চর্যাপদ বাংলা ভাষার প্রাচীনতম কাব্য।  একক কোনো কবির হাতে রচিত হয়নি চর্যাপদ।  খ্রিস্টীয় দশম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে রচিত এই গীতিপদাবলির রচয়িতারা ছিলেন সহজিয়া বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যগণ। কথিত রয়েছে;  ‘বাংলা সাধন সংগীত’  নামে শাখাটির সূত্রপাতও হয়েছিলো এই চর্যাপদ থেকেই।  একই সঙ্গে সমকালীন বাংলার সামাজিক ও প্রাকৃতিক চিত্রাবলির এক চিত্র এটি। চর্যাপদের সাহিত্যগুণ আজও অফুরন্ত। ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে; হরপ্রসাদ শাস্ত্রী নামের নেপালের রাজদরবারের গ্রন্থশালা থেকে চর্যার একটি খণ্ডিত পুঁথি উদ্ধার করেন তিনি।  পরবর্তী সময়ে; সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় নানা প্রকার ভাষাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে চর্যাপদের সঙ্গে বাংলা ভাষার এক মিলবন্ধন আবিষ্কার করেন।  চর্যাপদের আবিষ্কার নিয়ে রয়েছে নানা কিংবদন্তী। বাংলায়; মুসলমান সমাজের একক আধিপত্য বিস্তারের বহু পূর্বে, ব্রাহ্মণ্য হিন্দুসমাজের পীড়নে এবং মুসলমান শাসকদের শাসনে ধর্মচ্যুত হবার আশংকায় বাংলার বৌদ্ধগণ তাঁদের নিজস্ব ধর্মীয় পুঁথিপত্র নিয়ে তাঁরা দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হোন।  তাঁদের ধর্মের প্রধান পুরোহিত এবং অন্যান্য সঙ্গীদের সাথে করে তাঁরা নেপাল, ভুটান ও তিব্বতে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন।  ঘটে যাওয়া এই ঘটনার সত্যতা নিরূপণে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী চারবার নেপাল পরিভ্রমণ করেন।  

১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দে বৌদ্ধ লোকাচার সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংগ্রহের জন্য তিনি প্রথমবার নেপাল পরিভ্রমণ করেন। আবার; ১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয়বার নেপাল ভ্রমণের সময় তিনি কিছু বৌদ্ধ ধর্মীয় সংশ্লিষ্ট পুঁথিপত্র সংগ্রহ করেন।  ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী তৃতীয়বারের মতো যখন নেপাল পরিভ্রমন করেন; চর্যাচর্যবিনিশ্চয়  নামক একটি পুঁথি নেপাল রাজদরবারের অভিলিপিশালায় তাঁর দৃষ্টিগোচর হয়। ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে প্রকাশিত হাজার বছরের পুরাণ বাঙ্গালা বৌদ্ধগান ও দোঁহা  শিরোনামে যে লেখাগুলো প্রকাশিত হয়েছিল; সেখানে সম্পাদকীয় ও ভূমিকাসহ এ সব লেখা প্রকাশ করেন হরপ্রসাদ শাস্ত্রী তাঁর নিজ উদ্যোগেই।  

চর্যাচর্যবিনিশ্চয়, সরহপাদের দোহা এবং অদ্বয় বজ্রের সংস্কৃত সহজাম্নায় পঞ্জিকা, কৃষ্ণাচার্য বা কাহ্নপাদের দোহা, আচার্যপাদের সংস্কৃত মেখলা নামক টীকা ও আগেই আবিষ্কৃত ডাকার্ণব পুঁথিসহ একত্রে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মোট ৪৬টি পূর্ণাঙ্গ পদ এবং  একটি খণ্ডিত পদ আবিষ্কার করেন।  যা দেখা দেয় চর্যাপদেরই অংশ হ’য়ে।  প্রাপ্ত পুঁথিটি সুস্থ রূপে পাওয়া যায়নি। আবিষ্কৃত পুঁথিতে চর্যা-পদাবলির যে নাম পাওয়া যায় সেটি হলো 'চর্যাচর্যবিনিশ্চয়'। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী তাঁর সম্পাদিত গ্রন্থে এই নামটিই ব্যবহার করেছেন, সংক্ষেপে এটি ‘বৌদ্ধগান ও দোহা’ বা ‘চর্যাপদ’ নামেও অভিহিত হ’য়ে থাকে। কিন্তু আবিষ্কৃত পুঁথিটি যেহেতু মূল পুঁথি নয়, মূল পুঁথির নকলমাত্র এবং মূল পুঁথিটি (তিব্বতি পুঁথি) যেহেতু এপর্যন্ত অনাবিষ্কৃত, সেই কারণে পরবর্তীকালে চর্যা-পদাবলির প্রকৃত নাম নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে বিতর্কের সৃষ্টি হয়। স্থানে স্থানে বিচ্ছিন্নতা দেখা দেয় পুঁথিটি জুড়ে।  তাই সে দেখা দেয় অসম্পূর্ণতা নিয়ে। সম্পূর্ণ রূপে কি দেখা দিয়েছিল চর্যাপদ ? যা নিয়ে কোনো প্রশ্ন উত্থাপন করেননি অন্য কেউ! যদিও এর মধ্যে কাব্যটির বয়স হ’য়ে গিয়েছে কয়েকশো বছর।  কিন্তু তার সৌন্দর্যে কোনো মলিনতা ছোয়নি। সে যেন আজও চিরতরুণ। প্রথম দিনের মতো।  বিবর্তন ঘটেছে অনেক কিছুর; কিন্তু বাঙলার আদি কাব্যটি আজও সেই রকম। যে রকম ভাবে সে দেখা দিয়েছিল প্রথম দিনে। কতো বয়স দাঁড়ালো বাঙলার প্রাচীন এ কাব্যটির ?  

প্রাপ্ত চর্যাপদটির কয়েকটি পাতা ছেঁড়া ছিল; যার থেকে দেখা দেয় তার অস্পষ্টতা। প্রবোধচন্দ্র বাগচী চর্যার যে তিব্বতি অনুবাদ সংগ্রহ করেন তাতে আরও চারটি পদের অনুবাদসহ ওই খণ্ডপদটির অনুবাদও পাওয়া যায়। মূল পুঁথির পদের সংখ্যা ছিল ৫১। মূল তিব্বতি অনুবাদের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত হয়েছে যে, মূল পুঁথির নাম চর্যাগীতিকোষ এবং এতে পদের সংখ্যা ১০০। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী আবিষ্কৃত পুঁথিটি চর্যাগীতিকোষ থেকে নির্বাচিত পুঁথিসমূহের সমষ্টি।; যা চর্যাপদ নামে আজ পরিচিত।

