছিলুম ৭ই পৌষের লেখাটা লিখব তা আর লিখতে দিলে না। সকালে নাবার ঘরে দুটো নৈবেদ্য লিখতে পেরেছিলুম।’ মৃণালিনী দেবীকে লিখিত এই পর্বের চিঠিগুলো লেখা হয়েছে কলকাতা থেকে। আমরা এই চিঠিগুলোর মধ্যে খুঁজে পাই এই স্বাপ্নিক ও সাংসারিক রবীন্দ্রনাথকে। যিনি সব কিছুর খোঁজ খবর নিচ্ছেন নিজের মত করে। যেন কোন কিছুই বাদ যাচ্ছে না তাঁর দৃষ্টির সীমানা থেকে। ২০শে ডিসেম্বর, ১৯০০ সালে রবীন্দ্রনাথ লেখেন, ‘ভাই ছুটি’ বড় হোক ছোট হোক ভাল হোক মন্দ হোক একটা করে চিঠি আমাকে রোজ লেখনা কেন ? ডাকের সময় চিঠি না পেলে ভারি খালি ঠেকে। আজ আবার বিশেষ করে তোমার চিঠির অপেক্ষা করেছিলুম- রথী আসবে কিনা তোমার আজকের সকালের চিঠিতে জানতে পারব মনে করেছিলুম। যাই হোক চিঠি না পেলে কি রকম লাগে তোমাকে দেখাবার ইচ্ছা আছে। কাল বিকালে আমরা বোলপুরে চলে যাচ্ছি অতএব এ চিঠির উত্তর তোমাকে আর লিখতে হবে না- একদিন ছুটি পাবে। রবিবার সকালে এসে আশা করি তোমার একখানা চিঠি পাওয়া যাবে।
শনিবারে আমরা শান্তিনিকেতনে থাকব, সেদিন আমিও চিঠি লিখতে সময় পাব না। নায়েবের ভাইয়ের খবর কি ? নীতুর লিভার আজ পরীক্ষা করে দেখা গেল সেটা সম্পূর্ণ কমে গেছে- এখন কেবল তাঁর কাশি এবং জ্বরটা কমলেই তাকে মধুপুরে পাঠাবার বন্দোবস্ত করা যাবে। জ্বর খুব অল্প অল্প করে কমছে- অমাবস্যা গেলে হয়ত ছাড়তে পারে। তোমাদের বাগান এখন কি রকম ? কিছু ফসল পাচ্ছ ? করাইসুটি কতদিনে ধরবে ? ইঁদারায় ফটিক রোজ ফটকিরি দিচ্ছে ত ? জল সাফ হচ্ছে ? বামুন বামনীতে কিভাবে চলছে ? বিমলা সম্বন্ধে তোমার মত আমাকে শীঘ্র লিখো। ৭ই পৌষের লেখাটা নানা বাঁধার মধ্যে লিখছি এখনো শেষ হয়নি। এখন সেই লেখাটাতে হাত দিই গে যাই।’ চিঠি প্রাপ্তির মধ্যে রবীন্দ্রনাথ যে একরকম আনন্দ পান, তার চিহ্ন আমরা দেখতে পাই এই চিঠির শুরুতেই। এক রকম বিনীত অনুরোধ করে তিনি যেন মৃণালিনী দেবীর কাছ থেকে প্রাপ্ত চিঠিটি চেয়ে নিচ্ছেন। এই আকুলতা বা শূন্যতা যেন বড় এক বেদনাময় সুর হয়ে বেজে উঠে রবীন্দ্রনাথের মাঝে।
