এ যেনো বাঙলায় রাখা ভবিষ্যতের চির সঞ্চয়। যার আর কোনো প্রতিদান নেই। যা ফিরে আসে আপন সত্তার দিকে। আবার যা মিশে যাবে আগামী দিনের হ’য়ে। তাই কবিতার শেষে ব’লে উঠেন ‘বাঙলার সব রক্ত তীব্রভাবে মাটি অভিমুখি’।‘টয়লেট’ কবিতাটি খুব বেশি মৌলিক হ’য়ে দেয় না। যার থেকে প্রকাশ পাবে অন্য কিছু। কবিতাটির অভ্যন্তরে চোখ রাখলে দেখতে পাই সেই পূর্বের ন্যায় দাঁড়ি-কমা বর্জিত হ’য়ে রচিত হয় কবিতাটি। তীব্র আবেগ আর গভীর সৌন্দর্যের কবিতা ‘রোদনের স্মৃতি’। এ কবিতাটিতে প্রকাশিত আবেগ এর পূর্ব পর্যন্ত আমরা পাই নি; পাই নি সৌন্দর্যে কেঁপে উঠতে। আর তা যেন এক হ’য়ে আসে এখানে এসে। কবিতাটির প্রকাশিত সৌন্দর্য যেন এক গলিত অশ্রু হ’য়ে ফিরে আসে আমাদের আঁখিকোণে। যা স্মৃতি ও স্বপ্নময়; হিম ও জ্যোৎস্নায়। কবিতাটি একটু পড়িঃ

‘তোমাকে চোখের মধ্যে রেখে কাঁদি, আমার দু’ চোখে তুমি বিগলিত ঠাণ্ডা হিম, তুমি কাঁদছো, দু-চোখের একান্ত ভেতর গ’লে যাচ্ছে কালো আঁখিতারা, গ’লে গ’লে  একটি গাছের মতো  সবুজ, তোমার মতোন করুন হয়ে যাচ্ছে অশ্রুমালা তুমি নিথর নিরীহ দাঁড়িয়ে আছো আঁখি তারার ভেতর, তুমি, একাকিনী সবুজ পল্লব, কাঁপছো  বাতাসে শাদা হিমে ভিজছো  অক্টোবরের সন্ধ্যার কুয়াশায় ক্রিমে আমার বধির দুই চোখের মনিতে ব্যথিত রোদন হয়ে গেঁথে আছো তুমি’

কবিতাটিতে প্রকাশিত ‘তুমি’ কে তা আমরা এখনও জানতে পারলাম না। যার জন্য বিগলিত হিমে জ্যোৎস্নায় ঝ’রে পড়ে অশ্রুকণা। যার ধারা প্রবাহিত হ’তে থাকে স্নিগ্ধ সবুজ পল্লবে। হুমায়ুন আজাদ, যদি এভাবে এগিয়ে নিতেন কবিতাটিকে তাহ’লে এক রকম গভীর সৌন্দর্য লুকায়িত থাকতো কবিতাটিতে। যার ভাবধারা বা ‘তুমি’-কে খোঁজার জন্য কবিতাটি হয়তো পড়ে শেষ ক’রে ফেলতাম; তারপরও অনুক্ত থেকে যেত সেই ‘তুমি’ ব্যক্তিটি। যাকে না পাওয়ার বিরহে চোখের মনি কোণে লুকিয়ে থাকতো জমানো অশ্রুকণা। আর একটু গভীরে যাওয়া যাক কবিতাটিরঃ

‘কাঁদছে তোমার চুল, ঘন কালো, কাঁপছে তাঁরার মতো দু-কানের দুল লাল টিপ নরম নিরীহ শান্ত সরল রিষ্টওয়াচ, পায়ের আঙুলে মাটি খুঁড়ে নিয়ে আসছো ভূমধ্য থেকে সহোদরা শ্যামল রোদন তারা সব জ’মে  যাচ্ছে আমার চোখের মধ্যে বরফ যেমন’

আমাদের সামনে আর অজানা থাকে না সেই ‘তুমি’ ব্যক্তিটি। যে দেখা দেয় কোনো এক নারী হ’য়ে, যা আমরা অনুধাবন করতে পারি কবিতাটির অভ্যন্তরে এসে। আমরা স্পষ্টভাবে তাঁকে চিনে নিতে পারি তাঁর চুল, কানের দুল, লাল টিপ ইত্যাদির মধ্যে থেকে। ‘রোদনের স্মৃতি’ কবিতাটিতে একই সাথে ব্যবহার হয়েছে ‘রোদন’ ও ‘কান্না’ শব্দ দু’টি; যা সমার্থক শব্দ হিশেবে কাজ ক’রে। এ রকম শব্দের ব্যবহার আমরা পাই জীবনানন্দ দাশের কবিতায়। শব্দ দু’টি ছিল ‘আধার’ ও ‘অন্ধকার’। যে শব্দ দু’টি নিয়ে জীবনানন্দ দাশ খেলা করেছেন নিজের মতো ক’রে; তাঁর সমস্ত কবিতায়। ‘রোদনের স্মৃতি’ কবিতায় রচিত শব্দগুলো কেঁপে কেঁপে দেখা দেয় আমাদের। এ শব্দমালার সুর বেজে উ’ঠে আমাদের ইন্দ্রিয়ে, যা দেখা দেয় বিগলিত জ্যোৎস্না হ’য়ে। ‘চোখ’, ‘কাঁদি’, ‘ঠাণ্ডা’, ‘হিম’, ‘একান্ত’, ‘আঁখিতারা’, ‘সবুজ’, ‘করুন’, ‘অশ্রুমালা’, ‘নিথর’, ‘কুয়াশা’, ‘বধি’, ‘গেঁথে’, ‘চুল’, লাল টিপ’, ‘নরম’, ‘নিরীহ’, ‘শান্ত’, ‘সরল’, ‘সহোদরা’, ‘শ্যামল’, ‘বরফ’, ‘একফালি’, ‘কৃষিক্ষেত্রে’, ‘জাহাজের ডানা’, ‘ঘ্রাণ’, ‘ঐকতান’, ‘অন্ধ’, ‘বোবা’, ‘ম্লান’, ‘চরাচর’, ‘নক্ষত্র’, ‘সমদ্র’, ‘জলযান’, ‘ছায়া’, ‘গাঢ় সন্ধ্যা’, ‘নিরবধি’, ‘কান্না’ ইত্যাদি। যে শব্দগুলো হ’য়ে উ’ঠে কবিতার প্রাণ; যা সৌন্দর্যের দিকে প্রবাহিত ক’রে কবিতাটিকে। দাঁড়ি-কমা বর্জিত আর একটি কবিতা আমরা পাই ‘বিরোধী দল’ নামে। খুব দীর্ঘ নয় কবিতাটি। কবিতাটির প্রথম পঙক্তি আমাদেরকে জানিয়ে দেয় তাঁর অবস্থানকে। ‘আমার সমস্ত কিছু আমারই বিরুদ্ধে দাঁড়ায়’। রাজনৈতিক কর্ম সংশ্লিষ্ট শব্দগুলো জুড়ে বসে কবিতাটিতে। ফেস্টুন, প্ল্যাকার্ড, স্লোগান, নির্বাচন, সভামঞ্চ, মিছিল ইত্যাদি। যার সব কিছুই তাঁর বিরুদ্ধে স্লোগান মুখর হ’য়ে উঠে। ‘জ্যোৎস্নার অত্যাচার’ কবিতাটিতে পাই জ্যোৎস্না সাথে গভীর সৌন্দর্যবোধের সম্পর্কের। কবিতাটির দিকে চোখ দিলে আমরা দেখতে পাই উজ্জ্বল হ’য়ে আছে একটি তারিখ ‘আটষট্টির ৭ই এপ্রিল’ ; যার আকাশ ছিল কবির কাছে সবচেয়ে নীল। নীল আকাশের সাথে নীল বেদনা যেন একাকার হ’য়ে উ’ঠে হৃদয়ের গভীরে। কবির বয়স তখন একুশ। কি হয়েছিল তখন ? আমরা জানি; হয়তো জানি না। এই রাত অনেক গভীর আর কষ্টের হ’য়ে উ’ঠে জ্যোৎস্না ও আঁখিতারায় গেঁথে থাকা অশ্রুর মধ্যে দিয়ে। যিনি এই রাতে হয়ে উঠবেন একজন কবি হ’য়ে। যখন আপন মনে বলেন ‘এই রাতে বঙ্গে আমি হই একমাত্র কবি’। তাহ’লে কি ‘সব কিছু ভেঙে পড়ে’ চেতনায় আশ্রিত ভাব এখান থেকে ? ‘প্রেমভালোবাসা’ কবিতায় উচ্চারিত হয় পরিত্যক্ত জীবনের সুরধ্বনি। যা দেখা দেয় জীবনেরই অংশ হ’য়ে। কবিতাটির শুরু এ রকমঃ ‘হে আমার প্রেম, গুপ্ত ঘরে চুপিসারে জন্ম পাওয়া অবৈধ সন্তান’। ‘হে আমার প্রেম’ বার বার-ই আমাকে মনে করিয়ে দেয় রবীন্দ্রনাথের কথা। ‘হে আমার’ উচ্চারিত ক’রে তাঁর মতো এতো সংখ্যক কবিতা অন্য কেউ রচনা করেছে কিনা তা আমার জানা নেই। ‘আজ রাতে’ আমার অসম্ভাব ভালোলাগা একটি প্রিয় কবিতা। যার ভাব ও ভাবনার মধ্যে অনেক বার হারিয়ে গেছি আমি। কবিতাটির গভীর সৌন্দর্য গলিত রূপে দেখা দেয় আমার নিশ্চুপ আঁখিকোণে। কবিতাটি একটু পড়ে নিই।
  