একক কারো হাতে, একদিনে চর্যাপদ রচিত হয়নি। অনেকে মিলে রচনা করেছেন চর্যাপদ।  সম্মিলিত রচনার আকার হ’লো চর্যাপদ।  চর্যাপদ একটি সম্মিলিত প্রয়াসের ফসল। চর্যাপদের রচনাকারীরা কবি বা সিদ্ধাচার্য নামে পরিচিত হতেন অন্যর কাছে। ।উল্লেখ থাকে যে;  বজ্রযানী ও সহজযানী আচার্যগণই সিদ্ধাচার্য নামে অভিহিত হতেন। তিব্বতি ও ভারতীয় কিংবদন্তীতে এঁরাই চৌরাশি সিদ্ধা নামে পরিচিত ছিলেন। তবে আসলে এই ৮৪ জন সিদ্ধাচার্য কে বা কারা ছিলেন তা সঠিকমতে আজও জানা যায়নি। তাঁদের নাম ঠিকানা থেকে যায় এক গভীর অন্ধকারে। কোথায় থাকতেন তাঁরা ? কেমন ছিল তাঁদের জীবন-যাপন ? তাঁরা কি সুখী ছিলেন অন্য অনেক কিছুর মতো ? কোনো দুঃখ কি স্পর্শ ক’রেনি তাঁদের মনকে! হাহাকার আর আত্মচিৎকার থেকে প্রবাহিত ধারায় সুখ কি গ’লে যায়নি তাঁদের হৃদয়ে। তাঁরা কি স্বপ্ন দেখতেন আমাদের মতো ! না, তাঁরা রচনা করেছেন কবিতা সকাল বিকাল আর সন্ধ্যায়।  যেন এক নিত্য সৃষ্টির মাঝে নিমগ্ন রয়েছে তাঁরা।        
চর্যাপদের কবিরা ছিলেন পূর্ব ভারত ও নেপাল রাষ্ট্রের অধিবাসী। একক কোনো অঞ্চল নয়; বরং বিভিন্ন অঞ্চল থেকে তাঁরা সমবেত হয়েছিলেন। কেউ ছিলেন পূর্ব বঙ্গের, আবার কেউ উত্তরবঙ্গের; কেউ বা রাঢ়ের অধিবাসী। একক কোনো অঞ্চল থেকে তাঁরা আসেননি। কেউ এসেছেন বিহার থেকে, কেউ ওড়িশা, কেউ বা আবার অসম বা কামরূপের অঞ্চল থেকে। শুধু অঞ্চল নয়; বিভিন্ন জাতিগত ব্যক্তির সমন্নয় ঘটেছিল চর্যাপদের কবিদের মধ্যে। এদের মধ্যে কেউ ব্রাহ্মণ, কেউ কায়স্থ, কেউ ক্ষত্রিয়, কেউ বণিক, এমনকি অন্ত্যজ শ্রেণীর লোকও ছিল। তাঁদের  মধ্যে কেউ কেউ আবার রাজবংশজাতও ছিলেন। এঁরা পিতৃপ্রদত্ত নাম ত্যাগ ক’রে নতুন নাম ধারণ করেছিলেন; তাই এদের নিদিষ্ট ক’রে আর চিহ্নিত করা যায় না তাঁদের পূর্ব নামে বা পারিবারিক নামে। এদের মধ্য কেউ কেউ প্রচলিত হিন্দুধর্মের সনাতন শাস্ত্রবিধান পরিত্যাগ করেছেন ব’লে এদেরকে ধর্ম বিরোধী ব’লে আখ্যায়িত করা হয়েছে।  এর জন্য সহ্য করতে হয়েছে অনেক মান অভিমান।
বিধুশেখর শাস্ত্রী;  ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে চর্যার প্রথম পদের সংস্কৃত টীকাটি উদ্ধৃত ক’রে শ্লোকাংশের আশ্চর্যচর্যাচয় কথাটিকে কাব্যগ্রন্থটির নাম হিসাবে রাখার প্রস্তাব রাখেন। তিনি মনে করেন, আশ্চর্যচর্যাচয় কথাটিই নেপালী পুঁথি নকলকারীর ভুলবশত চর্যাচর্যবিনিশ্চয় হয়েছে। তবে তাঁর এই মতকে যথার্থ সত্য মনে করেননি অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়; তিনি সন্দেহ প্রকাশ করেন তাঁর এই কথায়। প্রবোধচন্দ্র বাগচী নামে অপর আর একজন ওই একই সূত্র ধরে চর্যা-পুঁথির নাম চর্যাশ্চর্যবিনিশ্চয় রাখার পক্ষপাতী ছিলেন। কিন্তু অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বিভিন্ন যুক্তি খণ্ডন ক’রে লিখেছেন, আশ্চর্যচর্যাচয় নামটিও অসামজ্জস্য নয়। কিন্তু চর্যাচর্যবিনিশ্চয় ও আশ্চর্যচর্যাচয়, দুই নামকে মিলিয়ে চর্যাশ্চর্যবিনিশ্চয় নামটি গ্রহণ করা যায় না।  এভাবে চলতে থাকে বছরের পর বছর।  কিন্তু এ সমস্যার কোনো সমাধান দেখা দেয় না তাঁদের হাতে।  

আবিষ্কৃত পুঁথিটিতে ৫০টি চর্যায় মোট ২৪ জন সিদ্ধাচার্যের নাম পাওয়া যায়। এঁরা হলেন: লুই, কুক্কুরী, বিরুআ, গুণ্ডরী, চাটিল, ভুসুকু, কাহ্ন, কাম্বলাম্বর, ডোম্বী, শান্তি, মহিত্তা, বীণা, সরহ, শবর, আজদেব, ঢেণ্ঢণ, দারিক, ভাদে, তাড়ক, কঙ্কণ, জঅনন্দি, ধাম, তান্তী পা, লাড়ীডোম্বী। এঁদের মধ্যে লাড়ীডোম্বীর পদটি পাওয়া যায়নি। ২৪, ২৫ ও ৪৮ সংখ্যক পদগুলি হরপ্রসাদ শাস্ত্রী আবিষ্কৃত পুঁথিটিতে না থাকলেও প্রবোধচন্দ্র বাগচী আবিষ্কৃত তিব্বতি অনুবাদে এগুলির রচয়িতার নাম উল্লিখিত হয়েছে যথাক্রমে কাহ্ন, তান্তী পা ও কুক্কুরী। এই নামগুলির অধিকাংশই তাঁদের ছদ্মনাম এবং ভনিতার শেষে তাঁরা নামের সঙ্গে 'পা' বা ‘পদ’ শব্দটি সম্ভ্রমবাচক অর্থে ব্যবহার করতেন।  যেন কারো সাথে কারো নাম একত্রে মিলে না যায়।

