বুদ্ধদেব বসু (১৯০৮-১৯৭৪), বাঙলা সাহিত্যের অন্যতম সাহিত্যিক। সাহিত্যের সকল দিকেই তিনি বিচরণ করেছেন। বাদ দেননি; বাঙলা সাহিত্যের এমন কোন স্থান নেই বললেই চলে। কিন্তু কবিতার প্রতিই তাঁর অনুরাগ বেশী। ‘যে আধার আলোর অধিক’ তাঁর অন্যতম একটি কাব্য। বুদ্ধদেব বসুর এ-কাব্যটি; অন্যান্য অনেক কাব্য থেকে, দেখা দেয় স্বতন্ত্র হ’য়ে। যার রচনাকাল হিশেবে পাওয়া যায় (১৯৫৪-১৯৫৮)। দীর্ঘ এই পাঁচ বছরে; তিনি রচনা করেন এ-কাব্যটি। পঞ্চান্নটি কবিতা নিয়ে ১৯৫৮-এর মে-তে; প্রথম প্রকাশিত হয় ‘যে আধার আলোর অধিক’ কাব্যগ্রন্থটি। বুদ্ধদেব বসুর অন্যান্য কাব্য থেকে; সম্পূর্ণ পৃথক হ’য়ে দেখা দেয় এ-কাব্যটি। কারণ হিশেবে পাওয়া যায়, বুদ্ধদেব বসুর পরিপূর্ণ বয়সেই এটি কাব্য হিশেবে আত্মপ্রকাশ পায়। তাই অন্যান্য কাব্যের কবিতা থেকে; অনেক বেশী গভীরতা রয়েছে এ-কাব্যের কবিতাগুলোর মধ্যে। যে প্রেমের উৎস প্রসারিত হয়েছিল ‘বন্দীর বন্দনা’ থেকে ‘শীতের প্রার্থনাঃ বসন্তের উত্তর’ পর্যন্ত। তার অনেকটা ধীর-স্থিতি ভাব দেখতে পাই এ-কাব্য পর্যন্ত। কাব্যটি, দ্বিতীয়বার মুদ্রিত হয়, ঠিক আট বছর পর ১৯৬৬-এর মে’তে। দ্বিতীয় সংস্করণে এসে বুদ্ধদেব বলেন, ‘এই বইয়ের দ্বিতীয় সংস্করণে কোনো-কোনো কবিতায় দু-একটি শব্দ, বা পঙক্তির অংশ, বা যতি চিহ্ন পরিবর্তন করেছি। পঞ্চান্নটির মধ্যে বারোটি ছাড়া; এ-বইয়ের বাকি সব কবিতাই সনেট বা সনেটধর্মী, যদিও পঙক্তি সংখ্যা একটি কবিতায় তের, এবং কয়েকটিতে ষোল। শিল্প ভাবনাবোধ ও সৌন্দর্য চর্চার বহিঃপ্রকাশ যথেষ্ট পরিমাণে রয়েছে ‘যে আধার আলোর অধিক’ গ্রন্থটিতে। জীবনের শেষ বিশ বছরে লেখা; বুদ্ধদেব বসুর কবিতাগুলি, ১৯৫৪ সালের আগে লেখা কবিতার তুলনায় উল্লেখযোগ্য পরিমাণে দুরূহ। শুধুমাত্র ‘একদিন চিরদিন’ গ্রন্থের কবিতাগুলি, বোধ করি গদ্য কবিতার বিস্তার আছে ব’লেই, অনেকটা সহজবোধ্য। মৃত্যুর একবছর আগে রচিত ‘কবিতা ও আমার জীবন’ নামের প্রবন্ধে ‘যে আধার আলোর অধিক’ গ্রন্থটি সম্পর্কে বুদ্ধদেব বসু বলেন, ‘বইটি আমার জীবনের এক সন্ধিলগ্নে দাঁড়িয়ে আছে। এর মধ্যে দিয়ে একটা সংকট আমি কাটিয়ে উঠেছিলাম, এবং তার দ্বার লব্ধ অভিজ্ঞতা আমার পরবর্তী সব কাব্যরচনায় কাজে লেগেছে-সেগুলি আকারে-প্রকারে যতই ভিন্ন হোক।’ একাধিক ভাবনার বিষয়বস্তু ও ভাবনাবোধের সংমিশ্রণ আমরা দেখতে পাব ‘যে আধার আলোর অধিক’ গ্রন্থটিতে। এ-গ্রন্থ সম্পর্কে ‘কবিতা’ পত্রিকায় [২৩শ বর্ষ,৩য় সংখ্যায়] রমেন্দ্রকুমার আচার্য চৌধুরী একটি দীর্ঘ প্রবন্ধ লেখেন। সেখানে প্রধান বিষয় হিশেবে যা উল্লেখ্য থাকে, তা অনেকটা এ-রকমঃ

