বিষ্ণু দে কবি। রবীন্দ্র উত্তর কবিদের অন্যতম। তিরিশি বাঙলা কবিতার উজ্জ্বল নক্ষত্রের একজন। ভাষা-ভাব-উৎকৃষ্টতা আর সৌন্দর্য্যরে অপূর্ব সম্বন্বয় ঘটিয়েছেন কবিতায়। কবিতায় কখনো তু’লে নিয়েছেন প্রেম, সৌন্দর্য-, নারী, সবুজ অরণ্যে, কিংবা গ্রীক উপখ্যানের রাজা-রানী। কোন দায়িত্ববোধ নয়, বরং ভালোবাসার তীব্র আকর্ষণে তাঁর কাব্যের পঙ্ক্তিতে পঙ্ক্তিতে বার বার এসেছেন রবীন্দ্রনাথ। ভালোবাসা ছাড়া এভাবে আসা যায় না। যেহেতু পূর্বগামীর ঋণ কখনও স্বীকার করতে হয় না। তিনি কী এ ঋণের কথা স্বীকার করেছেন বা করেননি, তা তাঁর কবিতায় প্রবেশ করলেই বোঝা যায়। বিষ্ণু দে’র কবিতায় রবীন্দ্রনাথের প্রথম উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায় তাঁর “চোরাবালি” কাব্যগ্রন্থে।
যেখানে রয়েছে রবীন্দ্রনাথের সেই সুপরিচিত কবিতার- শিরোনামটি: ‘আজি এ প্রভাতে রবির কর/কেমনে পশির প্রাণের’ পর/কেমনে পশিল গুহার আঁধার প্রভাত পাখির গান;/না জানি কেন রে এতদিন পরে জাগিয়া উঠিল প্রাণ’/ আমরা যখন বিষ্ণু দে’র ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গে’তে যাই তখন দেখতে পাই এরকম ‘সে কথা তো জানি তোমাতে আমার মুক্তি নেই!/ তবু বারে বারে তোমারই উঠানে যাওয়া-আসা।/ আত্মীয়া নও, সমাজের ইকরার-নামায়/কস্মিনকালে বাঁধা হয়নিকো তাই বাসা/ তোমাতে আমার স্বর্গ তো নেই, সে দুরাশা/মর্ত্যজীবীর মননে বুঝেছি হাড়ে হাড়েই।/তুমি যেন টিম্বক্ট ও আমি হিম লাসা,/তবু পাশাপাশি কোন আশ্বাসে সঙ্গ নিই’?
রবীন্দ্রনাথের ‘নিঝর্রের স্বপ্নভঙ্গতে’ পেলাম উজ্জ্বল সূর্যের আলো আর বিষ্ণু দে’তে পাশপাশি কোনো এক আশ্বাসে সঙ্গ নিতে থাকে। কিন্তু বিষ্ণু দে জানে না এ আশ্বাস বা সঙ্গ আর কতোদিন তাকে সরব করে রাখবে।
“চোরাবালি”-এর পরবর্তী কাব্য ‘পূর্বলেখ’। কবিতা রচনাকাল (১৯৩৬-১৯৪১)-এর মধ্যে। এই কাব্যগ্রন্থটি ‘পূর্বলেখ’ উৎসর্গ করা হয় রবীন্দ্রনাথকে। যা বিষ্ণু দে-কে ক’রে তোলে আরো বেশী আদরনীয়।
বিষ্ণু দে’র কবিতায় রবীন্দ্রনাথকে আবার পাওয়া যাবে ‘নাম রেখেছি কোমল গান্ধার’ কাব্যগ্রন্থে। যাদিও বিষ্ণু দে সম্পূর্ণ নামটি গ্রহণ করেছেন রবীন্দ্রনাথ থেকে। কবিতাটি এরকম: ‘নাম রেখেছি কোমল গান্ধার,/মনে মনে।/যদি তার কানে যেত অবাক হয়ে থাকত বসে,/বলতো হেসে ‘মানে কী’।/ মানে কিছুই যায় না বোঝা নেই মানেটাই খাঁটি।