সাধারণভাবে; লুইপাদকেই আদি সিদ্ধাচার্য মনে করা হয়।  তাঞ্জর বর্ণনা অনুযায়ী তিনি ছিলেন বাঙালি।  তিনি মগধের বাসিন্দা ছিলেন ও রাঢ় ও ময়ূরভঞ্জে আজও তাঁর নাম শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করা হয়। ১ ও ২৯ সংখ্যক পদদুটি তাঁর রচিত।
চর্যার পুঁথিতে সর্বাধিক সংখ্যক পদের রচয়িতাকারী হিশেবে যার নাম পাওয়া যায় তিনি  কাহ্ন বা কাহ্নপাদ। তিনি কৃষ্ণাচার্য, কৃষ্ণপাদ ও কৃষ্ণবজ্র নামেও পরিচিত। পুঁথিতে তাঁর মোট ১১টি পদ (পদ- ৭, ৯, ১১, ১২, ১৮, ১৯, ২৪, ৩৬, ৪০, ৪২ ও ৪৫) পাওয়া যায়। তিনি ‘ওড়িশার’ এক ব্রাহ্মণ বংশে জন্মগ্রহণ করেন বলে জানা যায়। শৌরসেনী অপভ্রংশ ও মাগধী অপভ্রংশজাত বাংলায় তিনি পদ রচনা করতেন।  ভুসুকুপাদও বাঙালি ছিলেন বলে অনেকে বিশ্বাস করেন। কেউ কেউ তাঁকে চর্যাগানের শান্তিপাদের সঙ্গে অভিন্ন মনে করেন। চর্যার পুঁথিতে তাঁর আটটি পদ (পদ- ৬, ২১, ২৩, ২৭, ৩০, ৪১, ৪৩, ৪৯) রয়েছে। এছাড়া সরহপাদ চারটি (পদ- ২২, ৩২, ৩৮, ৩৯), কুক্কুরীপাদ তিনটি(পদ- ২, ২০, ৪৮) এবং শান্তিপাদ (পদ- ১৫ ও ২৬) ও শবরপাদ দুইটি পদ (পদ- ২৮ ও ৫০) রচনা করেন। একটি করে পদ রচনা করেন বিরুআ (পদ ৩), গুণ্ডরী (পদ ৪), চাটিল (পদ ৫), কম্বলাম্বরপাদ (পদ ৮), ডোম্বীপাদ (পদ ১৪), মহিণ্ডা (পদ ১৬), বীণাপাদ (পদ ১৭), আজদেব (পদ ৩১), ঢেণ্ঢণ (পদ ৩৩), দারিক (পদ ৩৪), ভদ্রপাদ (পদ ৩৫), তাড়ক (পদ ৩৭), কঙ্কণ (পদ ৪৪), জঅনন্দি (পদ ৪৬), ধাম (পদ ৪৭) ও তান্তী পা (পদ ২৫, মূল বিলুপ্ত)।  নাড়ীডোম্বীপাদের  কোন পদ পাওয়া যায় না উল্লেখিত পুঁথিতে।

২.
চর্যার রচনার সময়কাল নিয়েও ইতিহাস গবেষকদের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় ও প্রবোধচন্দ্র বাগচীর মতে চর্যার পদগুলি খ্রিস্টীয় দশম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে রচিত। কিন্তু ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ও রাহুল সাংকৃত্যায়ন এই সময়কালকে আরও কমপক্ষে ২০০ বছর পিছিয়ে দিয়ে চর্যার রচনাকাল খ্রিস্টীয় অষ্টম থেকে দ্বাদশ শতাব্দী বলে মতপ্রকাশ করেছেন।  যদিও সবাই এখানে পৌঁছেতে পারেনি একক সিদ্ধান্তে।  যে সময় বা কালকে নির্ধারণ করা হবে এ পুঁথিটির রচনার একটি উৎকৃষ্ট সময়।  

হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মতে, অতীশ দীপঙ্কর (৯৮০-১০৫৩ খ্রিস্টাব্দ) তিব্বত যাত্রার পূর্বে (১০৩০ খ্রিস্টাব্দ) লুইপাদের অভিসময়বিহঙ্গ রচনায় সাহায্য করেছিলেন। একথা সত্য হলে লুইপাদ দশম শতাব্দীর শেষভাগে বর্তমান থাকবেন এটাও সত্য।  অপরদিকে তিব্বতি কিংবদন্তী অনুসারে তিনিই সিদ্ধাচার্যদের আদিগুরু; অর্থাৎ, চর্যার সময়কালও দশম শতাব্দীর পূর্বে হতে পারে না।  এখানেও দেখা দেয় বিভিন্ন মত; একক কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সম্ভবপর হ’য়ে উঠে না পুঁথিটি নিয়ে।  

অন্যদিকে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারে হেবজ্রপঞ্জিকাযোগরত্নমালা নামে এক বৌদ্ধতান্ত্রিক পুঁথির সন্ধান মেলে, যেটির রচনাকাল শেষ পালরাজা গোবিন্দপালের (১১৫৫ খ্রিস্টাব্দ) শাসনকাল। বিশেষজ্ঞদের মতে এই পুঁথির রচয়িতা শ্রীকৃষ্ণাচার্যই প্রকৃতপক্ষে চর্যার কাহ্নপাদ বা চর্যা-টীকার কৃষ্ণাচার্য।  কথিত রয়েছে, নাথ সাহিত্য অনুযায়ী কাহ্নপাদের গুরু জালন্ধরিপাদ বা হাড়িপা, যিনি গোরক্ষনাথের শিষ্য ছিলেন। আবার মারাঠি গ্রন্থ জ্ঞানেশ্বরী (রচনাকাল আনুমানিক ১২৯০ খ্রিস্টাব্দ) থেকে জানা যায় উক্ত গ্রন্থের রচয়িতা জ্ঞানদেব দীক্ষালাভ করেন নিবৃত্তিনাথের কাছ থেকে, যিনি গোরক্ষনাথের শিষ্য গেইনীনাথ বা গোয়নীনাথের থেকে দীক্ষাপ্রাপ্ত। সেই হিসাবেও কাহ্নপাদকে দ্বাদশ শতাব্দীর মানুষ বলে মনে হয় এবং প্রধান একজন মনে করা হয় রচিত এ পুঁথিটির।  যে পুঁথিটি বিস্তার ঘটাচ্ছে বহুজনের হাতে হাতে।  কার হাতে পরিপূর্ণতা পেয়েছিল চর্যাপদ নামক পুঁথিটি ? তা-কি আজও পরিপূর্ণ হ’য়ে দেখা দিয়েছে তার আদি সৃষ্টির সময় হতে।? নাকি হাতে হাতে তার বিবর্তন ঘটেছে সুচনা হতে আজ পর্যন্ত; যে চর্যাপদটি বেঁচে আছে বাংলা ভাষার প্রাচীনতম কাব্য হ’য়ে।

অনেক তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে চর্যার পদগুলি খ্রিস্টীয় দশম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে রচিত বলেই মনে করা হয়। কিন্তু কাদের মান বা তথ্য দিয়ে বিশ্লেষণ করা হয়েছিল এ পুঁথিটি তা অনেকটাই থেকে যায় অজ্ঞাত। তবে তার পরেও দু-তিনশো বছর ধরে গোপনে চর্যাগীতি রচিত হয়েছিল। শশিভূষণ দাশগুপ্ত নেপাল ও তরাই অঞ্চল থেকে এই ধরণের শতাধিক পদ উদ্ধার করেছেন ১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দে। এগুলো কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় নব চর্যাপদ নামে সংকলিত ও প্রকাশিত হয়; যা অনেকটা দেখা দেয় চর্যাপদের নব্য সংস্করণ রূপে।

