বুদ্ধদেব বসু, তিরিশি আধুনিক বাঙলা কবিদের অন্যতম। বাঙলা সাহিত্যকে করেছেন উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর। রবীন্দ্র, পরবর্তী সময়ে যাঁকে বাঙলা কবিতার প্রধান প্রতিভাময় প্রাণপুরুষ বলে আখ্যায়িত করা হয়। লেখেননি বা স্পর্শ করেননি বাঙলা সাহিত্যের এমন কিছু তিনি বাদ দেননি। যেখানেই হাত রেখেছেন, সেখানেই ছাঁড়িয়েছেন স্বর্গীয় আলো। যে আলোর বিচ্ছুরণ আজও লেগে আছে সমস্ত বাঙলা সাহিত্যে জুঁড়ে। বুদ্ধদেব, রবীন্দ্রনাথের মতো কবিতা দিয়ে শুরু করেন, তাই তিনি কবি। বুদ্ধদেব, যাঁর অক্লান্ত পরিশ্রম এবং নিঃস্বার্থ মনোভাব শুধু বাঙলা কবিতাকেই নয়, বাঙলার ওই কবিদের জন্যে হ’য়ে উঠেন আদর্শ ও পরামর্শ দাতারূপে। বুদ্ধদেব, যাঁর চিন্তাচেতনা, মনন ও মননশীলতায় এবং ধ্যানে সু-শৃঙ্খল বাঙলা ছাঁড়া অন্যে কিছু গড়ে উঠেনি।
বুদ্ধদেব মানেই বিশুদ্ধ বাঙলা ছাড়া অন্য কিছু নয়। ‘কবিতা’- নামক পত্রিকা নিয়ে তিনি কাটিয়েছেন জীবনের দীর্ঘতম সময়। বুদ্ধদেব বসু, এমন একজন কবি যিনি ব্যক্তিগত ক্ষতি সাধন করে সমৃদ্ধ করেছেন বাঙলা সাহিত্যকে। যাঁর কাছে ঋণী নয় বাঙলায় এমন কোনো কবি নেই বললেই চলে। বুদ্ধদেবের এমন কোনো রচনা নেই যা আমাকে বিস্ময় বিমুগ্ধ ক’রে না। বরং আমি নিশ্চুপ ভাবে পড়ে উঠতে থাকি ওই সৌন্দর্যময় ভাষাগুলোকে। বুদ্ধদেবের গদ্যের সামনে আমি বধির হয়ে উঠি। ওই গদ্যগুলোকে বুঝার জন্য আমাকে কষ্ট করতে হয় না, শুধু চোখ রাখতে হয় পাতার পর পাতায়। তিরিশি অন্যকারো লেখা বোঝার জন্য যেমন আমার সংগ্রহে রাখতে হয় একটি উৎকৃষ্ট মানের অভিধান। কিন্তু বুদ্ধদেব আমাকে নিস্কৃতি দেন ও রকম ব্যাপারগুলো থেকে। বুদ্ধদেবের সাথে আমার সংযোগ ঘটে গদ্যে দিয়ে নয়, পদ্যে দিয়ে। ওই পদ্যেগুলো পড়ার সময় তিনি কাব্যের স্থানে স্থানে অবতারণা করান কিছু গদ্যের। আমার বুঝে নিতে কষ্ট হয় না তিনি একজন বিশুদ্ধ গদ্যকারও। যে গদ্যগুলো আমি পড়ার জন্য অপেক্ষার পর অপেক্ষায় থাকি। এবং একদা আমি আমার অপেক্ষার নি®কৃতি ঘটাই। পড়তে থাকি ‘তিথিডোর’, ‘নির্জনস্বাক্ষর’, ‘মৌলিনাথ’ ‘নীলাঞ্জনের খাতা’, ‘রাত ভ’রে বৃষ্টি’, ‘আয়নার মধ্যে একা’ এবং বিষণœ বিস্ময়’-এর মতো কথাসাহিত্যেগুলো। যেগুলো পড়ার পর আমি বুঝতে থাকি ভাষাজ্ঞান এবং এর ব্যবহার সম্পর্কে বুদ্ধদেব কতটা সচেতন ছিলেন। প্রত্যেকটি অক্ষরই যেন তাঁর স্পর্শে হ’য়ে ওঠে আলোকময়।