প্রত্যেকটা চিঠির শেষে রবীন্দ্রনাথ লেখেন ‘রবি’। এই বলেই তিনি, তাঁর চিঠিটা শেষ করতেন। রবীন্দ্রনাথের লিখিত এই পর্বের চিঠিগুলো কখনো দীর্ঘ হয়ে দেখা দিত না; চিঠিগুলো ক্ষুদ্রকারে হয়ে উঠত। তা যেন এক নিঃশ্বাসেই পড়ে উঠা যায়। এই চিঠিগুলো পড়ার আগ্রহ যেন ক্রমশ বৃদ্ধি পেত। ভাব ও ভাবনার এক অভূতপূর্ব সমন্বয় ঘটে যেন রবীন্দ্র লিখিত চিঠিতে। কলকাতা থেকে এই পর্বের চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘আজ একদিনে তোমার দুখানা চিঠি পেয়ে খুব খুশি হলুম। কিন্তু তার উপযুক্ত প্রতিদান দেবার অবসর নেই। কেবল….। আজ বোলপুর যেতে হবে। বাবা মহাশয়কে আমার লেখা শোনালুম তিনি দুই একটা জায়গা বারাতে বল্লেন- এখনি তাই বসতে হবে- আর ঘণ্টাখানেক মাত্র সময় আছে। তাই মনের সঙ্গে হামি দেওয়া ছাড়া আর কিছু দিতে পারলুম না। আমাকে সুখী করবার জন্য তুমি বেশী কোন চেষ্টা কোরো না- আন্তরিক ভালবাসাই যথেষ্ট। অবশ্য তোমাতে আমাতে সকল কাজও সকল ভাবেই যদি যোগ থাকত খুব ভাল হত- কিন্তু সে কারও ইচ্ছায়ত্ত নয়। যদি তুমি আমার সঙ্গে সকল রকম বিষয়ে সকল রকম শিক্ষায় যোগ দিতে পারত খুশি হই- আমি যা কিছু জানতে চাই তমাকেও তা জানাতে পারি-আমি যা শিখতে চাই তুমিও আমার সঙ্গে কর তাহলে খুব সুখের হয়। জীবনে দুজনে মিলে সকল বিষয়ে অগ্রসর হবার চেষ্টা করলে অগ্রসর হওয়া সহজ হয়- তোমাকে কোন বিষয়ে আমি ছাড়িয়ে যেতে ইচ্ছা করিনে- কিন্তু জোর করে তোমাকে পীড়ন করতে আমার শঙ্কা হয়। সকলেরই স্বতন্ত্র রুচি অনুরাগ এবং অধিকারের বিষয় আছে- আমার ইচ্ছা ও অনুরাগের সঙ্গে তোমার সমস্ত প্রকৃতিতে সম্পূর্ণ মেলাবার ক্ষমতা তোমার নিজের হাতে নেই- সুতরাং সে সম্বন্ধে কিছু মাত্র খুঁৎ খুঁৎ না করে ভালবাসার দ্বারা যত্নের দ্বারা আমার জীবনকে মধুর- আমাকে অনাবশ্যক দুঃখকষ্ট থেকে রক্ষা করতে চেষ্টা করলে সে চেষ্টা আমার পক্ষে বহুমূল্য হবে।’ রবীন্দ্রনাথ ও মৃণালিনী দেবীর মধ্যকার নিবিড় ভালোবাসা ও লুকায়িত অব্যক্ত বাণী যেন সহজেই প্রকাশ পেল এ-চিঠির মাধ্যমেই। এক গভীর সৌন্দর্যবোধের বহিঃপ্রকাশ ঘটে যেন এ-চিঠির মাধ্যমে।
১৯০১ সালের জানুয়ারিতেই; কলকাতা থেকে তিনি চিঠি লেখেন মৃণালিনী দেবীকে। রবীন্দ্রনাথ এই চিঠি যখন লেখেন তাঁর বয়স চল্লিশ। এই পর্বেই তিনি শুরু করেন ‘চোখের বালি’ সূচনা। ‘গল্প’ ও ‘নৈবেদ্য’ কিছু লেখা পাওয়া যায় এই পর্ব থেকেই। এই ১৯০১ সালেই তিনি মাধুরীলতা ও রেণুকার বিয়ে দেন, এবং নবপর্যায় বঙ্গদর্শনে‘র সম্পাদক পদে নিযুক্ত হন। তাই এই পর্বেই অনেক কিছু গুরুত্বপূর্ণ হ’য়ে দেখা দেয় রবীন্দ্রনাথের কাছে। মৃণালিনী দেবীকে লিখিত চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘কাল যখন বাড়ি ফিরে এলুম তখন ঢং ঢং করে দুপুর বেজে গেল। সকালে গান শেখাবার কাজ সেরে খেয়ে দেয়ে নাটোরের বাড়িতে যাওয়া গেল-অমলার সন্ধানে। দেখি হেস নাটোরের ছবি আঁকছে। রাণীর ছবিও খানিকটা আঁকা পড়ে আছে। অমলার সঙ্গে চিঠি লেখালেখি করা গেল-অমলা বল্লে যখন হাতে পেয়েছি তখন ছাড়ব কেন, আমাদের বাড়িতে যাবেন সেখানে গান সম্বন্ধে আলোচনা হবে। আজ তিনটের সময় তাঁদের সেই বিরজ্জিতলার বাড়িতে গিয়ে মিষ্টান্ন ভোজন ও মিষ্ট কথার আলোচনা করতে হবে। ওখান থেকে সরলার সন্ধানে গেলুম-সরলা বাড়িতে নেই-তারকবাবু আর নদিদি-অনেকক্ষণ সরলার জন্য অপেক্ষা করা গেল এল না-নদিদি বল্লেন কাল সকালে এসে খেয়েও সেই সঙ্গে সরলাকে গান শিখিয়ে নিয়ো-তাতেই রাজি। তারকবাবু বল্লেন খাবার আগে আমার ওখানে যেও, পুরীরবাড়ি সম্বন্ধে কথা আছে- তাই সই। আজ সকালে স্নান করে প্রথমে তারকবাবু, পরে নদিদি, পরে সুরেন, পরে অমলাকে সেরে বাড়ি এসে ১১ই মাঘের গান শিখিয়ে রাত্রে সংগীতসমাজ সেরে ১২টার সময় নিদ্রার আয়োজন করতে হবে-ওদিকে আকাশ মেঘাচ্ছন্ন-রাত্রে খুব একচোট বৃষ্টি হয়ে গেছে। আবার হবার মত মেঘ জমে রয়েছে। শীতকালে আমি ত কখনো এমন মেঘ দেখি নি। তোমাদের ওখানে সম্ভবত এই রকম মেঘের আয়োজন হয়েছে- এই শীতকালের বাদল তোমাদের নিশ্চয়ই খুব খারাপ লাগছে। আমি তো সমস্ত দিন ঘুরে ঘুরে কাটাই, ভাল মন্দ লাগবার অবসর মাত্র পাই নে। বিকেলের দিকে যখন শরীরটা শ্রান্ত হয়ে আসে তখন স্বভাবতই তোমাদের দিকে মনটা চলে যায়-তখন গাড়ি হয় ত কলকাতার জনারণ্যের মধ্যে দিয়ে ছুটছে আর আমার সমস্ত চিন্তা শিলাইদহের ঘর কখানার মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কলকাতার রাস্তায় গাড়ির মধ্যে এবং দুপুর রাত্রে বিছানায় ঢুকে তোমাদের মনে করবার অবকাশ পাই-বাকি কেবল গোলমাল। আজ তোমার চিঠি পাবার পূর্বেই আমাকে বেরতে হবে তাই সকালে উঠেই তোমাকে চিঠি লিখে নিচ্ছি-চিঠি সেরেই স্নান করতে যাব-স্নান করেই দৌড়।
সেদিন সত্যর ছেলেদের দেখলুম-বেশ ছোটখাটো গোলগাল দেখতে হয়েছে-ভারি মজার রকম ধরণের। বড়দিদি এগারই মাঘের আগেই চলে আসছেন-গগনরাও দশই মাঘে আসবে আবার সমস্ত ভরপুর হয়ে উঠবে। ইলেকট্রিক আলোর তার গগনদের বাড়িতে আসছে, ওদের হয়ে গেলেই অল্পদিনের মধ্যেই আমাদের শূন্য ঘরেও বিদ্যুতের আলো জ্বলতে শুরু হবে। আজ তবে অনেক হামি দিয়ে স্নান করতে যাই।’ রবীন্দ্রনাথ, মৃণালিনী দেবীকে ছাব্বিশ সংখ্যক চিঠিটি লেখেন ১৯জানুয়ারি; ১৯০১ সালে। রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘কাল সুরেনের ওখানে গিয়েছিলুম। সে একটু ভাল বোধ করছে-তাকে এখন প্রতাপ মজুমদার চিকিৎসা করছেন-কাল অমাবস্যা, তাই জ্বরটা বোধ হয় অমাবস্যা না কাটলে কমবে না। মেজবৌঠান কালও বেলা এবং রেণুকাকে আনাবার জন্য বিশেষ করে বল্লেন-বিবির বাড়িতে ওদের রাখতে কোন অসুবিধা হবে না ইত্যাদি ইত্যাদি। তুমি কি বিবেচনা কর-ওরা এত করে আস্তে চাচ্ছে- না আস্তে পারলে বড় নিরাশ হবে-তাই ওদের জন্য মায়া হয়। নগেন্দ্রর সঙ্গে রাণী রথী বেলাকে একটা সেকেন্ড ক্লাস রিজার্ভ করে পাঠালে মন্দ হয় না। মঙ্গলবার ৯ই মাঘ আসবে- ১১ই মাঘ দেখে নীতুর সঙ্গে চলে যেতে পারে। মেজবৌঠান জানতে চান কোন ট্রেনে আসবে-তাদের আনতে গাড়ি পাঠাবেন। যদি পাঠানই স্থির কর তাহলে টেলিগ্রাফ কোরো। না হলে জানব আসবেনা। দুতিনদিনের জন্য বেলা বিবিদের ওখানে থাকলে কোন অনিষ্টের সম্ভাবনা দেখিনে। যা হোক, তুমি যা ভাল বিবেচনা কর তাই কোরো। মেজবৌঠান তোমাকে বলতে বলে দিয়েছেন যে দাসী পাওয়া যাবে- বোধ হয় শীঘ্র পাঠাতে পারবেন। সেলাই প্রভৃতি জানে এমন ভদ্ররকম খ্রিস্টান দাসীও পাওয়া যেতে পারে- চাও ত বলি। মাইনে টাকা আস্টেক। আমার ত বোধ হয় এ রকম দাসী হলে তোমার মন্দ হয় না।
আমরা এবার বোটে গিয়ে থাকব- সেখানে চাকরের অভাব তুমি তেমন অনুভব করবে না। তপসি থাকবে, অন্যান্য মাঝিও থাকবে, তোমার ফটিক থাকবে, পুটে থাকবে, বিপিন থাকবে, মেথর থাকবে- অনায়াসে চলে যাবে-ল্যাম্পের ল্যাঠা নেই, জল তোলার হাঙ্গামা নেই, ঘর ঝাড় দেওয়ার ব্যাপার নেই- কেবল খাবে স্নান করবে, বেড়াবে এবং ঘুমাবে। কালও রাত দুপুরের সময় এসেছি-সমস্ত দিন উৎপাত গেছে। আজ সকাল বেলায় এক চোট সাক্ষাৎকারীদের সমাগম এবং গান শিক্ষার হাঙ্গামা শেষ করে আহারটি করেই তোমাকে লিখতে বসেছি-এখনি সঙ্গীতসমাজওয়ালারা তাদের রিহার্সেলের জন্য আমাকে ধরতে আসবে- সেখানে চারটে পর্যন্ত চেঁচামেচি করে সুরেন কে দেখতে বালিগঞ্জে যাব-সেখান থেকে সরলাকে তুলে নিয়ে এসে গান শেখানোর ব্যাপারে রাত নটা বেজে যাবে-তার পরে সঙ্গীতসমাজ আবার রিহার্সালে রাত দুপুর হয়ে যাবে। চৈতন্য ভাগবত এনেছি- বিপিন একখানা মলিদা ও একটা রাগ এনেছে দেখেছি- মলিদা আনবার কি দরকার ছিল আমি কিছুই বুঝতে পারলুম না। নানা ব্যস্ততার মাঝখানে অল্প একটুখানি অবকাশে তোমাকে তাড়াতাড়ি করে লিখে ফেলতে হয় ভাল করে মন দিয়ে লিখতে পারিনে।’ এই চিঠি লেখার ঠিক বারো দিনের মাথায় রবীন্দ্রনাথ পরের চিঠিটি লেখেন মৃণালিনী দেবীকে। একটা চিঠি থেকে অপর চিঠির ব্যবধান থাকে খুব কম সময়ের। যেন চিঠি লেখাই এক নিরন্তর কাজ হ’য়ে দেখা রবীন্দ্রনাথের কাছে।
রবীন্দ্রনাথ ৩১ জানুয়ারি, ১৯০১ সালে, এলাহাবাদ থেকে মৃণালিনী দেবীকে লেখেন, ‘আজ এলাহাবাদে এসে পৌঁছেছি। সুসি এবং তার মার সঙ্গে দেখা হয়েছে। সুসি যেতে রাজি হয়েছে, তার মাও সম্মতি দিয়েছেন। কলকাতা হয়ে শিলাইদহে যাওয়াই স্থির হল। যে রকম বাধা পাব মনে করেছিলুম তার কিছুই নয়। ভাল করে বুঝিয়ে বললেই উভয়েই রাজি হল। পরশু অর্থাৎ, শনিবারে এখান থেকে ছাড়ব। ভাগ্যি সুরেন মোগলসরাই থেকে আমার সঙ্গ নিলে নইলে একা একা এই হোটেলে পড়ে পড়ে ক’টা দিন কাটান আমার পক্ষে ভারি কষ্টকর হত। কলকাতায় আমার শরীরটা ভারি খারাপ হয়ে এসেছিল। যাত্রার দিনে দশ গ্রেন কুইনিন খেয়ে বেরিয়েছিলুম-পথেই অনেকটা আরাম পেলুম। আজ আর শরীরে কোন গ্লানি নেই। কাল রাত্রে গাড়ি ছেড়ে দিলে পর আলোগুলোর নীচে পর্দা টেনে দিয়ে অন্ধকার করে দেওয়া গেল-বাইরে চমৎকার জ্যোৎস্না ছিল- আমি গাড়িতে একলা ছিলুম-মনটা বড় একটি সুমিষ্ট মাধুর্যে পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। তুমি তখন কোথায় কি করছিলে ? ছাঁদে ছিলে, না ঘরে ? কি ভাবছিলে, আমার হৃদয়টি জ্যোৎস্নারই মত স্নিগ্ধকোমলভাবে তোমাদের উপরে ব্যাপ্ত হয়েছিল- তার মধ্যে বাসনা বেদনার তীব্রতা ছিল না-কেবল একটি আনন্দ বিষাদ মিশ্রিত সুমঙ্গল সুমধুর ভাব।’ চিঠিগুলোতে পাওয়া যায় একান্ত ভাবাবেগের আলাপচারিতা, সুখ-দুঃখ এবং সৌন্দর্যময় কিছু চিত্র। যা আমাদের স্বপ্নের গভীরে নিয়ে যেতে সক্ষম। অনেকটা সময় ব্যবধান রেখে রবীন্দ্রনাথ লেখেন পরের চিঠিটি। তারিখ হিশেবে পাই জুন ১৯০১, শিলাইদহ। রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘ কাল পুণ্যাহের গোলমালে তোমাকে চিঠি লিখতে পারিনে। পরশুদিন বিকেলে শিলাইদহে এসে পৌছুলম। শূন্য বাড়ি হা হা করছে। মনে করেছিলুম অনেকদিন নানা গোলমালের পর একলা বাড়ি পেয়ে নির্জনে আরাম বোধ করব। কিন্তু যেখানে বরাবরা সকলে মিলে থাকা অভ্যাস, এবং একত্রবাসের নানাবিধ চিহ্ন বর্তমান সেখানে একলা প্রবেশ করতে প্রথমটা কিছুতেই মন যায় না। বিশেষতঃ পথশ্রমে শ্রান্ত হয়ে যখন বাড়িতে এলুম তখন বাড়িতে কেউ সেবা করবার, খুশি হবার, আদর করবার লোক পেলুম না। ভারি ফাঁকা বোধ হল। পড়তে চেষ্টা করলুম পড়া হল না। বাগান প্রভৃতি পর্যবেক্ষণ করে ফিরে এসে কেরোসিন জ্বালা শূন্য ঘর বেশি শূন্য মনে হতে লাগল।
