‘যদি মরে যাই কিছু থাকবে না।
এই মাটি যতোই বান্ধব হোক মনে রাখবে না।
পঁচিশ বছরে গদ্য পদ্য যা কিছু রচনা
সকলই অর্থহীন নির্বোধ অনুশোচনা।
শুধু থাকবে বলে এই মন
কলাভবনের তেতলা জুড়ে একটি মাতাল চুম্বন।’
হুমায়ুন আজাদ রচিত সবচেয়ে ক্ষুদ্র কবিতা এটি। শুধু এই কাব্যেয় নয়; সকল কাব্যের মধ্যে। অনেক সৌন্দর্য যেনো ম্লান হ’য়ে যায় এ কবিতার সামনে। যেখানে প্রবেশ করানো হয়েছে খুব সামান্য শব্দ। মৃত্যু চিন্তা বা তার বোধ যেনো কবিকে বেশ ভাবিয়ে তোলে। সৌন্দর্য থেকেও কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েছেন তিনি। নির্মম মৃত্যুকে মেনে নিয়েছেন পঁচিশ বছরে রচিত গদ্য পদ্যের সাথে। ব্যক্তিগত অনুশোচনা প্রকাশ পেয়েছে কবিতাটির মাঝে। অতিরিক্ত কোনো শব্দ জুড়ে বসেনি কবিতাটিতে; বরং রচিত শব্দগুলো বসেছে সুনির্দিষ্ট ভাবে পঙক্তিতে পঙক্তিতে। সাধারণ শব্দের মিশ্রণ দ্বারা কবিতাটিকে দিয়েছেন অফুরন্ত প্রাণ। যার সৌন্দর্য যেনো হিম জ্যোৎস্নার মতো গ’লে গ’লে পড়ে। এর পরে আমরা পাই তীব্র একটি প্রেমের কবিতা ‘দুদিন ধরে দেখা নেই’ নামে। কবিতাটি তিনি শুরু করেন এভাবেঃ ‘দু-দিন ধ’রে দেখা নেই দুশো বছরেও আর দেখা হবে না’। কবিতাটিতে আমরা পাই জীবনানন্দ দাশের দু’টি শব্দ ‘আলো’ এবং ‘আধার’। যে শব্দ দু’টি নিয়ে জীবনানন্দ দাশ মেতেছেন সবচেয়ে বেশি। তাঁর সেই রচিত শব্দ দু’টি আমরা পাই এ কবিতাটিতে। কবিতার একটি পঙক্তি এ ররকম ‘আলো আলোর ভেতরে আলো আঁধার আঁধারের ভেতর আঁধার’। কার সাথে তাঁর দেখা নেই; তা অনেকটা অস্পষ্ট হ’য়ে উ’ঠে কবিতাটিতে। কবির সাথে তাঁর কি সম্পর্ক ? আমরা তা শুধু মাত্র অনুমান করি। কবিতাটি তিনি শেষ করেন এভাবেঃ ‘তোমরা কি দেখা পাও যাকে হারাও/ দুশো কি দু-হাজার ব্যথিত বছরে’ ? প্রেম আর তার ভাবাবেগ থেকে তিনি সরে আসেন অনেক দূরে তাঁর রচিত ‘গৃহনির্মাণ’ কবিতাটিতে। ‘বাঙলাদেশ’ নিয়ে এর আগে আমরা পেয়েছি তাঁর ‘ব্লাডব্যাংক’ কবিতাটি। এবার আমরা পাই ‘গৃহনির্মাণ’ শিরোনামে আর একটি কবিতা। যে কবিতাটিতে প্রকাশ পেয়েছে বাঙলাদেশের একটি চিত্র। রচিত শব্দগুলোও অনেক সংবেদনশীল হ’য়ে উঠে পূর্বে রচিত শব্দ থেকে। এ কবিতায় নির্বাচিত শব্দগুলো