রবীন্দ্রনাথ, তাঁর পরবর্তী কবিদের কবিতায় উপস্থিত হয়েছেন স্ব-মহিমায়। পরবর্তী সেই সব কবি, যাঁরা কবিতা সৃষ্টি ক’রে কবিতাকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন একটি আদর্শ ও উজ্জ্বলতম পথে। যেখানে কবিতাই শুধু কবিতা হ’য়ে স্থান করে নিয়েছে। ওই সব কবিদের রচনায় কবিতা হ’য়ে উঠেছে শুধুই কবিতা, তাছাড়া অন্য কিছু নয়। কবিতা কী-বা কবিতা কি রকম হওয়া উচিত, বা কবিতা কী রকম হ’লে তা শুধু কবিতা হ’য়ে থাকবে, তা ওই কবিদের কবিতা না পড়লে বোঝা সম্ভব নয়। রবীন্দ্রনাথ, যাঁর সৃষ্টির সকল কর্মগুলো থেকে ‘কবিতা’ উজ্জ্বলতম। যদিও আমার কাছে তাঁর কোন সৃষ্টিকেই অন্ধকার মনে হয়নি। অন্ধকারে পড়ে থাকা জিনিসকে আলোর সামনে উপস্থিত করার জন্যেই বরং তিনি সৃষ্টি করেছেন নিরন্তন।
তিরিশি কবিদের কবিতায় রবীন্দ্রনাথ এসেছেন বারবার ঘুরে ফিরে। কোন কোন কবিদের উৎসর্গে বা কবিতার শিরোনামে বা কবিতার অংশ বিশেষ হ’য়ে বা সমস্ত কবিতা ছুঁড়ে বিরাজ করেছেন তিনি। শুধু তিরিশি কবিদের কবিতায় কেন? রবীন্দ্র, পরবর্তী যাঁরা কবিতা সৃষ্টি করেছেন তাঁরা কোন না কোন ভাবে রবীন্দ্রনাথকে এনে নিজেকে ধন্য করেছেন। শ্রেষ্ঠ কবির প্রতি আমাদের ভালোবাসা প্রকাশ পেয়েছে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ভাবে। সকল কবির কাছেই ছিল তাঁর উজ্জ্বল উপস্থিতি। যে উজ্জ্বল উপস্থিতিতে আলোকময় করেছে কবিতাগুলোকে।
‘জীবনানন্দ দাশ, একাই রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে লিখেছেন ছয়টি কবিতা। এতো সংখ্যক কবিতা বাঙলায় অন্যে কোন কবিকে নিয়ে লেখা হয়েছে কিনা তা আমার জানা নেই। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় প্রত্যেকটি কবিতার শিরোনাম ‘রবীন্দ্রনাথ’। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে জীবনানন্দ শুধু কবিতাই লিখেননি, লিখেছেন কয়েকটি উৎকৃষ্ট মানের প্রবন্ধ। জীবনানন্দ, রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে যে কবিতাগুলো লিখেছেন তা পাওয়া যাবে না তাঁর বিখ্যাত ‘ঝরাপালক’, ‘ধূসরপান্ডুলিপি’, ‘সাতটি তারার-তিমির’ নামক কাব্যগ্রন্থগুলিতে। কবিতাগুলো প্রথমে অপ্রকাশিত, পরে প্রকাশিত, কিন্তু অগ্রন্থিত। ওই ছয়টি কবিতা জীবনানন্দ সমান পঙ্ক্তিতে রচনা করেননি। তাঁর কোনটি বেশ দীর্ঘ আবার কোনটি ক্ষুদ্রকার। যেমন পাওয়া যাবে নয় বা বারো পঙ্ক্তির কবিতা, আবার রয়েছে ষাট পঙ্ক্তি বিশিষ্ট্য কবিতাও। ‘রবীন্দ্রনাথ’ শিরোনাম বিশিষ্ট্য ওই সকল কবিতার কোনটিতেই তিনি ব্যবহার করেননি রবীন্দ্রনাথের সম্পূর্ণ নামটি।