[ক] ‘বইটিতে প্রেমের কবিতা আছে কয়েকটি, কিন্তু বেশিরভাগ কবিতা শিল্পের সমস্যা, লক্ষ্য ও বিশেষ করে নিগুঢ় প্রতিক্রিয়া সম্বন্ধে। আমাদের অবচেতন ও নিজ্ঞার্ন মনে যে অক্ষয় স্মৃতির ঐশ্বর্য সঞ্চিত-সেই অন্ধকারের মধ্যে প্রবেশ করে বুদ্ধদেব শিল্পের প্রতিক্রিয়া ও উৎসকে বুঝতে চেয়েছেন এবং সেই সঙ্গে নিজের সম্ভাবনাকে উপলব্ধি করতে।’

[খ]  ‘বুদ্ধদেব বসুর মতে পরোপকার, কোনো কর্মপঞ্জির অনুসরণ বা জনগণের উম্মাদন শিল্পকর্মের উদ্দেশ্য নয়। পরোৎকর্ষে পৌছনো একটি নিটোল আপেলের মতো ফলে ওঠাই শিল্পীর একমাত্র সাধনা।’  

[গ]  ‘মহাভারতের কাহিনীর রূপান্তররণে বুদ্ধদেব বসুর স্বাতন্ত্র্য এবং শিল্প সম্বন্ধে বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গিই সূপ্রকট। রবীন্দ্রনাথ পৌরাণিক উপাখ্যানের ব্যবহার করেছেন সাধারণত নৈতিক কোনো উদ্দেশ্যে, বুদ্ধদেব শিল্পতত্ত্বের রূপক হিশেবে অথবা অনৈতিক কোনো মানবিক সত্যকে রূপ দেবার জন্য।’  

[ঘ]  ‘অধিকাংশ কবিতায় বুদ্ধদেব  এক কঠোর আত্মনিয়ন্ত্রণের অধীন। বস্তুত, ভাষা ও আবেগের উপর ক্রমিক আত্মকর্তিত্ব স্থাপনই তাঁর কাব্য জীবনের ইতিহাস, এবং এই সূত্রেই বুদ্ধদেব বসুর চরিত্রের পরিমাপ সম্ভাব। সনেটের ক্ষুদ্র পরিধির মধ্যে কবিতাগুলি একটা ঘনত্ব ও বিস্তার লাভ করেছে।’  

[ঙ]  ‘এ-বইয়ের প্রধান সুর নির্বেদের; শান্তমনে সব কিছু  মেনে নিয়ে শিল্পকর্মে ডুবে যাবার, বেদনাকে গানে রূপান্তরিত  করবার সাধনাই, কবির পক্ষে, একমাত্র উদ্ধার।’    