হ’য়ে উঠে তার কবিতার নিজস্ব শব্দ ব’লে। এসব শব্দের খুব বেশি আলোড়ন আমরা দেখতে পাবো না অন্য কোনো কবিতায়। ‘কারফিউ’, ‘লাল দিন’, ‘যুদ্ধ’, ‘রক্তপাত’, ‘উদ্বাস্তু’, ‘দস্যুরা’, ‘স্বাধীন’, ‘পতাকা’, ‘রক্তক্ষরণ’, ‘ব্যারিকেড’, ‘১৯৭১’, ‘১৯৪৭’, ‘বিকল্প’, ‘উদ্বাস্তু শিবির’, ‘ভিন্নদেশ’, ‘রক্তিম’, ‘মন্দির’ ইত্যাদির মতো শব্দ। কবিতাটির একটি পঙক্তিতে তিনি প্রকাশ করেন ‘বাঙলাদেশে বঙ্গদেশে’ মতো রচিত শব্দ। কবিতাটি যে যুদ্ধের পর রচিত তা আমাদের বুঝে নিতে আর কোনো কষ্ট হয় না। কবিতার একটি পঙক্তিতে তিনি প্রকাশ করেনঃ ‘যুদ্ধ শেষ রক্তপাত নেই প্রকাশ্যে কি সংগোপনে’। পরের একটি পঙক্তিতে দৃষ্টি দিলে আমরা দেখতে পাবো এ রকম কিছু পঙক্তি।‘রক্তক্ষরণহীন বঙ্গদেশ সারা বাঙলা ব্যারিকেডহীন’ ; ‘বিকল্পে তুললো মাথা সারি সারি উদ্বাস্তু শিবির’। কবিতায় রচিত শব্দমালা আমাকে বার বার মনে করিয়ে দিচ্ছে কবি শহীদ কাদরীর (১৯৪২-) কবিতার কথা। যার কবিতায় পাই এ রকম শব্দমালা। যে শব্দের মধ্যে দিয়ে তিনি যেনো এগিয়ে যান একটি নির্দিষ্ট দিকে; যেখানে রয়েছে ‘বাঙলাদেশ’ নামে একটি ভূখণ্ড। ঠিক সে রকম শব্দ আমরা পাই হুমায়ুন আজাদের কবিতায়। যে শব্দমালা আমাদের চোখকে প্রসারিত ক’রে; কিন্তু দেখায় না উজ্জ্বল আলো। কবিতাটিতে প্রকাশ পেয়েছে চরম নির্মম একটি সত্য, যা আমাদের শরীরে কাঁপন জাগিয়ে দেয়। ‘১৯৭১ যেমন ১৯৪৭-এর সংশোধন’। আমরা ভুলে গিয়েছিলাম সে রকম একটি দিনের কথা; যেখানে থেকে গ’ড়ে উঠেছিল ‘বাঙলাদেশ’ নামের একটি স্বাধীন ভূমণ্ডল। যার থেকে জন্ম নিয়েছিল আমাদের রচিত স্বপ্ন, কামনা, বাসনা, কল্পনা এবং বিশেষ ক’রে একটি স্বাধীনদেশ। যার জন্মের স্মৃতি গেঁথে আছে আমাদের বুকের গভীরে; যা আজও রয়েছে অক্ষুণ্ণ হ’য়ে । কোনো এক অশুভ’র প্রতীক হ’য়ে রচিত কবিতা ‘হরস্কোপ’। যেনো সব কিছুই আমার দৃষ্টি আর সীমার বাইরে থেকে খেলা ক’রে যায় আপন মনে। হুমায়ুন আজাদ কবিতাটি শুরু করেন এ ভাবেঃ ‘আমি বেরুলেই সূর্য নেভে/ বৃষ্টি নামে কাঁটাতারের মতোন/ নষ্ট হয় রাজপথ শহর বন্দর গ্রাম সারা বাঙলা/ বন্যায় ভেসে যায়/ আমি উঠলেই ট্যাক্সির টায়ার ফাটে/ চৌরাস্তার নষ্ট লাল্বাতি/চারিদিক চমকে দিয়ে আচমকা জ্ব’লে ওঠে/ ভীষণ বিব্রত হয় রিকশা ইস্কুটার বাস জনসাধারণ’। বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো ঘটনা দিয়ে তিনি শেষ করেন কবিতাটি।