/ কাজ আছে কর্ম আছে সংসারে,/ ভালো মন্দ অনেক রকম আছে-/তাই নিয়ে তার মোটামুটি সবার সঙ্গে চেনাশোনা।’ ‘নাম রেখেছি কোমলগান্ধার’ প্রথম কবিতাটি ‘২২শে শ্রাবণ’। যা আমাদের রবীন্দ্রনাথকে ছাড়া আর কাউকে মনে করিয়ে দেয় না। বাইশে শ্রাবণ আজ শুধু সীমাবদ্ধ থাকেনি কোনো জন্ম বা মৃত্যু তারিখের মাঝে। আজ তা পূর্ণতা পেয়েছে আমাদের জাতীয় জীবনের অংশ হ’য়ে। যা বাঙালির জাতীয় জীবনের অঙ্গীকার। এ অঙ্গীকার আরো বেশী দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হওয়ার; ব্যবচ্ছেদের নয়। ‘২২শে শ্রাবণ’ কবিতার শুরু এ রকম: ‘আনন্দে নিঃশ্বাসটানি, হৃৎস্পন্দে আমার আশ্বাস/শুনে আসা দীর্ঘকাল অভ্যাস, তবুও/হঠাৎ হাওয়ায় আসে উপবাসী মানুষের রোদনের দুয়ো,/ কেটে যায় বীটোফোন সিমফনির গন্ধর্ব বাতাস।’
কাব্যটির শেষে আমরা পাই এ বীটোফোন নামেই অর্থাৎ’ ‘নাম রেখেছি কোমলগান্ধার মনে মনে’ সম্পূর্ণ একটি কবিতা। এটা যে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে তাঁর জন্যে তিনি ক্ষুদ্রাকারে ‘রবীন্দ্রনাথ’ নামটি বসিয়ে দিয়েছেন। শিরোনামটির নিচে পাওয়া যায় আরো একটি নাম ‘জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র’-যিনি একাধারে কবি, গায়ক সুর স্রষ্টা ‘নাম রেখেছি কোমলগান্ধার মনে মনে’ ভালোলাগা কবিতাটি সম্পূর্ণ অংশ তুলে দেওয়া হল :
''ধুয়ে দাও এই গ্লানি
বাষ্পের আড়ালে এই গ্রীষ্মের গৃৃধুতা
ওড়াও ওড়াও এই কলকাতার শবে শবে গলিত তাপের গ্লানি
এই স্নায়ুর লড়াই স্বেদের আশ্রয়ে
ঢেউয়ে টেউয়ে ভেঙে দাও গ্রীষ্মের গোয়েন্দা তাপে বেঘোর ক্লান্তিতে
আর অঝোর সন্তাপে এই কোলাকুলির গান
সমুদ্র বাংলা আমাদের বাংলার সমুদ্র
আত্মভোলা নিয়ে চলো খুলে খুলে হুগলির
রূপনারানের মাথাভান্ডার মাতলার আগে
সাগরে সাগরেরও আগে সমুদ্রে সমুদ্রে
নিয়ে চলো হলদি ছাড়িয়ে রসুলপুরের আগে
উদ্দাম হাওয়ায় মলয়মরুতে কিম্বা মৈনাকমন্থনে ঝড়ে-
ভেঙে ভেঙে কলকাতার গলিত নিষেধ
ডিঙিতে শালতিতে পায়ে পায়ে বালিতে বালিতে জলে জলে
বালিয়াড়ি উজানে ওড়াও
পথিক হারাক পথ কাঁথিতে তমলুকে ভাঙুক কপাল
নিয়ে চলো মনপবনের নায়ে দীর্ঘ অভিযানে
গন্ধবণিকের দেশে দূর দেশে জলে জলে হাওয়ায় হাওয়ায়
জাভায় বলীতে কাম্বোজে শাম্পানে শাম্পানে
চীনসমুদ্রের পারে আরেক নীলের পারে
আরেক হলদির মুখে সমুদ্রে সমুদ্র
কিম্বা চলো মহানদী কিম্বা সেই সমুদ্র সূর্যের
প্রখর মিলননাট্যে পাথরে পাথরে কেটে