‘আজ রাতে চিলেকোঠা  থেকে নদী বয়ে যাবে
স্নানার্থীরা  দলে  দলে জমা হবে ছাদে ছাদে ছাদে
হ্রদে রাজপথে কোনো লোক থাকবে না কেউ যাবে না বাথরুমে রাস্তার কলের পারে পুকুরে নদীতে স্নানার্থীরা জড়ো  হবে ছাদে আজ রাতে চিলেকোঠা  থেকে নদী বয়ে যাবে’

কবিতাটিতে রয়েছে হিম জ্যোৎস্নার  মতো হৃদপিণ্ড কাঁপানো সৌন্দর্য। যা কবিতাটিকে ক’রে তোলে অন্যান্য কবিতা থেকে ভিন্নরূপ। বিপরীতমুখি সংবেদন কাজ ক’রে কবিতাটিতে। খুব বেশি ব্যবধান তৈরি ক’রে নদী ও চিলে কোঠার মধ্যে। কিন্তু লুকায়িত সৌন্দর্যে তা হারিয়ে যায়। শব্দ ও স্বপ্নের এক মিশ্রণ খেলা ক’রে সম্পূর্ণ কবিতাটি জুড়ে। দেখা দেয় স্বপ্ন ও অপূর্ব সৌন্দর্যের এক অভূতপূর্ব সমন্বয়। যা আমরা পাই না হুমায়ুন আজাদের অন্য কোনো কবিতায়।যা দেখা দেয় ‘আজ রাতে’ কবিতাটিতে। ‘সেই এক বেহালা’ শিরোনামের কবিতাটির অভ্যন্তরে রয়েছে তিনটি কবিতা। ‘তোমার ক্ষমতা’ , ‘বেহালা’ এবং ‘হাত’  নামে। এ রকম কবিতা বিন্যাস আমরা সবচেয়ে বেশি লক্ষ্য করি জীবনানন্দ দাশের কবিতায়। যার এ রকম রয়েছে অজস্র কবিতা। ‘তুমি’ নামের সেই ব্যক্তি কি পারে আর কি পারে না তার একটি ভাবধারা রয়েছে কবিতাটিতে। সে পারে সব কিছু থেকে তাঁকে বিচ্যুতি ঘটাতে। অন্যান্য কবিতার শব্দ থেকে এই কবিতার শব্দ হ’য়ে উ’ঠে কঠোরতম। এখানে আমরা পাই ভাঙতে, শুষে, রক্ত, লবণ, বিষাক্ত, তছনছ, উল্টেপাল্টে, বিষ, আত্মহত্যা, মাতাল ইত্যাদি শব্দগুলো। আমরা পাই না হিম, জ্যোৎস্না, সুখ, সুধা, বিগলিত, তারা আর নিশীথের মতো শব্দ। সব কিছু করার পরও কবি তীব্র ভাবে প্রশ্ন করে এর চেয়ে তুমি আর কি পারো ? ক্ষমতা প্রদর্শনের সব যেন শেষ হলো এখানে। ‘বেহালা’ কবিতায় আমরা দেখতে পাই যে, সেই বেহালা একা একা বেজে উ’ঠে আপন মনে। যে বন্দী কিন্তু তার সুর যেন থেমে নেই; কেঁপে উ’ঠে আপন মনে। অম্লান জল; যে জলের সাথে সে-ও যেন সুর মিলায় একাকী। সেই বেহালা বেজে উঠে একাকী, আপন মনে নিঃসঙ্গ হ’য়ে। এ যেন কোনো এক করুন আর্তনাদ। যা পরিণত হয় সুরের মূর্ছনায়। কবিতাটির একটি দিক খুব স্পষ্ট যে; অন্যান্য কবিতার তুলনায় ‘কমা’ ব্যবহার হয়েছে নির্বিচারে। পরের কবিতাটি ‘হাত’ শিরোনামে। যা আমাদের নিয়ে যায় বিচিত্র সৌন্দর্য আর গভীর আবেগের কাছে। আমরা যেন বার বার ফিরে যাই সেই হাতের কাছে; যা আমাদের টেনে নিবে আপন নিবিড় বন্ধনে। কবিতাটির কিছু অংশ পড়া যাকঃ