চর্যাপদ কি রচিত হয়েছিল বাংলা ভাষায় ? যে ভাষায় আমরা কথা বলি, কবিতা লিখি, গল্প লিখি, আমাদের মনের ভাব প্রকাশ করি।  এ নিয়েও দেখা দেয় অনেক মত, তার সাথে দ্বিধাদণ্ড ।  অনেক তর্ক- বিতর্কের পর যদিও এর অবসান ঘটে।  এটি বাংলা ভাষার একটি গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন তাতে কোনো সন্ধেহ নেই।  চর্যাপদের রচয়িতা বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যগণ সংস্কৃতে পারদর্শী হলেও তাঁরা তৎকালীন অপরিণত বাংলাতেই পদগুলি রচনা করেছিলেন বলেই মনে করা হয়। চর্যাপদের ভাষা বাংলা ভাষার অদ্যাবধি আবিষ্কৃত আদিতম রূপ। হিন্দি, ওড়িয়া বা মৈথিলি বিদ্বজ্জনেরা এই ভাষায় নিজেদের পূর্বসূরিত্বের সন্ধান করলেও ভাষাবৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের ফল বাংলা ভাষারই অনুকূল। এই ভাষা সম্প্রদায়বিশেষের সাধন-সঙ্গীতের ভাষা বিধায় এখানে দেখা দেয় ভাষার অস্পষ্ট ও দুর্বোধ্যতা; যদিও এতে উল্লিখিত ছন্দ ও রাগ-রাগিনী পরবর্তীকালের বাঙালি কবিদের পথনির্দেশিকারূপে কাজ করে এবং অনেকটা সহজ হ’য়ে দেখা দেয় চর্যাপদ।  চর্যার পদসংগ্রহ প্রকাশিত হবার পর চর্যার ভাষা নিয়ে যেমন প্রচুর গবেষণা হয়েছে, তেমনি ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের বিদ্বজ্জনেরা এই ভাষার উপর নিজ নিজ মাতৃভাষার অধিকার দাবি করে বিতর্ক সৃষ্টি করেছেন; এবং দাবী করেছেন পুঁথিটি নিজেদের ভাষার বলে।
হরপ্রসাদ শাস্ত্রী; তাঁর সম্পাদিত হাজার বছরের পুরাণ বাঙ্গালা বৌদ্ধ গান ও দোহা গ্রন্থের ভূমিকায় চর্যাচর্যবিনিশ্চয়, সরহপাদ ও কৃষ্ণাচার্যের দোহা এবং ডাকার্ণব-কে সম্পূর্ণ প্রাচীন বাংলার নিদর্শন বলে দাবি করেছেন। শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের আবিষ্কর্তা ও সম্পাদক বসন্তরঞ্জন রায় বিদ্বদ্বল্লভও তাঁর দাবিকে সমর্থন করেন মন প্রাণ দিয়ে। ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে বিজয়চন্দ্র মজুমদার তাঁদের দাবি অস্বীকার করে চর্যা ও অন্যান্য কবিতাগুলির সঙ্গে বাংলা ভাষার সম্বন্ধের দাবি পরিত্যাগ করার চেষ্টা করেন। কিন্তু, ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় তাঁর ‘The Origin and Development of the Bengali Language’ গ্রন্থে চর্যাগান ও দোহাগুলির ধ্বনিতত্ত্ব, ব্যাকরণ ও ছন্দ বিশ্লেষণ করে শুধুমাত্র এইগুলিকেই প্রাচীন বাংলার নিদর্শন হিসেবে গ্রহণ করেন। ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ’র প্যারিস থেকে প্রকাশিত ‘Les Chants Mystique de Saraha et de Kanha’ গ্রন্থে সুনীতিকুমারের একটি পরিপূর্ণ মত গ্রহণ করেন।  যার ফলে অনেকটা সহজ হ’য়ে দেখা দেয় চর্যাপদের ভবিষ্যৎ।  

যে সকল ভাষাতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য চর্যাপদের সঙ্গে বাংলার সম্পর্ককে আরও গভীর প্রমাণ ক’রে সেগুলির একটি তালিকা হলো এ রকমঃ
সম্বন্ধ পদে –অর বিভক্তি, সম্প্রদানে –কে, সম্প্রদানবাচক অনুসর্গ –অন্তরে (মধ্যযুগীয় ও আধুনিক রূপ –তরে), অধিকরণে –অন্ত, -ত, অধিকরণবাচক অনুসর্গ –মাঝে, অতীত ক্রিয়ায় –ইল এবং ভবিষ্যত ক্রিয়ায় -ইব। চর্যা মৈথিলী বা পূরবীয়া হিন্দিতে রচিত হলে অতীত ক্রিয়ায় –অল ও ভবিষ্যতে –অব যুক্ত হত।

গুনিয়া, লেহঁ, দিল, ভণিআঁ, সড়ি, পড়িআঁ, উঠি গেল, আখি বুজিঅ, ধরণ ন জাঅ, কহন না জাই, পার করেই, নিদ গেলা, আপনা মাংসে হরিণা বৈরী, হাড়ীত ভাত নাহি ইত্যাদি বাগভঙ্গিমা ও শব্দযোজনা বাংলা ভাষায় পরবর্তীকালেও আরও সুলভ হয়ে দেখা দেয় । এর সঙ্গে অবশ্য তসু, জৈসন, জিস, কাঁহি, পুছমি প্রভৃতি পশ্চিমা অপভ্রংশের শব্দও রয়েছে অজস্র পরিমাণে  ।; তবে সেগুলি মূলত কৃতঋণ শব্দ হিসাবেই চর্যায় ব্যবহৃত হয়েছে।
এছাড়া সম্প্রদানে –ক এবং –সাথ, -লাগ, -লগ-এর বদলে সঙ্গে, সম অনুসর্গের ব্যবহার এবং নাসিক্যধ্বনির বাহুল্যের জন্য চর্যার ভাষাকে রাঢ় অঞ্চলের ভাষা বলেও মনে করা হয়। অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় এ সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন, ‘চর্যার আচার্যেরা কামরূপ, সোমপুরী, বিক্রমপুর – যেখান থেকেই আসুন না কেন, আশ্চর্যের বিষয়, এঁরা সকলেই রাঢ় অঞ্চলের ভাষানীতি গ্রহণ করেছিলেন। ’ যার চিহ্ন আমরা দেখতে পাই চর্যাপদের সমস্ত শরীর জুড়ে।  

রাহুল সাংকৃত্যায়ন বা অন্যান্য ভাষার বিদ্বজ্জনেরা; যাঁরা চর্যাপদকে নিজ নিজ ভাষার প্রাচীন নিদর্শন বলে দাবি করেছিলেন, তাঁরা এই রকম সুস্পষ্ট ও যুক্তিপূর্ণ বৈজ্ঞানিক প্রমাণের দ্বারা নিজেদের দাবি প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হননি।  তাঁরা দেখাতে সক্ষম হননি চর্যাপদ তাদের ভাষারই হ’য়ে দেখা দিয়েছে।  যার দাবি শুধু তারাই করতে পারবে।
চর্যাপদের ভাষা প্রচলিত বাংলা ভাষার মতো নয়; সেই ভাষার অভ্যন্তরে রয়েছে অস্পষ্ট ও দুর্বোধ্যতা ; তা দেখা মাত্রই আমাদের হৃদয়ে প্রবেশ করে না; যেমন প্রবেশ করে আজকের ভাষা।  সেই কারণে চর্যায় ব্যবহৃত ভাষাকে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী  ‘সন্ধ্যাভাষা’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। তাঁর মতে,

