জীবনানন্দ দাশ মূলত কবি। প্রাবন্ধিক হিসেবেও বেশ সুপরিচিত, সুপ্রিয় নয়। সৃষ্টি বা রচনা করেননি এমন বিষয় নেই বললেই তার ক্ষেত্রে বলা চলে। আজ তা বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে সেটা বেশ ষ্পষ্ট হ’য়ে দেখা দেয়। যদিও তা আজ কারো কাছে অবিদিত নয়। একের পর এক রচনাগুলো বেড়িয়ে আসছে উজ্জ্বল আলোর দিকে, যা কিছু দিন পূর্বেও ছিল তিমির অন্ধকারে। উজ্জ্বল আভায় তা ভ’রে দিচ্ছে বাঙলা সাহিত্যকে। জীবনানন্দ কী ছিলেন বা কী ছিলেন না এ প্রশ্ন আজ অবান্তর। যদি বলতেই হয় তাহ’লে দৃঢ় কণ্ঠে উচ্চারিত ক’রে বলতে হয় তিনি কী ছিলেন না? তাঁর অজ্ঞাত রচনাগুলো যেমন তাঁকে প্রিয় থেকে আরো বেশী সুপ্রিয় ক’রে তুলেছে তেমনি ভাবে- করছে আরো বেশি গ্রহণযোগ্য। বর্তমান সময়ে তাঁর ওই সকল রচনা সমূহ যদি প্রকাশ না পেত তাহ’লেও বলা চলে, যে রচনা সমূহ বিদিত রয়েছে সেখানে জীবনানন্দের উপস্থিতি কোন অংশে কম আছে বলে আমার কখনো মনে হয়নি। বরং বলা চলে এ রচনা সমূহ প্রকাশ পেয়ে জীবনানন্দ দাশকে আরো বেশী পূর্ণাঙ্গ রূপ দিল। ‘তোমার যেখানে সাধ চ’লে যাও’ বা ‘কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসা’, ‘গভীর অন্ধকারের ঘুম থেকে নদীর চ্ছল চ্ছল শব্দে জেগে উঠলাম আবার’ বা ‘শোনা গেল লাশকাটা ঘরে নিয়ে গেছে তারে’ বা ‘তোমারে দেখার মতো চোখ নেই’ ইত্যাদি কবিতা সমূহের কবি যখন রচনা করেন কথাসাহিত্য তা কী রকম হবে? আবার যখন তিনি প্রকাশ করেন: ‘সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি’ বা ‘ইমাজিনেশন মানে কল্পনা প্রতিভা ভাব-প্রতিমা’ বা ‘কোনো বিশেষ যুগে জন্মেছে বলে কবি বড় বা ছোটো হয় না’ বা ‘আজ থেকে গত চার পাঁচশো বছরের ইউরোপীর চিন্তা ও ভাবলয়ের কাছে আমরা কম ঋণী নই’ বা ‘কবিতাও নিজেরই বিশেষ স্ব্ভাবের জিনিস’ ইত্যাদি প্রবন্ধসমূহের কবি যখন রচনা করেন কথাসাহিত্য তা কী রকম হ’তে পারে?