আনন্দের অবিরাম কদম্ব কেশর
জীবনের জয়গানে হাওয়ায় হাওয়ায় নিয়াখিয়া,
বালিতে বালিতে আর নীলজলে মৌশুমিতে মর্মরিত নারিকেলে
ঢেউয়ে ঢেউয়ে অবগণন ঢেউ
এক ও অনেক পর পর গায়ে গায়ে
ওঠা ভাঙা আয়োজন সুরের বিস্তারে-
একে মেশে অন্য এক
এদিকে ওদিকে পরপর অবিরাম বাহুবদ্ধ সমবেত নৃত্যে এক
সপ্তকের অন্যেন্য শ্রুতিতে ঢেউয়ে ঢেউয়ে মীড়বাঁধা অথচ ষ্পষ্টও
যেন এক মিয়াঁকি মল্লারে
ঢেউ দাও সমুদ্রের ঢেউ শুচি হিম উর্মিশুভ্র উত্তাল সবুজ
সবুজ সুনীল ঢেউ ভেঙে দাও নিয়ে চলো বিস্তীর্ণ দোলায়
দুলে দুলে ফুলে ফুলে ভেঙে দাও মালকোশে বা কানাড়ায়
ধুয়ে দাও জলে জলে পান্ডুর বালিতে আর স্বচ্ছ জলে
সবুজে ও নীলে দূর ফিরোজায়
ধুয়ে দাও কলকাতার গলিত সন্তাপ
হাওয়ায় হাওয়ায়
এই স্বেদের আশ্রয় কায়েমি নিষেধ
মনে দাও উর্মিল আছাড় ঢেউয়ে ঢেউয়ে গায়ে দাও
লবণাক্ত হিমশান্তি মুক্তি স্নান
সঞ্জীবনস্বাদ সমুদ্র বাংলার সমুদ্র ভারতের ভাঙো বাঁধা
মুক্তি দাও জলে জলে হাওয়ায় হাওয়ায় কাটামারানের পালে পালে
শীতল হাওয়ায় লবণাক্ত সঞ্জীবন স্বাদে বিস্তীর্ণ অবাধ
আমরাও গড়ে দেব বারবার হাওয়ার মন্দির
হাওয়ার ঘোড়ার রথ সমুদ্রের ঘোড়া
মুক্তির আনন্দ মূর্তি জীবনের মুক্তির আনন্দ
পাথরে পাথরে মানুষের অঙ্গীকার
অজ্ঞান পাথর খুলে খুলে মামল্ল সৈকতে
ঢেউ তুলে সমুদ্র্রে হাওয়ায় দীর্ঘছন্দ তোমার বাহুতে দুলে দুলে
সমুদ্রের কোমলগান্ধার।''
এই কাব্যের সর্বশেষ কবিতাটিও আমাদেরকে রবীন্দ্রনাথ এর কথা স্মরন করিয়ে দেয়। ‘২৫শে বৈশাখ’ কবিতাটি দীর্ঘ কোনো কবিতা নয়। যেমন দীর্ঘ ছিল পূর্বের কবিতাটি। এই কবিতাটির নাম বার বার আমাকে মনে করিয়ে দেয় বিষ্ণু দে’র ‘তুমি শুধু পঁচিশে বৈশাখ’ কাব্য গ্রন্থটিকে। কবিতাটির নামের সাথে মিল রয়েছে কাব্যগ্রন্থটির। কবিতাটি ওখানেও অন্তর্ভূক্ত হ’তে পারতো, এখানে হয়েছে বলে যে খুব খারাপ লাগছে তাও নয়, ওখানে হ’লে হয়তো আরো অনেক অনেক বেশী ভালো লাগতো। ‘রবীন্দ্রনাথকে’ নিয়ে বিষ্ণু দে’র মহোত্তম কবিতাটি ‘তুমি শুধু পঁচিশে বৈশাখ’ কবিতাটি। যেখানে রবীন্দ্রনাথ ফিরে এসেছে মঞ্চে মঞ্চে ছবি হয়ে, ‘কালবৈশাখীর তীব্র প্রতিভা’বা ‘বাইশে শ্রাবণ’ হ’য়ে। যাকে আমরা স্মৃতি উপলক্ষ্য ছাড়া আর কী ভাবতে পারি। ‘তুমি শুধু পঁচিশে বৈশাখ’ শিরোনামের কবিতাটিতে আবার ফিরে পাাই রবীন্দ্রনাথকে।
'তুমি কি কেবল-ই স্মৃতি, শুধু এক উপলক্ষ্য, কবি?
