বিয়ের পূর্ব নাম ভবতারিণী। বিয়ের পর রবীন্দ্রনাথ নাম রাখেন মৃণালিনী দেবী (১৮৭৪-১৯০২)। মৃণালিনীর জন্ম বাংলাদেশের খুলনা জেলার দক্ষিণডিহির ‘ফুলতলা’ গ্রামে। বাবা বেনীমাধব রায়চৌধুরী আর মাতা দাক্ষায়নী দেবী। রবীন্দ্রনাথের সাথে বিয়ে হয় ৯ ডিসেম্বর ১৮৮৩ সালে, দশ বছর বয়সে। আর রবীন্দ্রনাথের বয়স তখন বাইশ। রবীন্দ্র- মৃণালিনীর বিবাহ বর্ণনা পাওয়া যায় অবনীন্দ্রনাথের ‘ঘরোয়া’, হেমলতা দেবীর ‘রবীন্দ্রনাথের বিবাহবাসর’, ইন্দ্রিরা দেবীর ‘রবীন্দ্র স্মৃতি’ এবং মৈত্রেয়ী দেবীর ‘রবীন্দ্রনাথ গৃহে ও বিশ্বে’ গ্রন্থে। এ-ছাড়াও প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় (১৮৯২-১৯৮৫) রচিত রবীন্দ্রজীবনী’তে পাওয়া যায় রবীন্দ্রনাথ ও মৃণালিনীর বিয়ের কথা। এ গ্রন্থের প্রথম খণ্ডে তিনি বলেন, ‘বাইশ বৎসর বয়সে রবীন্দ্রনাথের বিবাহ হয় খুলনা জেলার শুকদেব রায়চৌধুরী গোষ্ঠীর বেণীমাধবের কন্যা ভবতারিণী দেবীর সহিত (২৪ অগ্রহায়ন ১২৯০/৯ ডিসেম্বর ১৮৮৩)। ঠাকুরবাড়িতে তাহাঁর নতুন নামকরণ হয় মৃণালিনী ও সেই নামেই তিনি পরিচিতা ছিলেন। বিবাহের সময় বধূর বয়স ছিল দশ-এগারো বৎসর, ত্রিশের পূর্বেই তাহাঁর মৃত্যু হয় (৭ অগ্রহায়ন ১৩০৮) ইহার গর্ভে তিন কন্যা ও দুই পুত্র জন্ম গ্রহণ করে।’ এই একই গ্রন্থে প্রভাতকুমার বলেন, ‘কারোয়ার হইতে ফিরিবার কয়েকমাস মধ্যে রবীন্দ্রনাথের বিবাহ হইল। জীবনস্মৃতিতে অতি সংক্ষেপে সংবাদটি দেওয়া আছে, ‘১২৯০  সালে ২৪ শে অগ্রহায়ণ আমার বিবাহ হয়। তখন আমার বয়স বাইশ বৎসর।’

বিবাহের দিনে প্রিয়নাথ সেনকে নিমন্ত্রণ করিয়া যে কৌতুকপূর্ণ পত্রখানি লিখিয়াছিলেন তাহা উপভোগ্য। বিবাহের ব্যবস্থা হইল এবং সঙ্গে সঙ্গে মহর্ষি তাহাকে সংসারের কর্মরজ্জুতে বাধিবারও ব্যবস্থা করিলেন। বিবাহের দুই দিন পূর্বে রবীন্দ্রনাথ পিতার নিকট হইতে যে পত্র পাইলেন তাহাতে তিনি খুশি হইয়াছিলেন কি না বলা কঠিন, পিতার পত্রখানি নিম্নে উদ্ধৃত করিলাম, ‘এইক্ষণে তুমি জমিদারির কার্য্য পর্যবেক্ষণ করিবার জন্য প্রস্তুত হও, প্রথম সদর কাছারিতে, কলিকাতায়, নিয়মিতরূপে বসিয়া সদর আমিনের নিকট হইতে জমাওয়াশীল বাকী ও জমাখরচ দেখিতে থাক এবং প্রতিদিনের আমদানি-রপ্তানি পত্র সকল দেখিয়া তার সারমর্ম নোট করিয়া রাখ। প্রতি সপ্তাহে  আমাকে তাহার রিপোর্ট দিলে উপযুক্ত মতে তোমাকে আমি উপদেশ দিব এবং তোমার কার্যে তৎপরতা ও বিচক্ষণতা আমার প্রতীতি হইলে  আমি তোমাকে মফস্বলে থাকিয়া কার্য করিবার ভার অর্পণ করিব।’ রবীন্দ্রনাথের ন্যায় সুপুরুষের উপযুক্ত বধূ সংগ্রহের জন্য বহু চেষ্টা হয়। কিন্তু সংকীর্ণ পিরালী ব্রাহ্মণ সমাজে সেরূপ ‘কন্যা’ দুর্লভ। কারণ সেযুগে ছেলেদের বিবাহ হইত বিশ বৎসরের মধ্যে এবং বধূদের বয়স হইত নয়-দশের ভিতরে। রবীন্দ্রনাথের বয়স তেইশ পূর্ণ, সুতরাং তাহাঁর জন্য অপেক্ষাকৃত অধিক বয়স্কা বালিকার সন্ধানে সবাই প্রবৃত্ত হইল। একবার এক অ-বাঙালী ধনী পরিবার হইতে বিবাহের প্রস্তাব আসে। কন্যা দেখিতে গিয়া তাহাঁরা কী দেখিলেন এবং কেন সেখানে বিবাহে রাজি হইলেন না- ইত্যাদি কাহিনী রবীন্দ্রনাথ বৃদ্ধ বয়সে খুব রসাইয়া মনপুতে মৈত্রেয়ী দেবীর কাছে বলেন। আমাদের সে কাহিনী তাহাঁর নিকট হইতেই শোনা। বিবাহ সেখানে না হইয়া  হইল ফুলতুলি গ্রামের এগারো বৎসরের এক কৃশ, রুগ্ন, অশিক্ষিত, অত্যন্ত  সাধারণ পাড়াগাঁয়ের বালিকার সঙ্গে।  দ্বিন্দ্রনাথ  স্বস্তির নিশ্বাস ফেলিয়া লিখিলেন, ‘বহু সন্ধানেও সর্ববাদিসম্মতিক্রমে কোনো বধূ  মিলিল না তখন স্থির হইল  ঠাকুর এস্টেটের সামান্য কর্মচারী বেণী মাধন রায়চৌধুরী একাদশ বর্ষীয়া কন্যার সহিত রবির বিবাহ হইবে। এক পিরালীত্ব  ছাড়া আর কোনো মিল  ছিল না এই দুই পরিবারের মধ্যে। খুলনা জিলার দক্ষিণডিহির শুকদেব রায়চৌধুরী বংশের বেণীমাধব ছিলেন মহর্ষির এস্টেটের সাধারণ কর্মচারী। সামাজিক, আর্থিক ও আধ্যাত্মিক কোনো দিক হইতেই অভিজাত ঠাকুর পরিবারের সহিত ইহাদের তুলনা হইতে পারে না। তবুও বিবাহ সেখানেই হইল।

মহর্ষি যথারীতি কুল গোত্রাদি দেখিয়াই বিবাহ দিতেন, এ-ক্ষেত্রে ও তাহার ব্যত্যয় হয় নাই। অভিভাবকদের মতানুসারে গতানুগতিকের বাঁধাপথ ধরিয়াই সমস্ত নিষ্পন্ন হইয়াছিল। বিবাহ হইল কলকাতায়, মহর্ষির ব্যবস্থায় তাহাদেরই বাড়িতে। বিবাহের সময়ে বধূর বয়স এগারো বৎসর মাত্র। কুলপঞ্জি অনুসারে কন্যার নাম চল ভবতারিণী। ঠাকুরবাড়িতে নতুন বধূর ঐ পুরনো  ধরনের নাম একেবারে অচল, সুতরাং নতুন নামকরণ হইল মৃণালিনী এবং সেই নামেই তিনি পরিচিত ছিলেন। মনে হয় এই মৃণালিনী নাম রবীন্দ্রনাথের দেওয়া, তাহার অতিপ্রিয় ‘নলিনী’ নামেরই প্রতিশব্দ। রবীন্দ্রনাথের বিবাহে মহর্ষি উপস্থিত হতে পারেন নাই। তিনি তখন নদী পথে ভ্রমণ করিতে করিতে বাঁকিপুর পৌঁছাইয়াছিলেন। সেখানে সংবাদ পাইলেন যে, ২৪ অগ্রহায়ণ তারিখে শিলাইদহের জমিদারিতে তাহার জ্যেষ্ঠ জামাতা সারদাপ্রসাদের মৃত্যু হইয়াছে। ঐ দিনই কলকাতায় রবীন্দ্রনাথের বিবাহ। সারদাপ্রসাদ, মহর্ষির কাছে পুত্র অপেক্ষা কম প্রিয় ছিলেন না। যাবতীয় বৈষয়িক কর্মে তিনি ছিলেন তাহার দক্ষিণহস্তস্বরূপ। জমিদারি কাজের অনেক হলাহল নিঃশব্দে পান করিয়া তিনি নীলকণ্ঠ হইয়াছিলেন। দেহমন দিয়া  সকল কর্মের সকল গ্লানি বহন করিয়া প্রভুর কার্য যথাসাধ্য সম্পন্ন করিতেন। স্ত্রী বিয়োগের পর মহর্ষির এই প্রথম শোক। তিনি নৌকা ছাড়িয়া দিয়া পাটনা হইতে রেলপথে বোলপুর আসিলেন। সেখান হইতে কলিকাতায় ফিরিয়া মাত্র তিনদিন জোড়াসাঁকোর বাড়িতে থাকেন, ও তার পর সেই যে ঐ বাড়ি ত্যাগ করিয়া বাহির হইলেন, মৃত্যুর অল্পকাল পূর্ব ব্যতীত আর সেখানে আসিয়া কখনো বাস করেন নাই।

রবীন্দ্রনাথের মনে জীবনসঙ্গিনী  সম্বন্ধে যেসব কল্পনা বা স্বপ্ন ছিলমএই বিবাহের দ্বারা সেগুলি কতদূর সফল হইয়াছিল তাহা বলা কঠিন। তাহাকে বাংলাদেশের পল্লীগ্রামের দরিদ্র গৃহস্তের অল্পশিক্ষিত এগারো বৎসরের বালিকাকে পত্নীরূপে গ্রহণ করিতে হইল। রবীন্দ্রনাথ য়ুরোপ-প্রবাসীর পত্রধারায়, ‘যথার্থ  দোসর’, ‘গোলামোচর’ প্রভৃতি রচনায় জীবনসঙ্গিনী সম্বন্ধে যেসব মনোরম মতামত ব্যক্ত করিয়াছিলেন, তাহা যে বাস্তব জগতে সম্ভব নহে তাহা প্রাচীনপন্থী পিতার শাসন ব্যবস্থায় প্রমাণিত হইল। রবীন্দ্রনাথের ন্যায় প্রতিভাবান যুবকের উপযুক্ত নারী জগতে অলভ্য না হইলেও বাংলার ক্ষুদ্রগণ্ডী পিরালী সমাজের ব্রাহ্মণশাখার মধ্যে যে দুর্লভ, তাহা বলাই বাহুল্য। ইহা জানিয়াই তাহার অভিভাবকগণ তাহাদের মনোনীত বালিকাকে জীবনসঙ্গীরূপে গ্রহণ করিতে কবিকে বাধ্য করিলেন, কবিও ভবিতব্যের অমোঘ বিধান জ্ঞানে তাহা মানিয়া লইলেন এবং অত্যন্ত স্নেহের সহিত নববধূকে গ্রহণ করিলেন। ঠাকুর পরিবারের আনন্দ উচ্ছ্বাস যেন কানায় কানায় উছলিয়া পড়িতেছে; পরিবারের কনিষ্ঠ পুত্রের  বিবাহ হইয়া গেল। পুত্রকন্যাগণের বিষয়ে মহর্ষির এই শেষ সামাজিক কর্তব্য অনুষ্ঠান। ছোটবউকে তিনি শিক্ষায়-দীক্ষায় ঠাকুর বাড়ির অন্যান্য বধূ ও কন্যাদের সমতুল্য করিবার জন্য ব্যবস্থা করিয়া দিলেন। চুঁচুড়া হইতে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ লিখিলেন, ‘ইংরেজি শিক্ষার জন্য ছোটবৌকে লরেটো হোউসে পাঠাইয়া দিবে। ক্লাসে অন্যান্য ছাত্রীদিগের  সহিত একত্র না পড়িয়া তাহার স্বতন্ত্র শিক্ষা দিবার বন্দোবস্ত উত্তম হইয়াছে। তাহার স্কুলে যাইবার কাপড় ও স্কুলের মাসিক বেতন ১৫ টাকা সরকারি হইতে খরচ পরিবে।’    