বুদ্ধদেব, যাঁর গদ্যেয় কোনো ভাবালুতা পাই না, বরং পাই চিন্তিত বিষয়ে চমৎকার বিশ্লেষণ। তিনি গদ্যে রচনার ক্ষেত্রে কখনো বিচলিত হননি বা বিচলিত করেননি বাঙলা সাহিত্যকে। বাঙলা গদ্যেয় বুদ্ধদেব বসু স্থান ক’রে নিয়েছেন আপন মহিমায়, উজ্জ্বলতর হ’য়ে বুদ্ধদেব বসু, তাঁর গদ্যেয় অর্থাৎ, কথাসাহিত্যেয় আনেননি এমন বিষয় খুব কম আছে বলেই আমার দৃঢ় বিশ্বাস। জীবন, প্রেম, কাম, সৌন্দর্য সব-ই তাঁর গদ্যেয় দেখা দেয় নির্মল হ’য়ে। এসব বিষয়ের ব্যাপক বিশ্লেষণ দেখিয়েছেন তাঁর সমস্ত গদ্যে জুঁড়ে। কবিতার মতো, কথাসাহিত্যেয়ও তিনি দেখিয়েছেন প্রেম কিভাবে ফিরে ফিরে দেখা দিতে পারে। প্রেম থেকে যখন তিনি প্রবেশ করেন কামে তখন অসম্ভব সৌন্দর্যময় হ’য়ে দেখা দেয় তাঁর ভাষা। সেই ভাষা বা ভাব আমাদের সাহিত্যেয় সুলভ নয়। তাঁর ওই শুভ্র ভাষার জন্যে বাঙলা সাহিত্যকে অপেক্ষা করতে হয় কয়েক দশক ধরে। এর মধ্যে তিনি নিরন্তর ভাবে সৃষ্টি করতে থাকেন নিজেকে। স্বাতন্ত্র এবং স্থিরবোধ থেকেই রচিত হতে পারে ওরকম উঁচুমানের সাহিত্যে, বিচলিত থেকে নয়। বুদ্ধদেব, যাঁর ব্যক্তিগত পেশা বা কর্মের সাথে সাদৃশ্য রেখে সৃষ্টি করেন কেন্দ্রিয় চরিত্রগুলো, যে তরুণ কবি বা অধ্যাপক। বুদ্ধদেবের গদ্যেয় বারবার ঘুরে ফিরে এসেছে রবীন্দ্রনাথ।
রবীন্দ্রনাথ, বুদ্ধদেবের সমস্ত রচনার মধ্যে আগত ব্যক্তিদের মধ্যে সম্ভবত সর্বাধিক। কবিতা, কথা সাহিত্য, প্রবন্ধ, আলোচনা এবং সমালোচনা, কোনোখানেই তিনি বাদ দেননি রবীন্দ্রনাথকে। দায়িত্ববোধ নয়, বরং, অসম্ভব ভালোবাসা থেকে জন্ম নিতে পারে এ রকম ব্যাপারগুলো। বুদ্ধদেব তাঁর কোন এক প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে বলেন : ‘তাঁর ওই কবিতা সমূহের বাইরে গদ্যেগুলোতে হাত দিলে বুঝতে বাকী থাকে না যে তিনি একজন বড় মাপের কবি ছিলেন’। রবীন্দ্র, পরবর্তী সময়ে বুদ্ধদেবের ক্ষেত্রে এরকমটা বললে সম্ভবত অত্যুক্তি বলা হয় না। কারণ, বুদ্ধদেবের গদ্যে জুঁড়েও এরকম অজস্র ষ্পষ্ট চিহ্ন রয়েছে। শুধু রবীন্দ্রনাথ-ই নয়, এ রকম আরো কয়েকজন বিশিষ্ট্য কবিদের কবিতা সংশ্লিষ্ট্য এবং তাঁদের জীবন সম্পর্কে আলোচনায় স্থান ক’রে নেয় বুদ্ধদেবের গদ্য।
বুদ্ধদেবের সমস্ত প্রবন্ধ গ্রন্থের একটি সমগ্র খুঁজছিলাম আমি। কিন্তু তা পাই না; হাতে আসে তাঁর দুটি খন্ডে বিভক্ত নিয়ে একটি ‘প্রবন্ধ সংকলন’ গ্রন্থ। যে গ্রন্থটি কিছুটা হলেও তাঁর প্রবন্ধের স্বাদ দিতে পারে। বুদ্ধদেবের বিভিন্ন গ্রন্থের কিছু কিছু প্রবন্ধ নিয়ে তৈরি করা হয় ‘প্রবন্ধ সংকলন’ গ্রন্থটি। ‘প্রবন্ধ সংকলন’ গ্রন্থের প্রবন্ধগুলো দু’টি ভাগে বিভক্ত। প্রথম ভাগে রয়েছে ‘সমালোচনা’ আর দ্বিতীয় ভাগে রয়েছে ‘রম্যরচনা ও ভ্রমণ’। সমালোচনা অংশে রয়েছে ষোলটি প্রবন্ধ, আর অপর অংশ রয়েছে এগারোটি রম্যরচনা ও ভ্রমণ কাহিনী।