এ-কাব্য গ্রন্থের শুরুতেই আমরা পাব ‘স্মৃতির প্রতি’ শিরোনামের বেশ কিছু কবিতা। ১৯৫৫-এর মে’র কোন এক সন্ধ্যা ও রাতেই একই দিনে রচিত হয় কবিতাগুলো। মে’র থেকে যদি এর সূচনা ধরা হয় তাহলে সামনে পাব আরও অনেক মৌলিক কবিতা। ‘সমুদ্রের প্রতি’ ও ‘আবির্ভাব’  কবিতা দু’টি লেখা হয় জুলাইতে, ১৯৫৪। এর পরের মাসে রচিত আর কোন কবিতা আমরা দেখতে পাই না। ঠিক সেপ্টেম্বরে পাব ‘সমর্পণ’ ও ‘যাওয়া-আসা’ শিরোনামের দু’টি কবিতা। একই ভাবে এই কবিতাগুলো লেখা হয় ১৯৫৪-তে। ‘বহুমুখী প্রতিভা’ , ‘শিল্পীর উত্তর’  ও ‘কবি’  শিরোনামের কবিতা দু’টি পাব নভেম্বর ও ডিসেম্বর-১৯৫৪। ১৯৫৫-এর জানুয়ারিতে রচিত দু’টি কবিতা পাব এখানে। এই কাব্যের প্রথম দশটি কবিতা যদি নির্বাচন করি, আমরা কিন্তু নির্দিষ্ট করে বলতে পারবো না একই সময়ে লেখা হয়েছে এই কবিতাগুলো। ১৯৫৪-১৯৫৫’এর সমন্বয় রয়েছে কবিতাগুলো মধ্যে। ‘দায়িত্বের ভার’ শিরোনামের কবিতা পাব ১৯৫৪- ডিসেম্বরে রচিত। কবিতাটি একটু পড়া যাকঃ


‘কিছুই সহজ নয়, কিছুই সহজ নয় আর।
লেখা, পড়া প্রুফ পড়া, চিঠি লেখা, কথোপকথন,
যা- কিছু ভুলিয়ে রাখে, আপাতত, প্রত্যহের ভার-
সব যেন, বৃহদরণ্যের মতো তর্কপরায়ণ
হ’য়ে আছে বিকল্প কুটিল এক চতুর পাহাড়।
          
জাগতিক কোন কিছুই যেন আর সহজ হয়ে আমাদের মাঝে দেখা দিচ্ছে না; তার উচ্চারণ রয়েছে কবিতাটিতে। এই ভাবনা বোধ যে কবির একা তা বলা যাবে না। এটা কখনো আমাদের বাস্তব জীবনের রূপ নিয়েও দেখা দিতে পারে। এই গভীর উপলব্ধি থেকে আমরাও যেন একই সাথে বলে উঠি ‘কিছুই সহজ নয়, কিছুই সহয় নয় আর’। তাই এই ব্যক্ত বাণী ও একাকার হ’য়ে উ’ঠে আমাদের জীবনেও। তাই, একটা সময় এসে আমরা যেন আর বলতে পারি না, এটা একক কোন কবির বাণী হয়ে উঠে। যে বাণীর উপলব্ধি রয়েছে আমাদের জীবনেও। ১৯৫৫-তে, লেখা হয় ‘নির্বাসন’ কবিতাটি। কবিতাটিতে নির্বাসনের কোন চিহ্ন আমাদের চোখে পড়ে না। তার পর ও সে যেন এগিয়ে যায় নির্বাসনের ভার নিয়ে। কবিতাটি একটু পড়া যাকঃ

‘তোমার নরম হাত কিছুতেই চারটে পারি না
এত ছোটো, এমন দূরত্বে ভরা, অথচ কেমনে
ছড়ায় ফুলের রেণু, স্পর্শময়, এই নির্বাসনে,
ব’য়ে  যায় তৃষ্ণার পাথর ফেটে আঁধার ঝরনা-
অরণ্যে, হারিয়ে পথ, চোখে যাকে দ্যাখে না পথিক,
কানে শোনে প্লাবন, চুম্বন, অবিরাম। বুঝিনি এমন হবে
বিরাট পরিশ্রম শেষ হ’লে। বহুকষ্টে। গতানুগতিক
গ্রামের আমের বন পার হ’য়, হিমেল গৌরবে।’    

আমরা কী বলতে পারি না; ভালো কবিতামাত্রই, অন্ততপক্ষে প্রাথমিকস্তরে, যেখানে রয়েছে অনুভূতিস্পর্শ ও আবেগগ্রাহ্য। যার স্পষ্ট চিহ্ন আমরা দেখতে পাবো ‘যে আঁধার  আলোর অধিক’ কাব্যেতে। এমন অনেক বিষয়বস্তু ও থীমের ব্যাপক উপস্থিতি প্রসঙ্গে আমরা বলতে পারি; যা একই সঙ্গে রয়েছে ‘যে আঁধার আলোর অধিক’ ও তার পার্শ্ববর্তী অন্যকোন কাব্যগ্রন্থে। একটু চোখ রাখা যাক কবিতা দু’টিতেঃ