হরেক উৎসবে হৈ হৈ
মঞ্চে মঞ্চে কেবল-ই কি ছবি?
তুমি শুধু পঁচিশে বৈশাখ
আর বাইশে শ্রাবণ?
কালবৈশাখীর তীব্র অতৃপ্ত প্রতিভা,
বাদলের প্রবল প্লাবন,
সবই শুধু বৎসরান্তে একদিনেই নিগর্ত নিঃশেষ?
অপঠিত নির্মনন, নেই আর কোনো আবেদন?
সাবিত্রীর ক্ষিপ্রকর বিভা
আমাদের দুস্থ চির-গৌধূলিতে ম্রিয়মান?
তোমারই কি ছিল এই নিরানন্দ ভঙ্গুর স্বদেশ
আলোহীন অন্ধকারহীন আপন সত্তার থেকে পলাতক
নিস্তব্ধ থাকার ভয়ে একার সংশয়ে জনতার অপমানে
নিত্য রুচি ক্ষয়ে ক্ষয়ে অসুন্দর?
কোথায় সে প্রতিদিন রূপের রচনা,
সেই নিরন্তর সুন্দরের ধ্যানের উন্মেষ,
অনাত্মীকরনে সদা নিজেকে সে উত্তরণ,
নিরলস জ্ঞানের নিয়ম
কঠিন শিক্ষার শ্রম,
বুদ্ধির নির্ভয় শুভ্র আলোকে আলোকে,
আত্মস্থের স্তদ্ধতার শুদ্ধ অন্ধকারে
শূন্যে শূন্যে ব্যথাময় অগ্নিবাষ্পে দীপ্ত-গীতে
চেতন্যের জ্যোতিষ্কে জ্যোৎস্নায়
উদ্ভাসিত সুদীর্ঘ জীবন,
যেখানে পর্বত ওড়ে আশ্বিনের নিরুদ্দেশ মেঘ,
সন্ধ্যারাগে ঝিলিমিলি ঝিলেেমর বাঁকা তলোয়ার
নদীর নূপুরে বাজে নদীর জোয়ার,
শিহরায় দেওদার বন।
তোমার আকাশ দাও, কবি দাও
দীর্ঘ আশি বছরের
আমাদের ক্ষীয়মান মানসে ছড়াও
সূর্যোদয় সূর্যাস্তের আশি বছরের আলো,
বহুধা কীর্তিতে শত শিল্পকর্মে উন্মুক্ত উধাও
তোমার কীর্তিতে আর তোমাতে যা দিকে দিকে
একাগ্র মহৎ,
সে কঠিন ব্রতের গৌরবে,
আমাদের বিকারের গজল ধূলার দিনরাত অন্যায়ে কুৎসিত
শুনি যেন সুন্দরের গান
দেখি যেন একনিষ্ঠ দীর্ঘায়ুর প্রগতির এক ছবি,
সুন্দরের গান যেন শুনি, গাই,
দশটার পাঁচটার উদ্ভ্রান্ত ট্রাফিকে,
বস্তিতে বাসায় আর বাংলার নয়া কলোনিতে,
জীবিকার জীবনের ভাঙা ধসা ভিতে,
বোম্বাই সিনেমা আর মার্কিনি মাইকে অসুস্থ বৈভবে,
মরা খেতে কারখানায় পড়ি যেন জীবনের
সংগ্রামশান্তির স্পষ্ট উপন্যাস,
খুঁজি যেন সকালের সূর্য থেকে সন্ধ্যার সূর্যের ছবি
শুনি যেন আমাদের কান্নার অতলজলে অমর ভৈরবী