‘সহজিয়া ধর্মের সকল বই-ই সন্ধ্যা ভাষায় লেখা।  সন্ধ্যা ভাষার মানে আলো-আঁধারি ভাষা, কতক আলো, কতক অন্ধকার, খানিক বুঝা যায়, খানিকটা বুঝা যায় না। অর্থাৎ, এই সকল উঁচু অঙ্গের ধর্মকথার ভিতরে একটা অন্য ভাবের কথাও আছে। সেটা খুলিয়া ব্যাখ্যা করিবার নয়। যাঁহারা সাধনভজন করেন তাঁহারাই সে কথা বুঝিবেন, আমাদের বুঝিয়া কাজ নাই।’

বজ্রযানী ও সহজযানী গ্রন্থকারগণ প্রায়ই এ ভাষা নিয়ে এক রহস্যের ইঙ্গিত দিতেন। বজ্রযানী গ্রন্থগুলিতে ‘সন্ধ্যাভাষা’ শব্দটি বহুল-ব্যবহৃত। তিব্বতি ভাষায় ‘সন্ধ্যাভাষা’র অর্থ ‘প্রহেলিকাচ্ছলে উক্ত দুরুহ তত্ত্বের ব্যাখ্যা’। যদিও মহামহোপাধ্যায় বিধুশেখর শাস্ত্রী ও ডক্টর প্রবোধচন্দ্র বাগচী ‘সন্ধ্যা’র বদলে সন্-ধা ধাতু থেকে নিষ্পন্ন ‘সন্ধা’ শব্দটি ব্যবহারের পক্ষপাতী। তাঁদের মতে, ‘সন্ধ্যা’ লিপিকরদের প্রমাদ। ‘সন্ধা’ শব্দের অর্থ ‘অভিপ্রেত, উদ্দিষ্ট, আভিপ্রায়িক বচন’। ম্যাক্সমুলার ‘সন্ধা’র অর্থ করেছেন ‘প্রচ্ছন্ন উক্তি’ (‘hidden saying’)। চর্যার ধর্মীয় প্রসঙ্গের সঙ্গে ‘সন্ধা’ এ-দিক দিয়ে যুক্তিগ্রাহ্য হলেও, যেহেতু অধিকাংশ পুঁথিতেই ‘সন্ধ্যা’ শব্দটি রয়েছে সেই কারণে হরপ্রসাদের অর্থেই আধুনিক গবেষকগণ এই শব্দটি গ্রহণ করেছেন। চর্যাপদের গুপ্ত ভাষার বৌদ্ধতান্ত্রিক ব্যাখ্যার চেষ্টা করা হয়েছে।

প্রাচীন বাংলার ভাষাতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যগুলির সন্ধানে প্রাকৃত বাংলায় রচিত চর্যাপদ একটি মূল্যবান উপাদান।  ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে  সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় প্রথম এই বৈশিষ্ট্যগুলি নিয়ে বিজ্ঞানসম্মত আলোচনা করেন তাঁর The Origin and Development of the Bengali Language গ্রন্থে। এরপর ডক্টর সুকুমার সেন, ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, তারাপদ মুখোপাধ্যায়, পরেশচন্দ্র মজুমদার ও ডক্টর রামেশ্বর শ' চর্যার ভাষাতত্ত্ব নিয়ে বিস্তারিত গবেষণা করেন।  ফলে আজ চর্যার ভাষার স্বরূপটি অনেক বেশি সুস্পষ্ট হ’য়ে দেখা দেয় সর্বজনের কাছে।  চর্যাপদের ভাষার রূপান্তরের একটি নমুনা নিচে উল্লখ করা হলো।

চর্যায় অ-কার কিছু বেশি বিবৃত (open) ; কতকটা আধুনিক আ-এর কাছাকাছি। সম্ভবত আদিস্বরের শ্বাসাঘাতের জন্য অ/আ ধ্বনির বিপর্যয় দেখা যায়। যেমন: অইস/আইস, কবালী/কাবালী, সমাঅ/সামাঅ ইত্যাদি।

ব্যঞ্জনধ্বনির ক্ষেত্রে প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো: পদমধ্যে ‘হ’-ধ্বনির সংরক্ষণ (যেমন: খনহ, তঁহি, করহ ইত্যাদি); মহাপ্রাণ বর্ণের অস্তিত্ব (যেমন: আহ্মে, কাহ্ন, দিঢ় ইত্যাদি) এবং ওড়িয়া-সুলভ ‘ল’-ধ্বনি বজায় থাকা।
প্রাকৃতের সমযুগ্মব্যঞ্জন সরলীকৃত হয়ে চর্যায় একক ব্যঞ্জনে পরিণত হয়েছে। ফলে পূর্বস্বরের পূরকদীর্ঘত্ব ঘটেছে। যেমন: প্রাচীন ভারতীয় আর্য ‘মধ্য’> মধ্য ভারতীয় আর্য ‘মজ্ঝ’> প্রাকৃত বাংলা ‘মাঝ’ ইত্যাদি।

নাসিক্যব্যঞ্জনের পূর্বস্বর দীর্ঘত্বলাভের সঙ্গে সঙ্গে অনুনাসিক হয়ে গেছে। যেমন: চন্দ্র>চন্দ>চাঁদ ইত্যাদি।

পাশাপাশি অবস্থিত একাধিক স্বরধ্বনির অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যায়। যেমন: উদাস>উআস। পদান্তেও স্বরধ্বনির ব্যবহার দেখা যায়। যেমন: ভণতি>ভণই ইত্যাদি।
পদান্তে স্থিত একাধিক স্বর যৌগিক স্বররূপে উচ্চারিত হতো এবং ক্রমে দুইয়ে মিলে একক স্বরে পরিণত হত। যেমন: প্রাচীন ভারতীয় আর্য ‘পুস্তিকা’> মধ্য ভারতীয় আর্য ‘পোত্থিআ’> প্রাকৃত বাংলা ‘পোথী’ ইত্যাদি।
‘য়’-শ্রুতি বিদ্যমান ছিল; ‘ব’-শ্রুতিও দেখা গেছে। যেমন: নিয়ড্ডী>নিয়ড়ি; নাই>নাবী ইত্যাদি।

চর্যায় স্বরসংগতির দু-একটি উদাহরণ মেলে। যেমন: সসুরা (<শ্বশুর) ইত্যাদি।
‘শ’, ‘ষ’, ‘স’ এবং ‘ন’, ‘ণ’-এর যথেচ্ছ ব্যবহার দেখা যায়। যেমন: নিঅ/ণিঅ, নাবী/ণাবী, সহজে/ষহজে, আস(<আশা) ইত্যাদি।

দীর্ঘস্বর ও হ্রস স্বরের উচ্চারণের পার্থক্য হ্রাস পেয়েছিল। যেমন: শবরি/সবরী, জোই/জোঈ ইত্যাদি।

পদের আদিতে ‘য’-ধ্বনি ‘জ’-ধ্বনিতে পরিণত হয়েছিল। যেমন: জাই/যাই।
চর্যার নামপদের লিঙ্গভেদ ছাড়াও সর্বনাম, বিশেষণ, সম্বন্ধবাচক শব্দেও লিঙ্গভেদ ছিল। যেমন: হরিণ/হরিণী, শবরা/শবরী, ‘রাতি পোহাইলি’, ‘গুঞ্জরী মালী’ ইত্যাদি।
একবচন-বহুবচনের পার্থক্য ছিল; সংখ্যাবাচক শব্দযোগে, সমষ্টিবাচক পদযোগে এবং দ্বিরুক্তিপদ প্রয়োগের দ্বারা বহুবচন বোঝান হতো। যেমন: ‘বতিস জোইনী’, ‘পঞ্চবিডাল’, ‘উঁচা উঁচা পাবত’ ইত্যাদি।