হুমায়ুন আজাদের এ কাব্যের আর একটি কবিতা হলো ‘আমার ছাত্র ও তার প্রেমিকার জন্য এলেজি’। কবিতাটির শুরু আমাদেরকে আবারও মনে করিয়ে দেয় শামসুর রাহমানের সেই বিখ্যাত কবিতাটির কথা। যা আমরা মন ও মগজে ধারণ করেছিলাম এক প্রকার ভালোবাসা থেকে। ‘বন্দী শিবির থেকে’ কাব্যের ‘তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা’ কবিতাটি। যা প্রকাশ পেয়েছিল হুমায়ুন আজাদের এ কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের ঠিক এক বছর পূর্বে ১৯৭২-এ। সময়ের দিক থেকে যারা হ’য়ে উঠেছিল সহোদর। হুমায়ুন আজাদের কবিতাটি শুরু হয় এ ভাবেঃ
‘তোমাকে পাওয়ার জন্যে সে ক্লাস ফাঁকি দিতো, দাঁড়িয়ে থাকতো পথে,কলেজের মুখোমুখি চৌরাস্তায়, খররৌদ্র, তোমাকে পাওয়ার জন্য, তুমি সহজে অধরা আকাশের কাছাকাছি জলপাই পল্লব, তুমি
ধরা দিতে বহু সাধ্য সাধনায়’ ( যে-সাধনায় ছেলেরা শ্রেণীতে প্রথম স্থান পায়)
আর শামসুর রাহমানের ‘বন্দী শিবির থেকে’ (১৯৭২)-এর কাব্যের একটি বিখ্যাত কবিতা ‘তোমাকে পাওয়ার জন্য, হে স্বাধীনতা’। কবিতা যে কতো বেশি আলোড়ন ছড়াতে পারে তা শামসুর রাহমানের এ কবিতাটি না পড়লে কখনও বুঝা যেতো না। শামসুর রাহমানের এ কবিতাটি যেনো প্রথম থেকেই আশ্চর্য আলো ছড়াতে থাকে সম্পূর্ণ কবিতাটি জুড়ে। যার পঙক্তিতে পঙক্তিতে রচিত শব্দ আর ভাবনা আমাদেরকে নিয়ে যায় অতীতের অনেক গভীরে। যেখানে গেঁথে রয়েছে আমাদের হারানো স্বপ্ন, কষ্ট, স্মৃতি আর অম্লান অশ্রুমালা। যে স্মৃতি থেকে আজও আমরা ফিরে আসতে পারিনি। পড়া যাক শামসুর রাহমানের এ কবিতাটির কয়েকটি পঙক্তিঃ ‘তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা,/ তোমাকে পাওয়ার জন্যে/আর কতবার ভাসতে হবে রক্তগঙ্গায় ?