মম্মথনাথ ঘোষ ‘কবিপত্নী’ শিরোনামে মৃণালিনী দেবীকে নিয়ে লিখেছেন, ‘যশোহর জিলার অন্তর্গত দক্ষিণডিহিতে এক সম্ভ্রান্ত ব্রাহ্মণ পরিবারে তিনি জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম বেণী মাধব রায় চৌধুরী। পিতৃগৃহে তাঁর নাম ছিল ভবতারিণী, ১৮৮২ খৃষ্টাব্দে রবীন্দ্রনাথের সহিত বিবাহের পর ইহার নতুন নামকরণ হয় মৃণালিনী, এবং এই নামেই তিনি সুপরিচিতা ছিলেন। বিবাহের সময় তিনি ক্ষীণকায়া ছিলেন। বিবাহের পর রবীন্দ্রনাথের তৃতীয় অগ্রজ হেমেন্দ্রনাথের পত্নী নীপময়ী তাহাঁর স্বাস্থ্য ও শিক্ষার উন্নতির ভার লন। তাহাঁর কন্যা প্রতিভা দেবী প্রভৃতির সহিত তাহাঁর শিক্ষাকার্য  অগ্রসর হয় এবং তিনি অল্প সময়ের মধ্যেই শিক্ষায় যথেষ্ট উন্নতি লাভ করেন। বাংলা ও ইংরেজি গল্প গ্রন্থাদি তিনি আগ্রহের সহিত পাঠ করিতেন। সংগীতেও তিনি শিক্ষা লাভ করিয়াছিলেন এবং বালক-বালিকাগণের ক্রীড়ায় যোগদান করিতে আনন্দ অনুভব করিতেন। মাননীয়া শ্রীযুক্তা স্বর্ণকুমারী দেবী মহোদয়ার মুখে শুনিয়াছি যে, তিনি মহিলাগণের শিল্পমেলায় অনেকবার অভিনয়ে যোগদান করিয়া সুখ্যাতি অর্জন করিয়াছিলেন। একবার ‘রাজা ও রাণী’ অভিনয়ে তিনি ব্রাহ্মণীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হইয়াছিলেন। তিনি কখনো কোনও রচনা লিখিয়াছিলেন কিনা জিজ্ঞাসা করায় স্বর্ণকুমারী বলেন যে, তাহাঁর স্বামী বাঙ্গালার একজন শ্রেষ্ঠ লেখক, সেই জন্য তিনি স্বয়ং কিছু লেখা প্রয়োজন মনে করেন নাই।’  

কৃষ্ণকলি বিশ্বাস ‘এ নগরীর নারী কথা’ শিরোনামের গ্রন্থে মৃণালিনী দেবী সম্পর্কে বলেন, ‘যশোরের দক্ষিণডিহি ফুলতলা গ্রামের বেণীমাধব শীলের কন্যা ভবতারিণীর বিয়ে হয় রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ১৮৮৩ সালে ৯ ডিসেম্বর। বিয়ের পর ঠাকুরবাড়ীতে তার নতুন নামকরণ হয় মৃণালিনী। তাকে ঠাকুরবাড়ীর উপযুক্ত করে গড়ে তোলবার ভার নিয়েছিলেন নীপময়ী। এ ছাড়াও তিনি লরেটো হাউসে পড়েন এবং পণ্ডিত হেমচন্দ্র বিদ্যারত্নের কাছে সংস্কৃত শিক্ষা করেন। এরই ফলশ্রুতিতে তিনি পরবর্তীকালে রামায়ণ অনুবাদে হাত দেন। তার অনুদিত মহাভারতের শ্লোক, মনুসংহিতা ও উপনিষদের শ্লোক পাওয়া যায়। রূপকথা সংগ্রহের কাজেও হাত দিয়েছিলেন তিনি। অবনীন্দ্রনাথের ‘ক্ষীরের পুতুল’ এর  মূল তার সংগ্রহ থেকে পাওয়া। মৃণালিনী শুধু এসবই করেননি, রবীন্দ্রনাথের নানান প্রচেষ্টার তিনি ছিলেন সহযোগী।  শান্তিনিকেতন প্রতিষ্ঠায় তার দান অপরিসীম। তিনি ঠাকুরবাড়ীর অভিনয়ে অংশগ্রহণ করতেন। তিনি স্বল্প আয়ু পান।’        

হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় মৃণালিনী দেবী শিরোনামের লেখাতে মৃণালিনী সম্পর্কে বলেন, ‘খুলনা জিলার দক্ষিণডিহি গ্রামের শুকদেবের বংশধর, বেণীমাধব রায়চৌধুরীর প্রথমসন্তান ভবতারিণী। তাহার জন্ম বাংলা ১২৮০ সালে। খেলাঘরে ঘরকণ্ণার সময় মৃণালিনীর স্বভাবের একটি বিশেষত্ব সকলেই লক্ষ করিতেন, ইহা সঙ্গিনীদের উপর তাঁহার কর্তিতের সখীসুলভ অধিকার, ইহাতে কর্তিতের সহজাত তাপ-চাপ ছিল না, সখী সুলভ প্রণয় প্রবণতায় ইহা সুস্নিগ্ধ কোমল সহনীয়; সঙ্গিনীরা তাই সখীর নির্দেশ মানিত, খেলা ও চলিত সখী ভাবে অবিরোধে। দক্ষিণডিহি গ্রামে এমন কি গ্রামের চতুর্দিকে ক্রোশের মধ্যেও উচ্চশিক্ষার বিদ্যালয় ছিল না। গ্রামে একটি প্রাইমারি পাঠশালা ছিল, এই পাঠশালায় মৃণালিনীর বিদ্যাশিক্ষার সূত্রপাত হয়। প্রথম বর্গ পর্যন্ত  অবাধে পড়াশুনা চলিয়াছিল। কিন্তু সমাজে নিন্দার ভয়ে সুদূর পরীক্ষাকেন্দ্রে উপস্থিত হইয়া পরীক্ষা দেওয়া তাঁহার পক্ষে সম্ভব হইয়া উঠে নাই; কাজেই বাংলা লেখাপড়ার সাধ ইচ্ছা সত্ত্বেও বাধ্য হইয়াই তাঁহাকে এই খানেই মিটাইতে হইয়াছিল।’ মৈত্রেয়ী দেবীর রবীন্দ্রনাথ গৃহে ও বিশ্বে গ্রন্থেও পাওয়া যায় রবীন্দ্রনাথের বিয়ের চিত্র। ‘২২ অগ্রহায়ণ ১২৯০ সালে ৯ই ডিসেম্বর ১৮৮৩ তারিখে রবীন্দ্রনাথের ২২ বছর ৭ মাস বয়সে, বেনীমাধব রায়চৌধুরীর কন্যা ভবতারিণীর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের বিয়ে হয়।

বেনীমাধব রায়চৌধুরী ঠাকুর বাড়ির জমিদারীর সেরেস্তায় কাজ করতেন সামান্য মাইনেয়। তাঁর কন্যার বয়স এগার বছর মাত্র। শোনা যায় তাঁর কথায় যশোর জেলার টান খুব বেশি ছিল বলে বিবাহের পর কিছুদিন পর্যন্ত কথাবার্তা বলেননি। এ দিকে রবীন্দ্রনাথ তখন বাংলার তরুণ কবি, তাঁর যশ ও প্রতিভা স্বীকৃতি পেয়েছে দেশের গুণী সমাজে। তাঁর মন কবিত্বের প্রেরণায় উদ্দীপিত। এই অসম অবস্থার বিবাহ তাঁর পক্ষে রুচিকর হওয়া অসম্ভাব এই রকম অনুমান কেউ কেউ করেছেন।’ কলকাতার অভিজাত, একান্নবর্তী পরিবারের আদরের ছোটো ছেলে ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। যিনি ব্যক্তিত্বে সুদর্শন এবং শিল্প ও সাহিত্যেয় প্রতিভাবান পুরুষ। তোরজোড় হচ্ছিল তাঁর বিয়ের জন্য; একই সাথে চলছিল উপযুক্ত কনে দেখার পর্বটিও। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর; তাঁর স্মৃতিকথা’য় লেখেন, বিয়ের ব্যাপারে একরকম চাপে পড়েই শেষ পর্যন্ত রাজী হতে হয়েছিল রবীন্দ্রনাথকে। রবীন্দ্রনাথের জন্য কনে নির্বাচনের বিষয়টি খুব সহজ হ’য়ে দেখা দিচ্ছে না ঠাকুর পরিবারে। অনেক খোঁজা-খুঁজি ক’রে তাঁরা বার-বার ব্যর্থ হচ্ছিল। শেষ পর্যন্ত ঠাকুর এস্টেটের কর্মচারী, বেণী মাধবের কন্যা ভবতারিণীর সাথেই রবীন্দ্রনাথের বিয়ে হয়। এর জন্য রবীন্দ্রনাথকে বরবেশে দক্ষিণডিহির ‘ফুলতলা’ গ্রামে আসতে হয়নি। বিয়ের পর্বটি জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারে সম্পূর্ণ হয়। রবীন্দ্রনাথের কনে দেখার পর্বে ছিলেন দুই বৌঠান।

মেজবৌদি জ্ঞানদানন্দিনী (১৮৫০-১৯৪১) এবং কাদম্বরী দেবী (১৮৫৯-১৮৮৪), ভ্রাতা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৪৯-১৯২৫), ভ্রাতুষ্পুত্র সুরেন্দ্রনাথ এবং আরও অনন্যা ব্যক্তিবর্গ। রবীন্দ্রনাথ, কনে দেখার পর্বে নিজেকে সম্পৃক্ত রেখেছিলেন কিনা তা নিয়ে রয়েছে নানামত। নরেন্দ্রপুর গ্রামে, জ্ঞানদানন্দিনীর বাপের বাড়ীতে আশ্রয় নিয়ে এই দল রবীন্দ্রনাথের জন্য একজন সুন্দরী পাত্রী খুঁজছিলেন। ইন্দিরা দেবীর লেখা ‘রবীন্দ্রস্মৃতি’ গ্রন্থে  তিনি বলেন, ‘পারিবারিক স্মৃতির কথা বলতে গেলে প্রথমেই পরিবার পত্তন বা বিয়ের কথা তুলতে হয়।