‘তোমার বিশাল হাতে গুঁজে আমি দিয়েছি
আমার সমস্ত জ্যোৎস্না রৌদ্র ব্যালকনি সুদূর নীলিমা সঙ্গ আর রক্তের নিবিড় গন্ধ তোমার সামান্য হাত এতো যে বিশাল সব গাছ উদ্যান অরণ্য নদী জ্যোৎস্না নিসর্গ সন্ধ্যা একটি ছোট্ট তিলের মতো পড়ে আছে তোমার মুঠোতে।’

এ যেন বিশাল হাতে প্রজ্বলিত এক সুনিবিড় গোলাপ পাপড়ির নীলবীথি। যেখান থেকে আমাদের আঁখি ভ’রে যায় জ্যোৎস্না আর সন্ধ্যার নিঃসঙ্গে। যার থেকে আমাদের ফিরে আসার আর কোনো পথ নেই। এতো সুন্দর একটি কবিতা, কিন্তু যার শুরুটা হয় ‘থাবার’ মধ্যে দিয়ে। যে থাবার মধ্যে দিয়ে তু’লে আসে লাল টকটকে মাংসপিণ্ড ; যার ভারে ছেড়ে যায় সঙ্গ আর নিঃসঙ্গ। এ যেন আমার করুন সুর রচিত হয় আমার কম্পনে। এ কবিতাটির শব্দ বিন্যাস হয় তার আপন মনে। স্বপ্নের গোলাপের পাপড়িতে যা ক্ষয়ে পড়ে। স্বপ্নের মধ্যে ঘটে যেতে পারে অনেক কিছু; যা আমাদের জানা নেই। এ রকম একটি কবিতা ‘স্বপ্নলোকে লুঠতরাজ’ । অন্যান্য কবিতা থেকে বেশ বৈচিত্ত্য রয়েছে কবিতাটিতে। স্বপ্নলোকের যাদুর কাঠির মতো ব্যবহার হয় অনেক শব্দ। যে শব্দগুলো নির্বাচিত হ’য়ে আসে এ কবিতার জন্য। যে শব্দমালার সাথে আমরা পরিচিত ছিলাম না এর পূর্বে; যার দেখা পাই এখান থেকেই। ‘চুরি’, ‘জানালা’, ‘কপাট’, ‘ছিদ্র’, ‘চোর’, ‘কাকই’, ‘কলম’, ‘চটিজুতো’, ‘সিঁধকাঠি’, ‘ছ্যাচরা’, ‘ছিঁড়ে’, ‘সোনার কানেট’, ‘স্বপ্নের বালাদ’, ‘কুটিল’, ‘সৌধ’, ‘বিবর্ণ’, ‘লিপস্টিক’, ‘নেলপালিশ’, ‘কেশের বিন্যাস’ ইত্যাদি। এ রকম শব্দের পূর্ণবিন্যাস আমরা আর পাবো কিনা তা জানি না। কিন্তু শব্দগুলোর ব্যাপক ব্যবহার হয়েছে কবিতাটিতে। চারটি অংশ নিয়ে রচিত হয়েছে ‘জীবন চরিতাংশ’ কবিতাটি। নামের মধ্যে দিয়েই আমরা চিনে নিতে পারি কবিতাটি। জন্ম নেওয়ার কল্পিতকণ্ঠে তা জেগে উঠে আপন ভাবনায়। এ যেন নিজের জীবনের স্পষ্ট কোনো এক আলো ছায়ার খেলা। যার কণ্ঠের সুর এখান থেকে রচিত হয়। কবিতাটির প্রথম অংশের কিছুটা পড়া যাকঃ
                                                