/ আর কতবার দেখতে হবে খাণ্ডবদাহন’ ? হুমায়ুন আজাদ এবং শামসুর রাহমানের এ দু’টি কবিতাই রচিত হয় দেশপ্রেমের গভীর মমত্ববোধ থেকে। যে কবিতা দু’টি কথা বলেছে আমাদের কণ্ঠস্বরে, আমাদের হ’য়ে। হুমায়ুন আজাদ কবিতাটি শেষ করেন এক করুন সম্পর্কের মধ্যে দিয়ে। তাই প্রকাশ করেনঃ ‘তোমাকে ফিরিয়ে আনতে গিয়ে আমার ক্লাশে আর ফিরে এলো না/ কোনো দিন, তুমিও তো ফিরলে না, তোমরা কি দুজন দুজনকে/ পেয়ে গেছো বুকে বুকে কো নো পাকিস্তানি বধ্যভূমিতে’ ? আবেগ এবং গভীর সৌন্দর্যের কবিতা ‘রেস্তোরাঁর পার্শ্ববর্তী টেবিলের তরুণের প্রতি’। ভাবনা এবং তার গভীর শরীর জুড়ে রয়েছে কোনো এক সৌন্দর্যের শৈলী। যা আমাদের কণ্ঠকেই শুধু কাঁপিয়ে তু’লে না; বরং আমাদের আঁখিকোণে জ’মে থাকে অমল পাপড়ি। ‘চমৎকার’, ‘কফি’, ‘পেয়ালা’, ‘চন্দনের সুগন্ধ’, ‘জ্যোৎস্না’, ‘নিসর্গ’, ‘নদী’, ‘নিরবধি’, ‘আঙুল’, ‘গাঁথা’, ‘ছোঁয়া’, ‘ঠোঁট’, ‘সুগন্ধ’, ‘দাউ দাউ’, ‘আগুন’, ‘প’চে প’চে’, ‘ছুরি’, ‘মল্লিকা’, ‘প্রজাপতি’, ‘ঝর্না’, ‘ভাটিয়ালি’, ‘খোঁপা’, ‘চাঁদ’, ‘বকুল’, ‘সুরভিত’, ‘কেক’ ইত্যাদি শব্দগুলো অন্তর্ভুক্ত রয়েছে কবিতাটিতে। অনেক বেশি কোমলতা প্রবাহিত রয়েছে কবিতাটিতে। এ কবিতাটিতে রচিত শব্দমালা আমাদেরকে নিয়ে যায় কোনো এক নিসর্গের দিকে; যেখানে রয়েছে স্বপ্ন, স্মৃতি আর কল্পনা। কিন্তু তার সাথে গেঁথে থাকে বিশাল এক শূন্যতা। যে শূন্যতায় বসবাস ক’রে হারানো আমারই কোনো স্মৃতি। আমার শহর থেকে এগিয়ে এসে আমরা হুমায়ুন আজাদের কবিতায় আবার পাই ‘চিত্রিত শহর’ শিরোনামের একটি কবিতা। কবিতাটির রচিত ভাবধারা এবং শব্দমালা খুব বেশি বৈচিত্র্য নিয়ে আসে না কবিতাটিতে। মনে হয় সেই পরিচিত শব্দ, সেই পরিচিত মুখ। যা খুব বেশি কাছে টানে না আমাদেরকে। ‘গৃহ নির্মাণ’ কবিতা থেকে বেড়িয়ে এসে আমরা আবার পাই ‘আমার গৃহ’ নামের নতুন একটি কবিতা। চৌদ্দ পঙক্তির কবিতা এটি। অসম্ভাব রকম ভালোলাগা যেন জেগে উ’ঠে কবিতাটিতে। অনেক তীব্র প্রেমের কবিতা থেকেও করুন সুর বেজে উ’ঠে কবিতাটিতে। যেনো ম্লান আর বধির ক’রে দিবে আমাদের দু’চোখকে। আমরা কি হারিয়ে যাবো তার সৌন্দর্যের মধ্যে ? যার থেকে আমরা আর ফিরে পাবো না অতীতের কোনো স্বপ্ন আর প্রজ্বলিত জ্যোৎস্নাকে ! যেখানে জেগে উঠবে না অতীন্দ্রিয় সুখ। এ কবিতাটি যে স্বাধীনতার পরে রচিত তা আমাদের বুঝতে কষ্ট হয় না। কবিতাটির শুরু এ রকমঃ