যশোর জেলা সেকালে ছিল ঠাকুরবংশের ভবিষাৎ গৃহিণীদের প্রধান আকর। কারণ সে দেশে ছিল পিরালী সম্প্রদায়ের কেন্দ্রস্থল। শুনেছি সেখানকার মেয়েদের রূপের সুখ্যাতি ছিল, যদিও পুরনো দাসী পাঠিয়ে তাদের পছন্দে নির্বাচন করে আনা হত। পূর্ব প্রথানুসারে রবিকাকার কনে খুঁজতেও তাঁর বৌঠাকুরানীরা, তার মানে মা আর নতুন কাকিমা, জ্যোতিকাকামশায় আর রবিকাকাকে সঙ্গে বেঁধে নিয়ে যশোর যাত্রা করলেন। বলা বাহুল্য, আমরা  দুই ভাইবোনেও সে যাত্রায় বাদ পড়ি নি। যশোরে নরেন্দ্রপুর গ্রামে ছিল আমার মামা বাড়ি। সেখানেই আমরা সদলবলে আশ্রয় নিলুম।’

রবীন্দ্রনাথের এই বিয়ে উপলক্ষে ভাই দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৪০-১৯২৬) নিজেই একটি কবিতা রচনা করেন তার জন্য। ‘শর্বরী গিয়াছে চলি ! দ্বিজ- রাজ শূন্যে একা পড়ি/প্রতীক্ষিছে রবির পূর্ণ উদয়।/গন্ধহীন দু’-চারি রজনীগন্ধা  লয়ে তড়িঘড়ি/ মালা এক গাঁথিয়া সে অসময়য়/ সপিছে রবির শিরে এই আজ আশিসিয়া তারে/ অনিন্দিতা স্বর্ণ- মৃণালিনী হোক/ সুবর্ণ তুলির তব পুরস্কার ! মন্দ্রজার কারে/ যে পড়ে সে পড়ুক খাইয়া চোক।’    

কিন্তু তিনি প্রিয় বন্ধু প্রিয়নাথ সেনকে স্বয়ং বিবাহের যে নিমন্ত্রণ পাঠিয়েছিলেন তা পড়লে মনে হয় না যে তখন কোনো ক্ষোভের, বা দুঃখের ঘটনা ঘটেছে বা অনভিপ্রেত কোনো কাজ তাকে করতে হচ্ছে। চিঠিখানিতে তাঁর স্বভাব সম্মত কৌতুকের ছোঁয়া রয়েছে।
প্রিয় বাবু,
আগামী রবিবার ২৪ অগ্রহায়ণ তারিখে শুভদিনে শুভলগ্নে আমার পরমাত্মীয় শ্রীমান রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শুভবিবাহ হইবেক আপন তদুপলক্ষে বৈকালে উক্ত দিবসে ৬নং জোড়াসাঁকোস্থ দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভবনে উপস্থিত থাকি। বিবাহাদি সম্পন্ন করিয়া আমাকে এবং আত্মীয়গণকে বাধিত করবেন।
ইতি
অনুগত
‘শ্রীরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর’  

রবীন্দ্রনাথের এই বিয়ের ইতিহাস আরো স্পষ্টভাবে জানা যায় হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা থেকে। তিনি লেখেন, ‘১২৯০ সালে চব্বিশে অগ্রহায়ণ রবিবারে রবীন্দ্রনাথের সহিত মৃণালিনী দেবীর শুভ পরিণয় সম্পন্ন হয়। তখন রবীন্দ্রনাথ চতুর্বিংশতিবর্ষীয় যুবক, মৃণালিনী দেবীর বয়স একাদশবর্ষ। বিবাহে ঘটকালি করিয়াছিলেন রবীন্দ্রনাথের মাতুল ব্রজেন্দ্রনাথ রায়ের পিসিমা আদ্যাসুন্দরী। প্রচলিত প্রথানুসারে, কন্যার পিতা তাঁহার বাড়িতে বর লইয়া বিবাহ দেওয়ার প্রস্তাব করিলে মহর্ষি তাঁহাকে জানাইয়াছিলেন, কলিকাতায় আদি ব্রাহ্ম সমাজের নিয়মানুসারে ব্রাহ্মমতে বিবাহ হইবে। এই প্রস্তাব স্বীকৃত হইলে মহর্ষি দক্ষিণডিহির বাড়িতে নানাবিধ খেলনা বসনভূষণাদি কর্মচারী সনানন্দ মজুমদারের সঙ্গে পাঠাইয়াছিলেন। সনানন্দ মহর্ষি কথানুসারে গ্রামে নানা মিষ্টান্ন প্রস্তুত করাইয়া কন্যার ও প্রতিবেশীর বাড়িতে পাঠাইবার ব্যবস্থা করিয়াছিলেন। ইহা বোধ হয় ‘কন্যার আশীর্বাদ’ বা ‘পাকা দেখা’র সামাজিক বিধি। বিবাহে মহর্ষি যে বংশ গোত্রের বিবেচনা ছিল, এ বিবাহে তাহার ব্যভিচার হয় নাই। সমৃদ্ধি ও বিদ্যাবত্তায় রায়চৌধুরী বংশ ঠাকুরপরিবারের সমতুল্য না হইলে এই বৈবাহিক সম্বদ্ধে মহর্ষিদেবের মতদ্বৈধ ছিল না। জোড়াসাঁকোর বাড়িতে ব্রহ্মোৎসব দালানে কূল প্রথানুসারে পরিণয়ৎসব শুভ সম্পন্ন হয়। নিমন্ত্রিত আত্মীয় কুটুম্বগণের সহিত মহর্ষি সমাজেতে কনিষ্ঠ পুত্রের শেষ সামাজিক কার্য নিষ্পন্ন করেন। পিতৃগৃহে কন্যার নাম ছিল ‘ভবতারিণী’, রবীন্দ্রনাথের নামের সঙ্গে সংগতি রক্ষা না হওয়ায় বিবাহের পরে পরিবর্তিত নাম হইল ‘মৃণালিনী’ রবি-মৃণালিনীর প্রণয়-সম্বদ্ধ কবিকল্পিত, চিরপ্রসিদ্ধ; তাই মনে হয়, এই নাম কবিকৃত কবিকল্পনাজাত। মতান্তরে, কবির প্রিয় ‘নলিনী’ নামের ইহা প্রতিশব্দ। যাহাই হউক, ‘ভবতারিণী’ বধূজীবনে ‘মৃণালিনী’ নামেই পরিচিত হইয়াছিলেন। ‘বৈষ্ণব কবিতায়’ কবি যে ‘ধরার সঙ্গিনী’র চিত্র বর্ণনার নানা বর্ণে রঞ্জিত করিয়া অঙ্কিত  করিয়াছেন তাহা তাঁহার কল্পনামাত্র নহে, ইহা বাস্তবিকের অনুভূতি অনুস্রুত পরিণাম, কবির সেই চিত্রগত বর্ণ কবিপত্নীর সাংসারিক জীবনে নানা বিষয়িনী শক্তিতে মূর্ত ও সার্থক হইয়া ফুটিয়া উঠিয়া ইহা সপ্রমাণ করিয়াছেন।’

বিবাহের পর; নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় মৃণালিনী দেবী। নাম পরিবর্তনের কাজটি স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ, ভবতারিণীকে ‘মৃণালিনী দেবী’ ক’রে নিলেন। এ-নাম পরিবর্তন নিয়েও রয়েছে নানা কিংবদন্তি। কেউ কেউ বলেন নিজের নামের সাথে সঙ্গতি রেখে রবীন্দ্রনাথ এটা করেছিলেন। আবার অন্য কেউ মনে করেন, অতীতে হারানো কোনো প্রিয় মানুষের নাম ধারণ করে দেন রবীন্দ্রনাথ, স্ত্রীর নামের পরিবর্তনের মাধ্যমে। অনেকে আবার একই সাথে মনে করেন, কৈশোরে মনের গভীরে দাগকাটা মারাঠি বান্ধবী আনা তড়খড়কে দেওয়া ‘নলিনী’ নামের ছায়ায় রবীন্দ্রনাথ নববধূর নাম রেখেছিলেন ‘মৃণালিনী দেবী’। রবীন্দ্রনাথের বিয়ে নিয়ে রয়েছে নানা গল্প। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর স্মৃতি কথায় লেখেন, ‘রবি কাকার বিয়ে আর হয় না, সবাই বলেন বিয়ে করো-বিয়ে করো এবারে, রবি কাকা রাজি হন না, চুপ করে ঘাড় হেঁট করে থাকেন। শেষে তো সবাই মিলে বুঝিয়ে সুজিয়ে রাজি করালেন। রবীন্দ্রনাথ এই শর্তে রাজি হলেন যে, তিনি কোথাও যাবেন না। বিয়ে হবে জোড়াসাঁকোতে।

রবীন্দ্রনাথ যখন বিয়েতে মত দিলেন তখন তাঁর অভিভাবকেরা কনের সন্ধানে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। ইতিপূর্বে একটি অবাঙালী নাবালিকা কন্যাকে তাঁরা দেখেছিলেন কিন্তু মনোনীত না হওয়াতে এবার বাঙ্গালী কন্যার সন্ধানে রত হলেন।’ বিয়ের ব্যাপারে একরকম চাপে পড়েই শেষ পর্যন্ত রাজী হ’তে হয়েছিল রবীন্দ্রনাথকে। রবীন্দ্রনাথের জন্য কনে নির্বাচনের বিষয়টি খুব সহজ হ’য়ে দেখা দিচ্ছে না ঠাকুর পরিবারে। অনেক খোঁজা-খুঁজি ক’রে তাঁরা বার-বার ব্যর্থ হচ্ছিল। রবীন্দ্রনাথের কনে দেখার পর্বে ছিলেন দুই বৌঠান; মেজবৌদি জ্ঞানদানন্দিনী (১৮৫০-১৯৪১) এবং কাদম্বরী দেবী (১৮৫৯-১৮৮৪), ভাই জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৪৯-১৯২৫), ভ্রাতুষ্পুত্র সুরেন্দ্রনাথ এবং ইন্দিরা দেবী। পাত্রীর সন্ধানে জ্ঞানদানন্দিনী দেবীর বাপের বাড়ি নরেন্দ্রপুর গ্রামে আশ্রয় নেন তাঁরা সকলে। প্রায়ই তাঁরা রবীন্দ্রনাথের জন্য বিভিন্ন গ্রামে কনে দেখতে যেতেন। কিন্তু তাঁদের পছন্দের মতো একটিও সুন্দরী পাত্রী খুঁজে পেলেন না। এভাবে চলতে থাকে কনে দেখার পর্বটি। কনে দেখার পর্ব শেষ করে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাদম্বরী দেবী, দিদি সৌদামিনী, জ্ঞানদানন্দিনী এবং রবীন্দ্রনাথ সহ সকলে মিলে চলে জান ভাই সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৪২-১৯২৩)-এর কর্মস্থল বম্বের করোয়ারে। সেখানে তিনি লেখেন ‘প্রকৃতির প্রতিশোধ’ নাট্যকাব্যটি। এই ‘প্রকৃতির প্রতিশোধ’ নাট্যকাব্যটি কবির জীবন ও কাব্যেয় একটি বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে রয়েছে।