এই সময় পর্যন্ত জীবনানন্দের তেরোটি উপন্যাস প্রকাশ পেয়েছে। তেরোটি উপন্যাস প্রকাশ পায়নি একসঙ্গে। দেখা দিয়েছে ধীরে ধীরে এবং পরিশেষে একত্রে, গ্রন্থকারে। কথাসাহিত্যগুলো বিস্ময় বিমুগ্ধ ক’রে তোলে আমাকে। লেখার রচনাকালনুযায়ী উপন্যাসগুলো হলো: এক. ‘পূর্ণিমা’, (নভেম্বর : ১৯৩১), দুই. ‘কল্যানী’ (জুলাই ১৯৩২), তিন. ‘বিভা’ (ফেব্রুয়ারি; ১৯৩৩), চার. ‘মৃণাল’ (ফেব্রুয়ারি :১৯৩৩), পাঁচ, ‘নিরুপম যাত্রা’ (মার্চ : ১৯৩৩), ছয়. ‘কারুবাসনা’ (আগস্ট: ১৯৩৩), সাত. ‘জীবন প্রণালী’ (আগস্ট ১৯৩৩), আট: ‘বিরাজ’ (আগস্ট :১৯৩৩), ‘প্রেতনীর রূপকথা’ (আগস্ট-সেপ্টম্বর : ১৯৩৩), দশ, ‘জলপাই হাটি’ (এপ্রিল-মে ১৯৪৮), এগারো. ‘সুতীর্থ’ (মে-জুন: ১৯৪৮), বারো. ‘মাল্যবান’ (জুন : ১৯৪৮) এবং তেরো ‘বাসমতীর উপাখ্যান’ (?: ১৯৪৮)।
এছাড়াও পরিশেষে ‘জীবন যাপন’ নামে একটি মাত্র খাতায় লেখা রয়েছে, যা তেরোটি উপন্যাসের অন্তর্ভূক্ত নয়। সেই রচনার অবশিষ্ট্য অংশটুকুও ছাপানো হয়েছে।
‘বিরাজ’ নামক উপন্যাসটি অসমাপ্ত থেকে যায় এবং যতটুকু প্রকাশিত হয়েছে তা পরিমানে খুবই কম। এ ছাড়া ‘পূর্ণিমা’, ‘কল্যাণী’, ‘নিরুপম যাত্রা’ এবং ‘প্রেতনীর রূপকথা’কে উপন্যাস না বলে বরং উপন্যাসের দয়িতা-ই বলি। এগুলো আসলে ছোটো গল্পের দীর্ঘায়িত রূপ। ‘জলপাই হাটি’, উপন্যাসের নামটি স্বয়ং কবির দেয়া নয়। তাঁর অনুজের দেওয়া। জীবনানন্দের প্রথম উপন্যাস ‘জলপাই হাটি’। এটি প্রকাশের পূর্বে প্রথম লেখা হয়েছিল ‘সুতীর্থ’। কারো কারো মতে ‘সুতীর্থ’-ই জীবনানন্দের প্রথম রচিত উপন্যাস। কিংবা যখন আমরা দেখতে পাই অনুজ বলেন: “জীবনানন্দের প্রথম উপন্যাস ‘সুতীর্থ’ (১৯৪৮-এর মে-জুন-এ) লেখা, যা পরে প্রকাশিত হয় ১৯৭৬-এ আরো যখন উল্লেখ করেন, ‘সুতীর্থ’ উপন্যাসটি তিনি সঞ্জয় ভট্টচার্যকে এবং ‘মাল্যবান’ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন অধ্যাপক অমলেন্দু বসুকে পড়তে দিয়েছিলেন, এবং তাঁরা উভয়ই উপন্যাসগুলি প্রকাশ করার জন্য আমাকে উৎসাহিত করেন।”
কবি জীবনানন্দ দাশ-কে ঔপন্যাসিক জীবনানন্দ দাশ থেকে কতটা পৃথক বা একত্রিত ক’রে দেখা হলে উভয়েই সার্থক হবে তা-ই বিবেচ্য বা আলোচ্য বিষয় হ’য়ে দেখা দেয়। যেহেতু কবি জীবনানন্দ দাশের ভিতর যত না তাড়া ছিল তার থেকে আরো বেশি তাড়া ছিল ঔপন্যাসিক জীবনানন্দের ভিতর। যার ফলশ্রুতিতে আমরা দেখতে পাই, ‘বিভা’, ‘মৃণাল’, ‘নিরুপম যাত্রা’, ‘কারুবাসনা’, ‘জীবন প্রণালী’ এবং ‘বিরাজ’ নামক উপন্যাস সমূহ একই বছরে (১৯৩৩) প্রকাশ পায়। এদের মধ্যে ‘নিরুপম যাত্রা’ ক্ষুদ্রকার এবং ‘বিরাজ’ ক্ষুদ্রা অবস্থাতেই অসমাপ্ত থেকে যায়। তাছাড়া অন্য সকল উপন্যাসগুলো বেশ বড়। এ সময়গুলোতে তিনি শুধু মাত্র উপন্যাসই রচনা করেননি, করেছেন কবিতা-ও। এর পরবর্তীতে দেখতে পাই তিনি ধারাবাহিক ভাবে উপন্যাস সৃষ্টি করে চলেননি। এ সকল উপন্যাস রচনাকালের পর; পরবর্তী উপন্যাস রচনার সময়কালের বেশ ব্যবধান রয়েছে। আবার যখন ১৯৪৮-এর দিকে তাকাই; তাহ’লে দেখতে পারো এ বছরে তিনি রচনা করেছেন ‘জলপাই হাটি’, ‘সুতীর্থ’ (প্রকাশ বা রচনাকালনুযায়ী), ‘মাল্যবান’ এবং ‘বাসমতীর উপখ্যান’ নামক চারটি উপন্যাস। যেগুলোর রচনাকাল একটি থেকে অপরটি একেবারে সন্নিকটে। তাহ’লে বলা যেতে পারে, ১৯৩৩ এবং ১৯৪৮ এর কিছু কিছু সময়ের সংমিশ্রন ঘটিয়ে জীবনানন্দ দাশ শেষ করেন তার উপন্যাস রচনা পর্ব।
১৯৩৩ এবং ১৯৪৮ পৃথক বছর হলেও তিনি উপন্যাস রচনার জন্য কোনো বছরকেই সম্পূর্ণরূপে ব্যবহার করেননি, করেছেন নির্দিষ্ট কিছু অংশ। তাই সেই স্বল্প কয়েক মাসের চেয়ে কিছুটা সময় বেশি নিয়ে তিনি উপন্যাস রচনা পর্ব শেষ করেন। ১৯৩৩ এবং ১৯৪৮ -এ দুটি বছরকে একত্রে করলে দেখা যাবে তিনি ব্যবহার করেননি সম্পূর্ণ একটি বছরকে। যে, বছরের সম্পূর্ণ সময়টি বেঁছে নিয়েছেন উপন্যাস রচনার জন্য।
কারো মতে, টমাস ম্যানের উপন্যাস ছিল জীবনানন্দের প্রিয়। তিনি শুধু টমাসের উপন্যাসই পড়েননি, পড়েছেন আরো অনেকের। কিন্তু পছন্দের তালিকায় তুলে নেন টমাস ম্যানকে। এদের লেখাগুলো পড়ামাত্র তিনি বুঝতে থাকেন তাঁকে হতে হবে কথাসাহিত্যিক। এছাড়া মনে মনে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করেন তাদেরকে যাঁদের লেখাগুলো পড়ামাত্র এ রকম একটা ইচ্ছা নিজের মনের ভিতর তীব্রভাবে দানা বাঁধতে থাকে।
১৯৫০-এ ‘আজকের বাংলা উপন্যাস’ নিয়ে একটি প্রবন্ধ রচনা করেন। নিজের অর্থকষ্ট কাটাতে স্বয়ং ছদ্মনামে উপন্যাস লেখার প্রস্তাব করেছেন সঞ্জয় ভট্টচার্যকে। তাহ’লে কী বলা যায, ঔপন্যাসিক হওয়ার চেয়ে ব্যক্তিগত অর্থকষ্ট সারানোর জন্যই তিনি উপন্যাস লেখার প্রতি এতো তাড়াবোধ করেছেন? আর তা-ই যদি করেন তাহ’লে এতোকাল পরে কেন তা প্রকাশ হল সেই দিকটাও বিবেচ্য বিষয়। জীবনানন্দ তখনও পঞ্চাশ ছোঁননি, তখন তিনি শেষ ক’রে উঠেন উপন্যাস রচনার পর্বটি। একদিকে দেশকে দ্বি-খন্ডিত করা। অপরদিকে ক্লান্ত-শ্রান্ত এক কবি, একের পর এক রচনা ক’রে চলেছেন নিজের ব্যক্তিগত দুঃখ-যন্ত্রণার বহিঃপ্রকাশ। ‘বনলতা সেন’; ‘অরুনিমা’, ‘সান্যাল’, ‘সুদর্শনা’, ‘শ্যামলী’, ‘শঙ্খমালা’, ‘সুরজ্জনা’, ‘সবিতা’, এবং ‘সুচেতনা’ ইত্যাদি নামগুলোর উপর এক ধরনের আকর্ষণ জন্মেছে কবির।