‘সকল সম্পর্ক ছিঁড়ে গেলে ভেঙে গেলে সব যোগাযোগ
প্রতিজ্ঞা গভীর স্মৃতি মধ্যরাতে অন্ধকারে আমি জন্ম নিই।জনকের সঙ্গে তখন অষ্টাদশী জননীর ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। জনকের ফ্ল্যাট ছেড়ে জননী নতুন ফ্ল্যাটে উঠে গেলে আমি জন্ম নিই। জন্মের সঙ্গেই আমি ও জননী উঠে গেছি ভিন্ন বিছানায়।’

কবিতাটির পরের কিছু অংশ পড়ে নেওয়া যাকঃ

‘চারদিকে ঘর ভাঙে ফ্ল্যাট ওঠে হোটেল মোটেলে
ভ’রে যায় বাঙলাদেশ বাঙলার মেয়েরা সব গান গায় নেচে যায় সাততলা হোটেলের প্রমোদখানায়’

খুব বেশি বিচ্ছিন্ন মনে হয় পরের পঙক্তিগুলোকে। মনে হয় এ অংশগুলো না থাকলেও খুব বেশি মূল্যহীন হ’য়ে উঠত না কবিতাটি। এ যেন পরিশুদ্ধ কবিতার অসমাপ্ত অংশ। যে পরিসর থেকে বেড়িয়ে এসেছে কবিতাটি। এ অংশটুকুকে সর্বদা মনে হয়েছে বিচ্ছিন্ন বলে। আসা যাক কবিতার আরও কিছু ভিতরে। যেখানে প্রকাশ পায় এ রকম কিছু অংশ ‘আমার গাড়ির সামনে শুধু মিছিল প্রবণ জনতার দল এসে/ বাধা দেয়, ঝকঝকে নতুন মডেলের গাড়ি/ অকস্মাৎ পথরোধ করে,/ আমি কি করবো আমি ওভারটেকিং জানি না’। এ যেন অজানা কোনো বলা; যার সাথে আমরা মিল পাই না কবিতার অভ্যন্তরের সাথে। এ যেন এক কবিতার বহুমাত্রিক বিচ্ছিন্ন বিন্যাস। যে ছেড়ে এসেছে তার অতীত অংশকে; যার কাছে সে আর কখনও ফিরে আসবে না। যেভাবে সে আর আসবে না কবিতার শরীরে। আমরা এগোতে থাকি কবিতাটির আরও একটু ভিতরে; যেখান থেকে তু’লে নিবো আরও কিছু অংশ।
                                    
ক.   ‘পাবনার রঙিন শাড়ি ভয়ঙ্কার মসৃণ কোমল’
         ব’লে গেলো যে ছাত্রী কী যেন ওর নাম
         পারসেনটেজে ওর কি দরকার ? ওর  নামে  প্রাণপায় আর্টস ফ্যাকাল্টির ১৬০ জন শিক্ষক।’
        
