সেদিনের দুপুরে ছিল অন্যরকম সূর্য
পলাশের ঘামে রাঙা আর চোখের শুকিয়ে যাওয়া
অবাধ্য অশ্রুর মতন-
সেদিনের বেয়নেট ছিল কৃষ্ণচূড়ার মত গাঢ় লাল,
বুলেটের ইপ্সায় জ্বলজ্বলে ছিল প্রতিটি হৃদপিণ্ড
দাড়কাকের মত কালো ছিল প্রশস্ত ফাঁকা বুলেভার্দ,
নগরের রন্ধ্রে  রন্ধ্রে গেথে ছিল নির্লিপ্ত মৃত্যুভয়,
বজ্রনির্ঘোষ স্লোগান ছিল অনবদ্য দেয়াল

প্রেসের নির্ঘুম  অন্ধকারে বসে থাকা যুবক রফিক,
অক্ষরগুলো ছাপে নির্লোভ আদরে, পরম মমতায়,
কাগজে লেগে থাকা কালির গন্ধ-
তার কাছে স্নেহাকুল মায়ের কোলের গন্ধ মনে হয়,
সেই ফাল্গুনের নির্মোহ দুপুরে,
যখন কিছু ভিনদেশী কুৎসিত অক্ষর,তার হাতে জড়ানো একান্ত মগ্ন অক্ষরগুলোকে
মহাগভীর বিলীনতায় মুছে দিতে চাইল,
বিদ্রোহী রফিক তখন তার নিজস্ব মস্তিষ্ক,
গলিত লোহার মতন বিলিয়ে দিল কংক্রিট রাস্তায়,
হয়ত মৃত্যুর আগেও তার হাত ছিল অক্ষরের মমতায়
দৃঢ় কন্ঠে বলছিল-
অক্ষরগুলো আমার হৃদয়,অক্ষরগুলো আমার হৃদয়।


সাতাশবর্ষী আব্দুস সালাম,
সেদিনের উৎসারিত রোদের সকালে যখন মায়ের পা ছুঁয়ে
বলেছিল, মা যাই
গভীর জনসমুদ্র তখন উচ্চাকাঙ্খী রাস্তার মোড়ে মোড়ে,
অক্ষরগুলো যখন মুখ থেকে কেড়ে নিতে চাইছিল,
কিছু রক্তচোষা ভূমিহীন জোঁক,
সালাম তখন সাইকেলের প্যাডেলে অধ্যবসায়ী ঘুর্ণন,
শিখর উত্তেজনায় বুকে নিল উত্তপ্ত বুলেট
পুনরুত্থানের কয়েক মুহুর্ত আগে,বুকে অব্যক্ত যন্ত্রনা নিয়ে,
আরক্তিম আভাসে স্লোগান দিয়ে গেল,
অক্ষরগুলো আমার হৃদয়,অক্ষরগুলো আমার হৃদয়


উচ্ছাসে তারুণ্যের অহংকার নিয়ে,
রাষ্ট্রাবিজ্ঞানের গভীর যোজনায় আবুল বরকত,
বইয়ের ধূসর পাতায় প্লেটো বা এরিস্টটলে,
জাগতিক সকল উত্তরে মগ্ন নিরন্তর,
সকল উন্নাসিক অত্যাচার আর অভেদ্য প্রাচীর ভেঙে
যখন নেমে এল দুপুরের নিষিক্ত রাজপথে,
গলায় নিয়ে উত্তাপ স্লোগান আর সজীব বজ্রমুষ্ঠি,
ভাষার নিরুপায় ফিরিশতা তখন তার মেধাবী স্নায়ুতে
বসত গড়ে পরম বিশ্বাসে,
অতঃপর কয়েকটি ধাতব বুলেট,
গাঢ় গোলাপের মতন রাঙিয়ে দিল সাদা ইশতেহার
ভাষার ভবিষ্যৎ আলোকবর্তিকা তখনো মুখর ছিল,
শব্দরত বরকতের নিস্তেজ ঠোঁট,
অক্ষরগুলো আমার হৃদয়,অক্ষরগুলো আমার হৃদয়।