[ক]  ‘আমার বিশ্বের জন্ম তোমার লীলায়,
তোমারই চকিত স্পর্শে কেঁপে ওঠে কল্পনার শ্রোণি,
কবিতার জন্ম হয়,
আমার হৃদয়
পূর্ণ করে তুমি আজ এলে বৃষ্টি ঝরা রাত্রিতে পা ফেলে
ঝংকারে, নিক্বণে,
অচেতন মনোবনে পতঙ্গগুঞ্জনে,
পাখির অশান্ত কাকলিতে,
সব-শেষে ভাষাতীত বিশাল নিভৃতে-
যে শূন্যে কিছুই নেই, শুধু এই নৃত্যবেগে উন্মত্ত সৃষ্টির
স্তব্ধ কেন্দ্রে তুমি আছো স্থির।’  
                               [দময়ন্তী-১৯৪৩ ‘ছন্দ’]    

প্রায় একই বিষয়ে দেখতে পাবো ‘যে আঁধার আলোর অধিকে’র একটি কবিতাতেঃ  

[খ]  ‘দেবতা, নিজ্ঞার্ন মন, না কি এক চতুর শয়তান ?
তার মুখে অনন্ত রাত্রির মায়া। তাই সে করুণা ক’রে
পাঠিয়েছে প্রতিভূ, প্রবক্তা, দূত-ছন্দ, মিল, ধ্বনির ইশারা,
নিরঞ্জন গণিত, আবহমান নিরুক্তের অমোঘ বিধান-
যার পূত শাসনে সঞ্চিত জল, নর্দমার স্বেচ্ছায় না-ঝ’রে
হ’য়ে ওঠে অধীন, উদ্দেশ্যয়, উজ্জ্বল ফোয়ারা।’  
                   [যে আঁধার আলোর অধিক-১৯৫৮ ‘মিল ও ছন্দ’]

প্রথম কবিতাটিতে একটু চোখ রাখলে দেখতে পাবো, ‘ছন্দ’কে তুলনা করা হয়েছে কোনো নটী বা নৃত্যপরা প্রণয়িনীর সঙ্গে, যার সৌন্দর্য ছড়াচ্ছে দিকে-দিকে, পায়ে যার নূপুর, বৃষ্টি-ঝরা রাত্রিতে যার ঝংকৃত অভিসার। শুধুমাত্র  তাই নয়, এই নারীরূপিণীর অমোঘ আবেদন আমাদের হৃদয়ের কাছে এসে যেন বলে যায়, ‘আমার হৃদয় পূর্ণ ক’রে আজ এলে’। ‘দময়ন্তী’ কবিতাটির প্রতি চোখ দিলে আমরা দেখতে পাব; যার প্রায় আঠারো বছর পড়ে যখন ‘ছন্দ’কে আবার সরাসরি কবিতার বিষয়বস্তু করা হলো, তখন সে আর সেই পূর্বের রূপ নিয়ে ফিরে আসে না কবিতাতে। তাই কবিতাটিতে দেখা দেয় আবেগ থেকেও নৈব্যত্তিক ভাবনাবোধের চিত্রায়ন। তাই একই ধাঁচের এ-রকম আরও কয়েকটি কবিতার কথা বলা যেতে পারে, যেমন-‘কুকুর’,‘কোন কুকুরের প্রতি’, ‘এখন বিকেল’ আর ‘স্মৃতির প্রতিঃ ১’ ইত্যাদি।

