আমি যখন শহরের উপকণ্ঠে পৌঁছালাম, বাইরে তখনও বিকেলের রৌদ্র,
আমাকে অভ্যর্থনা করেছিল প্রবেশদ্বারের সুবিশাল তোরণ, মসজিদের মিনার
এবং দক্ষিণের বৃক্ষহীন পাহাড়-চূড়া;
আর সেজন্যেই কি না ভেতরে ঢোকার আগমুহূর্ত পর্যন্তও টের পাইনি যে
শহরের বাসিন্দারা সবাই মৃত।
আকাশে তখনও বসন্তের পেঁজা তুলোর মতো মেঘ,
অথচ কী আশ্চর্য, শহর জুড়ে শুধু লাশ!
মৃত মানুষগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাস্তায়, গাড়িতে, বাসস্ট্যান্ডে,
এমনকি মা’র কোল আঁকড়ে থাকা শিশুটিও––যেন কার ক্ষমাহীন ফুৎকারে
থেমে গেছে একটি প্রাণবন্ত শহরের যাবতীয় ব্যস্ততা।
প্রবেশদ্বারের কোণে বসে কেউ একজন পাউরুটি খাচ্ছে ভেবে এগোতেই দেখি
রুটি নয়, পাশের ব্যক্তির কলিজা––তাছাড়া, দুজনেই মৃত;
প্রধান সড়ক জুড়ে ইতস্তত পড়ে আছে হাতা-কাটা কোট, কালো সানগ্লাস,
ফুটপাতে নামকরণের ভাঙ্গা ফলক, কয়েকটা বিদেশি ডিগ্রী,
এমনকি নেত্রীতনয়ের কুলখানি উপলক্ষে লেখা আগাম শোকবার্তা;
কোন এক গার্মেন্টসকর্মী আত্মহত্যার আগে ছাদ থেকে ঝুলিয়ে দিয়েছিলো চুল,
সেখান থেকে নারকেল তেল গড়াচ্ছে রাস্তায়, ভিজছে ব্যাংকের হারানো ডলার;
মেয়রের বাসভবনের সামনে অন্ধ ব্যক্তির ছবি––সম্ভবত: মেয়র নিজে,
নিচে উপদেষ্টাদের দীর্ঘ তালিকা, যদিও সবাই শুয়ে এখন, পাশাপাশি––মৃত।
শহরের কেন্দ্রে ঋণখেলাপির বসানো ফোয়ারা তখনও ঢালছে নীল বর্জ্য,
কোণে কিশোরীর শাড়ি-বাঁধা লাঠির আগায় ঝুলছে ফতোয়াবাজের টুপি;
স্কুলগুলো জনশূন্য, শুধুমাত্র একটি কক্ষে উপুড় হয়ে এক তরুণী––
সম্ভবত: সেই শিক্ষিকা, যাকে শ্রেণীকক্ষেই হত্যা করা হয়েছিল।
শহরের একমাত্র নদীর বুক চিরে কালো পানি, তাকে আটকে দখলবাজের শেড,
এর মাঝে ভাসছে বোনের অপমানের প্রতিকার চেয়ে নিহত যুবকের লাশ
এদিকে বিচারালয়ের দেয়াল জুড়ে কাটা-ছেঁড়া সংবিধান,
তার ভারে হেলে পড়া দাঁড়িপাল্লা,
এবং সামনের চত্বরে শেষতক শান্ত হয়ে দুই সারি আইনজীবি;
আফসোস––সকলেই মৃত।
নিকট অতীতের একটি প্রাণোচ্ছল শহর, যার আকাশ জুড়ে ছিল
সুউচ্চ টাওয়ারের মত বর্তমানের আস্ফালন,
এবং প্রধান সড়ক জুড়ে ব্যস্ত নিস্পৃহ নাগরিক;
অথচ হায়! এই ধূসর বিকেলে মৃত্যু এসে দিয়েছে মেলে বিশ্বস্ত ডানা,
সময় ছড়িয়েছে ঐতিহাসিক ঘ্রাণ।
পুনশ্চ: স্বদেশকে নিয়ে কী সীমাহীন শঙ্কা থেকেই না লিখেছিলাম এই পদ্যকথকতা! আজকের ২০২৪ এর মহানায়কেরাও হয়তো পুরোপুরি উপলব্ধি করতে পারবে না যে কী গভীর ব্যর্থতার ক্লেশ আর স্বোপার্জিত পরাধীনতার গ্লানি থেকে টেনে-হিঁচড়ে বের করে এনেছে ওরা আমাদের সেই ‘পরাজিত প্রজন্ম’কে। যৌবন, তোমাকে স্যালুট।