বিবাহ পূর্ব কবি কল্পনার বালিকারূপিণী সীমা ও সন্ন্যাসীরুপী অসীমের মিলন সাধনের মধ্যেই  কবির জীবনের পূর্ণতার কথা প্রকাশ করে নিজেরই জীবন নাট্যের ও কাব্যনাট্যের ভূমিকা রচনা করলেন। কবির জীবন ও কাব্যের এটাই একমাত্র পালা।  মিলন সাধনের পালা কবি আত্ম পরিচয়ে লিখেছেন, ‘তখন আমি নিজে ভাল করিয়া বুঝিয়াছিলাম কি না জানি না – কিন্তু তাহাতে এই কথা ছিল যে, এই বিশ্বকে গ্রহণ করিয়া এই সংসারকে বিশ্বাস করিয়া, এই প্রত্যক্ষকে শ্রদ্ধা করিয়া আমরা যথার্থভাবে অনন্তকে উপলব্ধি করিতে পারি। যে জাহাজে অনন্তকোটি লোক যাত্রা করিয়া বাহির হইতেছে তাহা হইতে লাফ দিয়া পরিয়া সাঁতারের জোরে পার হইবার চেষ্টা  সফল হইবার নহে।’ এই করোয়ার থেকে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, কাদম্বরী দেবী ও রবীন্দ্রনাথ ফিরে আসেন। রবীন্দ্রনাথ করোয়ার থেকে ফিরে এসে সার্কুলার রোডে লিখলেন ‘ছবি ও গান’ কাব্যগ্রন্থটি। এই কাব্যগ্রন্থের কবিতার মধ্যে রয়েছে সংসার অনভিজ্ঞ ‘বাতায়নবাসী’ কবির নবযৌবনের সুখ স্বপ্ন ও জাগ্রতস্বপ্নের  মধ্যে অনাগত অচেনা রহস্যময়ী ‘কে’র প্রতি উচ্ছ্বাস ও আনন্দের কাহিনি, আর তারই সঙ্গে কবির ভালো লাগুক বা না লাগুক স্থায়ীভাবে রহস্যময় যৌবনের আবির্ভাব হল ‘রাহুর প্রেম’-এ। তাই কবি জাগ্রত স্বপ্নের  মধ্যে লিখলেন- ‘কেহ কি আমারে চাহিবে না ?/ কাছে এসে গান গাহিবে না ? / পিপাসিত প্রাণে চাহি মুখপানে/  কবে না প্রাণের আশা ?’ রবীন্দ্রনাথ  কবিতাটি উল্লেখ্য করে নিজের মনের এই অবস্থার বর্ণনা দিয়েছেন প্রমথ চৌধুরীকে লেখা  চিঠিপত্র পঞ্চম খণ্ডে। কবির এই দুটি গ্রন্থই কনে দেখার পরবর্তীকালের ও বিবাহপূর্ব কবির অন্তর কাহিনির  বর্ণনা রয়েছে। তাই গ্রন্থ দু’টিতে (প্রকৃতির প্রতিশোধ, ছবি ও গান) বিশেষ ভাবে  ছবি ও গানে অনাগত ‘কে’র উদ্দেশ্যে বিবাহিত জীবনের পূর্বাভাষের ছবি একে কবি সুখস্বপ্ন  ও জাগ্রতস্বপ্ন দেখেছেন।  

করোয়ার থেকে ফিরে আসার কিছু পরেই ১৮৮৩ সালে রবীন্দ্রনাথের বিয়ে হয়। শেষ পর্যন্ত ঠাকুর এস্টেটের কর্মচারী, বেণী মাধবের কন্যা ‘ভবতারিণী’র সাথেই রবীন্দ্রনাথের বিয়ে। এর জন্য রবীন্দ্রনাথকে বরবেশে দক্ষিণডিহির ‘ফুলতলা’ গ্রামে আসতে হয়নি। বিয়ের পর্বটি জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারে সম্পূর্ণ হয়; রবীন্দ্রনাথের ইচ্ছানুসারে। ইন্দিরা দেবী, তাঁর ‘রবীন্দ্রস্মৃতি’ গ্রন্থে বলেন, ‘পারিবারিক স্মৃতির কথা বলতে গেলে প্রথমেই পরিবার পত্তন বা বিয়ের কথা তুলতে হয়। যশোর জেলা সেকালে ছিল ঠাকুরবংশের ভবিষাৎ গৃহিণীদের প্রধান আকর। কারণ সে দেশে ছিল পিরালী সম্প্রদায়ের কেন্দ্রস্থল। শুনেছি সেখানকার মেয়েদের রূপের সুখ্যাতি ছিল, যদিও পুরনো দাসী পাঠিয়ে তাদের পছন্দে নির্বাচন করে আনা হত। পূর্ব প্রথানুসারে রবিকাকার কনে খুঁজতেও তাঁর বৌঠাকুরানীরা, তার মানে মা আর নতুন কাকিমা, জ্যোতিকাকামশায় আর রবিকাকাকে সঙ্গে বেঁধে নিয়ে যশোর যাত্রা করলেন। বলা বাহুল্য, আমরা  দুই ভাইবোনেও সে যাত্রায় বাদ পড়ি নি। যশোরে নরেন্দ্রপুর গ্রামে ছিল আমার মামা বাড়ি। সেখানেই আমরা সদলবলে আশ্রয় নিলুম।’ বেনীমাধব রায় চৌধুরী ঠাকুর বাড়ির জমিদারীর সেরেস্তায় কাজ করতেন সামান্য বেতনে। তাঁর কন্যার বয়স এগার বছর মাত্র। শোনা যায়; তাঁর কথায় যশোর জেলার ভাষার টান খুব বেশি ছিল বলে বিবাহের পর কিছুদিন পর্যন্ত কথাবার্তা বলেননি। এ দিকে রবীন্দ্রনাথ তখন বাংলার তরুণ কবি, তাঁর যশ ও প্রতিভা স্বীকৃতি পেয়েছে দেশের গুণী সমাজে। তাঁর মন কবিত্বের প্রেরণায় উদ্দীপিত। এই অসম অবস্থার বিবাহ তাঁর পক্ষে রুচিকর হওয়া অসম্ভাব; এই রকম অনুমান কেউ কেউ করেছেন। কিন্তু তিনি প্রিয় বন্ধু প্রিয়নাথ সেনকে স্বয়ং বিবাহের যে নিমন্ত্রণ পাঠিয়েছিলেন, তা পরলে মনে হয় না যে, তখন কোনো ক্ষোভের, বা দুঃখের ঘটনা ঘটেছে বা অনভিপ্রেত কোনো কাজ তাকে করতে হচ্ছে। চিঠিখানিতে তাঁর স্বভাব সম্মত কৌতুকের ছোঁয়া রয়েছে।

রবীন্দ্রনাথ লিখলেন, ‘আগামী রবিবার ২৪ অগ্রহায়ণ তারিখে শুভদিনে শুভলগ্নে আমার পরমাত্মীয় শ্রীমান রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শুভবিবাহ হইবেক আপন তদুপলক্ষে বৈকালে উক্ত দিবসে ৬নং জোড়াসাঁকোস্থ দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভবনে উপস্থিত থাকি। বিবাহাদি সম্পন্ন করিয়া আমাকে এবং আত্মীয়গণকে বাধিত করবেন।’ এ-রকম হাস্যরসে ভরা ছিল রবীন্দ্রনাথের নিজের লেখা চিঠিটি। রবীন্দ্রনাথের বিয়ের নিমন্ত্রণপত্র, বন্ধুদের নিজ হাতে লিখে পাঠিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং। কতো জনকে তিনি এ-নিমন্ত্রণপত্র পাঠিয়েছিলেন তা স্পষ্ট করে জানা যায়নি। এই নিমন্ত্রণপত্রের উপর ছাপা ছিল মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘মেঘনাদ বধ কাব্যের’ একটি পঙক্তি আশার ছলনে ভুলি কি ফল লভিনু হায় ।  
রবীন্দ্রনাথের আইবুড়ো ভাত অবনীন্দ্রনাথের বাড়িতেই হয়। অবনীন্দ্রনাথের মা রবীন্দ্রনাথের স্ত্রী সম্পর্কের বোন হন। তাই তাঁর মা এ বিয়েতে খুব খুশি হয়েছিলেন; এবং রবীন্দ্রনাথের স্ত্রীকে তিনি ‘ভবতারিণী’ বলেই ডাকতেন। অবনীন্দ্রনাথ তাঁর স্মৃতি কথায় বলেন, ‘অবনীন্দ্রনাথের বড় পিসিমা কাদম্বরী দেবীর ঘরে আইবুড়ো ভাত সাজানো হয়। রবীন্দ্রনাথ খুব  জমকালো রঙ-চঙে লাল কিংবা সবুজ শাল গায়ে দিয়ে আইবুড়ো ভাত খেতে বসেছেন। আর অবনীন্দ্রনাথের পিসিমারা তাকে ঘিরে বসে বউ সম্পর্কে নানা প্রশ্ন করাতে কবি ঘাড় হেঁট করে বসে একটু করে খাবার মুখে দিচ্ছেন আর লজ্জায় মুখে কথাটি মাত্র নেই। রবীন্দ্রনাথ তাঁর বিয়ের গল্প কারো কাছে করেননি; কিন্তু কবিতায় টুকরো টুকরো করে সে কথা লিখে গেছেন। এ-ক্ষেত্রে মনে করা যেতে পারে, ‘ক্ষণিক মিলনে’র দুইখানি দিশাহারা মেঘের বর্ণনা পিছনে রবীন্দ্র-  মৃণালিনীর অকস্মাৎ বা হঠাৎ ঘটিত মিলন কাহিনি যা কাব্যেয় বহুবার লেখা হয়েছে। হেমলতা ঠাকুর রবীন্দ্রনাথের বিবাহ বাসরের বর্ণনা  দিয়েছেন, ‘ঘরের ছেলে নিতান্ত সাধারণ ঘরোয়া ভাবে রবীন্দ্রনাথের বিবাহ হয়েছিল। ধূমধামের সম্পর্ক ছিল না তাঁর মধ্যে। পারিবারিক বেনারসি শাল ছিল একখানা, যার যখন বিয়ে হত সেই খানি ছিল বরসজ্জার প্রধান উপকরণ। নিজেরই বাড়িতে পশ্চিমের বারান্দা ঘুরে রবীন্দ্রনাথ বিয়ে করতে এলেন অন্দরমহলে স্ত্রী আচারের সরঞ্জাম যেখানে সাজানো। বরসজ্জার শালখানি গায়ে জড়ানো রবীন্দ্রনাথ এসে দাঁড়ালেন পিড়ির উপর। নতুন কাকিমার আত্মীয়া, যাকে সবাই ডাকতেন ‘বড় গাঙ্গুলির স্ত্রী’ বলে-রবীন্দ্রনাথকে বরণ করলেন তিনি। তাঁর পরণে ছিল একখানি কালো রঙের  বেনারসী জরির ডুরে। বিয়ের সময় কাকিমা ছিল বেশ রোগা। গ্রামের বালিকা; শহরের হাব-ভাব তখন তিনি বুঝে উঠতে পারেননি। কনে এনে সাতপাক ঘুরানো হল–শেষে বরকনে দালানে চললেন সম্প্রদান স্থলে। বাড়ির অবিবাহিত বড় মেয়েগুলি সঙ্গে সঙ্গে চলল। আমিও জুটে গেলুম তাদের সঙ্গে। দালানের একধারে বসবার জায়গা ছিল আমাদের। দেখলুম সেখানে বসে সচক্ষে কাকিমার সম্প্রদান।’    