তাই বলে তিনি এই নামগুলো পূর্ণবার ব্যবহার ক’রে নাম রাখেননি উপন্যাসের। বেঁছে নিয়েছেন আবার নতুন কোন নাম যা কবিকে পূর্বের ন্যায় মুগ্ধ করে। এ দিক থেকে দেখে বলতে হয় তিনি নতুন সৃষ্টির স্বাদ গ্রহণ করেন নিজের মতো করে। পূর্ণবার বা একাধিক বার নাম ব্যবহার করা থেকে তিনি থাকেন বিরত। ‘ডালিম’, ‘পঁচা শসা’, ‘সবুজ মাঠ’, ‘নক্ষত্রের রাত’, ‘পেঁচা’ ‘নিশীথের বাতাস’, ‘পুরনো চালতা’, ‘সুপুরির সারি’, ‘সোনালি চিল,’ ‘ধানক্ষেত’, ‘নীলাকাশ’, ‘কুয়াশার সাধ’ ইত্যাদি শব্দগুলো যখন ব্যবহার ক’রে কবিতাকে করেছেন স্নিগ্ধ মোহিত। সেই কবি, আবার যখন রচনা করেন অন্য কোনো লেখা, তখন কী অনুপস্থিত থেকে যাবে ওই শব্দগুলো। যে শব্দগুলো শুধুমাত্র তাঁর নিজস্বতা প্রকাশ করে। উপন্যাসে সম্পূর্ণ বা সবগুলো শব্দ একবারে ব্যবহার না হ’য়ে তা হয়েছে বিভিন্নভাবে। ‘কুয়াশাচ্ছন্ন শীতের রাত’ এ রকম শব্দগুচ্ছ বার বার ব্যবহার করা হয়েছে বিভিন্ন উপন্যাসে। ‘ব্যর্থহৃদয়’ বা ‘তুমিহীন রাত’ ইত্যাদি বাক্যগুলো তিনি ব্যবহার করেছেন কবিতার মতো করে।
‘মাল্যবান’ উপন্যাসে জীবনানন্দ দাশ যখন বলেন:
‘রাস্তা দিয়ে কাহার মাহাভোরা একটা সড়া নিয়ে যাচ্ছে। কার যেন প্রাইভেট মোটর মাল্যবানদের বাড়ির কাছেই এসে বসল-গাড়িটা কী রকম বিগড়ে গেছে যেন, দু-চারজন মিস্ত্রি সেটা মেরামতের চেষ্টায় আছে, মবিল অয়েলের গন্ধ মাল্যবানের নাকে ঢুকল, মন্দ লাগল না তার, একটা ষাঁড় ফুট পথ দিয়ে যেতে যেতে ঘঁড় ঘড়ম করে উঠল এবার, সামনেই কাদের যেন দোতলার থেকে একটা বড় অষ্পষ্ট কান্না ও ঝগড়ার শব্দ শোনা যাচ্ছে, মাল্যবানের ঘরের পাশেই ড্রেনের কাছে একটা নেড়ি কুকুর ঘুর-ঘুর করে রাবিশের ভেতর থাবা নথ চালিয়ে বালি-ঘড়ির বাজনা বাজিয়ে চলেছে যেন অনেকক্ষণ থেকে, কী চায় সে? কী পাবে? খানিকটা দূরে একটা বাড়ির ভেতরে মহলে হয়ত কলতলায়, ভাঁড়ার ঘরে গুদোমে দুটো বেড়াল মরিয়া হয়ে ঝগড়া করছে অনেকক্ষণ ধরে, তাদের একটি এর একটি মাদি নিশ্চয়ই; এই শীত রাতে এই আশ্চর্য শীতে নিদারুণ কপট ঝগড়ার আড়ালে হুলো আর মেনির এই অত্যদ্ভূত রক্তোচ্ছাস কাম নিয়ে জীবনের যৌন ঋতুর, যৌন আগুনের এই প্রানান্তর দৌরাত্ব্যে-মাল্যবান দাঁত ফাঁক করে ভাবছিল, বেড়ালেরা ঝুটোপুটি কান্নকাটি করে, বেশি বয়সে বিয়ে করেছিল একজন সাদা দাড়িওালা বুড়ো প্রফেসরকে ঠিক এই রকমই করতে দেখেছিল মাল্যবান