প্রত্যহের সচেষ্ট উৎসবে,
সহজ অভ্যাস ফেলে সকালে সন্ধ্যায় বারো মাস
বছরে বছরে পড়ে যাই জীবনের স্বাধীন বিন্যাস,
নিভৃত ছায়ায় চৈত্রে শালবনে
তোমার বসন্ত গানে রক্তরাগে হৃদয় স্পন্দনে
আমাদের দিনের পাপড়িতে, জীবনের ফুলে ফলে
ভ্রমরগুঞ্জনে নব পল্লবমর্মরে
গড়ে তুলি আজ কাল, মাসে মাস, শত বর্ষ পরে।
আমাদের প্রতিদিন, কবি'
(তুমি শুধু পঁচিশে বৈশাখ ঃ তুমি শুধু পঁচিশে বৈশাখ)
একই কাব্যগ্রন্থে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে পাওয়া যায় আরো একটি কবিতা। যার শিরোনাম বিষ্ণু দে দেন ‘রবীন্দ্রনাথের কোন লেখা অভিভূত করেছিল’। কবি বিষ্ণু দে’কে এখানে আরো বেশী পাওয়া যায় ষ্পষ্ট হয়ে তিনি যে রবীন্দ্রনাথের সকল লেখার প্রতি যথেষ্ট অনুরাগী ছিলেন তা প্রমাণিত হয়। বিষ্ণু দে’র এ ভালোলাগাকে তিনি তুলনা করেছেন সূর্যের সাথে। যদিও বাঙলা সাহিত্যেয় রবীন্দ্রনাথ নিজেই একটি সূর্য।
বিষ্ণু দে, কবিতাটিতে দিনের কোনো এক মুহূর্তের সাথে অপর মুহূর্ত কতটা ভালো বা খারাপ লাগতে পারে তা যেমন প্রকাশ করেছেন, তেমনি অষ্পষ্ট থেকে যায় দিনের কোন মুহূর্তটিকে তিনি সবচেয়ে বেশি ভালোবেসেছেন বা সবচেয়ে বেশি ভালো বেসেছেন রবীন্দ্রনাথের কোন্ সৃষ্টিকে? এর সাথে তিনি আরো সংযুক্ত করছেন প্রকৃতির অপরূপ শোভাময় ঋতু বৈচিত্র্যকে।
‘স্মৃতি সত্তা ভবিষ্যত’-কাব্যতে পাওয়া যায় ‘মানবলোকে ভবিষ্যতে চেপে’ শিরোনামটি। যেখানে জুঁড়ে দেওয়া হয় রবীন্দ্রনাথের পিতামহ হবার ইচ্ছার কথা। ‘আমি আমার পৌত্র হইতে ইচ্ছা করি।’ ভবিষ্য তাঁহার চক্ষে এমন লোভনীয় বলিয়া ঠেকিয়াছিল। কিন্তু শতসহস্র লোক আছেন, তাঁহাদের উক্ত প্রশ্ন করিলে উত্তর করেন, আমি আমার পিতামহ হইতে ইচ্ছা করি।’-রবীন্দ্রনাথ সম্পূর্ণ কবিতাটি জুঁড়ে প্রকাশ পায় এই পিতামহ হবার অভিব্যক্তি।