দোতলার ঘরে গিয়ে আরও খালি বোধ হল। নীচে নেমে এসে আলো উস্কে দিয়ে আবার পরবার চেষ্টা করলুম- সুবিধা করতে পারলুম না। সকাল সকাল খেয়ে শুয়ে পড়লুম। দোতলার পশ্চিমের ঘরে আমি এবং পূর্বের ঘরে রথী শুয়েছিল। রাত্রি রীতিমত ঠাণ্ডা- গায়ে মলিদা দিতে হয়েছিল। দিনেও যথেষ্ট ঠাণ্ডা। কাল বাজনাবাদ্য উপাসনা ইত্যাদি করে পুণ্যাহ হয়ে গেল। সন্ধ্যাবেলায় কাছারিতে একদল কীর্তনওয়ালা এসেছিল। তাদের কীর্তন শুনতে রাত এগোরাটায় হয়ে গেল। তোমার শাকের ক্ষেত ভোরে গেছে। কিন্তু ডাঁটা গাছগুলো বড্ড বেশি ঘন ঘন হওয়াতে বাড়তে পারছে না। চালানের সঙ্গে তোমার শাক কিছু পাঠিয়ে দেওয়া যাবে। কুমড়ো অনেকগুলো পেরে রাখা হয়েছে। নীতু যে গোলাপ গাছ পাঠিয়েছিল সেগুলো ফুলে ভরে গেছে কিন্তু অধিকাংশই কাঠগোলাপ-তাকে ভয়ানক ফাঁকি দিয়েছে। রজনীগন্ধা, গন্ধরাজ, মালতী, ঝুমকো, মেদি খুব ফুটেছে। হাসু ও হেনা ফুটছে কিন্তু গন্ধ দিচ্ছে না, বোধ হয় বর্ষাকালে ফুলের গন্ধ থাকে না। দুটো চাবি পেয়েছি- কিন্তু আমার কর্পুর কাঠের দেরাজের চাবিটা দরকার। তার মধ্যে রথীর ঠিকুজি আছে সেইটের সঙ্গে মিলিয়ে রথীর কুষ্ঠি পরীক্ষা করতে দিতে হবে। সেটা চিঠি পেয়েই পাঠিয়ো। নীতু কেমন আছে লিখো। প্রতাপবাবু রোজ দেখতে আসছেন ত ? যাতে ওষুধ নিয়মিত খাওয়া হয় দেখো। পুকুর জলে পরিপূর্ণ হয়ে গেছে। সামনে আখের ক্ষেত খুব বেড়ে উঠেছে। চতুর্দিকের মাঠ শেষ পর্যন্ত শস্য পরিপূর্ণ- কোথাও সবুজের বিচ্ছেদ নেই। সবাই জিজ্ঞাসা করছে মা কবে আসবেন ? আমরা আসবনা শুনে এখানকার আমলারা খুব দমে গিয়েছিল। শরতের আর চিঠিপত্র এসেছে ? তার সম্বন্ধে আর কোন খবর বার্তা আছে ? বেলা যেন তাকে ভাল করে চিঠিপত্র লেখে। কি পাঠ লিখতে হবে যদি ভেবে না পায় আমাদের চিরকেলে দস্তরমত শ্রীচরণকমলেশু লিখতেই হয়-বাধাদোস্তরে গেলে ভাবনা থাকে না।