তাই প্রত্যেকটি কবিতাই সমান ভাবে ‘রবীন্দ্রনাথ’ নামে পরিচিত। জীবনানন্দ যেমন প্রকাশ করেছেন ঃ ‘অনেক সময় পাড়ি দিয়ে আমি অবশেষে কোনো এক বলয়িত পথে/মানুষের হৃদয়ের প্রীতির মতন এক বিভা/দেখেছি রাত্রির রঙে বিভাসিত হয়ে থেকে আপনার প্রাণের প্রতিভা/ বিচ্ছুরিত ক’রে দেয় ‘সঙ্গীতের মতো কণ্ঠস্বরে। হৃদয়ে নিমীল হয়ে অনুধ্যান করে/ময়দানবের দ্বীপ ভেঙে ফেলে স্বভাব সূর্যের গরিমাকে।’ কিংবা একই কবিতায় আবার যখন শুনতে পাই: ‘সে সবের বুক থেকে নিরুত্তেজ শব্দ নেমে গিয়ে/প্রশ্ন ক’রে যেতেছিল যে সময়ে নাবিকের কাছে/সিন্ধু ভেঙে কত দূর নরকের সিঁড়ি নেমে আছে?-/ততদূর সোপানের মতো তুমি পাতালের প্রতিভা সেঁধিয়ে/ অবারিতভাবে শাদা পাখির মতন সেই ঘুরুনো আধারে/নিজে প্রমাণিত হয়ে অনুভব করছিলে শোচনার সীমা/মানুষের আমিষের ভীষণ ম্লানিমা/ বৃহস্পতি ব্যাস শুক্র হোমরের হায়রান হাড়ে/ বিমুক্ত হয় না তবু-কি ক’রে বিমুক্ত তবু হয়/ভেবে তারা শুকè অস্থি হ’ল অফুরন্ত ‘সূর্যময়’। কিংবা আবার যখন তিনি বলতে থাকেন: ‘একবার মানুষের শরীরের ফাঁস থেকে বার হয়ে তুমি/সে শরীর ঈশ্বরের চেয়ে কিছু কম গরীয়ান/ যে কোনো বস্তুর থেকে পেতেছে সম্মিত সম্মান।’
জীবনানন্দ, নিজের অপ্রকাশিত গ্রন্থে এমন কিছু কবিতা পাওয়া যাবে। যা পরে প্রকাশিত। যা প্রথম দিকে একটি কবিতা থেকে অপর একটি কবিতার মধ্যে কোনো প্রকার অমিল নেই বলে মনে হয়। কিন্তু পরোক্ষণে সামান্য পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। এই রকম সামান্য পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে পৃথক করা হয়েছে একটি কবিতা থেকে অপর আরেকটি কবিতা। কিন্তু ‘রবীন্দ্রনাথ’ শিরোনাম ভিত্তিক কবিতাগুলো প্রত্যেকটিই পৃথকপৃথক কবিতা। সামান্য পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে পৃথক করা হয়নি কবিতাগুলোকে। ‘রবীন্দ্রনাথ’ শিরোনামে জীবনানন্দের আরেকটি কবিতা যেটি আমি বহুবার পড়েছি। এই কবিতাটির লোভ সামলাতে পারছি না তাই বিশেষ ‘কোন অংশ বা পঙ্ক্তি তুলে না দিয়ে সম্পূর্ণ কবিতাটি তুলে দিলাম ঃ
'দেয়ালচিত্রের শীর্ষে পৃথিবীর কোনো এক আশ্চর্য প্রাসাদে
একটি গভীর ছবি মানুষ দেখেছে চিরকাল।
কেউ তাকে ‘সূর্য ব’লে মনে করেছিল,
কেউ তাকে ভেবেছিল গরুড়ের উড্ডীন কপাল :
যখন সে অফুরন্ত রৌদ্রের অনন্ত তিমিরে
উদয় ও অস্তকে এক ক’রে দিতে ভালোবাসে;
শাদা রাজবিহঙ্গের প্রতিভায় বৈকুণ্ঠের দিকে উড়ে যায়,
হয়তো বা আমাদের মর্তপৃথিবীতে নেমে আসে।
