নিঝুম প্রহর –
আঁধার ঘিরিয়া বায়তুল আকসার
এরই মাঝে শোনো মিনার কাঁপিয়া
‘আল্লাহু আকবার’।
শোনো সবে ঠিক––এই মুয়াযযিন মানুষ তো নয় কোনো
ফেরেশতা এসেছে মরু দেশে নামি––মেরাজের রাতে––শোনো;
হলে কি অবাক মর্ত্য মাঝারে স্বর্গের ঝংকারে?
চেয়ে দেখ ওই বোরাক দাঁড়ানো মোকাদ্দাসের দ্বারে।
মক্কায় নবী বিশ্রামে যবে ব্যস্ত দিনের শেষে
শোনে তবু কার আগমন ধ্বনি সুমহান উদ্ভাসে;
কুর্নিশ করি খোদার নবীরে ফেরেশতা জিবরাইল
কহেন, খোদার সকাশে যেতে হবে আজ অযুত লক্ষ মাইল।
দেখবে বেহেশত, চিনবে দোজখ, শুনবে কেমন ত্রাসে
জালিম বাদশা কুরে কুরে কাঁদে, শুকরিয়া করে দাসে;
ফেরেশতা সব সাত আসমানে হয়ে গেছে জানাজানি
রহিম নবীরে পিঠে লয়ে শোনো বোরাকের ঝাপটানি।
মক্কা-মদিনা-মাদায়েন ছেড়ে ফিলিস্তিনের পাড়
কে বলে দূর? ওই দ্যাখো নবী আকসা ঘরের ধার;
শত রসূল আর পয়গম্বরেও আসিছে নামিয়া ভবে
মোকাদ্দাসেই পড়বে নামাজ এক জামাতেই সবে।
গায় গায় মিশে কাতার বন্দী মুসল্লী সব ভাবে
কে হবে ইমাম এই জামাতের––কে এই সুযোগ পাবে?
সফ ছাড়ি তবু আগুয়ান দেখি জিবরাইল আমিন
বুঝি ফেরেশতা-প্রধান পড়াবে নামাজ, নয়কো মানুষ জ্বীন!
সম্মুখে আসি রুহুল কুদুস নবী-কর ধরি কন,
‘খোদার ইচ্ছা মোহাম্মদ আপনি আজিকে ইমাম হন’
ধীর পায়ে তাই মিম্বর-পাশে রাসূলের সরদার
এসো নবীদের সাথে সকলেও বলি, ‘আল্লাহু আকবার’।
সৃষ্টির সেরা মানুষের নবী খাতামুন নাবিয়ীন
তারই হাত ধরে এসেছে কোরান, পূর্ণ হয়েছে দ্বীন;
নামাজ-অন্তে একে একে যত নবী-রাসূলেরা এসে
দোয়া বলে গেল শেষ নবী তরে বুক ভরে ভালবেসে।
সর্বাগ্রে আদমের দেখা––কী যে শোভা দ্যাখো তার
সুদীর্ঘ তার দেহের গড়ন, তুলনা নেইকো আর;
শেষ নবী তার জানান শ্রদ্ধা, সাদরে সালাম করে
পুত্রেরে পেয়ে আদি পিতা দোয়া বর্ষেন প্রাণভরে।
দাঁড়ায়ে কাছেই বুযুর্গ এক––এ তো ইবরাহীম খলিল!
দেখে আর চোখ ফেরে না নবীর––চেহারায় কতো মিল!
তিনিই তো সেই আদি মুসলিম, তার থেকে ইসলাম
তার দোয়াতেই এসেছেন নবী, তার তরে সালাম।
কহিলেন খলিল, ‘প্রশংসা যত বিশ্বপ্রভুর, গাই তার জয়গান
দোস্ত আমায় ডেকেছেন যিনি, করেছেন কাবা দান;
তার দয়াতেই চিনেছি তৌহিদ, আগুন হয়েছে পানি
একনিষ্ঠ আমি তার ইবাদতে, শরিক নেইকো, জানি’।
সেই তো ছিলেন খোদার বন্ধু ইবরাহীম খলিলুল্লাহ
তার পিছনেই দাঁড়ানো মুসা––হযরত কালিমুল্লাহ;
ঘোষিলেন মুসা, ‘প্রশংসা তার, এক রাতে যিনি তুর পাহাড়ের ধারে
কালাম শোনাতে ডেকে নেন মোরে ইসরাঈলের বারে।
শুধু কি কথা-ই, মেহেরবান রব নাযিলেন তওরাত
পাতা ভরা তার ন্যায়ের হুকুম, করুণার সওগাত’;
মুসা নবীরেও সালাম দিলেন আহমদ নবী ঠিক
একে একে আরো যত আম্বিয়া, তারাও সালাম নিক।
তালি দেয়া এক কম্বল গায়ে, চুল থেকে ঝরে পানি
‘কোঁকড়ানো চুলে কে এই যুবক, মনে হয় তারে জানি?’