‘ইতিমধ্যে বাঙলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। মিরপুর ব্রিজে
শুকিয়েছে রক্ত। বিশ্ব আর আমি নিজে
চারটি ক্যালেন্ডারের পাতা ছিঁড়ে ছুঁড়ে ফেলে
টাঙিয়েছি নতুন ক্যালেন্ডার। ইতিমধ্যে কতো শত জেলে
তুলেছে অজস্র রত্ন সাগরের নোনা জল থেকে।
প্রেমিক ও প্রেমিকারা হৃদয় ও রক্তের কথা লেখে লেখে
সভ্যতাকে করেছে রঙিন। ইতিমধ্যে মন দেয়া নেয়া ক’রে গেলো শাদা মার্কিন আর গণলালচীন।’
শাদা মার্কিনের নাম যেমন আমরা এ কবিতায় পাই। আবার একই সাথে পাই লাল গণচীনের নাম। সব কিছুই যেনো এক প্রতীক রূপে আসে কবিতাটিতে। ‘জনতা ও জান্টা’ কবিতায় আমরা আবারও পাই এ রকম কিছু শব্দ। ‘রক্ত’, ‘শুকনো মাটি’, ‘প্রতিবাদ’, ‘কামান’, ‘রাইফেল’, ‘মর্টার’, ‘পোড়া বুক’, ‘বুলেট’, ‘বারুদ’, ‘গোলাগুলি’, ‘আত্মসমর্পণ’, ‘চীন’, ‘আমেরিকা’ ইত্যাদি। রচিত শব্দ আমাদেরকে আর নিয়ে যায় না স্বপ্নের অভ্যন্তরে। বরং জানিয়ে দেয় আমার অধিকারের কথা। ‘কবি’ উচ্চারিত শব্দ নিয়ে একটি কবিতা পাই ‘এ সভা প্রস্তাব করছে’ শিরোনামে। কবিতাকে তিনি নিয়ে গেছেন মানুষের মৌলিক উপাদানের কাছে। যেখানে উচ্চারিত করেন ‘কবিতাই হবে বাঙলার কারেন্সি’। প্রস্তাবিত কবিদের কর্মকাণ্ড নিয়ে রয়েছে তার ব্যাপক ব্যাখ্যা। যেমন বলে উঠেনঃ ‘এ সভা প্রস্তাব করছে বাঙলার শাসনতন্ত্র রচনা করবেন কবিরা/ কেননা কবিতাই বাঙলার একমাত্র অবিনশ্বর তন্ত্র/ কবিতা ছাড়া বাঙলাদেশ আর কোনো তন্ত্রমন্ত্র জানে না’। এ কবিতার দিকে চোখ দিলে আমরা দেখতে পাই কবিতাটিতে ব্যবহার করা হয়নি একটি দাঁড়ি বা কমা। হুমায়ুন আজাদের এ রকম রয়েছে একাধিক কবিতা। যা আমাদের বার বার- ই মনে করিয়ে দেয় ফরাসি কবি গিয়োম আপোলিনের কথা। যার কবিতায় আমরা পাবো এ রকম কবিতা। কবিতাকে তিনি নিয়ে গেছেন গণপরিষদে। এ কবিতাটিতে আমরা পাই দু’জনের নাম মুজিবর ও রবীন্দ্রনাথ। সমাজ, রাষ্ট্র, সভ্যতার অভ্যন্তরে তিনি কবিতাকে প্রবেশ করাবেন; কেননা কবিতাই বাঙলার একমাত্র অবিনশ্বর বাহন। ‘খোকনের সানগ্লাস’ কবিতাটি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের উপর রচিত এ কাব্যের চমৎকার একটি কবিতা। কবিতার সৌন্দর্যের থেকে তার আবেগিয় অশ্রুধারা আমাদেরকে বধির ক’রে তোলে। বিশ বছরের খোকনের স্মৃতি আজ আমাদের সমগ্র বাঙলার চিত্র। বেশ দীর্ঘ কবিতা এটি। খোকনের স্মৃতি ফিরে আসে আমাদের অশ্রুকোণে। তাই কবিতাটিতে পাইঃ ‘খোকন মেলতো ডানা স্বপ্নের ভেতর, ডানার পল্লবে/পল্লবে মালার মতোন গেঁথে সমুদ্র অরণ্য রাত্রি আর দিবসগুলোকে।