সম্প্রদানের পর বরকনে এসে বাসরে বসলেন। রবীন্দ্রনাথের বউ এলে তার থাকবার জন্য একটি ঘর নির্দিষ্ট করা ছিল আগে থেকেই। বাসর হল সেই সেই ঘরেই। বাসরে বসেই রবীন্দ্রনাথ দুষ্টুমি আরম্ভ করলেন। ভাঁড়-কুলো খেলা আরম্ভ হল, ভাঁড়ের চালগুলি ঢালাই ভরাই হল ভাঁড় খেলা। রবীন্দ্রনাথ ভাঁড় খেলার বদলে ভাঁড়গুলো উপুর করে দিতে লাগল ধরে ধরে। তার ছোট কাকিমা ত্রিপুরা সুন্দরী বলে উঠলেন, ‘ওকি করিস রবি ? এই বুঝি তোর ভাঁড় খেলা ?  ভাঁড়গুলো সব উল্টে-পাল্টে দিচ্ছিস কেন ? রবীন্দ্রনাথের নিজের বাড়ি নিজেই বর। রবীন্দ্রনাথ বললেন, ‘জানো না কাকীমা সব যেন উলট পালট হয়ে যাচ্ছে- কাজে কাজেই আমি ভাঁড় গুলো উল্টে দিচ্ছি। রবীন্দ্রনাথ বাক সিদ্ধ মানুষ। তাকে কথায় হারানো যাবে না। তাই কাকিমা এবার বললেন, ‘তুই একটা গান কর। তোর বাসরে কে গাইবে তোর মত গায়ক থাকতে।’  রবীন্দ্রনাথের গানের গলা তখন নাকি বেস চমৎকার ছিল।

রবীন্দ্রনাথ আর মৃণালিনী দেবীর বিবাহবাসরের বর্ণনা লিখেছেন রবীন্দ্রনাথের বড়দাদা, দ্বিজেন্দ্রনাথের ছেলের স্ত্রী, হেমলতা ঠাকুর। তিনি লিখেছেন, ‘মহর্ষি তখন হিমালয়ে। খুবই ঘরোয়া আর  অনাড়ম্বর পরিবেশে তাঁদের বিয়ে হলো। ঠাকুর বাড়ীর বিয়েতে একটা বেনারসি শাল গায়ে দেবার রেওয়াজ ছিল। রবীন্দ্রনাথ সেই ধারাবাহিকতা রক্ষার্থে সেই শাল গায়ে দিলেন। জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ীর পশ্চিমের বারান্দা ঘুরে  বিয়ের কনেকে নিয়ে যেত। পিঁড়ির উপর দাঁড়ানো রবীন্দ্রনাথকে বরণ করা হলো। কনেকে সাতপাক ঘুরিয়ে করা হলো সম্প্রদান।’ রবীন্দ্রনাথের বিয়ের আরো ঘটনা জানা যায় চিত্রা দেবের ‘ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহল’ গ্রন্থ থেকে; সেখানে তিনি বলেন, ‘জীবন থেমে থাকে না। কাদম্বরী যখন চলে গেলেন ফুলতলির ভবতারিণী তখন বালিকা। তাঁকে ‘স্বর্ণমৃণালিনী’ হবার আশীর্বাদ করেছিলেন দ্বিজেন্দ্রনাথ। তাঁরপর ভবতারিণী একদিন হারিয়ে গেলেন মৃণালিনীর মধ্যে।

যদিও এই পরিবর্তন কোন আলোড়ন আনল না বহির্জগতে। একটুও তরঙ্গ তুলল না প্রগতিশীলাদের মনে। তবু মৃণালিনীকে সামান্য বলতে পারা যায় না।  মাত্র দশ বছর বয়সে একহাত ঘোমটা টেনে যে ভবতারিণী ঠাকুরবাড়িতে ঢুকেছিলেন সেদিন তিনি বুঝতেও পারেননি কোন বাড়িতে তাঁর বিয়ে হচ্ছে, কাকে পেলেন তিনি ! রবীন্দ্রনাথ বলতেন, ‘আমার বিয়ের কোন গল্প নেই’, বলতেন বিয়ে যা-তা করে হয়েছিল।’ কিন্তু প্রথম দিকে তোড়জোড় শুরু হয়েছিল বড় মাপে। দাসী পাঠিয়ে মেয়ে পছন্দ করা পুরনো ব্যাপার তাই এবার একটা কমিটি তৈরি হল-জ্ঞানদানন্দিনী, কাদম্বরী, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে। তাঁরা সদলবলে মেয়ে খুঁজতে গেলেন যশোরে-সেখান থেকেই ঠাকুরবাড়ির অধিকাংশ বৌ এসেছিলেন। জ্ঞানদানন্দিনীর বাপের বাড়ি নরেন্দ্রপুর গিয়ে উঠলেও দক্ষিণডিহি, চেঙ্গুটিয়া প্রভৃতি আশেপাশের সব গ্রামের বিবাহযোগ্য মেয়েই দেখা হয়ে গেল কিন্তু বৌঠাকুরানীদের মনের মতো সুন্দরী মেয়ে পাওয়া গেল না। তাই শেষকালে ঠাকুর ষ্টেটের কর্মচারী বেণীমাধব রায়ের বড় মেয়ে ভবতারিণীর সঙ্গেই বিয়ে ঠিক করা হল। অবশ্য দাদাদের মতো রবীন্দ্রনাথ বিয়ে করতে যশোরে জাননি, জোড়াসাঁকোতেই বিয়ে হয়েছিল। গুরুজনেরা যে সম্মন্ধ করেছিলেন, রবীন্দ্রনাথ বিনা দ্বিধায় তাঁকেই বরণ করে নিয়েছিলেন। বন্ধুদের নিজের বিয়ের নিমন্ত্রণ লিপি পাঠিয়ে দিলেও এ বিয়েতে ঘটাপটা বিশেষ হয়নি। পারিবারিক বেনারসী ‘দৌড়দার’ জমকালো শাল গায়ে দিয়ে তিনি বিয়ে করতে গেলেন নিজেদের বাড়ির পশ্চিম বারান্দা ঘুরে। বিয়ে করে আনলেন অজ্ঞ বালিকা ভবতারিণীকে।

কবির বাসর ঘরের সুন্দর বিবরণ পাওয়া যাবে প্রত্যক্ষদর্শী হেমলতার লেখায়, ‘বাসরে বসেই রবীন্দ্রনাথ দুষ্টুমি আরম্ভ করলেন।...ভাঁড় খেলার বদলে ভাঁড়গুলো উপুড় করে দিতে লাগলেন ধরে ধরে। তাঁর ছোট কাকিমা ত্রিপুরা সুন্দরী বলে উঠলেন, ‘ওকি করিস রবি? এই বুঝি তোর ভাঁড় খেলা? ভাঁড়গুলো সব উল্টে-পাল্টে দিচ্ছিস কেন ?...রবীন্দ্রনাথ বললেন, জানো না কাকিমা-সব ওলটপালট হয়ে যাচ্ছে কাজেই আমি ভাঁড়গুলো উল্টে দিচ্ছি।’...কাকিমা আবার বললেন, ‘তুই একটা গান কর’! তোর বাসরে আর কে গাইবে, তুই এমন গাইয়ে থাকতে ? এরপর তাঁর বাসর ঘরে একবার উকি দিলে দেখা যাবে সেখানে তিনি ওড়নাঢাকা জড়সড় বধূর দিকে চেয়ে কৌতুক ভরে গান ধরেছেন ‘আমরি লাবণ্যময়ী’। শোনা গেছে, কথায় প্রচণ্ড যশুরে টান থাকায় ভবতারিণী প্রথম দিকে বেশ কিছুদিন কথাই বলতেন না। কবি কি এই অসম বিবাহকে খুশি মনে গ্রহণ করেছিলেন ? তাই তো মনে হয়। ছোট ছোট ঘটনায় রয়েছে সুখের আমেজ। এরই মধ্যে শুরু হল ভবতারিণীর মৃণালিনী হয়ে উঠার শিক্ষা। প্রথমে তিনি মহর্ষির নির্দেশে ঠাকুরবাড়ির আদব- কায়দা, বাচনভঙ্গির ঘরোয়া তালিম নিলেন নীপময়ীর কাছে। তারপর নীপময়ীর মেয়েদের সঙ্গে মৃণালিনীও পড়তে গেলেন লরেটো হাঊসে।

ফুলতলির ভবতারিণী হয়তো হারিয়ে গেলেন কিন্ত মৃণালিনী অতি আধুনিক হয়েও ওঠেননি কিংবা তাঁর  লরেটোর ইংরেজি শিক্ষার, পিয়ানো শিক্ষা, হেমচন্দ্র বিদ্যারত্নের কাছে সংস্কৃত শিক্ষা কোন সৃষ্টিমূলক কাজেও লাগেনি। কারণ তাঁর জীবন সংসারের সকলের সুখে নিমজ্জিত ছিল। চারপাশে অতি সরব এবং সোচ্চার চরিত্রগুলির পাশে তাঁর নির্বাক ভূমিকাটি আমাদের কাছে তেমন স্পষ্ট নয়। অথচ তিনিও বাড়ির অন্যান্য মেয়ে-বউয়েদের মত অভিনয় করেছেন, রামায়ণ অনুবাদ করেছেন, রবীন্দ্রনাথের নির্দেশে রূপকথা সংগ্রহ করেছেন, আমোদ-প্রমোদ–দুঃখে-শোকে সবার সবচেয়ে বেশি কাছে এসে দাঁড়িয়েছেন। রবীন্দ্রনাথের ‘রাজা ও রাণী’ নাটকে প্রথম অভিনয়ে মৃণালিনী সেজেছিলেন ‘নারায়ণী’ আর ‘দেবদত্তে’র ভূমিকায় কে অভিনয় করেছিলেন জানেন ? তাঁর মেজ ভাশুর সত্যেন্দ্রনাথ। ঘরোয়া অভিনয় নয়, বেশ বড় মাপের আয়োজন হয়েছিল। যদিও প্রথমবার, তবুও তাঁর অনাড়ষ্ট সাবলীল অভিনয় ভালভাবেই উৎরেছিল। অথচ, ‘নবনাটকে’ অভিনয় করার জন্য, একটি স্ত্রীভূমিকা গ্রহণ করে, অক্ষয় চৌধুরী আর কিছুতেই স্টেজে এসে দাঁড়াতে পারেননি। মৃণালিনীরও এ রকম অবস্থা হতে পারত। বিশেষ করে ভাশুরের সঙ্গে অভিনয় ! কিন্তু কোন বিঘ্ন ঘটেনি। তবু রবীন্দ্রনাথের নাটক কিংবা অভিনয়ে যোগ দেবার আগ্রহও মৃণালিনীর ছিল না,একথা স্বীকার করতেই হবে। ‘সখিসমিতির’ দুএকটা অভিনয়ে কিংবা ‘মায়ার খেলা’র ছোটখাট চরিত্রাভিনয়ে যোগ দেওয়া ছাড়া আর কিছুই তাঁকে অংশ গ্রহণ করতে দেখা যায়নি।