১৯৪৪-এ, প্রকাশিত ‘রূপান্তর’-এ উৎসর্গ পত্রের কবিতাটিতে; পড়ে যা ‘েদ্রীপদীর শাড়ি’তে অন্তর্ভুক্ত করা হয়, এই ভাবনাবোধকে আমরা দেখতে পাব উত্তীর্ণ পর্যায়ের শিল্পে রূপান্তর হ’য়ে। একটি কথা পূর্বেই বলেছি; বুদ্ধদেব বসুর অন্যান্য কাব্যগ্রন্থ অনেক বেশী আবেগগ্রাহ্য ও উচ্ছ্বাসপ্রবণ। কিন্তু তার ব্যতিক্রম দেখতে পাব ‘যে আঁধার আলোর অধিক’ কাব্যগ্রন্থটিতে। মূলত, এখানে আমরা দেখতে পাব বুদ্ধিগ্রাহ্য ও ধারণা নির্ভরের সূক্ষ্ম ব্যবহার। এই কাব্য গ্রন্থটিতে; একটি জিনিস আমাদের সামনে স্পষ্ট হয়ে উঠে; আর তা হলো, এর বেশীর ভাগ কবিতাই একই ভাবধারার অন্তর্গত। যার ফলে প্রতিটি কবিতাই পরস্পরের পরিপূরক হয়ে দেখা দেয়। একটি কবিতায় যে উজ্জ্বল আলো জ্বলে উঠে; তারই সংস্পর্শে উদ্ভাসিত হয়ে ধরা দেয় পাশের কবিতাটি; যেন আপন সহোদর। এই প্রধান ভাবধারার সাথে সম্পর্ক রয়েছে ‘প্রকৃতি ও শিল্পের’ নিবিড় বন্ধনের। বুদ্ধদেব বসুর পূর্বের কবিতায় এই ভাবধারা যে একেবারে উপস্থিত ছিল না তা কিন্তু নয়; ১৯৪৮-এ, ‘েদ্রীপদীর শাড়ি’তে ‘মায়াবী টেবিল’ কবিতাটিতেই, প্রথম পঙক্তিতেই দেখতে পাব শিল্পবন্দনা।

‘তাহ’লে উজ্জলতর করো  দীপ, মায়াবী টেবিলে
সংকীর্ন আলোর চক্রে মগ্ন হও, যে আলোর বীজ
জন্ম দেয় সুন্দরীর, যার গান সমুদ্রের নীলে
কাঁপায়, জ্যোৎস্নায় যার ঝিলিমিলি স্বপ্নের শেমিজ
দিগ্বিজয়ী জাহাজেরে ভাঙে এনে পুরোনো পাথরে।’  