তাকাতে তাকাতে সেই প্রাসাদের মাধবী দেয়াল
আমাদের ইহলোক ব’লে মনে হয়-তবু সৃষ্টির অনন্ত পরকাল।
তোমার বিভূতি, বাক বেদনার থেকে ওঠে নীলিমাসঙ্গীতী,
আমাদের গরিমার বিকীরণে ডুবে, গ’ড়ে গেছে সব মানুষের প্রাণ
কী করে কল্যাণকৃৎ অর্থের তরঙ্গে জেগে (মোম নিভে গেলে)
স্বাতী, শুক্রতারকার মতন ধীমান
মহা অবয়বদের থেকে বিচ্ছুরিত হ’য়ে উঠে আভা দিতে পারে
শেয়াল শকুন শনি বানরের সমাজ ও রাষ্ট্রের ‘পরে;
সৃজনের আদি অন্তিমের রাঙা আন্তনের মতো গোলাকার
ব্যাপ্ত এক সঙ্গীতের বৃত্তের ভিতরে
পেয়ে যেতে পারে তার তিমি তিলে বিম্বিত ব্রহ্মাণ্ডের মানে,
সে সুর নিমীল হয়ে, লেলিহান হয়ে, নিমীলিত হতে জানে,
মহান, তোমার গানে, এই সব বলয়িত ক’রে চিরদিন-
অথবা যখন তুমি আমাদের দেশে সৃষ্টি শেষ ক’রে ফেলে
প্রকৃতির আন্তনের উৎস থেকে উঠে একদিন
নিঃস্বার্থ আন্তনে ফিরে গেলে,
পতঞ্জলি, প্লেটো, মনু ওরিজেন, হোমরের মতো
দাঁড়ায়ে রয়েছ তুমি একটি পৃথিবী ভাঙা গড়া শেষ ক’রে দিয়ে, কবি-
দানবীয় চিত্রদের অন্তরালে আপনার ভাস্বরতা নিয়ে;
নিকটে দাঁড়ায়ে আছে নিবিড় দানবী।
অথবা ছবির মতো মনে হয় আমার অন্নপানদোষে ম্লান চোখে
অল্প আলোকের থেকে যেই পুরাণ পুরুষ সব
চ’লে যায় অনুমেয়, অজ্ঞেয় আলোকে।'
‘রবীন্দ্রনাথ’,-শীর্ষক তৃতীয় কবিতাটির প্রতি চোখ রাখি। যার শুরুটা হয় রকমঃ ‘তার পর তুমি এলে’-এ পঙ্ক্তিটি লেখার সময় আমার বার বার রবীন্দ্রনাথের সেই কথাটির পূর্নবার মনে হচ্ছিল ‘শুরুর আগেও শুরু আছে।’ কবি যেমন বলেছেন তারপর তুমি এলে,
কিসের পর তুমি এলে? তাহলে তাঁর অভাববোধ আমাদের মাঝে দেখা দিয়েছিল অনেক পূর্ব থেকেই। আমরা যেমন পূর্ব থেকেই জরাজীর্ণ, দুঃখ, শোক-তাপ অন্ধকারাচ্ছন্ন ছিলাম। এসব থেকে তিনি যেন আমাদের মুক্তির দূত হয়ে মাঝে এসেছেন। কিংবা এ রকমও আমাদের মনে হতে পারে আমরা যেন ক্লান্ত পথিকের মতো তাঁর পথ চেয়ে বসে আছি কয়েক শতক ধরে। আমাদের মতো ক্লান্ত পথিকের অশেষ, পথটা তিনি এসেই যেন শেষ করলেন। জীবনানন্দ, রবীন্দ্রনাথের আগমন বার্তাকে শুধু আমাদের মধ্যে না রেখে সমস্ত পৃথিবীব্যাপি বিস্তৃত করে দিয়েছেন। তাই, তিনি বলেছেন, ‘এ পৃথিবী সকলের মতন তোমার প্রতীক্ষা করে বসেছিল।’