আসলে গান- অভিনয়-সাহিত্যচর্চার মধ্যে মৃণালিনীর প্রকৃত পরিচয় খুঁজে পাওয়া যাবে না। স্বামীর মহৎ আদর্শকে কাজে পরিণত করবার জন্য তিনি যখন রবীন্দ্রনাথের পাশে এসে দাঁড়ালেন, তখন শুধু তখনই তাঁর প্রকৃত পরিচয় প্রথমবার আমরা পেলুম। সামান্যর মধ্যে দেখা দিলেন অসামান্য। দেখা দিল সনাতন ভারতবর্ষের শাশ্বতী নারী। অবশ্য সে অনেক পরের কথা। ঠিক সুগৃহিণী বলতে যা বোঝায় ঠাকুরবাড়িতে মৃণালিনী ছিলেন তাই।  জোড়াসাঁকোতে সবার ছোট তবু সবাই তাঁর কথা শুনতেন। সবাইকে নিয়ে তিনি আমোদ-আহ্লাদ করতেন, বৌয়েদের সাজাতেন কিন্তু নিজে সাজতেন না। সমবয়সীরা অনুযোগ করলে বলতেন, ‘বড় বড় ভাশুর-পো ভায়েরা চারদিকে ঘুরছে-আমি আবার সাজব কি ?’ একদিন কানে দুটি ফুল ঝোলানো বীরবৌলি পড়েছিলেন সবার অনুরোধে। সেই সময়ে হঠাৎ কবি উপস্থিত হলে সঙ্গে সঙ্গে তিনি দু’হাত চাপা দিয়ে বীরবৌলি লুকিয়ে ফেলেছিলেন। গয়না পরায় এতই ছিল তাঁর লজ্জা। তিনি আরও ভালবাসতেন রান্না করতে, আর পাঁচজনকে ভালমন্দ রেঁধে খাওয়াতে। ঠাকুরবাড়িতে মেয়েদের গৃহকর্মে নানারকম তালিম দেওয়া হত। মহর্ষিকন্যা সৌদামিনী তাঁর ‘পিতৃস্মৃতি’তে লিখেছিলেন যে তাঁদের প্রতিদিন নিয়ম করে একটা তরকারি রাঁধতে হত। ‘রোজ একটা করিয়া টাকা পাইতাম, সেই টাকায় মাছ তরকারি কিনিয়া আমাদিগকে রাঁধিতে হইত।’ নতুন বৌয়েদের শিক্ষা শুরু হত পান সাজা দিয়ে। তারপর তাঁরা শিখতেন বড়ি দিতে, কাসুন্দি- আচার প্রভৃতি তৈরি করতে। ধনী পরিবারের বৌ হলেও এসব শিক্ষা ত্রুটি ছিল না।

বলাবাহুল্য মৃণালিনী এসব কাজে অত্যন্ত দক্ষতার পরিচয় দিয়েছিলেন। তবে একটা কথা মনে রাখতেই হবে, এ সময় দিন বদলাচ্ছে। পালাবদল চলছে বাড়ির বাইরে, বাড়ির ভিতরেও। না বদলালে কি জ্যোতিরিন্দ্র কাদম্বরী তিন তলার ছাদে ‘নন্দন কানন’ তৈরি করতে পারতেন ? সে সভায় অনাত্মীয় পুরুষেরাও অবাধে আসতেন, অথচ সত্যেন্দ্র বন্ধু মনোমোহনকে অন্তঃপুরে নিয়ে আসতে কম কাঠ খড় পোড়াতে হয়নি। যুগ বদলাচ্ছে। মৃণালিনী যখন লরেটো স্কুলে পড়তে গেলেন তখন আর কেউ ধিক্কার দিতে এলো না। কারণ তাঁর আগেই চন্দ্রমুখী ও কাদম্বিনী অসাধ্য সাধন করে ফেলেছেন। যাক সে কথা পরে হবে। এখন কথা হচ্ছে ঠাকুরবাড়ির সাবেকী চাল নিয়ে। অন্দরমহলের ব্যবস্থা বদলাতে বড় দেরি হয়। যাই যাই করেও গ্রীষ্মকালের শেষ সূর্যের আলোর মতো মেয়েদের চিরকেলে অভ্যাস যেন যেতে চায় না। তাই বাইরের জগতে কয়েকটি মেয়ে বিরাট পরিবর্তন আনলেও বৌয়েরা তখনও শিখতেন ঝুনি-রাইয়ের ঝাল কাসন্দি, আমসত্ত্ব, নারকেল চিড়ে তৈরি করতে। মৃণালিনী নানারকম মিষ্টি তৈরি করতে পারতেন। তাঁর মানকচুর জিলিপি, দইয়ের মালপো, পাকা আমের মিঠাই, চিঁড়ের পুলি যারা একবার খেয়েছেন তাঁরা আর ভোলেননি। স্ত্রীর রন্ধন নৈপুণ্যে কবিও উৎসাহী হয়ে মাঝে মাঝে নানা রকম উদ্ভট রান্নার এক্সপেরিমেন্ট করতেন। শেষে হাল ধরে সামাল দিতে হত মৃণালিনীকেই। শেষে তাঁকে বাগাবার জন্য কবি বলতেন, ‘দেখলে তোমাদের কাজ তোমাদেরই কেমন একটা শিখিয়ে দিলুম।’

মৃণালিনী চটে গিয়ে বলতেন, ‘তোমাদের সঙ্গে পারবে কে ? জিতেই আছ সকল বিষয়ে।’ লেখাপড়া শেখার পর শিলাইদহে বাস করবার সময় মৃণালিনী কবির নির্দেশে রামায়ণের সহজ ও সংক্ষিপ্ত অনুবাদের কাজে হাত দিয়েছিলেন। শেষ হয়নি। কবি সেই অসমাপ্ত খাতাটি তুলে  দিয়েছিলেন মাধুরীলতার হাতে, বাকিটুকু শেষ করার জন্য। অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করার আগেই অকালে মাধুরীর জীবনদীপ নিবে যাবার পর আর খাতাটির খোঁজ মেলেনি। রথীন্দ্রের  কাছে আর একটি খাতা চিল-তাতে মৃণালিনী মহাভারতের কিছু শ্লোক, মনুসংহিতা ও উপনিষদের শ্লোকের অনুবাদ করেন। এছাড়া কবির নির্দেশে তিনি বাংলাদেশের রূপকথা সংগ্রহের কাজেও হাত দিয়েছিলেন। অবনীন্দ্রনাথ তাঁর সংগ্রহ থেকেই পেয়েছিলেন ‘ক্ষীরের পুতুল’ গল্পটি। মৃণালিনী ঠিক যেমন করে গল্পটি বলেছিলেন ঠিক তেমনি করেই লিখেছিলেন অবনীন্দ্রনাথ। রূপকথার যাদুকরের সেদিন হাতেখড়ি হল মৃণালিনীর কাছেই। সকৃতজ্ঞ অবনীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘এই আমার রূপকথার আদি কথা।’ কিন্তু মৃণালিনীর লেখা আর কি ছিল ? স্বর্ণকুমারীকে এ নিয়ে একবার প্রশ্ন করা হলে তিনি দিপ্তভঙ্গিকে বলেছিলেন, ‘তাহার স্বামী বাঙলার একজন শ্রেষ্ঠ লেখক, সেই জন্য তিনি স্বয়ং কিছু লেখা প্রয়োজন বোধ করেন নাই।’ খুবই সত্যি কথা, তবু মনটা খুঁতখুঁত করে বৈকি ঠাকুরবাড়ির এই আমুদে বৌটি কি তাঁর মনের মধু সবটাই ঢেলে দিয়েছিলেন নীরব সেবায়। কালের সীমা পেরিয়ে কিছুই কি আমাদের কাছে এসে পৌছবে না ? দ্বিপেন্দ্রনাথের স্ত্রী হেমলতার লেখা থেকেই শুধু পাওয়া যাবে মৃণালিনীকে ? সুরসিকা মৃণালিনীর একটা-দুটো চিঠি অবশ্য রক্ষা পেয়েছে। সেই ছোট্ট সাংসারিক চিঠির মধ্যেও তাঁর পরিহাসপ্রিয় সহজ মনটি ধরা পড়েছিল।

সুধীন্দ্রনাথের স্ত্রী চারুবালাকে লেখা একটা চিঠিতে দেখা যাবে মৃণালিনী তাঁকে অনুযোগ করছেন অনেকদিন চিঠি না লেখার জন্য। তার মধ্যে যে অনাবিল স্বচ্ছতা আছে তার সৌন্দর্য বুঝি কোন সাহিত্যিক চিঠির চেয়ে কম নয়ঃ ‘তোমার সুন্দর মেয়ে হয়েছে বলে বুঝি আমাকে ভয়ে খবর দাওনি পাছে আমি হিংসে করি, তার মাথায় খুব চুল হয়েছে শুনে পর্যন্ত কুন্তলীন মাখতে আরম্ভ করেছি, তোমার মেয়ে মাথা ভরা চুল নিয়ে আমার ন্যাড়া মাথা দেখে হাসবে, সে আমার কিছুতেই সহ্য হবে না। সত্যিই বাপু, আমার বড় অভিমান হয়েছে, না হয়  আমাদের একটি সুন্দর নাতনী হয়েছে, তাই বলে কি আর আমাদের একেবারে ভুলে যেতে হয়।’                      

শান্তিনিকেতনে চলে গেলেও জোড়াসাঁকোর একান্নবর্তী পরিবারটির জন্য মৃণালিনীর আন্তরিকতা কখনো হ্রাস পায়নি। শিলাইদহে তার কাছেই ছুটে যেতেন ভাশুরপো ও ভাশুরঝিরা। বলেন্দ্রনাথ সংস্কৃত, ইংরেজি, বাংলা যখন যে বৈ পড়তেন কাকিমাকে পড়ে শোনাতেন। শুধু কি আত্মীয়স্বজন ? মৃণালিনী সবার সুখেই সুখী আবার সবার দুঃখেই সমদুঃখী। শিলাইদহে একদিন ‘মুলাসিং’ নামে এক পাঞ্জাবী তার কাছে এসে কাঁদতে কাঁদতে নিজের দুরবস্থার কথা জানিয়ে বললে, ‘মাইজী, একটি চাকরী দিয়ে আমাকে রক্ষা করুণ, নতুবা আমি সপরিবারে মারা পড়িব।’ রবীন্দ্রনাথ তখন শিলাইদহে ছিলেন না, মৃণালিনী তাকে কুঠিবাড়ির দারোয়ানের বহাল করলেন। কদিন পরে দেখলেন মুলাসিং তখনও বিষণ্ণ। মৃণালিনী দেবী কারণ জানতে চাইলেন। সে জানাল তার মাইনের সবটাই খরচ হয়ে যায় দুবেলা চারসের আটার রুটি খেতে। করুণাময়ী মৃণালিনী সেইদিন থেকে তার সংসার থেকে মুলা সিংয়ের জন্য চারসের আটা বরাদ্দ করলেন। মাইনে বাড়ল তবু আটার ব্যবস্থা আগের মতোই রয়ে গেল। দিনে দিনে তাঁর যে মূর্তিটি বড় হয়ে উঠেছে সে তাঁর জননী মূর্তি। শান্তিনিকেতন আশ্রম বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সময় তার পূর্ণ পরিচয় পাওয়া গেল। ‘সীমাস্বর্গের ইন্দ্রাণী’ সেখানে হয়ে উঠলেন অন্নপূর্ণা। মৃণালিনী রূপসী ছিলেন না, কিন্তু অপরূপ মাতৃত্বের আভা তার মুখে লাবণ্যের মত ঢলঢল করত।  