চর্যায় দেখা দেয় দুটি কারক।  যথা: মুখ্যকারক ও গৌণকারক।  মুখ্যকারকে বিভক্তি শূণ্য বা -এ।  যেমন: ‘সরহ ভণই’, ‘কুম্ভীরে খাঅ’ ইত্যাদি। গৌণকারকে -এঁ বা -এ বিভক্তি। যেমন: ‘সহজে থির করি’ (কর্ম কারক), ‘কুঠারে ছিজঅ’ (করণ কারক), ‘হিএঁ মাঝে’ (অধিকরণ কারক) ইত্যাদি।  বিভিন্ন স্থানে বিভক্তিহীনতার উদাহরণও পাওয়া যায়। যেমন: ‘কায়া তরুবর’।

-এর ও -ক বিভক্তির মাধ্যমে সম্বন্ধপদ নিষ্পন্ন হতো। যেমন: ‘রুখের তেন্তুলি’, ‘করণক পাটের আস’ ইত্যাদি।
-ক, -কে ও –রে বিভক্তি দ্বারা গৌণকর্মের ও সম্প্রদানের পদসিদ্ধ হতো।  যেমন: ‘নাশক’, ‘বাহবকে পারই’, ‘রসানেরে কংখা’ ইত্যাদি।
-ই, -এ, -হি, -তেঁ ও –ত অধিকরণের বিভক্তি হিসাবে ব্যবহৃত হতো।  যেমন: ‘নিঅড়ি’, ‘ঘরে’, ‘হিঅহি’, ‘সুখদুখেতেঁ’, ‘হাঁড়িত’ ইত্যাদি।

করণের বিশিষ্ট বিভক্তি –এঁ সপ্তমীর সঙ্গে প্রায় অভিন্ন হওয়ার কারণেও –তেঁ, -এতেঁ, -তে বিভক্তি দেখা যায়। যেমন: ‘সাঁদে’ (<শব্দেন), ‘বোধেঁ’ (<বোধেন), ‘মতিএঁ’, ‘সুখদুখেতেঁ’ (<সুখদুঃখ+এ+ত+এন)।
অপাদানে অপভ্রষ্ট থেকে আগত -হুঁ বিভক্তি দু-একটি পাওয়া গেছে। যেমন: ‘খেপহুঁ’, ‘রঅনহুঁ’।

চর্যাপদে গৌণকারকে ব্যবহৃত অনুসর্গেও (post position) বৈচিত্র্যময়তা দেখা যায়।  যেমন: ‘ডোম্বী-এর সঙ্গে’ (নামবাচক অনুসর্গ), ‘দিআঁ চঞ্চালী’ (অসমাপিকা অনুসর্গ)।
সংস্কৃতের মতো কর্মভাববাচ্যের প্রচুর বিস্তার রয়েছে চর্যাপদে। যেমন: ‘নাব ন ভেলা দীসই’, ‘ধরণ ন জাই’ ইত্যাদি।

চর্যাপদে যৌগিক কালের উদাহরণ না থাকলেও যৌগিক ক্রিয়ার ব্যবহার রয়েছে প্রচুর পরিমাণে।  যেমন: ‘গুণিআ লেহুঁ’, ‘নিদ গেল’ ইত্যাদি।
নিষ্ঠাপ্রত্যয়ে –এ বিভক্তি দেখা যায়।  যেমন: ‘সহজে থির করি’ ইত্যাদি।
চর্যায় এমন সব বিশিষ্ট প্রয়োগ আছে যা বাংলা ভাষাভিন্ন অন্য ভাষায় পাওয়া যায় না। যেমন: ‘ভান্তি ন বাসসি’, ‘দুহিল দুধু’ ইত্যাদি।

কর্মভাববাচ্যে অতীতকালে –ই, -ইল এবং ভবিষ্যতকালে –ইব বিভক্তির প্রয়োগ দেখা যায়। যেমন: ‘চলিল কাহ্ন’, ‘মই ভাইব’ ইত্যাদি।

প্রাচীন বাংলার চর্যাপদে ব্যবহৃত প্রবচনগুলি বাংলা ভাষায় ঐতিহ্যবাহী। যেমন: ‘হাড়িত ভাত নাহি নিতি আবেশী’, ‘আপনা মাংসেঁ হরিণা বৈরী’ ইত্যাদি।


৩.
চর্যাপদে রয়েছে ছন্দের খেলা।  চর্যার পদগুলি প্রধানত পয়ার ও ত্রিপদী পদে রচিত।  এতে মাত্রাছন্দের প্রভাবও লক্ষণীয়। ১৬ মাত্রার পাদাকুলক ছন্দের ব্যবহারই বেশি।  তবে সর্বত্র নির্দিষ্ট মাত্রারীতি দেখা যায়নি। ছন্দপংক্তির পর্বসংখ্যাগত বৈচিত্র্যও এই পদগুলির অন্যতম বৈশিষ্ট্য।  ডক্টর অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় মনে করেন, ‘তত্ত্বকথার ব্যাখ্যা এবং তাকে ব্রাহ্মণ সমাজের শ্যেনদৃষ্টি থেকে গোপন করা – এই দিকে পদকর্তারা এবং সিদ্ধাচার্যরা অত্যন্ত সচেতন ছিলেন বলে কবিতার আঙ্গিকের দিকে দৃষ্টি দেবার অবকাশ পাননি।  তবে একটা কথা সত্য যে , চর্যাগানেই সর্বপ্রথম পয়ার-ত্রিপদীর আদিসুর ধ্বনিত হয়েছে।  সংস্কৃতে রচিত গীতগোবিন্দও এর প্রভাব অস্বীকার করতে পারেনি। ’
চর্যায় অনুপ্রাসের প্রয়োগ ব্যাপক।; প্রায় প্রতিটি পদই অন্ত্যমিলযুক্ত।, অন্তানুপ্রাসও প্রচুর পরিমাণে। যেমন: ‘বাহ তু ডোম্বী বাহ লো ডোম্বী বাটত ভইলা উদারা’। চর্যায় উল্লিখিত ছন্দ ও অলংকারগুলি পরবর্তীকালের কবিদের পথপ্রদর্শকস্বরূপ হয়েছিল।
চর্যাপদ একাধিক চরণবিশিষ্ট, অন্ত্যমিলযুক্ত ও গীতিধর্মী। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, সংস্কৃত সাহিত্যের চিত্রধর্মী শ্লোক বাংলা সাহিত্যের উপর কোনও স্থায়ী প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি বরং চর্যার গীতিকবিতাগুলিই পরবর্তী বাংলা কাব্যসঙ্গীতের আঙ্গিকের ক্ষেত্রে আদর্শ হয়ে ওঠে। অন্যদিকে চর্যার কবিরা যে তাঁদের ধর্মদর্শন ও সাধনপদ্ধতি রূপকের আড়ালে ব্যক্ত করে গান বেঁধেছিলেন, পরবর্তীকালের হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের সাধককবিরা সেই আদর্শেই তাঁদের স্ব স্ব ধর্মীয় সাধনসঙ্গীত রচনায় প্রবৃত্ত হন। বৈষ্ণব পদাবলি, বাউল গান, সুফি মুর্শিদি গান, নাথপন্থী দেহযোগী গান বা শাক্তপদাবলি– সবই চর্যাসংগীতের উত্তরসূরী।