প্রায় বছর সাতেক আগে-সন্ধ্যারাতেই; গলা খাকারি না দিয়ে প্রফেসরমশাই এর ঘরে রবার সোল জুতো পায়ে ঢুকে পড়ছিল মাল্যবান, কিন্তু এ রকম মই মারণ হই মারণ ব্যাপার যে হবে তা তো ধারণা করতে পারেনি সে; কিন্তু সেই থেকে উপলব্ধি করছে মাল্যবান যে সমস্ত ইতর প্রাণীকে বিশ্লেষণ করে যে-মহৎসংশ্লেষে উপস্থিত হওয়া যায় তারই আশ্চর্য সন্তাপ, উচ্ছ্বাস ও পুঙ্খানুপঙ্খ ইতরতাকে তাড়িয়ে জ্বালিয়ে নাচিয়েই মানুষ তো হয়েছে ‘মানুষ।’
তাঁর উপন্যাসে মর্মেমর্মে কবিতারই প্রকাশ রয়েছে। রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে বুদ্ধদেব বলেছিলেন: ‘রবীন্দ্রনাথ ওই উপন্যাসগুলো পড়ার পর বুঝা যায় এর মধ্যে বড় কবির ষ্পষ্ট ছাপ রয়েছে বা কেউ যদি কবিতা না পড়ে শুধু ওই উপন্যাসগুলো পড়ে তাহ’লে তাদের বুঝে নিতে কষ্ট হবে না যে এখানে কোনো বড় কবির উপস্থিতি রয়েছে’। এ সত্যটুকু আমি মনে করি জীবনানন্দের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। জীবনানন্দে এই স্থানে এসে আমার বার বার মনে পড়তে থাকে কয়েকটি কবিতার পঙ্ক্তি: ‘ঘুম চোখ চায় না জড়াতে,-/বসন্তের রাতে? বিছানায় শুয়ে আছি;/ এখন সে কত রাত!/ওই দিকে শোনা যায় সমুদ্রের স্বর/স্কাইলাইট মাথার উপর,/ আকাশের পাখিরা কথা কয় পরষ্পর/ তারপর চ’লে যায় কোথায় আকাশে?/ তাদের ডানার ঘ্রাণ চারিদিকে ভাসে। আগুন বাতাস জল ঃ আদিম দেবতারা তাদের সর্পিল পরিহাসে/তোমাকে দিলো রূপ/কী ভয়াবহ নির্জনরূপ তোমাকে দিলো তারা;/ তোমার সংস্পর্শের মানুষদের রক্তে দিলো মাছির মতো কামনা বা হাইড্র্যান্ট খুলে দিয়ে কুষ্ঠরোগী চেটে নেয় জল,/ অথবা সে হাইড্যান্ট হয়তো বা গিয়েছিলেন ফেঁসে।/ এখন দুপুর রাত নগরীতে দল বেঁধে নামে।/ একটি মোটরকার গাড়লের মতো গেল কেশে/অস্থির পেট্রল ঝেড়ে-সতত সর্তক থেকে তবু/কেউ যেন ভয়াবহ পড়ে গেছে জলে।/ তিনটি রিক্শ ছুটে মিশে গেল শেষ গ্যাস ল্যাম্পে মায়াবীর মতো জাদু বলে।’ যখন আবার পড়তে থাকি তখন পাওয়া যাবে ‘জলপাই হাটি’তে ‘শ্যামলী’ নামটি। এ নামটির সাথে আমরা পূর্বেই পরিচিত, বা ‘শ্যামলী, তোমার মুখ সেকালের শান্তির মতন;/ যখন জাহাজ চড়ে যুবকের দল/সুদূর নতুন দেশে সোনা আছে বলে,/মহিলারি প্রতিভার সে ধাতু উজ্জ্বল/টের পেয়ে দ্রাক্ষা দুধ ময়ূরশয্যার কথা ভুলে/সকালের রূঢ় রৌদ্রে ডুবে যেত কোথায় অকূলে। এই পঙ্ক্তিগুলো অপরিচিত নয় বা এই শ্যামলী থেকে ‘জলপাই হাটি’ শ্যামলীর মধ্যে পাওয়া যাবে না বড়ো কোনো ব্যবধান।
‘প্রেতিনীর রূপকথাতে’ আবার যখন দেখতে পাই:
“একদিন কলকাতা থেকে এ ষ্টেশনে সন্ধ্যার সময় একা একা এসে পৌঁছেছি সেই কেরোসিনের মশালগুলো ধূ ধূ করে জ্বলে গেছে; কিন্তু এদের পাশের সেই তন্দ্রাচ্ছন্ন নারী মূর্তিটিকে খুঁজে পাইনি আমি আর। মশালগুলোর দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে হৃদয় ধুম্রকালিমায় নিহত সূর্যের মত নিস্তব্ধ হয়ে রয়েছে; ঘন অন্ধকার মাখা অলৌকিক অরণ্যের ভিতর যার হাতির দাতের মত হলুদ ম্লান মুখখানেক সবচেয়ে মানতে থাকে এই বাংলার মাঠের কাঁচপোকা অন্ধকার ও জোনাকির ভিতর থেকে কোন এক যুগ জন্মে কুড়িয়ে নিয়ে বিধাতা আবার এক নদী মাঠের দেশেই ফিরিয়ে দিয়েছিল, এই অশ্বত্থ, বট, জাম, বকুলে, কাল মুকুলে, মাথা বাংলার বুকের থেকে যুগে যুগে যে জন্ম নেবে, যার গায়ে রূপশালি ধান ও চালতা ফুলের গন্ধ ছড়িয়ে থাকবে চিরকাল সে আজ কোথায় চলে গেল?”
এই চলে যাওয়া
জীবনানন্দের কাছে নতুন কিছু নয়। তাঁরা কবির কাছে এসেছে কবির বিদায়ের পূর্বেই বিদায় নিয়েছে দূর থেকে বহু দূরে। তাঁদের সাথে এর পর আর কবির দেখা হয়নি। তাদের এই বিদায়ের সাথে কবি আহতও ব্যথিত হয়েছেন বহুবার। এই চলে যাওয়ায় সাথে মনে করতে পারি। পঁচিশ বছর পরে’, ‘১৩৩৩’; ‘তুমি কেন বহু দূরে’, ‘কোনো দিনে দেখিব না’, ‘কুড়ি বছর পরে’, ‘সুদর্শন, ‘সুরঞ্জনা’, ‘অঘ্রাণ’, ‘প্রান্তরে’, ‘জনান্তিকে’,-এ রকম আরো অনেক কবিতা যার মধ্যে আছে চলে যাওয়া। ‘রূপাশালি ধান’ ও চালতা ফুলের’ গন্ধ নতুন ক’রে আর কোন ঘ্রান নেয় না আমাদের নাক। জীবনানন্দ এ রকম আরো অনেক শব্দগুচ্ছ ব্যবহার করেছেন তাঁর প্রায় সমস্ত কাব্য জুঁড়ে। বিশেষ ক’রে ‘রূপসী বাংলা’র কথাই মনে পড়ে। জীবনানন্দ দাশ, ‘জলপাই হাটি’ রচনা করেন ১৯৪৮-এ। যে সময়টাতে বসে তিনি ঐ উপন্যসাটি লিখে চলছেন সে সময়টার বাহ্যিক পরিবেশ বেশ স্থির ছিলনা। বিশেষ ক’রে...দেশ দ্বি-খন্ডিত করার কথা মনে করিয়ে দিতে চাই, যা জীবনানন্দ দাশের উপন্যাসের বাইরে থাকেনি ঃ
ক. ‘মহামানুষরা থেকে থেকে দেশটা চালাতে চাচ্ছে বটে, কিন্তু ধাড়ি মনিবরাই তো চালাচ্ছে আজকাল। এদের, এদের সাঙ্গ পাঙ্গদের সুবিধাবাদে, শিল্পদর পনার চূড়ান্ত দেশের স্বাধীনতার কোনো মানেই খুঁজে পাওয়া গেল না আজ পর্যন্ত। ব্রিটিশ ভারতের অধীনতা -স্বাধীনতার পলিটিকস্ উড়িয়ে দিয়ে আমাদের জড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে, তান্ত্রিক ডাইনির হাতে বানানো গাছের মত এমনই এক জায়গায় যেখানে শিকড় নেই, দেশ নেই নেতাদের শক্তি নেই, পলিটিকস নেই, কিছু নেই, সমস্ত পৃথিবী সমস্ত পৃথিবীকে গিলছে শুধু। অন্ধকার অন্ধকারকে খাচ্ছে-।(জলপাই হাটি : ১৯৪৮)