একবার দেখলে আবার দেখতে ইচ্ছে হয়, এই ছিল প্রত্যক্ষদর্শীর অভিমত। পাঁচটি  সন্তানের জননী মৃণালিনীর এই মাতৃমূর্তি আরও সার্থক হয়ে উঠেছিল শান্তিনিকেতনের ঘর থেকে দূরে আসা শিশুগুলিকে আপন করে নেওয়ার মধ্যে। কবির প্রত্যাশা পূর্ণ করেছিলেন মৃণালিনী। জীবনের সর্বক্ষেত্রে এমনকি শান্তিনিকেতনে আদর্শবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বাসনা নিয়ে  রবীন্দ্রনাথ সেখানে গেলে মৃণালিনীও তাঁর পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। এই ধরনের কাণ্ডজ্ঞানহীনতায় আত্মীয়স্বজনের উপদেশ, উপহাস, বিরুদ্ধতা, বিদ্রূপ সবই সহ্য করতে হয়েছিল। আত্মীয়দের খুব দোষ নেই, সর্বনাশের মুখোমুখি গিয়ে কেউ দাঁড়াতে চাইলে তাকে তো সাবধান করবেই। নাবালক পাঁচটি সন্তান, তাঁর মধ্যে তিনটি মেয়ে, অথচ কবি তাঁর যথাসর্বস্ব ঢেলে দিচ্ছেন আশ্রম বিদ্যালয়ে। লোকে বলবে না কেন ? মৃণালিনীর মনেও এ নিয়ে ভাবনা ছিল, তবু তিনি স্বামীকে সব কাজে হাসিমুখে সাহায্য করেছেন। যখনি কোন প্রয়োজন হয়েছে, তখনই খুলে দিয়েছেন গায়ের এক একটি গয়না।

মৃণালিনী পেয়েছিলেন প্রচুর। সবই তিনি কবির কাজে ব্যয় করেছিলেন। রথীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘শেষ পর্যন্ত হাতে থাকা কয়েক গাছা চুড়ি ও গলায় একটি চেন হার ছাড়া তাঁর কোন গয়না অবশিষ্ট ছিল না।’ শুধু গয়না দিয়ে নয়,  আশ্রমের কাজেও মৃণালিনী, স্বামীকে যথাসাধ্য সাহায্য করেছেন। আধুনিক অর্থে, তাকে হয়তো প্রগতিশীলা বলা যাবে না, কারণ শিক্ষা-দীক্ষায় ঠাকুরবাড়ির মেয়েদের ছাড়িয়ে অন্যান্য মেয়েরাও ক্রমশ এগিয়ে যাচ্ছিলেন। উগ্র আধুনিকতা এ  বাড়ির মেয়েদের রক্তমজ্জায় প্রবেশ করেনি। দীর্ঘকাল ধরে জ্ঞানদানন্দিনীই সেখানে উগ্র আধুনিকতার পরিচয় দিয়ে এসেছেন। কিন্তু মহৎ নারীর পরিচয় মৃণালিনী দেবীর মধ্যে আছে। ‘চারিত্রপূজা’ গ্রন্থ লেখবার সময়  রবীন্দ্রনাথ এক জায়গায় লিখেছেন, ‘মহাপুরুষের ইতিহাস বাহিরে নানা কার্যে এবং জীবন বৃত্তান্তে স্থায়ী হয়, আর মহৎ নারীর ইতিহাস... তাহাঁর স্বামীর কার্যে রচিত হইয়া থাকে; এবং সে লেখায় তাহাঁর নামোল্লেখ থাকে না।’ এরই মধ্যে আমরা মৃণালিনী দেবীর আসল পরিচয় খুঁজে পাব। তিনি রবীন্দ্রজীবনে, ঠাকুরবাড়িতে, শান্তিনিকেতনের আশ্রম বিদ্যালয়ে মিশে আছেন ফুলের সুরভির মত। দেখা যায় না; অনুভবে মন ভরে যায়।’  
                                
বন্ধুদের নিমন্ত্রণ করে খাওয়াতে ভালোবাসতেন রবীন্দ্রনাথ। বন্ধু প্রিয়নাথ সেন (১৮৫৪-১৯১৬) এবং কবি বিহারীলালের (১৮৩৫-১৮৯৪) অবাধ বিচরণ ছিল জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়ীতে। একাধিকবার তাঁরা রবীন্দ্রনাথের সাথে অন্ন গ্রহণ করেছেন। রবীন্দ্রনাথ ও তাঁদের কাছে পেয়ে আবেগ আপ্লুত হ’য়ে পড়েন। ঠাকুর পরিবারে তাঁদের নিমন্ত্রণ আয়োজনে কোন প্রকার ত্রুটি ছিল না। মৃণালিনী দেবী নিজ হাতে রান্না ক’রে তাঁদের খাওয়াতেন। মৃণালিনী দেবী ছিলেন গভীর ব্যক্তিত্বময়ী, আদরপরায়ণ এবং সুদর্শনা নারী। নানা বর্ণনা থেকে জানা যায় তাঁর গায়ের রঙ ছিল একটু চাপা। কিন্তু, রবীন্দ্রনাথের সুন্দরী ভ্রাতুস্পুত্রী ইন্দিরা দেবী (১৮৭৩-১৯৬০), তাঁর স্মৃতি কথায় কেন যে লিখেছিলেন, ‘তাঁর গুণবান, রূপবান, ভাগ্যবান, ধনবান এবং খ্যাতিমান রবিকাকার স্ত্রী মৃণালিনী দেবী দেখতে ততো ভালো ছিলেন না।’

এ মতটা কি ইন্দিরা দেবীর না অন্য কারো ছিল, তা আজও স্পষ্ট ক’রে জানা যায়নি। মৃণালিনী দেবী সম্পর্কে ঊর্মিলা দেবী তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন, ‘রবীন্দ্রনাথের স্ত্রী শে রকম তো ভালো দেখতে নন। তার পর ভালো করে দেখে তিনিই আবার লিখলেন, এক অপরূপা লাবণ্য সমস্ত মুখখানা যেন ঢল ঢল করছে, আর একটা মাতৃত্বের আভাস যেন মুখখানা উজ্জ্বল। একবার দেখলে আবার দেখতে ইচ্ছা হয়। প্রকৃত অর্থে, ঊর্মিলা দেবী শুনেছিলেন ঠাকুরবাড়ীর মেয়েরা সব অপ্সরীর মতো, তাঁরা দুধ দিয়ে স্নান করেন, ক্ষীর সর ছানা বেটে রূপটান মাখেন, কতো গয়না, কতো কাপড় যে আটপৌরে পড়েন তার ঠিক নেই।’

ছেলের বিয়ে দিয়েই অপরিণত পুত্রবধুকে ঘর সংসার সামলানোর কাজে ব্যস্ত ক’রে তোলেননি পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮১৭-১৯০৫)। তিনি খুবই স্নেহ করতেন তাঁর ছোটো পুত্রবধূ মৃণালিনী দেবীকে। ঊর্মিলা দেবী লিখেছেন, ‘মহর্ষি (দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর) পছন্দ করেন না এমন কোন কাজ করতে চাইতেন না মৃণালিনী। কখনো ও তর্ক করে রবীন্দ্রনাথকেও বলতেন, বাবামশায়  থাকলে তুমি এ কাজ করতে পারতে ? তাঁর লেখা থেকেই জানা যায় রবীন্দ্রনাথের উপর অখণ্ড প্রতাপ ছিল অভিমানিনী মৃণালিনীর। আর স্ত্রীর মানভঞ্জনের জন্য বেশ বেগ পেতে হতো রবীন্দ্রনাথকে।’
  
ভাশুর বিরেন্দ্রনাথের ছেলে বলেন্দ্রনাথের কাছে ইংরেজি, বাংলা আর সংস্কৃতি সাহিত্যের সঙ্গে পরিচিতি হয়েছিলেন মৃণালিনী দেবী। ছিলেন মার্ক টোয়েনের একান্ত অনুরাগিণী। কন্যা মাধুরীলতার চিঠিতে কখনোও পাওয়া যায় সমস্তদিন বই পড়তে পড়তে, রবীন্দ্রনাথকে চিঠি লিখে উঠতে পারছেন না মৃণালিনী দেবী। ছোটো মেয়ে মীরার স্মৃতি কথায় পাওয়া যায় মৃণালিনী দেবীর বই পড়ার চিত্র। তিনি সেই স্মৃতি কথায় লিখেছেন, ‘শান্তিনিকেতনের দোতলার গাড়িবারান্দার ছাঁদে একটা টেবিল ল্যাম্প জ্বলছে। মার হাতে একটা ইংরেজি নভেল। তাঁর থেকে বাংলায় অনুবাদ করে দিদিমাকে শোনাচ্ছেন।’ কয়েক পৃষ্ঠা মহাভারতের ‘শান্তিপর্ব’, ‘ঈশপোনিষদ’, ‘কঠোপনিষদ’ ইত্যাদি অনুবাদ করা অভ্যাস করা মৃণালিনীর একটা খাতা দেখা যায় বিশ্বভারতীর রবীন্দ্রভবনে। বিয়ের পর নির্দিষ্ট কোথাও বসবাস করেননি তাঁরা। কখনো কলকাতায়, কখনো শিলাইদহ, কখনো আবার সোলাপুর বা শান্তিনিকেতনে বার বার বাসা বদল করেছেন। বিয়ের পাঁচ বছর পর রবীন্দ্রনাথ আর শিশুকন্যা বেলার সঙ্গে পশ্চিম ভারতের গাজিপুরে কিছুদিন ছিলেন মৃণালিনী দেবী। পশ্চিম ভারতের এই স্থানটিতে গোলাপ বাগানের টানে রবীন্দ্রনাথও গিয়েছিলেন কয়েকবার।

বৈশাখ থেকে আষাঢ়ের মধ্যে সেখানেই রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন আঠাশটি কবিতা। পরবর্তীতে, এই কবিতাগুলো অন্তর্ভুক্ত করা হলো তাঁর ‘মানসী’ কাব্য গ্রন্থে। মৃণালিনী দেবীর সঙ্গে, এই স্থানে এসেই রবীন্দ্রনাথ হারিয়ে ফেলেছিলেন তাঁর প্রিয় বৌঠান কাদম্বরীর উপহার দেওয়া একটি সোনার আংটি। বিয়ের প্রায় পাঁচ বছরের মাথায় জমিদারী দেখাশোনার কাজে রবীন্দ্রনাথকে শিলাইদহে পাঠিয়ে দিলেন পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। সে বারও সঙ্গে মৃণালিনী দেবী আর দুই শিশু সন্তান; মাধুরীলতা আর রথীন্দ্রনাথ। ১৮৯১ এ- রবীন্দ্রনাথ, বেলা, রথী আর রেণুকাকে সঙ্গে নিয়ে প্রথমবার শান্তিনিকেতনে এসে, এলাকার আদিবাড়ি শান্তিনিকেতনের গৃহের দোতলায় কিছুদিন ছিলেন মৃণালিনী দেবী। এর পরবর্তী বিভিন্ন সময়ে, ১৯০২ সাল অবধি প্রায় সাতবার মৃণালিনী দেবী নানা কারণে শান্তিনিকেতনে এসেছিলেন বলে অনুমান করা হয়।