চর্যার পদগুলিতে পদকর্তাদের নামের সঙ্গে বিভিন্ন রাগ-রাগিনীর নামও পাওয়া যায়। এথেকে সহজেই অনুমিত হয় যে, এই পদগুলি সুরসহযোগে গাওয়া হতো। পটমঞ্জরী রাগে চর্যার ১১টি পদ (পদ- ১, ৬, ৭, ৯, ১১, ১৭, ২০, ২৯, ৩১, ৩৩ ও ৩৬) নিবদ্ধ। এই রাগে গাওয়া পদের সংখ্যাই সর্বাধিক। এরপরেই মল্লারী রাগে ৫টি পদ (পদ- ৩০, ৩৫, ৪৪, ৪৫ ও ৪৯) নিবদ্ধ রয়েছে। ৪টি করে পদ ভৈরবী (পদ-১২, ১৬, ১৯ ও ৩৮), কামোদ (পদ- ১৩, ২৭, ৩৭ ও ৪২), বরাড়ী (চর্যায় অপর নাম বলাড্ডি, পদ- ২১, ২৩, ২৮ ও ৩৪) এবং গুঞ্জরী (চর্যায় অপর নাম গুঁজরী বা কহূ গুংজরী, পদ- ৫, ২২, ৪১ ও ৪৭) রাগে নিবদ্ধ। গৌড় (চর্যায় নাম গবড়া বা গউড়া, পদ- ২, ৩, ১৮) রাগে ৩টি পদ নিবদ্ধ। দেশাখ (চর্যায় অপর নাম দ্বেশাখ, পদ- ১০ ও ৩২), রামকেলি (চর্যায় অপর নাম রামক্রী, পদ- ১৫ ও ৫০), আশাবরী (চর্যায় অপর নাম শিবরী বা শবরী, পদ- ২৬ ও ৪৬) ও মালসী (চর্যায় অপর নাম মালসী গবুড়া, পদ- ৩৯ ও ৪০) রাগে ২টি করে এবং অরু (পদ ৪), দেবগিরি (চর্যায় অপর নাম দেবক্রী, পদ ৮), ধানশী (চর্যায় অপর নাম ধনসী,পদ ১৪) ও বঙ্গাল (পদ ৩৩) রাগে একটি করে পদ নিবদ্ধ। ২৫তম পদটি খণ্ডিত ও এর রাগনির্দেশ সম্পর্কে কিছুই জানা যায় না।

চর্যাগীতিতে প্রতি পদের প্রত্যেক দুই লাইনের শেষে ধ্রু এই শব্দটি পাওয়া যায়, যা ধুঁয়া বা ধ্রুবপদের সংকেত বলে ঐতিহাসিক নীহাররঞ্জন রায় মনে করেছেন। চর্যাপদের সংস্কৃত টীকাতে ধ্রুবপদেন দৃঢ়ীকুর্বন, ধ্রুবপদেন চতুর্থানন্দমুদ্দীপয়ন্নাহ ইত্যাদি ব্যাখ্যা থেকে এই প্রমাণ পাওয়া যায়। তিব্বতীতে এই পদকে ধু পদ বলা হয়েছে। প্রত্যেক পদ গাইবার পর শ্রোতাকে আকৃষ্ট করার জন্য বারবার ধ্রুবপদ গাইবার রীতি ছিল।

সিদ্ধাচার্যগণ অসামান্য কবিত্বশক্তির অধিকারী হলেও তাঁরা মূলত ছিলেন সাধক। বৌদ্ধ সহজযানী চিন্তা, দর্শন ও সাধনপদ্ধতিই তাই চর্যাপদের উপজীব্য হয়ে ওঠে। এই সহজযানী দর্শন একান্তই ভাববাদী। সিদ্ধাচার্যগণ সহজমার্গের পথিক ছিলেন। শুষ্ক তত্ত্বকথা নিয়ে তাঁরা সন্তুষ্ট থাকতেন না। সেজন্য প্রথাগত সংস্কারের ধারও তাঁরা ধরতেন না।
মায়াপ্রপঞ্চ ও দ্বৈতবোধের উর্ধ্বে স্থিত যে ‘বোধিচিত্ত’, সকল প্রকার দ্বৈতবোধ পরিহার করে সাধনযোগে অবধূতিকামার্গের পথে সেই ‘বোধিচিত্ত’কে ‘মহাসুখকমল’-এ স্থিত করাই সিদ্ধাচার্যদের সাধনার লক্ষ্য ছিল। এই ‘মহাসুখ’ সহজযান মতে একটি বিশেষ তত্ত্ব। সাধক ‘মহাসুখ’ লাভ করলে মায়াময় পৃথিবী সম্পর্কে জ্ঞানরহিত হন। এখানে হিন্দুদর্শনের সমাধিতত্ত্বের সঙ্গে ‘মহাসুখ’ দর্শনের সাদৃশ্য লক্ষ করা যায়। চর্যাকারগণ গুরুবাদকে স্বীকার করেছেন। কুক্কুরীপাদের মতে, এক কোটি লোকের মধ্যে একজন চর্যার গূহ্যার্থ অনুধাবনে সক্ষম। সেক্ষেত্রে গুরুভিন্ন গতি নেই।  বাস্তবিকই চর্যার কথা লৌকিক অর্থের বদলে সংকেতে আবৃত হওয়ায় তা সর্বসাধারণের বুদ্ধিতে ঠিক ধরে না। এই দ্বৈতার্থের কয়েকটি নিদর্শন হলো: নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস অর্থে 'চন্দ্র', চিত্ত অর্থে 'হরিণ', জ্ঞানমুদ্রা অর্থে 'হরিণী', মহাসুখকায় অর্থে 'নৌকা', শবরী অর্থে 'দেবী নৈরাত্মা' ইত্যাদি।

চর্যার বিষয় ধর্মকেন্দ্রিক ও তত্ত্ববহুল হলেও তার বাহ্যিক রূপটি লৌকিক ও সামাজিক জীবনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। এর ফলে চর্যাপদের সাহিত্যিক মূল্যটি অস্বীকার করা যায় না। চর্যার কোনও কোনও পদে তত্ত্ব তার কাব্যের রূপটিকে ছাপিয়ে গেছে। সেইসব পদের সাহিত্যমূল্য নগন্য। কিন্তু অনেক পদেই যেসকল রূপকের আড়ালে ধর্মকথা ব্যাখ্যা করা হয়েছে তার সজীবতা ও পার্থিব সুবাস তাকে একটি সর্বাঙ্গসুন্দর কাব্যচিত্ররূপে তুলে ধরেছে। এইসব পদের সাহিত্যমূল্য অপরিসীম।