আবার পড়া যাক কিছু অংশঃ  

খ. ‘আমার লেটার বক্স উৎকণ্ঠিত হয়ে আছে
     একটি নীল খামের প্রত্যাশায়। সব চিঠি ব্যাগে     নিয়ে পালিয়েছে সবুজ পিয়ন নীল নক্ষত্রের দিকে।
        তার সাইকেল ডানা মেলে উড়ে যাচ্ছে ডাক    বিভাগের সীমানা পেরিয়ে।’

একই কবিতার পরের পাঁচটি পঙক্তিঃ

গ. ‘সম্রাজ্ঞী তোমার স্তব ছাড়া কোনো গান নেই স্বর্গে মাটিতে তোমার স্নানের পর বাথরুম  কী  রকম সেন্টে ভরে থাকে তোমার হাতের তালু থেকে আলো
আর চন্দ্রের অবিনাশী চন্দন ঝ’রে যায়
বিপর্যস্ত আকাশের সুনীল শয্যায়।’

কবিতার পঙক্তিগুলো বিন্যাস হয়েছিল একই কবিতায় পর্যায়ক্রমে। কবিতায় তা গেঁথে ছিল তার আপন শরীরে। কবিতার প্রথম চারটি পঙক্তি পড়ে আমরা যেমন মিল পাই না তার পরের পাঁচটি পঙক্তির সাথে। একই ভাবে তার সাথে আবার ব্যবধান তৈরি ক’রে পরের পাঁচটি পঙক্তি। আমাদের পক্ষে  নিরূপণ করা সম্ভাব হ’য়ে উ’ঠে না যে তারা গেঁথে ছিল একই শরীরে এক সাথে। মনে হয় পঙক্তিগুলোর স্তর বিন্যাস করা হয়েছে অনেক দূরে অবস্থান ক’রে। পৃথক ভাবে আমরা যদি এ পঙক্তিগুলো পড়ি; না দেখা মাত্র বলা সম্ভাবপর হ’য়ে উঠে না তারা একই কবিতার স্তর। ‘পাবনার রঙিন শাড়ীর ভয়ঙ্কর মসৃণ কোমল’ এর সাথে যেমন খুঁজে পাওয়া যাবে না ‘আমার লেটার বক্স উৎকণ্ঠিত হয়ে আছে’ এর সাথে। পরের বা শেষ পঙক্তিগুলো অনেক বেশি বিচ্ছিন্ন হ’য়ে পড়ে তার পূর্বের পঙক্তির সাথে। যদি তারা জুড়ে আছে ‘জীবন চরিতাংশ’ কবিতার অভ্যন্তরে। অনেক ইচ্ছা রয়েছে তাঁর। যার মধ্যে নাম ফলক একটি। তাই আপন মনে প্রকাশ করেনঃ ‘আমার নাম ফলক আজোও সাঁটা হয়নি দেয়ালে’ মতো পঙক্তি। শেষের দিকে ফিরে আসে বাঙলাদেশের কথা ব’লে। আমরা পাই এ দেশের সেই কিংবদন্তীর কথা যা বিচিত্র ও বহুমাত্রিক হ’য়ে ফিরে আসে কবিতাটিতে। পাই রবীন্দ্রনাথ ও  বাঙলাদেশের কথা। সমস্ত আবেদন শেষ ক’রে তাই কবি ফিরে আসেন নিজ গৃহে। অন্যান্য অনেক কবিতা থেকে দীর্ঘ হ’য়ে রয় কবিতাটি। ‘বাঘিনী’ কবিতার পঙক্তি বিন্যাস বেশ বৈচিত্র্য আনে কবিতাটিতে। এ কবিতাটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় টি এস এলিয়টের ‘জলহস্তী’ কবিতাটির নাম। এ রকম কবিতার নাম তিনি বেছে নিয়েছিলেন জীবজন্তুর নাম থেকে। এ কবিতাটিতে আমরা খুঁজে পাই ‘বাঘিনী’, ‘ঝাউ’, ‘দালান’, ‘ডাস্টবিন’, ‘নর্দমা’, ‘ফড়িং’, ‘হরিণ’, ‘সাপ’, ‘মাকড়শা’, ‘কাঠবিড়ালি’, ‘ছোবল’, ‘পোকার