শফিউর যখন তার ছোট্ট শাহনাজের কপালে চুমু একে,
বলেছিল,আমি ফিরে আসব।
তখন হয়ত সে জানত না,
তার শাহনাজের মুখের আধো শব্দগুচ্ছ,
ধ্বংসের অপাশে নিয়ে যেতে চায় কিছু নপুংসক পিশাচ,
তাই হয়ত বুলেটের সুতীব্র বেদনা ধারণ করে নিতে
ছিলনা তার কোন দ্বিধাবোধ,
হয়ত মৃত্যুর আগে চোখে তার ঝলকে উঠেছিল,
প্রিয় শাহনাজের মুখ আর কিছু অক্ষর,
ঠোটের কোণের আলতো হাসিতে হয়ত সে বলেছিল,
ফিরিয়ে দিলাম আমার শাহনাজের প্রিয় শব্দগুচ্ছ,
অক্ষরগুলো আমার হৃদয়,অক্ষরগুলো আমার হৃদয়।


গৃহত্যাগী আব্দুল জব্বার,
পদব্রজে ঘুরে বেড়ানো এক আটপৌরে মানব,
অশান্ত ঢাকার বুকে সেদিনের জটিল উন্মাদনা
তার বোধের কিছুটা বাইরে ছিল,
ঝুল বারান্দায় যখন গুলির তীব্র আঘাতে
মৃত্যর উৎসবে মুখোমুখি সকল ব্যাথিত প্রাণ
জব্বার তখন মেঘহীন আকাশের পানে তাকিয়ে বলেছিল,
বাঙলা তুমি চিরঞ্জীবিনী হও,
অক্ষরগুলো আমার হৃদয়,অক্ষরগুলো আমার হৃদয়।


ইটভাঙা সদ্যজাত হাতের শিশু অহিউল্লাহ
শ্রমের ঘাম কপালের ভাঁজ থেকে মুছে নিয়ে,
চরম উৎসাহে হয়েছিল মিছিলের সম্মুখ,
সবার আগে জনতার অগোচরে-
শিশুর অনুভবে ছিল বাঙলার জন্য পরম ভালবাসা
কণ্ঠে ছিল চিরন্তনী উল্লাস,
পৃথিবীর রকমারি চাকচিক্য বহুদিন দেখার আগেই,
চুপিচুপি ফাগুনের উতল হাওয়ার মত
চিরবিদায়ের ঘন্টাধ্বনি শুনিয়ে সকল শোষকের অহমিকায়,
মৃত্যুর উচ্ছসিত পতাকা হাতে, অহিউল্লাহ বলেছিল,
অক্ষরগুলো আমার হৃদয়,অক্ষরগুলো আমার হৃদয়।


নিসংকোচে,নিঃসঙ্গতায় ভাষার প্রতিটি পরতে লুকিয়ে আছে,
এমন আরো অনেক মহতী লৌকিক শহীদ,
যাদের কাছে অক্ষরগুলো ছিল হিরন্ময়,
নির্দ্বিধায় প্রাণ বিলিয়ে দেওয়া সেইসব মৃত্যঞ্জয়,
অশ্রুর আড়ালে বিস্মৃত হবে না কোনদিন,
দিগন্তের অকথিত রুপকথার অঙ্গীকার নিয়ে
বাঙলা ভাষা তাদের জড়িয়ে রাখবে অয়োময় স্নেহে,
প্রতিটি নিজস্ব ভোরের লালিমায়,শিমুলের রঙের আবেশে
বিগলিত চুলে হাত বুলিয়ে বাঙলা মা-
মাতৃস্নেহের প্রগাঢ় উষ্ণতায় নাকের নোলক নেড়ে বলবে,
তোরাই আমার হৃদয়,তোরাই বাঙলার হৃদয়।