এখান থেকে কোন জিনিষ যদি দরকার থাকে লিখো। দই মাছ পাঠিয়ে দেওয়া যাবে।’ সেই একই মাসে শিলাইদহ থেকে রবীন্দ্রনাথ লেখেন পরের চিঠিটি। রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘পুণ্যাহের চালান আজ যাবে মনে করেছিলুম-কিন্তু আরও কিছু টাকা আদায়ের চেষ্টায় গেলনা না। কাল যাবে। আমার আম ফুরিয়ে এসেছে। কিছু আম না পাঠিয়ে দিলে অসুবিধা হবে। খাওয়া দাওয়া আমাদের সাদাসিদে রকম চলছে, তাতে শরীরটা বেশ ভাল আছে। বামুন ঠাকুর শিলাইদহের সুবিখ্যাত লালমোহন তৈরি করেছিল-লোভ সত্ত্বেও আমি খাইনি-দেখছি কোন রকম মিষ্টি না খেয়েই শরীরটা ভাল আছে- মিষ্টি খেলেই পাকযন্ত্র বিগরে যায়। কুঞ্জ ঠাকুরকে ত আমি নিয়ে এলুম, তোমাদের আহারাদিটা কি রকম চলছে ? আমার এখানে কেবল মাত্র কুঞ্জ এবং ফটিকে বেশ শান্তভাবে কাজ চলে যাচ্ছে-বিপিনের জলদমন্দ্রকণ্ঠস্বর না থাকাতে শিলাইদহ দিব্যি নিস্তব্ধ হয়ে আছে-কাজ চলছে অথচ কাজের আস্ফালন না থাকাতে বেশ আরাম বোধ হচ্ছে- বিপিন থাকলে মনে হত অপরিমিত কাজের তারায় সমস্ত সংসার যেন উৎখাত হয়ে রয়েছে, কোথাও কারও যেন হাঁপ ছাড়বার সময় নেই। আমার ইচ্ছে কোন কথাটি না কয়ে সমস্ত কাজ নিঃশব্দে নিয়মমত হয়ে যায়-আয়োজন বেশি না হয় অথচ সমস্ত বেশ সহজে পরিপাটি পরিচ্ছন্ন এবং সুসম্পন্ন হয়-বেশ নিয়মে চলে অথচ অল্পে চলে এবং নিঃশব্দে চলে।
একলা থাকার ঐ একটা সুখ আছে স্বীকার করতে হবে, চারদিকে প্রভূত চেষ্টার চিহ্ন এবং সরঞ্জামের ভিড় থাকে না-তাতে মনটা বেশ মুক্ত থাকতে পায়। আমি আছি বলে পৃথিবীতে একটা হুলস্থূল কাণ্ড চলচেনা এইটেতে বড় হাল্কা বোধ হয়। আজকাল আমার চারদিকে লোকজন হাঁসফাঁস তোলপাড় ডাকাডাকি হাঁকাহাঁকি করছে না বলে আমার অবসরকালকে খুব বৃহৎ খুব প্রশস্ত মনে হচ্ছে। সকালে ঠিক সময়েই দুটি আম খাই, দুপুরবেলায় অন্ন, বিকেলেও দুটি আম এবং রাত্রে গরম লুচি ও ভাজা-সাদাসিদে খাওয়া ও নিয়মমত খাওয়া বলে ক্ষুধা থাকে খেয়ে তৃপ্তি হয়-ভরি ভরি ওষুধ খেতে হয় না। কোন রকম করে জীবনযাত্রাকে অত্যন্ত সরল করে না আনতে পারলে জীবন যথার্থ সুখের স্থান পাওয়া যায় না-জিনিসপত্রের গলেমালে হাঙ্গামহুজ্জতে হিসেবপত্রেই সুখসন্তোষের সমস্ত জায়গা নিঃশেষে অধিকার করে বসে- আরামের চেষ্টাতেই আরাম নষ্ট করে দেয়। বহিব্যাপারের চেষ্টাকে লঘু করে দিয়ে মানসিক ব্যাপারের চেষ্টাকে কঠিন করে তোলাই মনুষ্যত্বতের সাধনা। ছোটখাট ব্যাপারেই জীবনকে ভারগ্রস্ত করে ফেললে বড় বড় ব্যাপারকে ছেঁটে ফেলতে হয়, সামান্য জিনিষকেই সংসারের পথ জটিল হয়ে ওঠে এবং সকলের