শুনিয়া প্রশ্ন জিবরীল কহে, ‘সালাম করুন তাকে,
নিশ্চয় তিনি রুহুল্লাহ––রক্ষা করেছি যাকে’।
আখেরী নবীর সালাম শুনেই এগিয়ে এলেন ঈসা
তার ছোঁয়াতেই ফিরত মৃতেরা, অন্ধেরা পেত দিশা;
‘এ সবই হতো খোদার হুকুমে––আমি মসীহ নই কেউ
পিতা বিনে আমি এই পৃথিবীতে, আমার সালাম নেও’।
এলেন দাউদ-সুলায়মানও, শ্রেষ্ঠ শাসক তারা
ধরার বক্ষে ন্যায়ের ঝান্ডা উড়ায়ে বেড়ালো যারা;
খোদার ভয়ে ত্রস্ত সদা––শাসিতের কতো দাম!
তাদের থেকেই ইনসাফ শিখি, তা'র তরেও সালাম।
সকল নবীর দুআ নিয়ে শেষে মোকাদ্দাসের বারে
ফিরিয়া যখন এলেন রাসূল, সিঁড়ি লেগে এক দ্বারে;
একে একে তায় পেরোন আসমান, শত ফেরেশতা হেরি
হাজির হলেন খোদার সকাশে––হয় নাই তবু দেরি।
আরশ হইতে আল্লাহ সোবহান তাকিয়ে তাহার পানে
বান্দা মোহাম্মদ লুটাল সিজদায় স্রষ্টার সম্মানে,
ধ্বনিত হইল, ‘কী লয়ে এলেন বন্ধু আপনি, নিয়ে কোন নযরানা?
উম্মতের থেকে আমার সকাশে এনেছেন কিছু কি না?’
কহিল বান্দা, ‘ইবাদত যত করেছি আমি, আমরা সকলে মিলে
খুশি হব যদি তোমার কৃপায় আজই সব নিয়ে নিলে’
রহমান প্রভু, দয়া-ভার, ঠিক নিলেন কবুল করে –
‘নবী, বর্ষণ হোক রহমত আমার, শান্তি করুণা ভরে’।
রহমত নবী ক্ষান্ত কি হন––উম্মতের কি হবে!
কহেন, ’শান্তি ঝরুক আমার সাথেও সালেহিন যারা রবে’;
চারপাশে যত ফেরেশতা ছিল সজোরে সাক্ষ্য দিলো
‘উপাস্য আল্লাহ, দূত মোহাম্মদ’––সন্দেহ কি কভু ছিলো!
প্রভুর দীদারে সিক্ত বান্দা আসবে যখন চলে
খোদ বেহেস্তের চাবি দিলেন খোদা––নামাজের কথা বলে;
ফির পথে হেরি বেহেশত-বাগিচা, দেখে আর আশ মেটে?
তার বাদে যেবা সামনে দোযখ, যায় বুঝি বুক ফেটে!
সুদখোর, কৃপণ, বেনামাজীর কত না আযাব ভার
দেখে অত ভয় দয়াল নবীর––এরা কি উম্মত তার!
অন্যের মাল মেরে খেল যে লোভী, ছিল যে সেখানে সেও
ফিতনা-ফাসাদ-গীবতকারী––ছিল না তো বাকী কেউ।
ফিরতি পথে নবীর হৃদয় আশা আর ত্রাসে ভরে
এক রাতে মহাবিশ্ব ভ্রমণ, শেষতক নবী ঘরে;
স্বপ্নে তো নয়––সশরীরেই––এই যে সফর হলো
অসাধ্য কি বিশ্বপ্রভুর, তোমরা সবেই বলো?
মুনাফিক যত খবর শুনিয়া আবু বকরেরে হেসে কয়
‘মোহাম্মদ নবী শেষ কালে হলো উন্মাদ নিশ্চয়’;
কহেন বকর, ‘শোন্ ভাল করে অবিশ্বাসীর দল,
এর চে আজব খবরেও ছিলাম নবী 'পরে অটল’।
শুনে খুব খুশি আল্লাহর নবী, সাহাবীরে কন, ‘শোনো,
আবু বকর এই সিদ্দীকও ঠিক, আজ থেকে সবে জেনো’;
শুধু কি মুসলিম? কাফেরেরা যত ছিল বেঁচে সেই দিন
একে একে সবে সত্য মেনেছে, ছিল না কো দ্বিধা ক্ষীণ।
এই অবিশ্বাস্য ভ্রমণের কথা আছে লেখা কোরআনে
যখন আসমান-জমিন একাকার হল মানুষের সম্মানে;
‘প্রশংসা তার, এক রাতে যিনি দেখালেন স্বীয় বান্দারে
কাবাঘর থেকে বায়তুল আকসা, রহমত যার চার ধারে’।
মেরাজের শতো আছে তো জানার, কতো না শিক্ষা তার
এসো আর একবার সকলেই বলি, ‘আল্লাহু আকবার’।
তথ্যসূত্র:
১। আল কোরআন, সূরা বনী ইসরাঈল (১৭:১)
২। সহীহ বোখারী এবং তফসীরে ইবনে কাসীর এ অন্তর্ভুক্ত মেরাজ সংক্রান্ত হাদিসসমূহ
৩। ‘বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা:) এর জীবনী’, মাওলানা ফজলুর রহমান ও মাওলানা আবুল কালাম আজাদ প্রণীত, নয়া দিগন্ত প্রকাশন, ২০০৫ ইং
(প্রথম প্রকাশ: বাংলা কবিতা ডট কম, জানুয়ারী ২০২৫ / রজব ১৪৪৬)