মতো’ ইত্যাদি শব্দ। যা কবিতায় ফিরে আসে ভয়ঙ্কর রূপধারণ করে। আমরা কোনো সৌন্দর্য খুঁজতে চাই না এ কবিতার মাঝে। ‘রাত্রি’ কবিতায় আমরা প্রথম উচ্চারণ করতে শুনি ‘আমি ভয় পাই’–এর মতো শব্দ; যা দেখা দিবে দণ্ডিত লোকের মতো। যারা রাত হলেই কেঁপে উঠে সমস্ত শরীরে। ঘুমের কথা তাঁকে যেন কোনো ভাবেই বলা যাবে না। যা তাঁর কাছে ফিরে আসে ভয়ঙ্কর রূপে। আমার ঘুম আজ গেঁথে রয় অন্যর আঁখিকোণে। সে ফিরে আসে আমার বাস্তবতা থেকে স্বপ্নে অনেক বেশি। কবিতাটিতে আমরা খুঁজে পাই নির্দিষ্ট একটি জেলার নাম ‘বগুড়া’। কবি তাই বলে উঠেনঃ ’ঘুমোতে হবে ভাবতেই আমি ভয় পাই/ আমার সমস্ত নিদ্রা গোপনে হরণ করে আজ/ একজন নিবিড় ঘুমোচ্ছে বগুড়ায়’। কবিতাটির দিকে একটু লক্ষ্য করলে আমরা দেখে পাই একই সাথে ‘নিদ্রা’ ও ‘ঘুম’ শব্দের ব্যবহার। আমি পূর্বেই বলেছি এ রকম শব্দের ব্যবহার আমরা জীবনানন্দ দাশের কবিতায় দেখতে পেয়েছি  বহুবার। আজ আমরা যা পেলাম এই কবিতায়। বগুড়ায় কে ঘুমোচ্ছে তা আমাদের আর জানা হ’য়ে উঠে না। ‘অলৌকিক ইস্টিমার’ কাব্যের নামে আমরা পাই একটি কবিতা। এ যেন ভেসে আসা স্বপ্নের জগতের এক  অলৌকিক ইস্টিমার। ফিরে আসা কোনো এক দেবদূতের অতীত স্মৃতিচারণ গেঁথে রয় অমল আঁখিকোণে। কোনো এক আত্মীয়ের সম্পর্কের সাথে তা গেঁথে আছে মৌলিক সম্পর্ক হ’য়ে। ‘চোখের মতন সেই ইস্টিমার/ নীল নক্ষত্র থেকে ছুটে আসছে গাঢ় বেগে/ যারা শুয়ে আছে  পাটাতনে/ প্রথম দ্বিতীয় তৃতীয়  বিভিন্ন শ্রেণীতে/ তারা আমার গভীর আত্মীয়’। যেন কোনো এক দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে তাদের মাঝে তৈরি হয়েছে বিশাল এক শূন্যতা; যা পরিপূর্ণতা পাবে এই গভীর আলিঙ্গনের মধ্যে দিয়ে। কবি দেখতে পেতেন সেই অলৌকিক ইস্টিমার আসতো প্রতি রাতে। তা যেন গেঁথে রয়েছে কবির আঁখিকোণে। অলৌকিক ইস্টিমার আসে সব রাতে/ সব বৃষ্টি ভর ক’রে/ নদী জ্যোৎস্না ফুলদানি বেয়ে/ যারা এসে নামছে জেটিতে তারা আমার গভীর আত্মীয়’। চল্লিশ পঙক্তির কবিতা ‘ছাদআরোহীর কাসিদা’। আমার অসম্ভাব ভালো লাগা একটি কবিতা। যে কবিতাটি তু’লে নিয়েছিলাম আমার কণ্ঠে। কবিতাটি একটু পড়িঃ
                
‘আমরা সবাই ছাদে উঠি কখোন  কখোন
সন্ধ্যায় মধ্যরাতে শিশিরের ভোরে
লাফ দিই চোখ বুজে উচ্চতম ছাদগুলো থেকে
যেমন সবাই আমরা কোনো কোনো দিন গভীর আবেগে ছুঁই ভালো বাসি তাজা বৈদ্যুতিক তার।’...............চলবে