এখানে আরেকটি বিষয় উল্লেখ্য যে, জীবনানন্দ কবিতার অভ্যন্তরে ‘গান’ শব্দটিও ব্যবহার করেছেন। গান গাওয়ার জন্যই যেন তাঁর আগমন এবং তা শেষ হলেই তিনি ফিরে যাবেন। আর এই গানের মধ্যে যেন রয়েছে রবীন্দ্রনাথের অমরত্ব। যে গান শেষ হলেই তিনি ফিরে যাবেন তাঁর নিজের স্থানে। এর পরের বেশ কিছু পঙ্ক্তিতে চোখ রাখলে এ রকমটা দেখতে পাই: ‘তুমি এই পৃথিবীরে তোমার গানের সুতা দিয়ে আকাশের অন্য নক্ষত্রের সাথে বেঁধে দিয়ে চলে গেছ’। জীবনানন্দ এখানে ‘গানের সুতা’ ব্যবহার করে রবীন্দ্রনাথের আরেকটি উজ্জ্বল দিক আমাদের সামনে প্রকাশ করেছেন। যেন মনে হয় তিনি বার বার কবিতা দিয়ে না বেঁধে গান দিয়েই বাঁধলে শক্ত হবে। তিনি তার গানের দিকটাও কম ভালোবাসতেন না। এর পরের আরো কয়েকটি পঙ্ক্তি: ‘আজো তাই নক্ষত্রেরা এত কাছে সুন্দর নিকটে এত-শান্তি, প্রেম, ক্ষমা।/ আজো তাই নক্ষত্ররা এত কাছে/তাদের নৃত্যের সুর তবু থেকে থেকে ক্ষীণ হয়ে আসিতেছে/কবি, তুমি ক্রমে ক্রমে হিম হয়ে পড়িতেছ ব’লে/সুন্দর যেতেছে মরে ধীরে ধীরে/ শান্তি আর থাকিবে না। সুন্দর, শান্তি, প্রেম, উপস্থিত, হ’য়ে ধরা দেয় আমাদেরকে। অপর দিকে কবির বিদায়কে আখ্যায়িত করেছে সুন্দরের চির বিদায়ের সঙ্গে। এর পর হয়তো আর কোনো সুন্দর এতো তীব্রভাবে আমাদেরকে দেখা দিবে না।
জীবনানন্দ রচিত ‘রবীন্দ্রনাথ’ শীর্ষক চতুর্থ কবিতায় হাত রাখি। যেখানে শুরুতেই পাওয়া যাবে ‘আজ এই পৃথিবীতে অনেকেই কথা ভাবে।/তবুও অনেক বেশি লোক আজ শতাব্দী সন্ধির অসময়ে/পাপী ও তাপীর শব বহনের কাজে উচাটন হয়ে অমৃত হবে সাগরের বালি, পাতালের কালি ক্ষয়’? প্রথম পঙ্ক্তিতে যে কথা প্রকাশ পেয়েছে তা ধরে বলা যেতে পারে, পৃথিবীতে অনেকেই কথা ভাবে, কারা ভাবে বা কাদের নিয়ে ভাবা হয় তা কিন্তু আমাদের অজ্ঞাত। অনেকেই কথা ভাবে কিন্তু এখানে বলা হয়নি সবাই ভাবে, তিনি কিন্তু এই অনেকের সাথে সবার সংমিশ্রণ ঘটাতে চাননি। পৃথক ক’রে রেখেছেন ‘সবার’ থেকে ‘অনেককেই’।
দ্বিতীয় পঙ্ক্তিতে প্রকাশ পেয়েছে তাদের কথা যারা আজ শতাব্দী-সন্ধির অসময়ে। যাঁরা হয়তো একদিন এই পৃথিবীতেই ছিল। কিন্তু আজ তারা নেই। পরবর্তীতে তাঁরাই পাপী ও তাপী এবং উভয়ের-ই মৃত্যুদেহ বহন করতে থাকে। কবিতাটির শেষের কয়েকটি পঙ্ক্তি: ‘কবিও নিকট লোকের মতো, বড়ো এক প্রিয়-/ অন্ধ মরুতে কবে ফাহিয়ান সূর্যের সোনা দেখেছিল’- বিশদ প্রসঙ্গে আজ ততোধিকভাবে স্মরণীয়। কবি প্রিয় অন্যে সবার মতো না হয়ে বলা হযেছে নিকট লোকের মতো। যাঁর অপর বলতে আর কোন কিছু বাদ থাকে না। নিকট লোক প্রিয় না হলেও কবি প্রিয় হয়ে দেখা দিক অন্য সবার কাছে। ‘রবীন্দ্রনাথ’ শিরোনামের ছোটো কবিতাটি পড়া যাক :
‘পৃথিবীর কোলাহল সব ফুরিয়ে গেছে
সেই শেষ ঘুম এসেছে নক্ষত্রের ভিড়ে
এখুনি তাদের আলো নিভে যাবে।
পড়ে থাকবে অন্ধকার নিস্তব্ধ চরাচর
পড়ে থাকবে ভালোবাসার চিরকাল
সেই হিম অন্ধকারের শান্তির ভিতর