‘স্মৃতি সত্তা ভবিষ্যত’-এ ‘রবীন্দ্রনাথ’ শিরোনামে পাই আরো একটি কবিতা। বিষ্ণু দে পূর্ববর্তী কবিতাগুলিতে ‘রবীন্দ্রনাথ’ নামটি সরাসরি ব্যবহার করেননি। যদিও কবিতাগুলো রচিত হয়েছে রবীন্দ্রনাথকে নিয়েই। ‘২২শে শ্রাবণ’, ‘২৫ শে বৈশাখ’, ‘তুমি শুধু পঁচিশে বৈশাখ’,-এই সকল নাম যে কেবলমাত্র রবীন্দ্র অভিব্যক্তি প্রকাশ পায়, তার খোলামেলা রূপটি বিষ্ণু দে প্রকাশ করেন ‘রবীন্দ্র’ শিরোনামের মধ্য দিয়েই।
'বিনিদ্র শতাব্দী ব্যাপে দিনরাত্রি বেঁধে যে সূর্যের
দীর্ঘ আয়ু একাধারে বাঁশি ও তুর্যের,
কুসুমে ও বজ্রে তীব্র যার সদা ছন্দায়িত প্রাণ,
ধ্যান যার সূর্যোদয়ে, সূর্যাস্তে বিধূর যার গান,
সেই তো বিশ্রামহীন মধ্যাহ্নের কমিষ্ঠ রৌদ্রের
প্রাবল্যে চেয়েছে ফল ফুল আর আউশ আমন,
যেখানে সবার হতে অধম ও সর্বহারা দীন,
চেয়েছে যে প্রতিদিন দেশব্যাপী সর্বতোভাবের
সর্বত্র সকলে হোক সচেতন সচ্ছল ও সুখী।
হে বন্ধু তোমরা বলো কেন তবু বলিষ্ঠ মননে
আলোকিত নিত্যকর্মে আমরাও সৌন্দর্যে স্বাধীন
সর্বদা উদ্গ্রীব নই, লক্ষ লক্ষ চিত্ত সূর্যমুখী?'
(রবীন্দ্রনাথ: স্মৃতি সত্তা ভবিষ্যত)
‘স্মৃতি সত্তা ভবিষ্যত’ কাব্যগ্রন্থের শেষ কবিতা ‘শতবার্ষিকী’। কবিতাটি আবারও পাওয়া যায় সেই ‘পঁচিশে বৈশাখ’ ও ‘বাইশে শ্রাবণ’। তাই ধরে নিই এখানেও আমরা কোন না কোন ভাবে পাই রবীন্দ্রনাথকে। যিনি এখানে ফিরে এসেছেন শতবার্ষিকীরূপে। এই কাব্যের বিভিন্ন দিক দিয়ে রবীন্দ্রনাথ আমাদেরকে ধরা দেন বিভিন্ন রূপে।
আজ রবীন্দ্রনাথকে চিহ্নিত করার জন্য কোন ‘বাইশে শ্রাবণ’ বা ‘পঁচিশে বৈশাখ’ এর প্রয়োজন নেই। পঁচিশে বৈশাখ থেকে অনেক বেশী উজ্জ্বল তাঁর ঝঁরে পড়া পঙক্তিগুলো। যা সর্বকালে ও সর্বসময়ে বাঙলা সাহিত্যেকে করছে সমৃদ্ধশালী। রবীন্দ্রনাথ, শুধু যে বিষ্ণু দে’র প্রিয় হোক আমরা তাই চাই না। বরং রবীন্দ্রনাথ, আরো বেশী প্রিয় থেকে প্রিয়তম হ’য়ে উঠুক মনন-সৃষ্টিশীল রবীন্দ্রনুরাগীদের কাছে। প্রিয় হ’য়ে উঠুক আমাদের মননে।