প্রথম অংশের প্রবন্ধগুলা ‘রবীন্দ্রনাথ: বিশ্বকবি ও বাঙালি’, ‘রবীন্দ্রনাথের প্রবন্ধ ও গদ্যশিল্প’, ‘কথাসাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ’, ‘গল্গগুচ্ছ’, ‘রবীন্দ্রনাথ ও উত্তরসাধক’, ‘নজরুল ইসলাম’, ‘জীবনানন্দ দাশ-এর স্মরণে’, ‘সুধীন্দ্রনাথ দত্ত: কবি’, ‘অমিয় চক্রবর্তীর পালাবদল’, ‘রামায়ণ’, ‘বাংলা শিশুসাহিত্য’, ‘সংস্কৃত কবিতা ও আধুনিক যুগ’, ‘শার্ল-বোদলেয়ার ও আধুনিক যুগ’, ‘ভাষা, কবিতা ও মনুষ্যত্ব’, ‘চার্লস চ্যাপলিন’ এবং ‘এক গ্রীষ্মে দুই কবি’। গ্রন্থটির প্রথমেই রয়েছে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে পাঁচটি প্রবন্ধ। যে প্রবন্ধগুলো পড়লে বুঝতে পারি, বুদ্ধদেবের ভাষার গভীর ব্যবহার এবং গদ্যে ভাষা কতটা অপরূপ হ’য়ে দেখা দিতে পারে। রবীন্দ্র শীর্ষক প্রবন্ধগুলো পড়া মাত্র বুঝে উঠতে পারি গভীর দৃষ্টিভঙ্গি না থাকলে কখনো ও রকম সৃষ্টিশীল রচনা সৃষ্টি করা সম্ভাবপর হ’য়ে উঠে না। গভীর থেকে আরো গভীরে বাঙলা ভাষাকে ব্যবহার করেন নিজের মতো করে, নিজস্ব তৈরি ভাব ও ভাষায়।
রবীন্দ্রাথ যখন ‘কবি’ বা ‘গল্পকার’ বা ‘প্রাবন্ধিক’ বা কথাসাহিত্যের ইত্যাদি বিষয়গুলো তিনি এনেছেন, আর তার তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ দেখিয়েছেন। বুদ্ধদেবের এসব গদ্যে রচনা থেকে বাদ যায়নি বাঙলা সাহিত্যের অনেক সুখ্যাত লেখক। এই গ্রন্থের দ্বিতীয় অংশে রয়েছে এগারোটি রচনা। যে রচনাগুলো পড়ামাত্র ব্যক্তি বুদ্ধদেবের খুব কাছাকাছি পৌঁছানো সম্ভব। এ অংশের রচনাগুলো হলো: ‘পুরানা পল্টন’, ‘ক্লাইভ ষ্ট্রিচ চাঁদ’, ‘মৃত্যু-কল্পনা’, ‘উত্তরতিরিশ’, ‘আড্ডা,’ ‘নোয়াখালি,’ ‘কোণারকের পথে’, ‘গোলাপ পুর-অন-সী’, ‘রবীন্দ্রনাথের শেষ জীবন’, ‘বীটবংশ ও গ্রীনিচ গ্রাম’, এবং ‘যে আঁধার আলোর অধিক’। বুদ্ধদেব যেহেতু এ অংশের নাম দিয়েছেন ‘রম্যরচনা ও ভ্রমন’- তাই এ অংশ রয়েছে তাঁর প্রিয় অপ্রিয় ব্যাপারগুলো এবং শৈশব ও কৈশোর এবং তাঁর পরবর্তীতে ঢাকার একটি চিত্র। সেই সময়কার ঢাকার বর্ণনা এমন ভাবে দিয়েছেন তা- যে অনেক দিন আগের কখনো মনে হয় না। এ রকমটা সম্ভব হ’য়ে উঠে বুদ্ধদেব বসুর ভাষা এবং সৌন্দর্যময় গদ্যের অসম্ভব ব্যবহারের ফলে।
তাই বলতে হয়, নিজস্ব বা স্বাতন্ত্রবোধ নিয়ে বুদ্ধদেবের রচনাগুলো আজও আমাদের বাঙলা ভাষার ব্যবহারে আকৃষ্ট করতে থাকে। ভাষার ব্যবহারে বলতে হয়, বুদ্ধদেবের ওই জ্যোতির্ময় গদ্যে, বাঙলা সাহ্যিত্যেয় আজও বিরল হ’য়ে দেখা দেয়। রবীন্দ্র উত্তর, বাঙলা সাহিত্যের গদ্যেকে নিয়ে যান উন্নত শিখরে। বুদ্ধদেব, যদিও কবিতার দিকে চোখ রেখে এগিয়ে ছিলেন বাঙলা সাহিত্যের দিকে। স্পর্শ করেছেন বাঙলা সাহিত্যের উজ্জ্বলময় স্তরগুলোতে। যাঁর স্পর্শে বাঙলা ভাষার রচনাগুলো আজও আলোর ঝলকানিরূপে দেখা দিতে থাকে, কিন্তু হঠাৎ আলোর ঝলকানি হ’য়ে নয়।