/ উড়তো সে, উড়তো সে, উড়তো খোকন। আমাদের এখানে মনে পরে যায় শামসুর রাহমানের ‘নিজবাসভূমে’ (১৯৭০) কাব্যগ্রন্থের ‘আসাদের শার্ট’ কবিতাটির কথা। আসাদ এবং তাঁর শার্ট যেমন মিশে আসে কবিতাটিতে; তেমনি একই ভাবে খোকন এবং তাঁর সানগ্লাস এর চিত্র আমরা দেখতে পাই হুমায়ুন আজাদের এ কবিতাটিতে। ব্যক্তি এবং তাঁর পরিহিত উপাদান দু’টি কবিতাতেই এসেছে সমান ভাবে। আমরা এ কবিতাটিতে পাই একটি নির্দিষ্ট দিন ২৯ মার্চ ১৯৭১। যা খোকনের দিন হিশেবে গণ্য হয় কবিতাটিতে। হুমায়ুন আজাদ কবিতাটি শেষ করেন খোকনের সানগ্লাস এর বিষাদমাখা স্মৃতির মধ্যে দিয়ে। যে স্মৃতি যেনো দ্রুত সরে না যায় আমাদের চোখের কোণ থেকে; যা বার বার ফিরে আসে মন ও স্মৃতিতে। হুমায়ুন আজাদ কবিতাটি শেষ করেন বিষাদের সুরে। তাই আমরা শেষ পঙক্তিগুলো দেখতে পাই এ রকমঃ
‘সবুজ গোলাপ হাতে পথে প্রান্তে হাঁটছে হল্লা করছে লক্ষ মুজিবর। খোকনের সানগ্লাস প’ড়ে আছে শুধু খোকা নেই। খোকন, তুমি কি দেখছো বাঙলাদেশ আজকাল এমনি সুন্দর। তাই এ নিসর্গলোকে
কারো সানগ্লাস পরতে হয় না। এখানে সবার চোখে এমনিই নীল। তোমার সানগ্লাস কেমন নীল হয়ে লেগে আছে সকলের চোখের মণিতে।
তোমার সানগ্লাস সকলের চোখের মণিতে...’
উনিশ পঙক্তি নিয়ে রচিত ‘যাও রিকশা, যাও’ কবিতাটি। হুমায়ুন আজাদ; কবিতাটিতে তৈরি করেছেন একটি নিজস্ব কাঠামো বা ভাবধারা। তাই কবিতাটিতে ব’লে উঠেনঃ ‘যাও রিকশা, যাও, হুমায়ুন আজাদের মন্দির’। কবিতাটিতে নিজের নাম উচ্চারণ হয়েছে ব্যাপক-বিস্তৃত ভাবে। তিনি সেখানেই ফিরে যেতে চান; যেখানে রয়েছে নিজের এক আপন নিবাস। যাকে তিনি সম্বোধন করেছেন ‘মন্দির’ শিরোনামে। এবং এ নামটি অনেক প্রিয় হ’য়ে দেখা দেয় হুমায়ুন আজাদের কাছে। ‘কবি’ উচ্চারিত নামও আমরা পাই কবিতাটিতে। যে রকমটা আমরা পেয়েছিলাম পূর্বের কোনো এক কবিতায়। ‘মন্দির’ এবং ‘কবি’ এ দু’টি শব্দ পুরোপুরি ভাবে জড়িয়ে রেখেছে কবিতাটি। যেমন আমরা কবিতাটিতে পাই ‘মন্দির’, ‘মরমী মন্দির’, ‘নিজের মন্দির’, ‘স্বমন্দির’, ‘আপনার মন্দির’ ইত্যাদি শব্দগুলো। যা নিজের দিকেই আবর্তিত হ’য়ে ফিরে আসে। একই ভাবে ‘কবি’ নিয়ে আমরা পাই ‘কবিদের ঠিকানা’, ‘কবি ছাড়া সবাই উদ্বাস্তু’, ‘কবি ছাড়া কে আর নিজের ঘরের মতো দেখে সব ঘর’, ‘কবিদেরই শুধু স্থায়ী নিজস্ব ঠিকানা রয়েছে’ ইত্যাদি শিরোনামের পঙক্তিগুলো। যা কবিকে ক’রে তোলে আরও আপন। সেই রিকশাটা পৌঁছে যাবে তাঁর আপন ঠিকানায়; যেখানে রয়েছে একজন কবি। তিনিই হবেন তাঁর একমাত্র আগন্তুক। শব্দ নিয়ে খেলেছেন আপন মনে। তাই মন্দিরের মতো শব্দ ও তু’লে নেওয়া হয় প্রিয় তালিকায়। কবি ছাড়া সবাই একপ্রকার শূন্যহীন।
তিনি হুমায়ুন আজাদ, তু’লে নিয়েছেন কবিতায় নিজের নাম। রিকশাকে আদেশ করেন সেই গন্তব্যেয় যাওয়ার জন্য যেখানে রয়েছে আপন ঠিকানা। যে ঠিকানা হ’য়ে উঠে কবিদের আপন ঠিকানা। তিনি যখন পৌঁছে যাবেন নিজের ঠিকানায়; তখন যেনো বলা হয় ‘আপনার মন্দির, নামুন’। ‘আলয়’ শব্দ থেকেও অনেক প্রিয় হ’য়ে দেখা দেয় এই ‘মন্দির’ শব্দটি। উচ্চারণগত শ্রুতিমাধুর্যর জন্য তিনি তু’লে নেন এ রকম একটি শব্দ। যে শব্দটির কম্পন সুরচিত সুর হ’য়ে দেখা দেয় হুমায়ুন আজাদের নিকট। কবিরা যে তাঁর নিজস্ব ঠিকানায় রয়েছে তা উচ্চারিত হয় অকুণ্ঠ চিত্তে। কবিতার পঙক্তিতে যেমন তিনি বলেনঃ ‘কবি ছাড়া কে আর নিজের ঘরের মতো দেখে সব ঘর/এমন সহজে কে আর পাতার সবুজ ছেঁকে গ’ড়ে তোলে মরমী মন্দির। এ কবিতাটিতে বিভিন্ন ভাবে উচ্চারিত হয়েছে ‘মন্দির’ শব্দটি। যে শব্দটি আর অন্য কারো শব্দ হ’য়ে দেয় না; বরং তা দেখা দেয় আপন রচিত শব্দ হ’য়ে। এ ভাবেই শেষ হয় এ কবিতাটি। এ কাব্যের সবচেয়ে দীর্ঘ এবং শেষ কবিতা ‘হুমায়ুন আজাদ’। কবিতার শিরোনাম থেকে আমাদের বুঝে নিতে কষ্ট হয় না তিনি কে। এ নামেই রচিত হয় দীর্ঘ কবিতাটি। এর পূর্বে যেমন আমরা পেয়েছি আত্মজৈবনিক নির্ভর কবিতা; ঠিক তেমনি এ কবিতাটিতে রয়েছে কবির বেঁড়ে উঠা সোনালী স্বপ্নময় স্মৃতি। যে স্মৃতি জমে রয়েছে তাঁর আঁখিকোণে। কবিতাটি তিনি শুরু করেন এভাবেঃ ... চ্লবে