থাকে কবিতাটি। আবার দেখতে পাব ‘না লেখা কবিতার প্রতিঃ ১’, ‘না কিন্তু ঐ একই বই থেকে এমন অনেক উদাহরণ তুলে দেওয়া যায় যা এই শিল্পপ্রাণতার সম্পূর্ণ বিপরীত। পক্ষান্তরে;এক ধরণের শিল্পমনস্কতা, এবং আরও স্পষ্ট করে যদি বলি, শিল্প ও প্রকৃতির সম্পর্কজনিত ভাবধারাটি, ‘যে আঁধার আলোর অধিক’-এর প্রায় অধিকাংশ কবিতার প্রাণরস। শুধু তাই নয়; বুদ্ধদেব যে অপেক্ষাকৃত নতুনভাবে তাঁর শিল্প ও জীবন বিষয়ক অভিজ্ঞাতাকে অনুধাবন করেছেন; তা এই কাব্যগ্রন্থটি হাতে নিলেই স্পষ্ট বুঝা যায়। ‘যে আঁধার আলোর অধিক’ প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৫৮’র মে-মাসে। পূর্বের বছরের এপ্রিলে, ‘কঙ্কাবতী’র পরিবর্ধিত ‘নাভানা সংস্করণের’ ভূমিকায় বুদ্ধদেব বসু লিখেছিলেন, ‘যে সব স্থলে পরিবর্তন করেছি- যেমন ‘পৃথিবীর পথে’র কবিতাবলীতে, বা ‘কোনো বিদেশিনীর প্রতি’ বা ‘বিবাহ’ কবিতায়- সেখানেও আমার আজকের দিনের কোনো  অভিজ্ঞতাকে প্রবেশ করতে দিইনি।’ এই আজকের দিনের অভিজ্ঞতার অনুপ্রবেশ ঘটেছে ‘যে আঁধার আলোর অধিক’-এর অধিকাংশ কবিতায়। পঞ্চান্নটি কবিতা নিয়ে ১৯৫৮’তে ‘যে আঁধার আলোর অধিক’ প্রকাশিত হয় তখন বুদ্ধদেব বসুর বয়স পঞ্চাশ। নিশ্চয় বলা যেতে পারে; এখানে এসে কবিতা সম্পর্কে নতুন কোনো অভিজ্ঞতা বাদ রয়েছে বুদ্ধদেব বসুর। তারপরও, বলতে পারি অনেক পরিপক্ব হয়ে দেখা দেয় এই গ্রন্থটি। কবিতার বিভিন্ন নাম না রেখেও; একই শিরোনামের কবিতা হতে পারে একাধিক; যা স্পষ্ট ‘যে আঁধার আলোর অধিক’ কাব্যগ্রন্থটি। ‘স্মৃতির প্রতিঃ ১’,  ‘স্মৃতির প্রতিঃ ২’ এবং ‘স্মৃতির প্রতিঃ ৩’; এভাবে পাব তিনটি কবিতা। ‘কবি’ শিরোনামের পাওয়া যাবে দু’টি কবিতা। ‘রাত তিনটের সনেটঃ ১’ এবং ‘রাত তিনটের সনেটঃ ২’-এ নামে পাওয়া যাবে দু’টি কবিতা। এ-কাব্যতে রয়েছে ‘রবীন্দ্রনাথ’ শিরোনামের একটি কবিতা। যার রচনাকাল আমরা পাব ২১ এপ্রিল, ১৯৫৫। তিনি কবিতাটি শুরু করেন এভাবে, ‘ছিলে না বনের মৃগ, ঘাস, ফুল, মেঘের গহ্বরে/ রঙিন আলোর খেলা। এমনকি, বালক ছিলে না/ তিক্ষ্ম চোখ ঘিরে ছিলো সারাদিন/ হাতের খেলেনা/ ভারি হ’য়ে প’ড়ে গেছে হাত থেকে/ তবু ছিলে অবসরে ভ’রে। এভাবেই এগোতে লেখা কবিতার প্রতিঃ ২’, এবং ‘না লেখা কবিতার প্রতিঃ ৩’ শিরোনামের কিছু কবিতা। আবার দেখা দেয় ‘আটচল্লিশের শীতের জন্যঃ ১’, ‘আটচল্লিশের শীতের জন্যঃ ২’ এবং ‘আটচল্লিশের শীতের জন্যঃ ৩’ নামের তিনটি কবিতা। একই ভাবে তিনটি ক’রে কবিতা দেখতে পাব ‘দেবযানীর স্মরণে কচ’ নামে। ‘প্রেমিকের গান’ শিরোনামের পাব দু’টি কবিতা। একই শিরোনামের হলেও পৃথক হ’য়ে দেখা দেয় প্রত্যেকটি কবিতা; কিন্তু কবিতার মর্মে বিরাজ ক’রে একই সুর। যে সুর উৎসারিত হয় একই স্থান থেকে। তাহ’লে কী আমরা বলতে পারি; ‘যে আঁধার আলোর অধিক’ হ’লো অফুরন্ত, অসম্পূর্ণ, সম্ভাবনাপুঞ্জ আর সেই সাথে শিল্প দেখা দেয় অমোঘ, কৃত্রিম, অব্যর্থ রূপকার; যা ছড়িয়ে ছিটিয়ে সর্বত্র পড়ে থাকে; এবং দেখা দিতে পারে রূপান্তরিত শিল্পে; এবং এই দিক থেকে শিল্প শুধু প্রকৃতি থেকে স্বতন্ত্র নয়; গুনগতভাবে উৎকৃষ্টও বটে। আমরা যদি একটু লক্ষ্য করি তাহলে দেখতে পাব, ‘বোদলেয়ার, তাঁর কবিতায়; নগ্নিকার অঙ্গেও অন্তত একটি অলঙ্কার পরিয়ে দিতেন, কেননা অলঙ্কার কৃত্রিম ও নির্মিতঃ শিল্পের প্রতীক। টমাস ম্যান প্রায় অঙ্কের মতো ভাগ করেছিলেন প্রকৃতি ও শিল্পের সম্পর্ক। ‘নেশা’ শিরোনামের রয়েছে একটি কবিতা। যার রচনাকাল পাওয়া যায় ১২ জুন, ১৯৫৫। বোদলেয়ারের সেই বাণী যেন আবার দেখা দিল এখানে। উচ্চারণ করলেন তিনি, ‘মাতাল, মাতাল হও- বোদলেয়ার দিলেন বিধান-/ অবিরাম পেন্ডুলামে যে তোমার উপাংশুঘাতক, /সেই ক্রুর কালের চতুরতর হও কালান্তক;-/পুণ্য, প্রেম, মদিরা কবিতা তার প্রখ্যাত নিধান।’ এ বিধান চিরতর হ’য়ে দেখা দিবে বাঙলা কবিতায়; যেখানে শুধু কবিতা নয়, অভ্যন্তরে থাকবে কবি। এ-কাব্যের শেষে পাওয়া যাবে ‘পঞ্চাশের প্রান্তে’ নামে একটি কবিতা। খুব বেশী মূল্যবান হ’য়ে দেখা দেয় না কবিতাটি। এর চেয়েও অনেক গভীর কবিতা রয়েছে এ কাব্যতেই। সৌন্দর্য ও তাৎপর্যের দিক থেকে অনেক দূরে রয়েছে এ কবিতাটি।  
বইটি আলোচনা করে ‘কলকাতা’ পত্রিকায় ৭-৮ যুগ্ম সংকলনে (১৯৬৮) প্রণবেন্দু দাশগুপ্ত বলেছিলেন যে, বুদ্ধদেব বসুর কবিতায় পূর্বে যে সব থিম ও বিষয় ছিল অনেক বেশী আবেগগ্রাহ্য ও উচ্ছ্বাসপ্রবণ, সেগুলি এ বইয়ের কবিতায় মূলত বুদ্ধিগ্রাহ্য ও ধরনানির্ভর। আরও কিছু দরকারি এবং কবিতাগুলিতে প্রবেশের পক্ষে সহায়ক তাঁর অন্যান্য মন্তব্যের মধ্যে ছিলঃ  

       [ক]  ‘প্রায় প্রতিটি কবিতাই পরস্পরের পরিপূরক- একটি কবিতায় যে আলো জ্বলে ওঠে তারই সংস্পর্শে উদ্ভাসিত হয়
            পাশের কবিতাটি।’

       [খ]  ‘এক ধরণের শিল্পমনস্কতা , এবং শিল্প ও প্রকৃতির সম্পর্ক জনিত থিমটি এর প্রায় অধিকাংশ কবিতার প্রাণরস।’
      
       [গ]  ‘রিলকে-র ‘অর্ফুসের প্রতি সনেটগুচ্ছ’-এর সঙ্গে ‘যে আধার আলোর অধিক’-এর আত্মিক সাদৃশ্য চোখে পড়ে কখনো-কখনো-‘রূপান্তর’ থিমটির সূত্রে বিশেষত। শিল্প ও জীবন সম্পর্কে বোদলেয়ার, রিলকে, এবং মান একই সত্যকে বিভিন্ন দিক থেকে আলোকিত করেছিলেন; বাঙলা কবিতায় সেই  দায়িত্ব পালন করেছেন বুদ্ধদেব বসু।’
      
       [ঘ]  ‘যাদের  আজকাল ‘পঞ্চাশের কবি’ বলা হয়। তাদের অনেকেই এই গ্রন্থের দ্বারা জন্মান্তরিত হয়েছিলেন।’        

‘কলকাতা’ পত্রিকায় ঐ সংখ্যাতেই প্রকাশিত আরও দুটি মন্তব্য উল্লেখযোগ্য। অম্লান দত্ত লিখেছিলেন, ’বুদ্ধদেবের কাছে প্রকৃতি তিক্ত ও কদর্য, শিল্পে রূপান্তরিত হ’য়ে তবে সে মধুর ও সুন্দর। তার জন্যই তিনি বাঁচতে চেয়েছেন। এই সাধুসন্তের দেশে বুদ্ধদেব নির্বাণের চাইতেও সেই তৃষ্ণাকে বরণীয় ব’লে গ্রহণ করেছেন কাব্যে যার ফলশ্রুতি।’ অন্য পক্ষে অশোক মিত্র লিখেছিলেন, ‘বুদ্ধদেব বসু গত আটদশ বছরে যা-যা লিখেছেন, আমার উপলব্ধির বাইরে সে সমস্ত রচনার হৃদয়তা।’