এই চিত্রকল্পগুলিই চর্যার সাহিত্যমূল্য বহন করছে। গুণ্ডরীপাদের একটি পদ পার্থিব প্রেমের তীব্র আর্তিতে জীবন্ত: “যোইণি তঁই বিণু খনহিঁ ন জীবমি। / তো মুহ চুম্বী কমলরস পীবমি।” (পদ ৪, অর্থাৎ- যোগিনী, তোমাকে ছাড়া মুহুর্তকালও বাঁচব না। তোমার মুখ চুম্বন করে কমলরস অর্থাৎ পদ্মমধু পান করব।)
শবরপাদের একটি পদে দেখা যায় নরনারীর প্রেমের এক অপূর্ব চিত্রণ-
উঁচা উঁচা পাবত তঁহি বসই সবরী বালী।
মোরঙ্গি পীচ্ছ পরহিণ সবরী গীবত গুঞ্জরী মালী।।
উমত সবরো পাগল শবরো মা কর গুলী গুহাডা তোহৌরি।
ণিঅ ঘরণী ণামে সহজ সুন্দারী।।
ণাণা তরুবর মৌলিল রে গঅণত লাগেলি ডালী।
একেলী সবরী এ বণ হিণ্ডই কর্ণ কুণ্ডলবজ্রধারী।।

(পদ ২৮, অর্থাৎ- উঁচু পর্বতে শবরী বালিকা বাস করে। তার মাথায় ময়ূরপুচ্ছ, গলায় গুঞ্জামালিকা। নানা তরু মুকুলিত হলো। তাদের শাখা-প্রশাখা আকাশে বিস্তৃত হলো। শবর-শবরীর প্রেমে পাগল হলো। কামনার রঙে তাদের হৃদয় রঙিন ও উদ্দাম। শয্যা পাতা হলো। শবর-শবরী প্রেমাবেশে রাত্রিযাপন করলো।)
আবার সমাজ ও মানুষের প্রতি অকৃত্রিম দরদও আধুনিক পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ঢেণ্ঢণের পদে দেখা যায়– “টালত মোর ঘর নাহি পরবেষী। / হাড়ীত ভাত নাঁহি নিতি আবেশী।” (পদ ৩৩, অর্থাৎ- টিলার উপর আমার ঘর, কোনও প্রতিবেশী নেই। হাঁড়িতেও ভাত নেই, তবু নিত্য অতিথি আসে।)

কোনও কোনও পদে নিছক দর্শনকথা অসামান্য চিত্ররূপের মাধ্যমে ফুটে উঠেছে। চাটিল লিখছেন– “ভবণই গহণগম্ভীরা বেগেঁ বাহী। দুআন্তে চিখিল মাঝেঁ ন ঠাহী।” (পদ ৫, অর্থাৎ- ভবনদী গহন ও গম্ভীর অর্থাৎ প্রবল বেগে প্রবহমান। তার দুইতীর কর্দমাক্ত ও পিচ্ছিল।)

আবার কখনও বা তত্ত্বের ব্যাখ্যায় যে প্রহেলিকার অবতারণা করা হয়েছে, সেগুলিও অসামান্য সাহিত্যগুণমণ্ডিত হয়ে উঠেছে। যেমন: কুক্কুরীপাদ লিখেছেন– “দুলি দুহি পিটা ধরণ ন জাই। / রুখের তেন্তুলি কুম্ভীরে খাঅ।।” (পদ ২, অর্থাৎ- মাদী কাছিম দোহন করে দুধ পাত্রে রাখা যাচ্ছে না। গাছের তেঁতুল কুমিরে খাচ্ছে।)

চর্যাগীতিতে ব্যবহৃত উপমা ও রূপকল্পগুলি তৎকালীন বাংলার সমাজজীবন, পরিবারজীবন ও প্রাকৃতিক উপাদান থেকে সংগৃহীত। প্রসঙ্গত মনে রাখা প্রয়োজন, সেই যুগে বাংলার ভৌগোলিক সীমা আজকের পশ্চিমবঙ্গ-বাংলাদেশ ভূখণ্ডের বাইরেও পূর্বে অসম ও পশ্চিমে বিহার, ঝাড়খণ্ড ও পূর্ব উত্তর প্রদেশ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। চর্যাকারগণ সাধক হলেও কাঠখোট্টা তত্ত্বজ্ঞানী ছিলেন না। চারপাশের রূপরসময় পৃথিবীর সৌন্দর্য্য তাঁরা অকুণ্ঠ পান করে তাঁদের কাব্যকে সজীব ও প্রাণোচ্ছল করে তুলেছিলেন। এই কারণে তৎকালীন বাংলার ভূগোল ও সমাজ সম্পর্কে যে স্পষ্ট ছবি চর্যাপদ থেকে পাওয়া যায়, তা সেই সময়কার বাঙালির ইতিহাস রচনায় একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।
চর্যায় নদী ও নৌকা-সংক্রান্ত রূপকের সংখ্যাধিক্য নদীমাতৃক বাংলার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। সাঁকো, কেডুয়াল, গুণ টানা, দাঁড় টানা, পাল তোলা, সেঁউতি, কাছি, খুণ্টী, উজান বাওয়া প্রভৃতি বারবার চর্যায় উল্লিখিত হয়েছে। ৩৮তম পদে দেখা যায়-
কাঅ ণাবডহি খান্টি মন কেডুয়াল।
সদগুরুবঅণে ধর পতবাল। ।
অর্থাৎ- কায়  ছোট নৌকাখানি, মন  কেরোয়াল। সদ্গুরু-বচনে পতবাল (পাল) ধর। (অনুবাদ: সুকুমার সেন)
এছাড়া পর্বত ও অরণ্যের উল্লেখও চর্যায় দেখা যায়।

চর্যায় বাঙালি সমাজের, বিশেষত ব্রাহ্মণ্যপীড়িত অন্ত্যজ সমাজের এক দরদী চিত্র অঙ্কিত হয়েছে। ডোম, শবর, চণ্ডাল প্রভৃতি অন্ত্যজ সম্প্রদায়ের জীবন ও জীবিকার নানা তথ্য এই পদগুলি থেকে জানা যায়।  আবার পারিবারিক জীবনের আচার ও ব্যাভিচার উভয়ই সমান দক্ষতায় ফুটে উঠেছে চর্যার পদগুলিতে (২তম পদটি দ্রষ্টব্য)।

কাহ্নপাদের একটি পদে সেকালের বিবাহ-অনুষ্ঠানের চিত্র ধরা পড়েছে। সেযুগের খেলাধুলা, নৃত্যগীত ও আমোদপ্রমোদের চিত্রও চর্যাকারগণ সুপটু হাতে এঁকেছেন। বীণাপাদের ১৭তম পদটিতে আছে– “নাচন্তি বাজিল গান্তি দেবী। বুদ্ধ নাটক বিষমা হোই।।” (অর্থাৎ- বজ্রযান নাচছেন, দেবী গাইছেন আর বুদ্ধনাটক অভিনীত হচ্ছে।)
এছাড়াও সে যুগের ধর্মীয় ক্রিয়াকাণ্ড, সাজসজ্জা, তৈজসপত্র, বাদ্যযন্ত্র, নিত্যব্যবহার্য জিনিসপত্র, খাদ্যপানীয় সবই চর্যার গানগুলিতে টুকরো টুকরো ছবির আকারে ধরা পড়েছে।  ফুটে উঠেছে তার চিত্র সমস্ত চর্যাপদ জুড়ে।  যেন জীবনের এক উজ্জ্বল চিত্র এখানে প্রকাশ পেয়েছে জীবনের নানা রঙে।