আবার একই উপন্যাসে দেখতে পাই :
খ. আজকাল কেউই আর দেশের, ঠিক বলতে গেলে মানুষের, খাঁটি স্বাধীনতা ও শান্তির জন্য নতুন করে স্বার্থত্যাগ করতে প্রস্তুত নয়, অনেকেরই মনের ভাব এই যে, স্বাধীনতা পাওয়া হয়ে গেছে, আবার কী, এবার সকলেই সবচেয়ে আগে যে যাকে পারে, পায়ে মাড়িয়ে মুখে রক্ততুলে, ছুটে আস্বাদ করবে, উপভোগ করবে চারদিককার ঘাতঘুতরোর ভেতর অফুরন্ত ভালুকের মত। কিন্তু সেটা কি কোনো ভাল রাষ্ট্র ব্যবস্থা হল? কিন্তু এও তো হচ্ছে না। আমাদের দেশে, আমেরিকায়, হয় তো এ রকম, কিন্তু পৃথিবীর প্রায় অন্য কোনো জায়গায়ই এটুকু মজা লুটবারও অবসর নেই। বিশৃঙ্খল প্রতুলতায় মরছে না তারা, উচ্ছৃঙ্খল অন্যাভাবে নিক্ষেপ হয়ে যাচ্ছে।
(জলপাই হাটি : ১৯৪৮)
এরকম আরো হয়তো অনেক পাওয়া যাবে। তাই আর বেশী তু’লে দেওয়ার চেষ্টা করলাম না। জীবনানন্দ দাশের উপন্যাসের আরেকটি দিক না তুলে আমার মন স্থির হচ্ছে না। উল্লেখ্য যে, ব্যক্তিগতজীবনের অধ্যাপনার ছাপ এসেছে অনেক উপন্যাসে। প্রায়ই উপন্যাসের দিকে দৃষ্টি দিলে এ দিকটির দেখা পাই। উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র যাকে নির্ভর করে গ’ড়ে উঠে সে হয়তো একজন তরুণ অধ্যাপক। তাহ’লে কী বলতে পারি না যে, কবি নিজেই উপস্থিত হচ্ছেন বার বার। কবি বা কবিতা নিয়ে আলোচনা বা তাদের প্রিয় কোন কাব্যর নাম এসেছে বারবার। আমার এখন মনে পড়ছে ‘লুক্রেশিয়াসের’ কথা। যাঁর কবিতার জন্য, বার বার ব্যর্থ হয় প্রধান চরিত্রটি। ঐ দিক দিয়ে আমি বুদ্ধদেব বসুর সাথে জীবনানন্দের বেশ সাদৃশ্য দেখতে পাই। যদিও ব্যক্তিগত জীবনে দু’জনেই অধ্যাপনায় নিয়োজিত ছিলেন। তাই হয়তো বার বার ফিরে এসেছে পেশাটি।
যে অধ্যাপনায় নিয়োজিত ছিলেন বুদ্ধদেব বসু ও জীবনানন্দ দাশ, চরিত্র নির্মাণের রূপটি হ’য়ে ওঠে ব্যক্তিগত জীবনের প্রতিচ্ছবি।
জীবনানন্দ দাশের উপন্যাসে উঠে আসে মধ্যবিত্ত শ্রেণির জীবন-যাপন-কামনা-বাসনা আশা পূর্ণতা-এরকম আরো অনেক কিছু। এ উপন্যাসগুলো শুধু জীবনানন্দকে আরো ব্যাপকভাবে পরিচিত করেনি, করেছে পৃথক কিছু সৃষ্টির আস্বাদ। ব্যর্থ কবি যখন মৃত্যুযন্ত্রণায় কাতরতা বোধ করতে থাকেন তখন তাঁর গদ্যের ভাষা কী রকমভাবে প্রকাশ পেল তা-ই দৃষ্টিতে ফিরে আসে; এবং ফিরে তাঁকাই। একজন নিকটতম কবি ব’লে খ্যাত জীবনানন্দ দাশের দিকে। যাঁর ভাব ও ভাষা কবিতা থেকে কিভাবে রূপান্তর ঘটে কথাসাহিত্যের দিকে।