গ্রামের পাঠশালাতেই মৃণালিনী দেবীর পড়ালেখার পর্ব শুরু হয়। রবীন্দ্রনাথের পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের (১৮১৭-১৯০৫) আদেশে ১৮৮৪-১৮৮৫ সালের দিকে লরেটো হাউসে  ইংরেজি শিক্ষার জন্য গমন করেন। পরবর্তী সময়ে, রবীন্দ্রনাথের একান্ত ইচ্ছায় (১৮৮৫-১৮৮৬) সালের দিকে পণ্ডিত হেমচন্দ্র বিদ্যারত্নের নিকট সংস্কৃতি শিক্ষালাভ শুরু। পিতৃগৃহে মৃণালিনী দেবীর বিদ্যাশিক্ষার যে ক্ষুদ্রতম পরিধি তাহা ঠাকুর পরিবারের বধূগণের ও কন্যাদিকের বিদ্যার তুলনায় নিতান্ত নগণ্য। প্রতিভাবান সুশিক্ষিত কবির অনুরূপ স্ত্রীরত্ন লাভ বিরল হইলেও একান্ত বিরল বলিয়া মনে হয় না। কিন্তু সৌভাগ্যমূলক ভবিতব্যতা সর্বত্র অবাধ; তাই মহর্ষির এই পরিণয়ে অসম্মতির কোনো কারণ ছিল না। কবিও পিতৃদেবের মর্যাদা লঙ্ঘন করেন নাই। কিন্তু সহধর্মিণীকে উপযুক্ত সহধর্মিণী করিবার নিমিত্তে কবি নববধূর ইংরেজি শিক্ষার ব্যবস্থা করিলেন, এমন কি বালিকা বধূকে লরেটো হাউজে পড়িবার অনুমতি দিলেন। এই সময়ে নগেন্দ্রনাথ দিদির কাছে আসিয়া একটি ইংরেজি বিদ্যালয়ে পড়িতেন। অবসরক্রমে দিদি পড়া বলিয়া দিয়া তাঁহার সাহায্য করিতেন। কখনো কখনো নগেন্দ্রনাথ  দুই একটি ইংরেজি শব্দের অর্থ জিজ্ঞাসা করিতেন; দিদি অর্থ বলিয়া দিয়া পাঠ বুঝাইয়া দিতেন। প

ত্নীর ইংরেজি শিক্ষার ব্যবস্থা করিয়াই কবি নিরস্ত হইতে পারেন নাই। রামায়ণাদির সংস্কৃত সহজ শ্লোকের  অর্থগ্রহণ যাহাতে অনায়াসে হয় তিনি সেই উদ্দেশ্যই পত্নীকে মোটামুটিভাবে কিছু সংস্কৃত শিখাইবার নিমিত্তে উদ্যোগী হইলেন এবং আদি ব্রাহ্মসমাজের আচার্য পণ্ডিত হেমচন্দ্র বিদ্যারত্ন মহাশয়কে সংস্কৃত শিক্ষার্থ  নিযুক্ত করিলেন। কবির নির্দেশানুসারে বিদ্যারত্ন রামায়ণের গল্পাংশের শ্লোকের বাংলায় ব্যাখ্যা করিতেন, ছাত্রী সেই ব্যাখ্যা শুনিয়া তাহার বাংলায় অনুবাদ লিপিবদ্ধ করিতেন। এইরূপে রামায়ণের গল্পাংশের অনুবাদ সমাপ্ত হইয়াছিল।  

বলেন্দ্রনাথ সংস্কৃতে বিশেষ অনুরাগী ছিলেন। তিনি সংস্কৃতে কাব্য নাটকাদির শ্লোক গদ্যাংশ কখনো কখনো ব্যাখ্যা ও সরল বাংলায় অনুবাদ করিয়া কাকিমাকে বুঝাইয়া দিতেন। এই প্রকারে অনুবাদের সাহায্য ও বলেন্দ্রনাথের  ব্যাখ্যায়, শ্লোকের আবৃত্তি শ্রবণে মৃণালিনী দেবীর সংস্কৃত অর্থবোধে বেশ কিছু পারদর্শিতা জন্মিয়াছিল। রথীন্দ্রনাথ রবীন্দ্রভবনে মায়ের স্বহস্তে পেন্সিলে লিখিত একখানি খাতা দিয়াছেন। তাঁহার বিশ্বাস ছিল, খাতাখানি মায়ের লিখিত রামায়ণের সেই অনুবাদের পাণ্ডুলিপি। খাতা খুলিয়া দেখিলাম ইহা রামায়ণের অনুবাদ পাণ্ডুলিপি নহে, মহাভারত মনুসংহিতা ঈশোপনিষৎ কঠোপনিষৎ প্রভৃতির অনুবাদ ইহাতে লিপিবদ্ধ হইয়াছে। কবি এখন সম্পূর্ণ গৃহস্থ না হইলেও গৃহী হইয়াছেন বলা যায়।

বিবাহের পর তিনি পৈতৃক প্রাসাদে নির্ধারিত প্রকোষ্ঠে কিছুকাল অবস্থান করিয়াছিলেন; তখন ঠাকুরপরিবারে সুবিপুল মহর্ষির পুত্র, পুত্রবধূ, পৌত্র-পৌত্রী, কন্যা, দৌহিত্র-দৌহিত্রী, আত্মীয়-কুটুম্ব প্রভৃতির স্থান সুবিশাল ত্রিতল অট্টালিকায়ও যথেষ্ট হইত না। কাব্যময় জীবন উপভোগ করায় কবির পক্ষে কোনো বাধা ছিল না। একবার তিনি ইচ্ছা করিলেন, গাজিপুরে কোনো নিভৃতে নিবাসে বাস করিয়া প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সম্ভোগে কবিজীবন সফল করিবেন। এই অভিপ্রায়ে ১২৯৪ সালের শেষভাগে তিনি গাজিপুরে যাওয়া স্থির করিলেন। এই সিদ্ধান্তের অজুহাতে তিনি লিখিয়াছেন-

‘বাল্যকাল থেকে পশ্চিম ভারত আমার কাছে রোম্যান্টিক কল্পনার বিষয় ছিল।....শুনেছিলুম, গাজিপুরে আছে গোলাপের ক্ষেত।....তারি মোহ আমাকে প্রবলভাবে টেনেছিল।’ এখন রবীন্দ্রনাথের পরিবার ক্ষুদ্র। পত্নী মৃণালিনী দেবী, শিশুকন্যা বেলা। এই সংসার নিয়ে কবি গাজিপুরে উপস্থিত হলেন। এখানে তাঁর দুর-সম্পর্কীয় আত্মীয় আফিম-বিভাগের একজন প্রধান কর্মচারী গগনচন্দ্র রায় বাস করেন। তাঁর সাহায্য কবির সুখস্বচ্ছন্দে বাসোপযোগী ব্যবস্থা সমস্তই সহজেই সম্পন্ন হ’লো। সপরিবারে গাজিপুরে বাস সাংসারিক কবি জীবনের প্রথম ও প্রধান পর্ব।  আপনার সংসারে স্বামীকে আপনার মতো করিয়া পাওয়ার প্রবল আকাঙ্ক্ষা স্ত্রীমাত্রের পক্ষে স্বাভাবিক। বৃহৎ ঠাকুরপরিবারের মধ্যেবাসে কবিপত্নীর সে অভিলাষ এ পর্যন্ত অপূর্ণই ছিল। গাজিপুরে বাসে পৃথক সাংসারিক জীবনের সূত্রপাতে তাহা এই প্রথম কার্যে পরিণত হ’লো; পক্ষান্তরে যৌবনের পরিপূর্ণতায় কবিও এখন প্রথম পাইলেন পত্নীকে ধরার সঙ্গিনীরূপে; প্রণয়িনীরূপে ‘আশা দিয়ে, ভাষা দিয়ে তাহে ভালোবাসা দিয়ে গড়ে তুলি মানস প্রতিম।’

এ যে তাঁর পক্ষে বিজয়াদশমীর দিন। বিষাদমলিন সকলকে কাছে এনে মাইজী স্নিগ্ধ সান্ত্বনাবাক্যে বললেন, ‘শান্ত হও, আমি আবার আসব, তোমাদের কি কখনো ভুলতে পারি।’ সস্নেহ প্রবোধবাক্যে সকলে কিছু আশ্বস্ত হলো। স্নেহের এটাই মোহিনী শক্তি ! মহর্ষির কনিষ্ঠা ভ্রাতা নগেন্দ্রনাথের বিধবা পত্নী ত্রিপুরাসুন্দরী মহর্ষির পুত্রবধূগণের কাকিমা। তিনি জোড়াসাঁকোর বাড়িতে থাকিতেন না, বিরজিতলায় একটি বাড়িতে যাবজ্জীবন বাস করেছিলেন। মহর্ষিদেব এই বাড়ি তাঁকে দিয়ে দিলেন। মধ্যে মধ্যে আত্মীয়দের সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ করতে  জোড়াসাঁকোর বাড়িতে আসতেন, বউমাদের সঙ্গে কিছুক্ষণ আলাপ-সালাপ, আমোদ-সামোদ করে চলে যেতেন।

মহর্ষির সদর খাজাঞ্জি প্রতিমাসে মাসহারা দিতে যাইবেন; তাঁহার মুখে শুনিয়া ছিলাম, কাকিমা হাজার টাকার একখানি নোটই পছন্দ করতেন, তাও বিশেষ পরীক্ষা করে নিতেন। একবার কাকিমা জোড়াসাঁকোয় আসলে মৃণালিনী দেবী না ছোড় হয়ে তাঁকে ধরে বসলেন, বললেন, ‘কাকিমা, আপনি বারবার আসেন যান, একবারও কিছুই খান না; আমি নিজেই মিষ্টান্ন তৈরি করেছি, তা আজ খেতেই হবে।’ বউমার এই অভাবনীয় সনির্বন্ধ আবদারে কাকিমা বিপন্ন হয়ে পড়লেন; নানা উপায়ে বউমাকে নিরস্ত করার চেষ্টাও করলেন; কিন্তু বউমার আবদার এড়াতে পারলেন না। কাকিমার নিমরাজ ভাব বুঝিয়া সুচতুর বউমা কালবিলম্ব করলেন না, তখনই বড়ো পাত্রে ভরা নানাবিধ মিষ্টি এনে কাকিমার হাতে দিলেন; বউমার এইরূপ ক্ষিপ্র আয়োজন কাকিমার আর না-না বলিবার উপায় রইল না। অনন্যেপায় হয়ে পাত্র নিয়ে অবশিষ্ট বধূদের মিষ্টি কিছু কিছু পরিবেশন করে অবশিষ্ট কিছু অংশ নিজে খেলেন। বলেন্দ্রনাথের বিবাহে জননী প্রফুল্লময়ী দেবী ছোট জায়ের ভূয়সী প্রশংসা করে লিখলেন-‘বলুর বিবাহে খুব ঘটা হইয়াছিল...আমার ছোট জা মৃণালিনী দেবীও সঙ্গে যোগ দিয়া নানারকম ভাবে সাহায্য করেন। তিনি আত্মীয়স্বজনকে সঙ্গে লইয়া আমোদ-আহ্লাদ করিতে ভালবাসিতেন। মনটা খুব সরল ছিল। সেই জন্য বাড়ির সকলেই তাকে খুব ভালবাসিত। পুত্রকন্যাগণের শিক্ষা গৃহবিদ্যালয়ের পত্তন করিয়া কবি যখন শিলাইদহের কুঠিবাড়িতে সপরিবারে বাস করিয়াছিলেন, সেই সময়ে মিষ্টান্ন প্রস্তুত করিয়া মৃণালিনী দেবী কর্মচারীদিগের জন্য জমিদারি কাছারিতে পাঠাইয়া দিতেন। কখনো কোনো কোনো বিশিষ্ট কর্মচারীকে নিমন্ত্রণ করিয়া কুঠিবাড়িতে খাওয়াইতেন।’