বিধাতার হাতের কাজ ফুরিয়ে যাবে।
সেই শেষ ঘুম এসেছে নক্ষত্রের ভিড়ে
সেই শেষ ঘুম।’
কবি ব্যথা দগ্ধ হৃদয়ে আজ আর কোনো আনন্দ খুঁজে পান না। কখনো আনন্দময় জীবনের কথা চিন্তা করেছেন কিনা তা-ও স্পষ্ট নয়। ‘পৃথিবীর কোলাহল সব ফুরিয়ে গেছে’ প্রকৃতভাবে কোলাহল শেষ হয়েছে কিনা জানি না। কিন্তু এটা ষ্পষ্ট যে, কবির হৃদয়ে আজ আর কোন কোলাহল নেই। বেদনাসিক্ত কবি নিজের ব্যক্তিগত আনন্দ নিঃশেষ হওয়াকে তুলনা করেছেন পৃথিবীর কোলাহলের সঙ্গে কবি আজ আর কোন কোলাহল দেখতে পান না কারণ, মৃত্যু যন্ত্রণা তাঁর নিকট তীব্র হ’য়ে দেখা দেয়।
নিজের চিরদিনের শারীরিক বিদায়কে তুলনা করেছেন শেষ ঘুমের সঙ্গে। সমস্ত নক্ষত্র ঠেলে যেন সেই ঘুম-ই গ্রাস করতে আসছে কবিকে। তাই অতীতের অনেক কিছুই মনে পড়ছে তার। যেমন মনে পড়ে নিস্তব্ধ চরাচর, আর চিরকালের ভালোবাসা। মৃত্যুকেও তিনি আহ্বান করছেন শান্তির ভিতর দিয়ে। বার বার একই কথা মনে হয়েছে, যেন সেই শেষ ঘুম তাঁকে নক্ষত্রের ভিড় ঠেলে এসে গ্রাস করলেই তিনি সবচেয়ে শান্তি পাবেন। ঘুম ব্যতীত সংসারের কোন কিছুই যেন শান্তি দিতে পারে না। তাই বারবার শেষ ঘুমের প্রার্থনায় তিনি মগ্ন হয়েছেন। ‘রবীন্দ্রনাথ’ শিরোনামের শেষ কবিতাটি :
‘মানুষের মনে দীপ্তি আছে
তাই রোজ নক্ষত্র ও সূর্য মধুর-
এরকম কথা যেন শোনা যেত কোনো একদিন,
আজ সেই বক্তা ঢের দূর
চলে গেছে মনে হয় তবু;
আমাদের আজকের ইতিহাস হিমে
নিমজ্জিত হয়ে আছে বলে
ওরা ভাবে লীন হয়ে গিয়েছে অন্তিমে
সৃষ্টির প্রথম নাদ-শিব ও সৌন্দর্যের;
তবুও মূল্য ফিরে আসে
নতুন সময়তীরে সার্বভৌম সত্যের মতন
মানুষের চেতনায় আশায় প্রয়াসে।'
কবি মৃত্যুযন্ত্রণায় যখন আচ্ছন্ন এবং শেষ ঘুমের অপেক্ষায় রয়েছেন, ঠিক সেই সময় অপর আরেক কবিতায় মানুষের মনে যে হাসি, আনন্দ ছিল এবং এই ভালোলাগা থেকে অন্যে আরো অনেক ভালোলাগার জন্ম নিতে পারে তা প্রকাশ পায়। কবি এই ভালোলাগার কথা সব সময় শুনতে পান না। আর যখন এ রকম কথা শুনতে পেতেন আজ তা গত হয়েছে। তিনি যেন প্রত্যেকটি মানুষের মুখের দিকে তাঁকিয়ে রয়েছেন, এ রকমটা শোনার জন্য, কিন্তু তা আর পান না। সেই রকম মানুষ, যাঁরা সুখে ছিল কিংবা যাদের অফুরন্ত ভালোলাগা ছিল, তাঁরা আর দেখা দিবেন না কবির সামনে। এই ভালোলাগার সাথে ইতিহাসের সমাপ্তির বা গত হওয়ার কথাও ব্যক্ত করেছেন। সমস্ত কিছু যেন ইতিহাসের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বদলে গেছে। মানুষের চেতনায় আবার জন্ম লাভ করুক আশা এবং নতুন প্রয়াস। এটাই ছিল কবি জীবনানন্দ দাশের প্রার্থনা।